বিংশ শতাব্দী তো বটেই, সভ্যতার ইতিহাসে একটি বিরাট বিপ্লবের নাম কিউবা বিপ্লব। সমাজের ক্ষমতাধর, পুঁজিপতি শ্রেণীদের বিপক্ষে এ যেন সমাজের নিপীড়িত জনতার এক সুমহান বিজয়। আজো পৃথিবীর বুকে ঘটে যাওয়া যেকোনো ছোট বড় আন্দোলনের আদর্শ হয়ে আছে কিউবা বিপ্লব। কিউবা বিপ্লবের ইতিহাস আজো পৃথিবী জুড়ে স্বাধীনতাকামী মুক্ত জনতার সুপাঠ্য হিসেবে বিবেচিত। ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখা এই বিপ্লবের ইতিহাসই আজ তুলে ধরবো
সময়টা ১৯৫২ সাল। ২য় মেয়াদে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে স্বৈরাচারী ফ্লেজানসিও বাতিস্তা কিউবাকে নিয়ে যান অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলার সর্বোচ্চ পর্যায়ে। পার্শ্ববর্তী দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য নিয়ে তিনি কিউবার সাধারণ নাগরিকদের বিভিন্ন নাগরিক অধিকারও ছিনিয়ে নিতে লাগলেন। ইতিহাস বলে, সরকারি কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদস্বরূপ হরতাল কিংবা অবরোধও এসময় নিষিদ্ধ করে বাতিস্তা সরকার।
বাতিস্তা সরকারের অধীনে কিউবার মারাত্মক ক্ষতি হয় অর্থনীতিতে। কিউবার প্রধান অর্থকড়ি ফসল চিনি শিল্প এসময় ধ্বংস হতে থাকে আমেরিকান বুর্জোয়া এবং মাফিয়াদের হাতে। পুরো কিউবাই এসময় আমেরিকান বুর্জোয়াদের জুয়া খেলার মাঠে পরিণত হয়। যা দেশের তৎকালীন গরীব ও ধনী শ্রেণীর মাঝে আকাশসম পার্থক্য গড়ে তুলে।
শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়, সামাজিক ক্ষেত্রেও এসময় কিউবায় নেমে আসে প্রবল দুর্ভোগ। বিশেষ করে কিউবায় আসা আমেরিকান মাফিয়াদের প্রবল প্রতাপে লণ্ডভন্ড হয়ে যায় কিউবার সামাজিক অবস্থা। যেমন, ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোতে যৌণবৃত্তি একটি প্রচলিত পেশা। তবে বাতিস্তার শাসনামলে তার রূপরেখা দাড়ায় চরম বিপর্যয়ে। একটা পরিসংখ্যানে দেখানো হয়, মাত্র ১০লাখ জনসংখ্যার শহর হাভানাতে প্রায় ২৭০টি যৌনপল্লি এসময় চালু থাকে। যাতে যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করতো প্রায় সাড়ে বারো হাজার মহিলা ও শিশু। যা একটি দেশের সামাজিক ভারসাম্যকে অবশ্যই প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলে।
এছাড়াও যৌনবৃত্তির পাশাপাশি এই সময় চরম আকারে বৃদ্ধি পায় মাদক আমদানির হার। যা একটি দেশের সামাজিক অবস্থাকে অরাজকতায় রূপান্তর করার প্রথম উপায়। দেশের তরুণ সমাজ যখন ব্যাপকভাবে মাদকের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে, তখন দেশটির ভবিষ্যৎ যে চরম অন্ধকারে পর্যবসিত হচ্ছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
কিউবার তৎকালীন এহেন শোচনীয় অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে কোনো সুসংগঠিত পদক্ষেপও আসছিল না তৎকালীন রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে। উপরন্তু তৎকালীন সুযোগসন্ধানী ও ভীতু রাজনীতিবিদরা পিছু হঠছিলো রাজনীতির মাঠ থেকে।
কিউবার এমন অশৃঙ্খল অবস্থাকে বিশ্ববিবেকের কাছে তুলে ধরতেও ব্যর্থ হয়েছিলো তৎকালীন সংবাদ মাধ্যম৷ দেশটির সংবাদমাধ্যমগুলোও জিম্মি ছিলো বাতিস্তা সরকারের হাতে। দেশের কোথাও যাতে অভ্যুত্থান কিংবা জনবিপ্লব গঠতে না পেরে তার জন্য বাতিস্তা সরকার তৈরি করেছিলো গুপ্ত পুলিশ। শোনা যায়, প্রায় ২০০০০ নিরীহ জনগণ খুন হয়েছিল এই গুপ্ত পুলিশদের হাতে।
