মরুভূমির প্রখর তাপ, বালি ঝড় আর প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকা জনগোষ্ঠী বেদুঈন। মরুভূমির আদ্যাপন্ত তাদের জানা। তাদেরকে অভিযাত্রীও বলা যায়, কারণ তারা সর্বদা ভ্রমণশীল। কি, শুনতে খুবই রোমাঞ্চকর লাগছে নিশ্চয়ই? শুনতে আকর্ষণীয় লাগলেও বাস্তবে তাদের জীবন সংগ্রামের জীবন। উইলফ্রেদ থিসিঞ্জার এর মতে, বেদুঈন জীবন হল “ কঠিন ও নির্দয়……সর্বদা ক্ষুদা ও তৃষ্ণার সাথে বসবাস”। সংগ্রামী, যাযাবর এবং প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থা থেকে ভিন্ন পথে চলা বেদুঈনদের নিয়ে জানা অজানা বিভিন্ন তথ্যে সাজানো আজকের আয়োজন।
বেদুঈন কাকে বলে?
বেদুঈন শব্দের উৎপত্তি ঘটেছে আরবি শব্দ “বেদু” থেকে, আরবিতে যার অর্থ “বাদিয়াহ বাসী”। আরবি “বাদিয়াহ” শব্দের বাংলা করলে এর অর্থ দাঁড়ায় ‘সমতল ভুমি‘ বা ‘মরুভূমি’ অর্থাৎ বেদুঈন শব্দের অর্থ দাঁড়ায় ‘যারা মরুভুমির বাসিন্দা’। বেদুঈন শব্দে আরেক আরবি বিশেষ্য এর ব্যবহার দেখা যায়, সেটা হল “বেদেয়া” যার অর্থ ‘আরম্ভ’। বেশিরভাগ আরবীদের বিশ্বাস, বেদুঈনরাই প্রথম আরবে এসে বসতি স্থাপন করে। আরবের ইতিহাসে তাদের ধরে নেয়া হয় “আরবের উৎস এবং ইসলামের সত্ত্বা” হিসেবে আর এর থেকেই ‘বেদেয়া’ শব্দ থেকে বেদুঈন শব্দের উৎপত্তির বিষয়ে ধারণা লাভ করা যায়।
বেদুঈন কারা?
মরু অঞ্চলের যাযাবর জনগোষ্ঠীকে বেদুঈন বলা হয়। মধ্যপ্রাচ্যের মরুভূমি, বিশেষত, উত্তর আফ্রিকা, আরাবিয়ান উপদ্বীপ, মিশর, ইসরায়েল, ইরাক, সিরিয়া এবং জর্ডানের মরু অঞ্চলগুলোতে বেদুঈনদের বসবাস। বেদুঈনরা নিজেদের সত্যিকার আরবের “গৌরবান্বিত উত্তরাধিকারী” (Heirs of Glory) হিসেবে দাবি করে থাকে। বেদুঈনরা ছোট ছোট দলে বিভক্ত থাকে। তাদের মূল পেশা পশু পালন এবং বিক্রয় করা। বেশিরভাগ বেদুঈন পশু পালক শীত এবং বর্ষায় মরু অঞ্চলে স্থান বদল করে এবং গ্রীষ্মে মূল ভুমিতে ফিরে আসে। কোন দল কি ধরনের পশু পালন করছে তার ভিত্তিতে বেদুঈন গোষ্ঠী বিভক্ত হয়, যেমন; যে বেদুঈন দল উট পালন করে, তাদের বেশিরভাগ অবস্থান করে সাহারা, সিরিয়া এবং আরাবিয়ান মরু অঞ্চলে। যারা গবাদি পশু পালন করে তারা প্রধানত আরবের দক্ষিণে এবং সুদানে অবস্থান করে যেখানে তাদের ডাকা হয় “বাগারা” বলে। ছাগল এবং ভেড়া পালনকারী বেদুঈনরা বাস করে জর্ডান, সিরিয়া এবং ইরাকের মূল ভূমির কাছাকাছি এলাকায়। এছাড়াও, ইতিহাস বলে যে, বেদুঈনরা অতীতে ব্যবসায়ী মরুযাত্রীদল এবং গ্রাম আক্রমণ করতো অথবা অর্থের বিনিময়ে তাদের সুরক্ষা প্রদান করতো।
