পৃথিবীর অন্যতম নিচু, উষ্ণ আর নিষ্ঠুরতম জায়গাটির নাম ডানাকিল মরুভূমি। এই মরুভূমি টি ইথিওপিয়া, ইরিত্রিয়া আর জিবুতির মাঝখানে অবস্থিত বৈরী আবহাওয়া সম্পন্ন একটি স্থান। আরফা ট্রায়াঙ্গেলের মাঝে প্রায় ১৩৬,৯৫৬ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এই অনুর্বর ভূখণ্ড টি বিখ্যাত তার আগ্নেয়গিরি আর অতিরিক্ত বেশি তাপমাত্রার জন্য। ডানাকিলে দিনের বেলা তাপমাত্রা সবসময় ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি থাকে এবং এখানে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত ১ ইঞ্চিরও কম। এখানকার স্থানীয় ভূতত্ত্বের বৈশিষ্ট্য গুলো হল আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত , টেকটোনিক গতিবিধি, বিভিন্ন রকম জলবায়ু চক্র আর অনিয়মিত ভূমি ক্ষয়। ধারনা করা হয়, এই অঞ্চলের মুল ভৌগোলিক পরিবর্তনের কারণ হল আফ্রিকা মহাদেশের এশিয়া মহাদেশ থেকে আলাদা হওয়ার সময়কার টেকটোনিক প্লেটের জায়গা পরিবর্তন। ঐ সময় ঐখানে পর্বত মালা গড়ে উঠেছিল কিন্তু পরে পুরাজীবীয় কালে আবার ক্ষয় হয়ে গিয়েছিল। সামুদ্রিক প্লাবনের ফলে ঐখানে বালি শিলা তৈরি হয় এবং চুনাপাথর গুলো তীরে স্থানান্তরিত হয়। পরবর্তীতে আবার ও ভূমি জেগে উঠার পর চুনাপাথরের উপর বালি শিলার আবরণ তৈরি হয়। পরবর্তী সময়ে আবারও টেকটোনিক প্লেটের স্থান পরিবর্তনের ফলে শিলা ফেটে লাভা পলল সমভূমির উপর জমা হয়।

Source: Medirtour
ডানাকিল মরুভূমিতে লাভা প্রবাহিত হয়ে বেশ কিছু সংখ্যক লেকের সৃষ্টি করছে যা আবার অনেক গুলো উপত্যকার মুখে বাধা সৃষ্টি করেছে। এই উপত্যকার বৈশিষ্ট্য হলো পৃথিবীর টেকটোনিক প্লেটগুলো একটি অন্যটি থেকে সরছে। আর নতুন নতুন ফাটল তৈরি করছে। এখানে তিনটি প্লেট বছরে ১ থেকে ১ সেন্টিমিটার করে দূরে সরছে। এখানকার লাভার পুকুরগুলো জ্বলজ্বল করে। এগুলো রাতের আকাশকেও আলোকিত করে রাখে।
একদিন, লাখ লাখ বছর পর প্লেটগুলো সরে যাবে বহুদূর। আর এই খাত ভরে যাবে লোহিত সাগরের নোনা পানিতে।
এখানে মেক্যল নামে একটি ছোট শহর আছে। উচ্চ ইথিওপিয়া থেকে এক ভয়াবহ মোটর যাত্রায় যাওয়া যায় সেখানে। যেখানে মরুভূমির রুক্ষতা টের পাওয়া যায়। এখানকার পরিস্থিতি দেখলে মনে হয়, মানুষের বসবাস অসম্ভব। উঁচু ভূমির মানুষের কাছে এমন মনে হলেও আফার জনগোষ্ঠী এখানেই বসবাস করে। অন্য অঞ্চলের মানুষ যখন পানির জন্য আকুল হয়ে উঠে, তখন আফরাদের দেখা যায় শান্ত, নির্বিকার। এখানে বিবর্তন ক্রিয়াশীল দৃশ্যমান ভাবে। আফরাদের শরীর কম পানি ও খাবারে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে।
