আপনি হয়তবা প্রশ্ন করতে পারেন ফুটবল ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ জার্মান ফুটবলার কে? সেটির উত্তরে প্রথমেই যার নাম চলে আসে তিনি হলেন ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার। একজন চৌকস অধিনায়ক, ফুটবল ম্যানেজার হিসেবে একজন অনুপ্রেরণীয় নেতা এবং একজন সুযোগ্য প্রশাসক হিসেবে তার সুখ্যাতি সারা দুনিয়ায় ছিল। জার্মান ও বিশ্ব ফুটবল অঙ্গনে এই ৭২ বছর বয়সী ফুটবলপ্রেমী মানুষটি প্রায় ৫০ বছর ধরে আলোড়ন করে গেছেন। জার্মানির দক্ষিনাঞ্চলের মিউনিখ শহরের এই ডিফেন্ডার কিভাবে বিশ্বব্যাপী ‘ডার কাইজার’ খেতাব পেলেন এটাই আজকের ইতিবৃত্তের আলোচ্য বিষয়।
“বেকেনবাওয়ার ছিলেন আমার দেখা অন্যতম সেরা ফুটবল খেলোয়াড়!”
পেলে, ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তী, যিনি কিনা নিজে নিজেকেই ফুটবল সামর্থ্যের দিক থেকে নিজেকে অতুলনীয় ঘোষণা করেছিলেন, বেকেনবাওয়ার সম্পর্কে এই উক্তি করেছিলেন।
একজন কৌশলী ডিফেন্ডার হিসেবে বেকেনবাওয়ারের খ্যাতি ছিল দুনিয়া জুড়ে। রক্ষনভাগে অপরিসীম দায়িত্ব এবং মাধুর্য দেখিয়ে তিনি তার জীবনে বহু গুরুত্বপূর্ণ শিরোপা জয় করেছেন। পশ্চিম জার্মানির কাপ্তান হিসেবে ১৯৭৪ সালের বিশ্বকাপ জয় এবং ১৯৭২ সালের ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ জয় ছিল এর মধ্যে অন্যতম।
১৯৭৪ সালে বিশ্ব ফুটবলের ১০ম আসর বসে পশ্চিম জার্মানিতে। এই টুর্নামেন্টে ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার ছিলেন সবচেয়ে সফল।
কাকতালীয়ভাবে টুর্নামেন্টের গ্রুপপর্বেই দেখা হয় পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানির। গ্রুপপর্বের সেই ম্যাচে শেষ মিনিটের গোলে ১-০ ব্যবধানের জয় পায় পূর্ব জার্মানি। যদিও দুই জার্মানিই গ্রুপ পর্ব উৎরিয়ে যায় তবে পশ্চিম জার্মান শিবিরে এই হারটি লজ্জাজনক হিসেবে প্রমাণিত হয়। যার ফলে পরের রাউন্ডগুলোতে পশ্চিম জার্মান একাদশে গুরুতর পরিবর্তন দেখা গিয়েছিল। পশ্চিম জার্মানি তাদের দৃঢ়তা ফিরে পায়। একে একে তারা হারিয়ে দেয় সুইডেন, যুগোস্লাভিয়া ও পোল্যান্ডকে হারিয়ে দেয়। তবে এবার ফাইনালে তাদের প্রতিপক্ষ ফেভারিট নেদারল্যান্ডস।

ফাইনালে পশ্চিম জার্মানি ও নেদারল্যান্ডসের এই মুখোমুখি হওয়াটা যথাক্রমে বেকেনবাওয়ার ও ইউহান ক্রুইফ দুজনের জন্যই ছিল চ্যালেঞ্জ। ক্রুইফ এবং তার দল ডাচ দল ‘টোটাল ফুটবল’ নামে এক ভিন্নধর্মী খেলার ভঙ্গি ফুটবলে যোগ করেছিল। যার ফলে তারা প্রতি ম্যাচেই প্রতিপক্ষের উপর প্রাধান্য বিস্তার করত। প্রতি দলের রক্ষনভাগের কাছেই তাদের আটকানো প্রায় অসাধ্য হয়ে উঠেছিল। ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার, যাকে কিনা সর্বকালের অন্যতম সেরা ডিফেন্ডারও মানা হয়, একমাত্র তারই সাধ্য ছিল ক্রুইফকে গোল করা থেকে রুখে দেওয়া। ম্যাচের প্রথম ভাগ অনেকটাই চলে গিয়েছিল নেদারল্যান্ডসের অনুকূলে। ক্রুইফকে বক্সে ফাউল করার ফলে পেনাল্টি পায় নেদারল্যান্ডস। নিস্কেন্স পেনাল্টির সুযোগটি হাতছাড়া না করে পশ্চিম জার্মানির জালে বল জড়ান। পশ্চিম জার্মানি ম্যাচে ধুঁকছিল যতক্ষণ না তারাও একটি পেনাল্টি জিতে নেয়। এবার ব্রাইটনার স্পট কিক থেকে দলকে সমতায় ফেরান। এটাই ছিল প্রথম বিশ্বকাপ ফাইনাল যেখানে রেফারি ২ টি পেনাল্টির নির্দেশনা দেন। পেনাল্টি থেকে ১-১ সমতায় ফেরার পর পশ্চিম জার্মানির খেলায় অন্যরকম গতি চলে আসে। অবশেষে স্ট্রাইকার গার্ড ম্যুলারের ৪৩ তম মিনিটের করা গোলে শেষ পর্যন্ত জয় পায় পশ্চিম জার্মানি। নিঃসন্দেহে পশ্চিম জার্মানির এই বিশ্বকাপ জয়ের পেছনে বেকেনবাওয়ারের নেতৃত্বের অসামান্য ভূমিকা ছিল। তার নেতৃত্বের উপর ভর করেই পশ্চিম জার্মানি নেদারল্যান্ডসের টোটাল ফুটবলকে রুখে দিতে সক্ষম হয়েছিল।