ইতিহাস
বেদুঈনদের ইতিহাস জানতে হলে যেতে খ্রিস্টপূর্ব ৬০০০ সালে। তখন সিরিয়ার দক্ষিণ প্রান্তে কৃষক এবং পশু পালকেরা বসতি স্থাপন করছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৮৫০ এর মধ্যে আধুনিক আরবদের পূর্বপুরুষেরা মরুদ্যানের বসতি এবং পশুপালকদের ক্যাম্পের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে। তারাই পরবর্তীতে বাকি অঞ্চলগুলোতে নিজেদের কর্মক্ষেত্রের বিস্তার ঘটায়। প্রাথমিকভাবে বেদুঈনদেরকে “পবিত্র ভুমি”র বাসিন্দা হিসেবে ধরে নেয়া হয়। সম্ভবত আব্রাহাম, ইসহাক এবং যাকোব বেদুঈন গোষ্ঠীর সদস্য ছিলেন। আর বিবলিকাল সময় থেকে আজ পর্যন্ত বেদুঈনদের অনেক কিছুই এখনও পর্যন্ত অপরিবর্তিত রয়ে গেছে।
খ্রিস্টপূর্ব ১ম শতাব্দীতে বেদুঈনরা পশ্চিমে- জর্ডান, সিনাই উপদ্বীপ এবং লোহিত সাগরের উপকূলীয় অঞ্চলে গমন করে। ৭ম শতাব্দীর মধ্যে যারা ইসলাম ধর্ম গ্রহন করেছিল, তাদের মধ্যে বেদুঈনরা ছিল অন্যতম। চারিদিকে যখন ইসলাম ধর্মের প্রসার ঘটছে, তখন হাজার হাজার মুসলিম, যাদের মধ্যে বেদুইনরাও ছিল, আগের জায়গা ছেড়ে নিকটবর্তী এলাকায় বসতি স্থাপন করে আর এভাবেই পরবর্তীতে মধ্য প্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকায় ইসলাম ধর্মের প্রসার ঘটে। মঙ্গোলদের আক্রমণের পর মধ্যপ্রাচ্যের কৃষিজমিগুলো ব্যাপক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যার ফলে বেদুঈনরা পশুপালনকে তাদের প্রধান পেশা হিসেবে গ্রহন করে নেয়।
বেদুঈন সমাজ
বেদুঈন সমাজ গোষ্ঠীগত এবং পিতৃতান্ত্রিক। বেদুঈনরা সাধারণত যৌথ পরিবার গঠন করে। বেদুঈন পরিবারগুলো অন্তর্মুখী হয়, পরিবারে বহুবিবাহের অস্তিত্ব থাকে এবং পরিবারের কর্তার ভূমিকা পালন করে পুরুষ সদস্য। বেদুঈন সমাজের ভিত্তি হল বিশ্বস্ততা। এই বিষয়ে বেদুঈনদের মধ্যে প্রবাদ প্রচলিত আছে, “ আমি আমার ভাইয়ের বিরুদ্ধে, আমি এবং আমার ভাই আমাদের জ্ঞাতি ভাইদের বিরুদ্ধে, এবং আমি আর আমার জ্ঞাতি ভাই বিদেশীর বিরুদ্ধে”- অর্থাৎ বেদুঈন সমাজ গড়ে উঠেছে বিশ্বস্ততা আর আত্মীয়তার ভিত্তিতে।