ডানাকিল পৃথিবীর অন্যতম রুক্ষ আবহাওয়ার একটি জায়গা যার অধিকাংশ জায়গায় উদ্ভিদ বা প্রাণীর সন্ধান পাওয়া যায়না, শুধু মাঝে মাঝে বিচ্ছিন্ন কিছু পাহাড় দেখতে পাওয়া যায় পুরো মরুভূমি জুড়ে। কিছু কিছু পাহাড়ের মাঝখানে অবশ্য উপত্যকার দেখা মেলে যেখানে প্রাণের চিহ্ন বলতে শুধু কিছু কণ্টক যুক্ত বাবলা গাছের কথা বলা যায়। এখানকার ভূমিরূপ এমনই যে গেলে মনে হবে এটা সবুজ-শ্যামল পৃথিবী নয় অন্য কোন গ্রহ। লাভা পুকুরে বুদবুদ উঠছে, নানা রঙে তাপ বলয় আর লবণ মাঠের বিস্তার চোখে সয়না। লাভা পুকুরের তাপ যখন লবণের স্তূপে বিস্তার লাভ করে তখন চারদিকে বর্ণালী দেখা যায়। প্রকৃতি গরম করে তোলার জন্য আরও উপকরণ আছে, উষ্ণ প্রস্রবণ। এসব প্রস্রবণ থেকে উঁচুতে লাফিয়ে উঠছে জল। চারপাশে তাপ ছড়িয়ে, মিশে যাচ্ছে মাটিতে বা লবণের স্তূপে।

Source: Travel and holiday
ইথিওপিয়ান উচ্চভূমির দিকে আরও আগালে দেখা যায় এই ডানাকিল আরও সম্প্রসারিত হয়েছে সামনের দিকে এবং স্থানবিশেষ এ এটি সমুদ্র পৃষ্ঠের চেয়ে ১২০ মিটার পর্যন্ত নিচু। এইজন্যই ইরিত্রিয়ার এই জায়গাটিকে পৃথিবীর অন্যতম নিচু স্থান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এখানে ভূত্বক এতো পাতলা যে শিলা ফাটল দিয়ে উদগিরিত লাভা দিয়ে নতুন ভূত্বক গড়ে উঠে প্রতিনিয়ত। এখানে পানি বারবার পরি-স্রাবিত হয় এবং ঐ পানিই আবার বাষ্প আকারে শিলা পাথরের ফাটল দিয়ে ধুয়া আকারে নির্গত হয়। বছরে প্রায় কয়েক হাজার ছোট বড় ভূমিকম্প অনুভূত হয় এই অঞ্চলে।
১০০০০ বছর আগে ডানাকিল লোহিত সাগরের অংশ ছিল যখন ভূত্বক ধ্বস হয়েছিল এবং সাগরের পানি প্লাবিত হয়েছিল। আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের কারণে ব্যাসাল্টিক শিলার নিচে পানি গুলো চাপা পরে যায়। পরবর্তীতে এই পানিই বাষ্পাকারে বেরিয়ে যায় অতিরিক্ত সূর্য তাপের ফলে এবং প্রচুর পরিমাণ লবণ জমা থেকে যায় ভূগর্ভে। এখানে তাপমাত্রা কখনও কমেনা বরং কখনও কখনও তাপমাত্রা ১৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্তও হয়ে থাকে। এবং এখানে যে বায়ু প্রবাহিত হয় টা এতো বেশি শুষ্ক যে তা স্বস্তির পরিবর্তে অস্বস্তিই বেশি দেয়।
অবাক করার মত ব্যাপার হল ক্ষয় হয়ে যাওয়া কঠিন শিলা আর লাভার প্রবাহ সমৃদ্ধ এই অঞ্চলেও মানুষ বসবাস করে। এই অঞ্চলের অধিবাসীদের বলা হয় “আফার”।

Source: Ethiopia Tropical Tours
এই আফার জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই যাযাবর আর ধর্ম বিশ্বাসে শতভাগ মুসলমান। ৪ টি প্রধান সুলতানি শাসন ও অসংখ্য শেখের শাসন চলে এই অঞ্চলে। ইরিত্রিয়ায় ৩০০০০০০, ইথিওপিয়ায় ১০০০০০০ এবং জিবুতিতে ৩০০০০০ আফার বাস করে। আফার দের ভাষা টি একটি কুশিটিক ভাষা।
