ইতিহাসের সর্ববৃহৎ গণহত্যাগুলো ঘটেছিলো ২য় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের নাৎসি বাহিনীর হাতে। জার্মানিদের তথাকথিত অহংকারের কারণে সৃষ্ট ইহুদিদের প্রতি ঘৃণা থেকে উৎসারিত এই গণহত্যার শিকার হয়েছিলো প্রায় ৬০ লক্ষ ইহুদি। ইহুদিরা যখন রক্তপিপাসু জার্মান নাৎসি বাহিনীর শিকার, তখন এক হাজার দুই’শ মানুষের জন্য স্বর্গীয় দূত হয়ে এসেছিলেন অস্কার শিন্ডলার।
১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বর। জার্মান বাহিনীর কাছে মাত্র দুই সপ্তাহের যুদ্ধে পোলিশ বাহিনী পরাজিত। জার্মান বাহিনীর দখলে চলে যায় পোল্যান্ড। নাৎসি বাহিনীর নির্দেশে সারা দেশ থেকে দলে দলে ইহুদিরা জড়ো হতে থাকে ‘ক্র্যাকো’ শরণার্থী শিবিরে।
অস্কার শিন্ডলার তখন নাৎসি জার্মানির গোয়েন্দা সংস্থা ‘আপভেয়া’ এর গোয়েন্দা হিসেবে সামরিক দপ্তর, রেলওয়ে, সামরিক অভিযান ইত্যাদির তথ্য জোগাড় করতেন। ১৯৩৯ সালে নাৎসি বাহিনীতে যোগ দেন অস্কার শিন্ডলার।

Source: Wikipedia
পোল্যান্ডের ক্র্যাকো শহরে এসেছিলেন দাপ্তরিক ও ব্যবসায়িক কাজে। তখন শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। নাৎসি বাহিনীর সদস্য হিসেবে ইহুদিদের জন্য তৈরি ক্যাম্পে যেতে পারতেন তিনি। সেখানে তার সাথে পরিচয় হয় ইটঝ্যাক স্টার্নের সাথে। ইটঝ্যাক স্টার্ন ‘ক্র্যাকো’ শহরের এক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের একাউন্টেন্ট ছিলেন। শিন্ডলার তার সাথে আলোচনা করে ক্র্যাকো শহরেরই এক পরিত্যক্ত কারখানা অল্প দামে কিনে নেন। নতুন কারখানার নাম দেন Deutsche Emaillewaren-Fabrik। গোপনে তিনি যোগাযোগ করতে থাকেন ইহুদী ব্যবসায়ীদের সাথে। মূল লক্ষ্য তাদের কাছে থেকে মূলধন সংগ্রহ করে ব্যবসার সূচনা করা। তাকে সাহায্য করেন ইটঝ্যাক স্টার্ন।
শুরু হয় তাদের ব্যবসা। আপভেয়ায় কাজ করার সুবাদে নাৎসি বাহিনীর সামরিক অফিসারদের সাথে ভালো পরিচয় ছিলো তার। তাদের সাথে আলোচনা করে, অনেক ক্ষেত্রে বিশাল পরিমাণ ঘুষ দিয়ে সামরিক অফিসারদের জন্য থালা-বাসন-হাঁড়ি ইত্যাদি ক্রোকারিজ পণ্য তৈরির কাজ নেন। অফিসারদের ঘুষ দিয়ে শরণার্থী শিবির থেকে শ্রমিক নেয়ার কথা জানান তিনি। এর জন্য তাকে অনেক অফিসারকে ঘুষ দিতে হয়েছিলো। তাদের অনুমতিক্রমে শ্রমিক হিসাবে যোগ দিতে থাকে শরণার্থীর বাসিন্দারা। স্টার্ন শরণার্থীদের মাঝে থেকে সংগ্রহ করতে থাকেন শ্রমিক।

