শুধুমাত্র অতি উৎসাহী কিছু ভারতীয় বিমান সেনার ভুলের কারণে সেদিন অনেক বেশি খেসারত দিতে হয়েছিলো সদ্য গঠিত বাংলাদেশি নৌবাহিনীর তা হয়তো অনেকেরই অজানা।
সেদিন ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই হতবিহব্বল হয়ে পড়েছিলো।
বাংলাদেশ নৌবাহিনীর পথযাত্রার শুরু মাত্র। সেপ্টেম্বর মাসে গঠিত নৌবাহিনীতে যোগ হয়েছিলো ভারত হতে উপহার পাওয়া দুটো টাগবোট যা কলকাতা গার্ডেনরিচ ন্যাভাল ওয়ার্কশপে নিয়ে ২টি করে বাফার গান ও মাইন পড সংযোজন করা হয় এবং ব্রিটিশ ধরণের ৪ টি ৫০০ পাউন্ড ওজনের মার্কমাইন বহনের উপযোগী করে দুইটাকেই গানবোটে পরিণত করা হয়। নামকরণ হিসেবে একটার নাম দেয়া হয় পদ্মা আরেকটার নাম পলাশ। বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন ছিলেন পলাশের ইঞ্জিনরুমের আর্টিফিসারের দায়িত্বে।
বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন যোগ দেন ১০ নম্বর নৌ সেক্টরে।
সময় ডিসেম্বর ৬, ১৯৭১। বিজয়ের মাত্র ১০ দিন পূর্বেকার কথা। যশোরে পাকিস্তান সেনানিবাসের পতনের পর ‘পদ্মা’ , ‘পলাশ’ ও ভারতীয় গানবোট ‘পাভেল’ মংলা বন্দরের পাকিস্তানি নৌঘাঁটি পিএনএস তিতুমীর দখলের উদ্দেশ্যে ভারতের হলদিয়া নৌঘাঁটি থেকে যাত্রা শুরু করে। ৮ ডিসেম্বর তাদের সাথে সুন্দরবনের আড়াই বাঁকি থেকে বিএসএফ (ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী) এর টহল জাহাজ চিত্রাঙ্গদাও এসে যোগ দেয় মুক্তিবাহিনীর সাথে।বাধাবিপত্তি ছাড়াই ৯ ডিসেম্বর তাঁরা হিরণ পয়েন্টে পৌঁছান।
সময় ১৯৭১, ১০ ডিসেম্বর এর ভোরের সকাল। মিত্রবাহিনীর সাথে মুক্তিবাহিনী মংলা বন্দরের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। টহল জাহাজ ‘চিত্রাঙ্গদা’ সেখাইনেই পজিশন নিয়ে নেয় আর বাকি কনভয় খুলনা শিপইয়ার্ড দখলের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।
মধ্যদুপুরে হঠাৎ রুপসা নদীতে উড়ে যায় কয়েকটী বোমারু বিমান।
সেনারা শত্রুপক্ষের বিমান ভেবে পজিশন নিয়ে গুলি করার অনুমতি চাইলে ক্যাপ্টেন মনেন্দ্রনাথ অভয় দিয়ে জানালেন ওগুলো ভারতীয় বিমান, সুতরাং ভয় পাওয়ার কিছুই নেই কিন্তু বলা কওয়া ছাড়াই হঠাৎ করে কিছু বুঝে উঠার আগেই দক্ষিণ-পশ্চিমে উড়ে এসে নিচে নেমে পাকি নৌবহর মনে করে শুরু করে প্রবল গোলাবর্ষণ। এখানে ভারতীয় বিমান বাহিনীর অপরিপক্কতা ফুটে উঠে এই কারণেই যে আগে হতেই ভারতীয় বিমান বাহিনীকে জানানো হয়েছিলো এই এলাকায় যাতে কোনভাবেই বোম্বিং করা না হয় এবং জানিয়ে দেয়া হয়েছিলো উপরিভাগ হলুদ রঙ করা গানবোটগুলো মুক্তিবাহিনীদের এবং এতে কোনভাবেই আক্রমণ করা যাবে না কিন্তু হঠাৎ এমন অযাচিত আক্রমণ পুরো পরিস্থিতি বদলে দেয়। তাদের ফেলা গোলা এসে পড়ে গানবোট ‘পদ্মা’র ইঞ্জিনরুমে। একেবারে ধ্বংস হয়ে গেলো পদ্মার ইঞ্জিনরুম, হতাহতের সংখ্যাও কম ছিল না। শহীদ হোন বীরবিক্রম মহিবুল্লাহ।