বেদুঈন সমাজের একক পরিবারকে বলা হয় তাবু। সাধারণত একটি পরিবারে ৩-৪ জন প্রাপ্তবয়স্ক সদস্য এবং যে কোন সংখ্যার ছেলেমেয়ে থাকে। যখন খাদ্যের অনেকগুলো উৎস খুঁজে পাওয়া যায়, তখন অনেকগুলো তাবু একসাথে ‘গউম’ হিসেবে ভ্রমন করে। কখনও কখনও ‘গউম’ এ বিয়ে অথবা পরিচিতির ভিত্তিতেও সদস্যযুক্ত করা হয়। সবচেয়ে বড় পরিবারের প্রধানকে বেদুঈন দলের প্রধান হিসেবে ধরে নেয়া হয় এবং সেই প্রধানকে “শেখ” বলে ডাকা হয়। শেখ এর সহকারি হিসেবে থাকে সমাজের গুরুজনদের একটি কাউন্সিল।
ঐতিহ্যগত ভাবে বেদুঈনরা সম্মান রক্ষার ক্ষেত্রে বেশ কিছু নিয়মকানুন পালন করে, সেগুলোকে বলা হয় “অনার কোডস”। বেদুঈনরা ৪ ধরনের অনার কোড অনুসরণ করে থাকে- সারাফ, ইর্দ, দিয়াফা এবং হামাসা। বেদুঈনদের আইন প্রতিষ্ঠিত হয় এই দুই কোডের ভিত্তিতে। ইর্দ হল নারীদের জন্য নির্দিষ্ট অনার কোড। একজন নারী তার ইর্দ নিয়ে জন্মগ্রহণ করে, কিন্তু কামজ অপরাধ তার ইর্দ ধ্বংস করে দিতে পারে। সতীত্ব আর ইর্দ ভিন্ন দুই ধারণা, সতীত্ব শারীরিক এবং ইর্দ মানসিক। ইর্দ হারালে তা আর ফিরে আসে না।
সারাফ হল পুরুষদের অনার কোড। সারাফ জয় করা যায়, উদ্দীপিত করা যায়, হারিয়ে আবার পুনরুদ্ধার করা যায়। সারাফের দায়িত্ব হল পরিবারের নারীদের ইর্দ রক্ষা করা, সম্পদের সংরক্ষণ করা, বংশের মান রক্ষা করা এবং নিজের গোত্রের সুরক্ষা করা।
দিয়াফা অনেকটা সারাফের মত মানবিক গুণ। যদি প্রয়োজন হয়, তাহলে শত্রুকে আশ্রয় দেয়া এবং আতিথেয়তা দেখানো দিয়াফার দায়িত্বগুলোর একটি। অর্থাৎ দিয়াফা হল পরস্পরের প্রতি মিত্রতা এবং ভাল ব্যবহার করার অনার কোড। হামাসা হল সাহসিকতা সম্পর্কিত অনার কোড এবং এটিও অনেকটা সারাফের মত। নিজের গোত্রের সুরক্ষার জন্য স্বদিচ্ছা হল হামাসা।
নাম রাখার সময়েও বেদুঈনরা নিজেদের পন্থা অবলম্বন করে। বেদুঈন সমাজে নাম রাখার ক্ষেত্রে প্রথমে নিজস্ব নাম, পরে বাবার নাম এবং শেষে অবশ্যই স্বগোত্রীয় পূর্বপুরুষের নাম যুক্ত করতে হয়। নারীরা বিয়ের পরও বাবার পদবি ব্যবহার করে।
বেদুঈনদের ভাষা ও ধর্ম
আরবের অন্যান্য জনগণের মত বেদুঈনদের মাতৃভাষাও আরবি। তবে বেদুঈনরা আরবির ভিন্ন ভিন্ন উপভাষা ব্যবহার করে। বেশিরভাগ বেদুঈন সুন্নি মুসলিম এবং সকল মুসলিম আচার-অনুষ্ঠান পালন করে। ধর্ম বিশেষজ্ঞ সকল ব্যবস্থাপনা এবং ধর্ম শিক্ষা প্রচারের দায়িত্বে থাকেন। অনেক বেদুঈন জিন, রাক্ষস এবং আহল আল আরদ এর মত মন্দ আত্মায় বিশ্বাস করে যারা কখনও কখনও মরুভুমিতে একাকী যাতায়াত করা মানুষদের ক্ষতিসাধন করে। সমাধি দেয়ার ক্ষেত্রেও বেদুঈনরা ইসলামিক নিয়ম অনুসরণ করে থাকে। কবরগুলোতে কোন ধরনের চিহ্ন ব্যবহার করা হয়না।