একসময় ক্র্যাকো শহরে নাৎসি বাহিনীর সেনা অফিসার হিসেবে যোগ দেন অ্যামন গোথের। ইহুদিদের উপর অত্যাচারে একজন কুখ্যাত ভয়ঙ্কর অফিসার। ইহুদি হত্যা করে সে এক ধরণের দানবীয় আনন্দ অনুভব করত। নির্বিচারে হত্যায় মেতে ওঠে। এদিকে শিন্ডলারের শ্রমিকদের অনেকেই মরতে থাকে গোথের হাতে।
একজন জার্মান হয়েও এই হত্যাযজ্ঞ তার কাছে চরম অবিচার মনে হয়। সে গোথের সাথে বন্ধুত্বের শুরু করে তার শ্রমিকদের রক্ষা করতে। গোথ ঘুষের বিনিময়ে রাজি হয়়।
কিছুদিন পর পর নাৎসি বাহিনীর ট্রেন আসে ক্রাকো-তে, প্রয়োজনীয় শ্রমিক ব্যতীত বাকিদের নিয়ে যাওয়া হয় এক্সটার্মিনেশন ক্যাম্পে। সেখানে নিয়ে পৈশাচিক সব কায়দায় খুন করা হত তাদের। ত্রিশ লক্ষ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল গোসল করানোর নাম করে গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে। শিন্ডলারের মনে গভীর ছাপ ফেলে যায় এইসব ঘটনা।

“আমার সমবয়সী সঙ্গী সবাইকে ট্রেনে করে নিয়ে যায় এক্সটার্মিনেশন ক্যাম্পে। আমি শিন্ডলারের কারখানায় ছিলাম বলে বেচে গিয়েছিলাম।”- বলেছিলেন মি. লিয়ন লেসন। যিনি সবচেয়ে কম বয়সী শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। তিনি ৭০বছর বয়সে এসে The boy in the wooden box নামে একটি বই লিখেন, যা তার মৃত্যুর পর ২০১৩সালে প্রকাশ পায়। যাতে তিনি সেই সময়ের হলোকাস্টের সময়ে শিল্ডলার নিজের জীবন তুচ্ছ করে ইহুদিদের রক্ষা করার জন্য যে আত্মত্যাগ, শ্রম, অর্থব্যয় করেন তা বিস্তারিত তুলে ধরেন।
শিন্ডলার প্রথমে ব্যবসা শুরু করেছিলেন তার আর্থিক প্রয়োজনে, আর ইহুদিদের কাজে নিয়েছিলেন তারা পোলিশদের থেকে সস্তা শ্রমিক বলে। কিন্তু পরবর্তীতে ইহুদিদের নিয়ে তার মনোভাব পাল্টাতে থাকে।

“যুদ্ধের শেষ দু’বছরে তাঁর মধ্যে এক নাটকীয় পরিবর্তন লক্ষ করা যায়, এবং তিনি নাৎসি জার্মানদের ছেড়ে বিভিন্ন ভাবে ইহুদিদের সহায়তা করতে শুরু করেন” -ডেভিড মি.ক্রো (লেখক, অস্কার শিন্ডলারঃ দ্যা আনটোল্ড স্টোরি) ।
কিছুদিন পরপর ক্র্যাকো শরণার্থী শিবির থেকে ট্রেনে করে অকেজো শ্রমিকদের নিয়ে যাওয়া হয় এক্সটার্মিনেশান ক্যাম্পে। শিন্ডলার এই মানুষগুলোকে রক্ষায় এক কৌশল বের করেন। সে তার শ্রমিকদের নিয়ে নিজ শহরে চলে যেতে চায়। কিন্তু গোথ তাতে রাজি নয়। অবশেষে প্রচুর টাকার বিনিময়ে গোথ রাজি হয়। শুরু হয় শিন্ডলারের লিস্ট তৈরি। কয়েকশ শ্রমিককে নিয়ে দু’টি ট্রেনে সে রওনা হয়। কিন্তু একটি ট্রেন ভুলে চলে যায় আস্টুইটজ কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প-এ, যেখানেও গ্যাস চেম্বারে মানুষ হত্যা করা হত। শিন্ডালার ছুটে যায় সেখানে, অফিসারদের প্রচুর টাকার বিনিময়ে ফিরিয়ে নিয়ে আসে তাদের।
মানুষ বাঁচানোর অদ্ভুত এক নেশা তাকে পেয়ে বসে। নিজের প্রায় সব অর্থ শুধু সে মানুষকে রক্ষার জন্য খরচ করতে থাকে।
শিন্ডলারের স্ত্রী এমিলি সবকিছুতে শিন্ডলারকে সহায়তা করেন। এসএস বাহিনী যে রেশন দিতো তা ছিলো খুব সামান্য। তখন কারখানার সকল শ্রমিকের জন্য খাবার জোগাড় অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ছিলো। এমিলি লুকিয়ে শ্রমিকদের জন্য রেশনের খাবার নিয়ে আসতেন। কারখানার ভেতরে অস্থায়ী হাসপাতাল তৈরি করেছিলেন এমিলি। অপরদিকে শিন্ডলার সামরিক অফিসারদের নিয়মিত ঘুষ দিয়ে যাচ্ছেন, যাতে তারা তার কারখানার শ্রমিকদের যেন কারখানা থেকে না নিয়ে যায়।