বেকেনবাওয়ার প্রথমবারের মত নব্য বিশ্বকাপ ট্রফি উঁচু করার গৌরব অর্জন করলেন আর পশ্চিম জার্মানি তাদের ঘরে তুলল নিজেদের ২য় শিরোপা। এই পশ্চিম জার্মান দলই প্রথম বারের মত একসাথে ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ ও বিশ্বকাপ জিতে এক অনন্য রেকর্ড গড়ে।
ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার তার ঘরের ক্লাব বায়ার্ন মিউনিখের হয়ে তিনি ইউরোপিয়ান কাপ জয় করেছেন পরপর তিনবার। আর ঘরোয়া লিগেও নিজ ক্লাব বায়ার্ন মিউনিখ থেকে ১৯৭৭ সালে চলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত জিতে নিয়েছিলেন ৪ টি জার্মান লিগ শিরোপা। ব্যাক্তিগত কৃতিত্বের দিক দিয়েও কম যান না এই জার্মান ফুটবল মশাল। চারবার জিতেছেন ‘জার্মান ফুটবলার অফ দ্য ইয়ার’ সম্মাননা। ইউরোপিয়ান ফুটবল এসোসিয়েশন উয়েফা তাকে দুইবার ‘ইউরোপিয়ান ফুটবলার অফ দ্য ইয়ার’ সম্মাননা দেয়।

নিজের প্রাণপ্রিয় ক্লাব বায়ার্ন মিউনিখ ত্যাগ করার পর তিনি আমেরিকান ক্লাব নিউইয়র্ক কসমসে যোগ দেন। সেখানে আরেক কিংবদন্তি পেলের সাথে নর্থ আমেরিকান সকার লিগে ‘পোস্টার বয়’ খ্যাতি পান।
ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার ফুটবল মাঠে নেতৃত্ব দেওয়ার দিক দিয়ে খুব কম বয়স থেকেই অনন্য ছিলেন। তাই তার ফুটবল ম্যানেজার হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার বিষয়টি প্রায় অনেকের কাছেই অনুমেয় ছিল। কিন্তু খেলোয়াড় হিসেবে অবসর নেওয়ার এক বছরেরও কম সময়ে তিনি পশ্চিম জার্মানির ফুটবল ম্যানেজার হিসেবে যেভাবে কর্ম সম্পাদন করেন তা সবাইকে সত্যিই অবাক করেছিল। হয়তবা আরও অবাক করা বিষয় ছিল যেভাবে তিনি একটি সাধারণ পশ্চিম জার্মান ফুটবল দলকে ১৯৮৬ সালের মেক্সিকো বিশ্বকাপের ফাইনালে নিয়ে যান। যদিও এই দল শেষমেশ ম্যারাডোনার আর্জেন্টিনার কাছে হেরে যায় ৩-২ গোল ব্যবধানে। আজটেকার সেই ফাইনাল জিততে না পারলেও সারা দুনিয়াকে হতবাক করেছিল ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ারের পশ্চিম জার্মানি দল।

৪ বছর পর গঠিত পশ্চিম জার্মানি দল অবশ্য আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। লোথার ম্যাথিয়াস, ইয়ুর্গেন ক্লিন্সম্যান ও রুডি ভোলারকে নিয়ে গড়া এই দল গত বিশ্বকাপ ফাইনালের হারের বদলা নেওয়ার জন্য মুখিয়ে ছিল। শেষ পর্যন্ত বেকেনবাওয়ারের নেতৃত্বে পশ্চিম জার্মানি ইতালিতে অনুষ্ঠিত ১৯৯০ সালের ফাইনালে ১-০ গোলে জয় পায়। ফলে ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার ব্রাজিলের মারিও জাগালোর পর প্রথম কোন ফুটবলার এবং ম্যানেজার উভয় হিসেবে বিশ্বকাপ জয়ের গৌরব অর্জন করেন। বিশ্বকাপের এ যাবতকালের ইতিহাসে এমন রেকর্ড মিলেছে মাত্র ২ বারই। আন্তর্জাতিক ফুটবলের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জনের পর ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার মন দেন ক্লাব ফুটবলের দিকে। প্রথমে ফরাসি লিগের মার্শেই দলকে নেতৃত্ব দিলেও পরে ফিরে আসেন নিজের ছেলে বেলার ক্লাব বায়ার্ন মিউনিখে। বায়ার্নে যোগ দেওয়ার পরই দলকে ১৯৯৪ সালে বুন্দেসলিগা শিরোপা জিতান। দুই বছর পরই ঘরে তুলেন উয়েফা কাপ শিরোপা।