বেদুঈন সংস্কৃতি
বেদুঈন সংস্কৃতি বেদুঈনদের মতই ভিন্ন। প্রধান পেশা পশু পালন হওয়ার কারণে বেদুঈনদের প্রধান খাদ্য দুগ্ধজাত দ্রব্য। বেদুঈনদের আমিষের প্রধান উৎস ছাগল এবং উট। উটকে “ঈশ্বর প্রদত্ত উপহার” হিসেবে বিবেচনা করা হয় বেদুঈন সমাজে আর এ কারণে যেকোনো উৎসবে বিনোদন হিসেবে উটের দৌড়ের ব্যবস্থা করা হয়।
বেদুঈনদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল মৌখিক কবিতা। কোন গোত্রে যদি কোন কবি থাকতো তাহলে বেদুঈন সমাজে সেই কবিকে আলাদা মর্যাদা দেয়া হত। এছাড়া, মৌখিক কবিতাকে তথ্য প্রদান এবং সচেতনতা ছড়ানোর মাধ্যম হিসেবেও ব্যবহার করা হত।
বেদুঈনরা মুসলিম আইন অনুসরণ করে নিজেদের আত্মীয়দের মধ্যে বিয়ে সম্পন্ন করে, সাধারণত একজন পুরুষ তার পিতার ভাইয়ের মেয়েকে বিয়ে করে। নিজ পরিবারের বাইরে বিয়ের ঘটনা খুব কম হলেও যদি অন্য গোত্রের সাথে মিত্রতার সম্পর্ক স্থাপিত হয়, তাহলে সে ক্ষেত্রে দুই গোত্রের মাঝে বিয়ের ঘটনা ঘটে। বিয়ের পর অনেক সন্তান জন্ম দেয়াটাকে বেদুঈনরা দায়িত্বের কাতারে ফেলে কারণ যে গোত্রের যত বেশি সদস্য, তার তত বেশি শক্তি। বেদুঈনদের মাঝে বহুবিবাহ অনুমোদিত কিন্তু ধনী বেদুঈন ছাড়া কারও পক্ষে একের অধিক বিয়ে করা সম্ভব হয় না।
বেদুঈনদের নিজস্ব গান এবং সুর রয়েছে। সুর বাধার সময় তারা ড্রাম, এক তারের বাদ্যযন্ত্র এবং রেকর্ডারের মত দেখতে বাতাস চালিত বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করে তারা। এছাড়া তারা কিন্নর নামের একধরনের বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করে যার অস্তিত্ব বিবলিকাল সময়কে নির্দেশ করে।
বর্তমানে বেদুঈন
বর্তমানে যাযাবর বেদুঈনদের সংখ্যা দিন দিন কমতে শুরু করেছে। অনেকে বিভিন্ন স্থানে স্থায়ি ভাবে বাস করা শুরু করেছে। অনেক বেদুঈন এখন আর পশুপালন করেনা। বর্তমান যুগের সাথে তাল মিলিয়ে বেদুইনরাও এখন শহরমুখি হচ্ছে। অনেক বেদুঈন এখন বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা করে এবং আগের তুলনায় তাদের অবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে বলে বিশ্বাস করে। বেদুঈনরা যে মূলত যাযাবর, তার প্রমান মেলে তখনি যখন তাদের কোন যাযাবর আত্মীয়ের সাথে তাদের ভাল যোগাযোগ থাকে। তা না হলে বেদুঈনরা এখন আমার আপনার মতই আধুনিকতার স্পর্শে স্পর্শিত।