গোলা বর্ষণের পর আবার ফিরে এলো বিমানগুলো। তখন অবধি কোনোরকমে রক্ষা পেলো গানবোট ‘পলাশ’ ও ‘পাভেল’। সবাই যখন ঘটনার আকস্মিকতায় হতবিহব্বল তখনই হঠাৎ করে ক্যাপ্টেন রায় চৌধুরীর জাহাজ ত্যাগের নির্দেশে যারপরনাই ক্ষুব্ধ হলেন ইঞ্জিন আর্টিফিসার রুহুল আমিন। কোনোভাবেই তিনি জাহাজ ছেড়ে যাবেন না। তাঁর লক্ষ্য কোনক্রমে গানবোটকে বাঁচানো কারণ তখন বাংলাদেশ নৌবাহিনীর পদযাত্রা মাত্র শুরু আর এসময়ে গানবোট ধ্বংস হওয়া মানে অনেক বড় অপূরণীয় ক্ষতি।
বাংলার দামাল ছেলের অনুরোধ ছিল তাঁর সহযোদ্ধাদের কাছে,
“গানবোটটি বাঁচানো না গেলে বাংলাদেশ নৌবাহিনীকেও রক্ষা করা যাবে না, তা অংকুরেই বিনষ্ট হয়ে যাবে।”
রুহুল আমিনের বিমান লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ার আদেশ অমান্য করে কেউই আর গুলি ছোঁড়ে নিই। পশ্চাৎপদ হওয়ার আগে ক্রুদের অনুরোধ সত্ত্বেও তিনি থেকে গেলেন। অন্যান্যরা জাহাজ ছেড়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন নদীতে।
এরইমধ্যে আবারও বিমানবাহিনীর ছোঁড়া গোলা এসে পড়ে সরাসরি ‘পলাশ’ এর ইঞ্জিনরুমে। তখন ইঞ্জিনরুমে থেকে জাহাজটিকে বাঁচানোর জন্যে আগুন নেভাবার এবং জাহাজটীকে সচল রাখার আপ্রাণ চেষ্টায় ছিলেন বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন। মিত্রবাহিনীর ছোঁড়া গোলা এসে ইঞ্জিনরুমের উপর পড়ে ইঞ্জিন সম্পূর্ণ বিকল করে দেয় এবং ফলশ্রুতিতে আগুন ধরে যায় এবং দূর্ভাগ্যবশত আর্টিফিসার রুহুল আমিনের ডান হাত সম্পূর্ণ উড়ে যায়। ধ্বংসাবশেষ নিয়ে তলিয়ে যায় ‘পলাশ’। রুহুল আমিন আহতাবস্থায় ঝাঁপিয়ে পড়েন নদীতে এবং অদম্য মনোবল নিয়ে সাতরিয়ে নদী পার হয়ে যখন কূলে উঠে তখন অপেক্ষারত স্বাধীনতাবিরোধী ঘৃণ্য শত্রু রাজাকারেরা তাঁকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। তাঁর পবিত্র আত্মা দেহত্যাগ করে এবং দেশ জননী পায় তাঁর অসীম সাহসী সন্তানকে যিনি মৃত্যুর আগপর্যন্ত ভেবেছিলেন দেশের কাঠামো দৃঢ় রাখতে।
বাংলার এই বীর সন্তান জন্মেছিলেন ১৯৩৪ (মতান্তরে ১৯৩৫) এর জুন মাসে নোয়াখালী জেলার সাবেক বেগমগঞ্জ থানার সোনাইমুড়ী উপজেলার বাগপাদুরা যা বর্তমানে তাঁরই নামে রুপান্তরিত হয়ে আমিননগর নামে পরিচিত। পিতার নাম মোঃ আজহার পাটোয়ারী এবং মায়ের নাম মোছাম্মৎ জুলেখা খাতুন। ছয়জন ভাইবোনের মধ্যে তিনিই ছিলেন সবার বড়।
পড়ালেখার পাটখড়ি হয় নিজ গ্রামের বাঘচাপড়া প্রাইমারী স্কুলে। হাই স্কুলের পাঠ চুকান পার্শ্ববর্তী থানার আমিষাপাড়া হাইস্কুলে। সমুদ্রের প্রতি ভীষণ টান ছিলো বলে বেছে নিয়েছিলেন নৌবাহিনীর চাকরি। এসএসসি পাশ করে ১৯৫৩ সালে জুনিয়র মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে পাকিস্তানী নৌ-বাহিনীতে যোগ দেন।
মোহাম্মদ রুহুল আমিন পাকিস্তান নৌ-বাহিনীতে যোগ দেয়ার পর প্রাথমিক প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্য পাড়ি জমান করাচির নিকটবর্তী আরব সাগরে মধ্যে অবস্থিত মানোরা দ্বীপে পাকিস্তান নেভাল জাহাজ (পি.এন.এস) বাহাদুরে। প্রাথমিক প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর সেখান থেকে পি.এন.এস. কারসাজ অর্থাৎ নৌবাহিনীর কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যোগদান করেন। পরবর্তীতে পি.এন.এস বাবর, পি.এন.এস খাইবার, পি.এন.এস তুঘরিলে দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৮ সালে পেশাগত প্রশিক্ষণ শেষ করেন। ১৯৬৫ সালে মেকানিসিয়ান কোর্সের জন্য নির্বাচিত হন। পি.এন.এস. কারসাজে কোর্স সমাপ্ত করার পর আর্টিফিসার পদে নিযুক্ত হন। ১৯৬৮ সালে চট্টগ্রাম পি.এন.এস. বখতিয়ার নৌ-ঘাটিঁতে বদলি হয়ে যান।