কিউবার এমন সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবক্ষয়ে যখন সেদেশের পুনর্জাগরণের আলো নিমিষেই অস্তমিত হচ্ছিল, ঠিক তখনই ভোরের সূর্যের মতোই উদিত হন বিপ্লবী ফিদেল কাস্ত্রো। তার সাংগঠনিক দূরদর্শিতা এবং বিপ্লবী মনোভাব যা পরবর্তীতে কিউবা বিপ্লবকে নিয়ে যায় এক অনন্য উচ্চতায়।
শুধু ফিদেল কাস্ত্রো নন, কিউবা বিপ্লবের সূচনালগ্নের এমন ভয়াল মুহূর্তে আবির্ভূত হন চে গেভারা, সিয়েরা মায়েস্ত্রার, রামিরো ভালদেস, রাউল কাস্ত্রো ও হুয়ান আইমেদা সহ আরও অনেকে।
মূলত কাস্ত্রোর নেতৃত্বে কিউবা বিপ্লবে সূচনা গঠে ১৯৫৩ সালের ২৬ জুলাই। এর আগে তিনি ১৫০০ যুবককে নিয়ে একটি বিগ্রেড তৈরি করেন। যাদের প্রায় অনেকেই পূর্বে বাতিস্তার সেনাদল থেকে চাকরীচ্যুত। এদের অনেকের বয়সই ছিলো ৩০এর কাছাকাছি। ঐ ১৫০০ বিপ্লবীরা আন্দোলনের প্রতি এমনই উৎসর্গিত ছিলো যে, আন্দোলনের জন্য নিজেদের সর্বশেষ সম্বলটুকুও ত্যাগ করতে পিছুপা হননি। তাদের নিজস্ব অর্থ দিয়েই তারা আন্দোলনের যাবতীয় ব্যয় নির্বাহ করতো। আরও শোনা যায়, বিপ্লবীদের অনেকেই তাদের সারাজীবনের সঞ্চয় আন্দোলনের ব্যয় নির্বাহ করতে দান করেন। নিজের চাকরী সামান্য কিছু টাকার জন্য বিক্রি করে আন্দোলনে অর্থায়ন করার নজীরও পাওয়া যায়।
কাস্ত্রো এমন ত্যাগী সদস্যদের কে সুসংগঠিত করেন এবং ১৯৫৩ সালের ২৬শে জুলাই সান্টিয়াগো শহরের মনকাদা ব্যারাক ও বেয়ামো সেনা ক্যাম্প আক্রমণ করেন। মূলত বাতিস্তা সেনাদলের সাথে কোনো সম্মুখ যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার কোনো লক্ষ্য কাস্ত্রোর ছিলোনা। তিনি চেয়েছিলেন- সেনা ক্যাম্প থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণে অস্ত্র লুণ্ঠন করতে এবং বেতারের মাধ্যমে আক্রমণের বার্তা ঘোষণা করে শহরবাসীকে একটি অভ্যুত্থানের প্রতি ধাবিত করতে।
তবে দুঃখের বিষয় হলও, ২৬শে জুলাইয়ের ভোর ৫টার ঐ আক্রমণ পুরোপুরি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ব্যর্থতার কারণ হিসেবে বলা যায়, শক্তি সামর্থ্যের বিচারে বাতিস্তা সেনাদল বিপ্লবীদের তুলনায় অনেক শক্তিশালী এবং সুসংগঠিত ছিলো। আক্রমণটি ব্যর্থ হলে, বিপ্লবীদের অনেকেই নিহত ও আটক হন। আর অনেকেই শহর ছেড়ে পালিয়ে যান।
ফিদেল ও তার ১৮জন সহচরী কোনোমতে পালিয়ে এসে একটি পর্বতের গুহায় আশ্রয় নেন। অবশ্য এক সপ্তাহ পরে তারা পুলিশের হাতে ধরা পরেন। এদিকে গ্রেপ্তার হওয়ার পর ফিদেলের ১৫বছরের জেল হয়। তবে ১৯৫৫ সালে তিনি আবার মুক্ত হন। ২৩শে জুলাইয়ের ঐ বিপ্লব ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলেও, ফিদেল কিঞ্চিত পরিমাণও ভেঙে পড়েননি। ঘুণে ধরা ঐ বিপ্লবকে আবার সুসংগঠিত করতে তিনি মেক্সিকো চলে যান। এখানেই মূলত কিউবা বিপ্লবের প্রাণের সঞ্চার হয়।
মেক্সিকোতে তিনি বিভিন্ন স্থান ঘুরে বেড়ান এবং বিপ্লবের জন্য কর্মী খুঁজতে থাকেন। এবার তার দলে যোগ দেয় প্রায় সকলই ছিলো তরুণ ও যুবা। কিউবা থেকেও অনেক তরুণ এই দলে যোগ দিতে আসেন বলে শোনা যায়। বিপ্লবে উদ্বুদ্ধ এই যুবকদের তিনি প্রশিক্ষণ দেন এবং তাদেরকে বিপ্লবী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন। ফলে ফিদেলের এবারের দলটি হয় পূর্বের চেয়েও আরও সুসংগঠিত ও ভয়ঙ্কর।