কারখানা ভেতরে প্রায় ১৭০০ শ্রমিক, যার ১২০০ ইহুদি। সবাই প্রতিনিয়ত আতংকের মধ্যে দিন গুনছে যুদ্ধ শেষ হওয়ার অপেক্ষায়। ১৯৪৫ এর ৭ মে রেডিওতে শুনলেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের ঘোষণা, জার্মানি আত্মসমর্পণ করেছে। যুদ্ধ শেষ হয়, কিন্তু তার উপলব্ধি হয় আরো অনেক মানুষকে হয়তো সে রক্ষা করতে পারতো।
কিন্তু তখনই শিন্ডলার তার নিজের জীবন নিয়ে শঙ্কায় পড়েন। নাৎসি অফিসাররা তাকে হুমকি দিতে থাকেন। তিনি তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যেতে চাইলেও যেতে পারেন নি, কারণ তিনি নাৎসি বাহিনীর একজন সদস্য ছিলেন। পরবর্তীতে শিন্ডলার তার স্ত্রী এমিলি কে নিয়ে আর্জেন্টিনায় গমন করেন।
আর্জেন্টিনায় কিছুদিন চললেও একসময় আর্থিক সংকটে পড়ে গিয়ে তার ব্যবসা ১৯৫৮ সালে একদম বন্ধ হয়ে যায়। জার্মানি ফিরতে চাইলেও ব্যর্থ হন। পরে তিনি পোল্যান্ডের সেসব ইহুদিদের সাহায্য নেন, যাদের তিনি রক্ষা করেন ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময়। তাদের আর্থিক সহায়তায় শিন্ডলারের বাকি জীবন অতিবাহিত হয়।
১৯৬৩ সালে ইসরাইল সরকার হলোকাস্টের সময় ইহুদিদের রক্ষার জন্য তাকে Righteous Among the Nations এ সম্মানিত করেন।

২য় বিশ্বযুদ্ধের এ মহৎপ্রাণ ৯ অক্টোবর ১৯৭৪ সালে ৬৬ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। জীবদ্দশায় তিনি জেরুজালেমে সমাহিত হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করে বলেন, “My children are here (Jerusalem)।” তাই তাকে জেরুজালেমে সমাহিত করা হয়।
তার সমাধিতে আজো সেই সমস্ত মানুষেরা দল বেঁধে আসেন শ্রদ্ধা জানাতে যাদের তিনি বাঁচিয়েছিলেন।

নোবেল বিজয়ী অস্ট্রেলিয়ান সাহিত্যিক থমাস কেনিয়েলি ‘শিন্ডলার্স আর্ক’ নামে একটি বই লেখেন। এ বই অনুসারে স্টিভেন স্পিলবার্গ ‘শিন্ডলারস লিস্ট’ নামে ১৯৯৩ সালে একটি চলচ্চিত্র তৈরি করেন। অস্কার শিন্ডলারের জীবনী নিয়ে আরো অনেক বই লেখা হয়েছে।
[…] [১] [২] [৩] […]