রুহুল আমিনের দুই ছেলে এবং তিন মেয়ের মধ্যে বড় ছেলে মোঃ বাহার মারা যান প্রায় ১৪ বছর আগেই। রুহুল আমিন শহীদ হওয়ার সময় ছোট ছেলে শওকতের বয়স ছিল মাত্র দুই বছর। বর্তমানে নিউজপেপার ঘাটলেই দেখতে পাই বীরশ্রেষ্ঠের ছোট সন্তানের আহাজারি, দুমুঠো খেতে না পারার আক্ষেপ নিয়ে বেঁচে আছেন তাঁর বাবার ভিটের উপর। কখনো করাত কলে গাছ টেনে বা চায়ের দোকানের পানি টেনে জীবিকা নির্বাহ করছেন। এলাকাবাসীর সহায়তায় কোনোরকমে বেঁচে আছে তাঁরা। শওকতের স্ত্রী রাবেয়া আক্তারের মুখে ফুটে উঠে সেই আক্ষেপ অনেকটা এইভাবে,
‘এ ঈদেও নিজেরা কোরবান দিতে পারিনি। পাড়ার লোকজন যখন দুই-তিন টুকরা গোশত হাতে করে দিয়ে যান তখন কষ্টে বুক ফেটে যায়।’
আবার শওকত নিজেই বলেন,
‘বাবা বীরদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হয়েছেন—সেই গর্বে সব দুঃখ, কষ্ট ভুলে থাকি।’
আক্ষেপের আরেকটা বড় কারণ শওকতের কান্নাজড়িত কন্ঠে ফুটে উঠে কারণ অর্থকষ্টের কারণে মংলা বন্দরে গিয়ে বাবার সমাধিটিও দেখার সৌভাগ্য হয়নি তাঁদের।
সবশেষে এটুকুই পাওয়া, বাড়ির সম্মুখে বীরশ্রেষ্ঠর পরিবারের দেয়া ২০ শতাংশ জমিতেই স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে নোয়াখালী জেলা পরিষদ ৬২ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করছে রুহুল আমিন স্মৃতি জাদুঘর ও গ্রন্থাগার। এছাড়াও বাংলাদেশ নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ বিএনএস রুহুল আমিনের নামকরণও তার নামে করা হয়েছে।
রূপসার পাড়ে তাঁর মৃতদেহ পড়ে ছিলো কিছুদিন। এরপর স্থানীয় গ্রামবাসী তার মৃতদেহ উদ্ধার করে এবং রূপসা নদীর তীরে বাগমারা গ্রামে তাকে দাফন করা হয়। সেখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভও নির্মিত হয়েছে।
বাংলাদেশের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে বীরশ্রেষ্ঠদের নাম, লেখা থাকবে সূর্যসন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের নাম যারা কোন বাচবিচার ছাড়াই বিলিয়ে দিয়েছিলেন নিজেদের প্রাণ। তাঁদের সবারই আশা ছিলো একটা সূর্য উঠবে যেথায় লেখা থাকবে একটা স্বাধীন দেশের নাম, যার নাম হলো, ‘ বাংলাদেশ’।
Source: http://en.banglapedia.org/index.php?title=Amin,_Birsrestha_Mohammad_Ruhul
http://bangladeshcontinual.blogspot.com/2011/07/bir-sreshtho-mohammad-ruhul-amin.html
https://en.wikipedia.org/wiki/Mohammad_Ruhul_Amin
buy terbinafine sale – how to get griseofulvin without a prescription griseofulvin canada
rybelsus 14 mg over the counter – buy generic DDAVP desmopressin over the counter