মেক্সিকোতে ফিদেল ও তার ভাই রাউলের সাথে দেখা হয় চে গুয়েভারার। যা তার দলের জন্য আরও একটি বিশাল প্রাপ্তি। ফিদেলের গেরিলা দলে চে গুয়েভারার মতো একজন বিপ্লবীর যোগদান কিউবা বিপ্লবের সাফল্যের মাত্রা আরও বিশাল গুণে বাড়িয়ে দেয়। কিউবা বিপ্লবের শেষ পর্যন্ত সুখে, দুঃখে ফিদেলের সঙ্গ দেন চে।
সবশেষে ফিদেল ও তার প্রায় আশি জন সহচর ১৯৫৬ সালের ২৫ নভেম্বর “গ্রানামা” নামক জাহাজে করে কিউবার উদ্দেশ্যে রওনা দেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিলো ৩০শে ডিসেম্বর নাগাদ সময়ের মধ্যেই তারা কিউবা পৌঁছে যাবেন। কিন্তু যাত্রা শুরুর কয়েক দিনের মাঝেই সমুদ্রের প্রতিকূল আবহাওয়ার মুখে পরে বিপ্লবীদের অনেকে অসুস্থ হয়ে পরেন। ফলে দূঃখজনকভাবেই যাত্রা শুরুর ৭ দিনের মাঝেই তারা অনির্ধারিত একটি সমুদ্র উপকূলে জাহাজ থামান। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, ঐ উপকূলে জাহাজ ভিড়াতেই খবর পেয়ে যান স্থানীয় কোস্টগার্ডরা। কোস্টগার্ডের প্রদেয় খবরে সেনাবাহিনীর আক্রমণের মুখে পরেন কাস্ত্রো বাহিনী। শুরু হয়ে যায় যুদ্ধ। এই যুদ্ধে অনেকেই নিহত হন। শেষমেশ ফিদেলসহ বিপ্লবীদের ২২ জন পার্শ্ববর্তী সিয়েরা মায়েস্ত্রো পাহাড়ে পালিয়ে যান। তবে হার মানেন নি ফিদেল। এখান থেকেই বিপ্লবে ঝাঁপিয়ে পড়েন তিনি।
সিয়েরা মায়েস্ত্রোর পাহাড় ঘেষা এলাকাটি মূলত আঁখ চাষের জন্য বিশেষভাবে বিখ্যাত ছিলো। আর আখ চাষিদের উপর বাতিস্তা সরকারের চলমান নিপীড়ন ক্ষুব্ধ করে তুলেছিল স্থানীয় আখ চাষিদের। আর তাদের মধ্যে ফিদেলের জনপ্রিয়তা ছিলো আকাশচুম্বী। স্থানীয় আখচাষীরা দলে দলে ফিদেলের দলে যোগ দান করতে থাকেন এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে গেরিলা আক্রমণ চালান। যা বাতিস্তা সরকার ও তার সামরিক বাহিনীকে নড়েচড়ে বসতে বাধ্য করেছিলো। আর এমন গেরিলা আক্রমণের মধ্য দিয়েই মূলত-শুরু হয় কিউবা বিপ্লব। গেরিলাদের পাশাপাশি বিপ্লবে অংশ নিতে থাকেন স্থানীয় বাম সংগঠনগুলো।
এরপর শুরু হয় বাতিস্তা সরকারের নির্মম হত্যাকাণ্ড। বিপ্লবীদের বিভিন্নভাবে আক্রমণ চালাতে থাকেন বাতিস্তা সরকার। আর বাতিস্তার সাথে যোগ দেন মার্কিন পুঁজিপতিরা। তবে আক্রমণে কোনোমতেই পিছপা হননি বিপ্লবীরা। আক্রমণ আর পাল্টা আক্রমণের মধ্য দিয়ে বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করতে থাকেন ফিদেল বাহিনী। বাতিস্তা সরকারও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে গিয়ে বারবার ব্যর্থ হন। শেষমেশ ১৯৫৮ সালের ৩১শে ডিসেম্বরে আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। বিপ্লবীদের নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে হাভানা ছেড়ে মেক্সিকোতে পালিয়ে যান বাতিস্তা। এভাবেই ফিদেল ও তার সঙ্গীদের অধ্যবসায়, দেশপ্রেম আর নৈপুণ্যতার উপর ভর করে সফল হয় কিউবা বিপ্লব।
কিউবা বিপ্লব শুধু একটি বিপ্লবই নয়, যেনো সমাজের পুঁজিপতি শোষকশ্রেণীর বিরুদ্ধে শ্রমজীবী গণ-মানুষের হুংকার। ইতিহাস তার নিজ গতিতে চললেও, কিউবা বিপ্লব রয়ে যাবে তার নিজস্ব স্থানে, নিজস্ব মহিমাতে।
zofran laxative
zyprexa in elderly
lamisil 250mg cost – purchase fluconazole online cheap buy generic grifulvin v
order metformin 1000mg online cheap – buy glycomet online cheap buy precose 25mg sale