অধিকাংশ আফাররা যাযাবর। তাদের মুল পেশা এখনও লবণ সংগ্রহ করে তা বাজারে নিয়ে বিক্রি করা। মাঝে মাঝেই দেখা যায় আরফা যুবক রা উটের পিঠে লবণের বস্তা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সামনের কোন বাজারে। এই লবণ বিক্রির উপার্জন দিয়েই জীবিকা নির্বাহ করে তাঁরা। একবার লবণ নিয়ে বিক্রি করে ফিরে আসতে সময় লেগে যায় প্রায় ৭ দিন। এই ৭ দিন হয়তো তাঁরা একটি পাউরুটি আর এক বোতল পানি খেয়েই পার করে দেয়। ডানাকিলের এই বৈরী আবহাওয়াই হয়তো তাদের শিখিয়েছে কিভাবে বৈরিতা কে হার মানিয়ে বেঁচে থাকতে হয়। লবণ সংগ্রহের পাশাপাশি তাঁরা পশুপালন ও করে থাকে। যেহেতু তাঁরা মূলত যাযাবর তাই তাঁরা বেশির ভাগ সময় উট, ছাগল পালন করে থাকে যেগুলো স্থানান্তরের সময় কাজে লাগে।যাদের পালিত পশু রয়েছে তাঁরা অনেক সময় অনেকদূর পর্যন্ত চলে যায় অত্যল্প শাকপাতার সন্ধানে। কেউ কেউ আবার উপকূলীয় অঞ্চলেও চলে যায় যারা মৎস্য শিকারে পারদর্শী। প্রতিটা যাযাবর দলেরই একজন করে দলনেতা থাকে।
আফারদের গৃহ বলতে যা বুঝায় তা হল কাঠের তৈরি গোলাকৃতির তাঁবু, যা তাদের কে সূর্যের তাপ থেকে রক্ষা করে আর তাদের যৎসামান্য সম্পদের সংরক্ষণে ব্যবহৃত হয়। এই তাঁবু আয়তনে খুবই ছোট যেন তা সহজে উটের পিঠে বহন করা যায় স্থানান্তরের সময়। আফার রা যখন এক জায়গা পরিবর্তন করে আরেক জায়গায় যায় তখন তাঁরা মূলত কূপের কাছাকাছি কোন জায়গা খুঁজে।
আফারদের মূল খাদ্য হল মাছ, মাংস, টক দই,বিশেষ এক ধরনের জা্উ এবং আটার তৈরি মোটা রুটি যার উপর ঘি আর মরিচের সস মিশানো থাকে।দুধ আফারদের খাদ্য তালিকার অত্যাবশ্যকীয় একটি অংশ। এমনকি তাদের বাড়িতে মেহমান আসলে তাঁরা প্রথমে দুধ দিয়ে আপ্যায়ন করে কেননা এটাই তাদের ঐতিহ্য। আফার রা সবসময় ডান হাতে খাবার গ্রহণ করে থাকে। তাদের মতে বাম হাতে খাবার খাওয়া, উপহার নেয়া বা দেয়া অথবা হাত মেলানো অভদ্রতার প্রকাশ।

Source: New Faces, New Places
আফাররা সাধারণত বিচ্ছিন্ন ভাবেই বসবাস করে থাকে। একটি গোষ্ঠী কিংবা বর্ধিত পরিবার আফারদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সংগঠন। তাদের মতে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অবতারণা ঘটে পিতার কাছ থেকে, আর উচ্চতা এবং আত্মিক বৈশিষ্ট্য আসে মা এর কাছ থেকে। আফার রা অত্যন্ত স্বাধীনচেতা এবং খুব ই শক্তিশালী ও কঠোর মন মানসিকতার হয়ে থাকে। দুর্বল চিতের লোকজন ডানাকিল মরুভূমিতে টিকে থাকতে পারেনা। অতীতে ডানাকিল মরুভূমিতে পৌরুষত্য অর্জন করার যোগ্যতা ছিল শত্রু পক্ষের একজন কে হত্যা করা এবং তার জননশক্তি নষ্ট করা। এইরকম করতে সক্ষম হলে সেই আফার যুবক কে সম্মানের চোখে দেখা হতো এবং তাঁকে কিছু নির্দিষ্ট অধিকার যেমন বিয়ের অধিকার দেয়া হতো। আফাররা বেশ সহজ সরল জীবন যাপন করে থাকে। এইরকম একটা বৈরী পরিবেশে আফারদের এই সহজ সরল জীবন যাপন সত্যিই অবাক করার মত একটা বিষয়।