খুব শীঘ্রই তিনি বায়ার্ন মিউনিখের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তবে ১৯৯৮ সাল থেকে জার্মান ফুটবল এসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে জার্মান ফুটবলের দায়ভার নেন এই ফুটবল কিংবদন্তী। জার্মান ফুটবলে ২০০৩ সালের পর থেকে যে তরুণ ফুটবলার দের জোয়ার এসেছিল তার অনেকটাই কৃতিত্ব দেওয়া যায় ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ারকে।
“আমি একদা ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ারকে একটি রেস্টুরেন্টে ধুকতে দেখেছিলাম। তিনি রেস্টুরেন্টে সেই ভঙ্গিতে ধুকছিলেন ঠিক যেরকম উচ্চমান ও কর্তৃত্ব দিয়ে তিনি ফুটবল মাঠে খেলতেন”। -নটিংহ্যাম ফরেস্ট ফুটবল ক্লাবের প্রাক্তন ম্যানেজার ব্রায়ান ক্লাউফ
“তিনি ছিলেন খেলোয়াড়দের একজন নেতা, একজন প্রভাবশালী উপস্থিতি যিনি কিনা নিজের চারুতা ও কৌশল দিয়ে বল বের করে নিয়ে আসতেন”। -প্রাক্তন মার্শেই, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড এবং ফ্রেঞ্চ স্ট্রাইকার এরিক ক্যান্টোনা।
“একজন অসাধারণ খেলোয়াড়ের ছাপ সেখানেই যেখানে তিনি ফুটবলের বিভিন্ন যুগে নিজের সক্রিয় ভূমিকার স্বাক্ষর রেখে যান। তরুণ খেলোয়াড় জীবনে তিনি আমার মধ্যে অনেক অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন”। -প্রাক্তন ইংলিশ ম্যানেজার গ্লেন হডেল।
“ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার ফুটবলের একজন প্রতীকীস্বরূপ যিনি কিনা সর্বদা জয়ের মনোবৃত্তিতে বিভোর থাকতেন। তাছাড়া তিনি তার নিজের দেশকে বিশ্বকাপ জয় করে এনে দিয়েছেন। আমরা তাকে নিয়ে গর্বিত”। -জার্মান টেনিস তারকা বরিস বেকার

“সে একজন অসাধারণ বন্ধু। খেলোয়াড় হিসেবে সে নিজের শক্তিমত্তার চেয়ে বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগানোর জন্যই বেশি পরিচিত ছিলেন। সে জার্মানদের মত না, বরং ফুটবল খেলত ব্রাজিলিয়ানদের মত। -ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তী পেলে, নিউইয়র্ক কসমসে থাকাকালীন সময়ে বেকেনবাওয়ারের সহযোদ্ধা।
“ফুটবলে ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ারের অবদান বলতে গেলে বলতে হবে, তিনি নিঃসন্দেহে একজন সংস্কারক ছিলেন। আমি নিশ্চিত, উনাকে ছাড়া আমরা কখনই ২০০৬ ফিফা বিশ্বকাপ জার্মানিতে আয়োজন করতে পারতাম না। ১৯৭৪ সালে তিনি একজন খেলোয়াড় হিসেবে বিশ্বকাপ জিতেছেন, ১৯৯০ সালে একজন কোচ হিসেবে বিশ্বকাপ জিতেছেন আর ২০০৬ সালে একজন প্রধান সংগঠক হিসেবে বিশ্বকাপ আয়োজনের দৌড়ে জার্মানিকে চ্যাম্পিয়ন করেছেন”। -সাবেক জার্মান চ্যান্সেলর গেরহার্ড শ্রডার
“তিনি অত্যন্ত ভদ্র একজন মানুষ, একজন পূর্ণাঙ্গ ইংলিশম্যান, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তিনি একজন ইংরেজ নন”। -কেভিন কিগেন, সাবেক ইংল্যান্ড জাতীয় দলের খেলোয়াড় এবং হ্যামবুর্গ এসভিতে থাকাকালীন তার সহযোদ্ধা।
order avodart 0.5mg pills order celecoxib generic buy ondansetron sale
levofloxacin sale levofloxacin 500mg drug