বিজ্ঞানীরা যারা এই অঞ্চল নিয়ে গবেষণা করেছেন তাঁরা আরও কিছু মজার বিষয় খুঁজে পেয়েছেন এই জায়গা কে ঘিরে। তাঁরা দেখেতে পান যে একই অঞ্চলে ৩ ধরনের বাস্তুসংস্থান বিদ্যমান। গবেষণা করতে গিয়ে তাঁরা একটি ফুটন্ত পুকুরের মত জায়গা খুঁজে পান যেখানে ৩ রঙের উপস্থিতি ছিল। এই ৩ টি রঙ ৩ টি ভিন্ন বাস্তুসংস্থানের প্রতীক। সেই ৩ টি বাস্তুসংস্থান হল:
১. হলুদ রঙের সালফার বাস্তুসংস্থান।
২. হলুদাভ বাদামি রঙের সালফেট খনিজ বাস্তুসংস্থান।
৩. লাল রঙের আয়রন অক্সাইড বাস্তুসংস্থান।
এর মাঝে ২ টি বাস্তুসংস্থানে বিজ্ঞানীরা একটি অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করেন আর তা হল ২ টি রঙ আসছিল অত্যন্ত গরম পানির থার্মাল চিমনির মধ্য দিয়ে। তাঁরা ধারনা করেন এই চিমনি গুলো হয়তো থার্মফিলিক ব্যাকটেরিয়ার আবাসভূমি। বিজ্ঞানীদের এই দল ৩ দিন ডানাকিলে থেকে বেশ কিছু নমুনা সংগ্রহ করেন পরবর্তী পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য। ডানাকিল এর এই মরুভূমি নিয়ে গবেষণার পিছনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে। কারণ ডানাকিলে যে পরিবেশ ও আবহাওয়া দেখা যায় তা আমাদের পৃথিবীর বাইরে সৌর জগতের অন্য গ্রহেও দেখা যায়।যেমন এখানকার আয়রন সমৃদ্ধ বাস্তুসংস্থানের সাথে মিল পাওয়া যায় মঙ্গল গ্রহের বাস্তুসংস্থানের, আবার ইউরোপা-জুপিটারের সাথে মিল পাওয়া যায় সালফেট সমৃদ্ধ বাস্তুসংস্থানের দিক থেকে। এখন ডানাকিলে যদি প্রাণের উপস্থিতি সম্ভব হয় তাহলে অন্য গ্রহ গুলোতেও সম্ভব কিনা সেটা পরীক্ষা করার জন্য বিজ্ঞানীরা ডানাকিল মরুভূমি নিয়ে অনবরত গবেষণা করে চলেছেন। তবে যাই হোক, ডানাকিল নিয়ে গবেষণার পিছনে যে কারণ গুলো আমরা ভাবছি, প্রকৃতপক্ষে তার চেয়েও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হয়তো রয়েছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে বিজ্ঞানীরা কত টা সফল হবে তাদের গবেষণায়। এখানে উল্লেখ্য যে ডানাকিল মরুভূমির খুব কাছেই “Lucy Autralopithecus” এর জীবাশ্ম খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। এইজন্যই ডানাকিল কে “ মনুষ্য সভ্যতার শৈশাবস্থা” বলা হয়ে থাকে। এখন যদি বিজ্ঞানীরা একদিন আবিষ্কার করেন যে এই ডানাকিলেই প্রথম মনুষ্য প্রাণের আবির্ভাব ঘটেছিলো তাহলে হয়তো অবাক হওয়ার মত কিছু হবেনা। এখন শুধু সেটা জানার জন্য আমাদের অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছু করার নেই আপাতত।
রেফারেন্সঃ
http://factslegend.org/danakil-depression-earths-hostile-place-may-support-life/
https://en.wikipedia.org/wiki/Danakil_Desert