বর্তমান কালে অভিজাত কিছু কোচের নাম বললে সাম্পোলি তাদের মধ্যে থাকবে। সাম্পোলির বড় গুণ হল তার ট্যাকটিক্যাল ভার্সেটালাইটি। সেভিয়ার কোচ থাকার সময় তার হাই প্রেসিং খুবই প্রশংসা কুড়িয়েছিল। সেভিয়া এতটা প্রেস করত যে রামোস ম্যাচ শেষে সাম্পোলি কে কনগ্রেটচুলেশন পর্যন্ত জানিয়েছিল। সেই সাম্পোলিকে দিয়েই চিলি জিতে নিয়েছিল ‘১৫ এর কোপা।

‘১৬ তে কোপাতে হেরে যখন আর্জেন্টিনা অবস্থা হতাশাজনক তখন দায়িত্ব আসে সাম্পোলি। খুব সম্ভবত ভুল না করলে সাম্পোলির হাতে ম্যাচ ছিল ৩ কি ৪টা । আর সব ম্যাচেই ছিল তার জন্য “হয় বাঁচ না হয় মর”। আর এই রকম অবস্থায় দল নিয়ে কোন রকম পরিকল্পনা করা প্রায় অসম্ভব। তবে সব শেষে মেসির হাত ধরে আর্জেন্টিনা জায়গা পায় রাশিয়া বিশ্বকাপে।
সন্দেহ নেই, ‘১৮ বিশ্বকাপেও সাম্পোলির মূল অস্ত্র হতে যাচ্ছে মেসি। কারণটা পরে ব্যাখ্যা করছি।
আমরা প্রথমে দেখে আসার চেষ্টা করি, আধুনিক ফুটবলে আক্রমণটা কিভাবে হয়। খেয়াল করলে দেখা যাবে প্রতিটা বড় দলই চেষ্টা করে মাঠ বড় করে খেলতে যত বড় মাঠ তত বেশি আক্রমণের সুযোগ। আর মাঠ বড় করতে সাহায্য করে ফুলব্যাক উইংব্যাকরা। ব্রাজিলের মার্সেলো, দানিলো। স্পেনের আলবা, কার্ভাহাল। জার্মানীর কিমিচ, হেক্টর অথবা রিউস(ওয়াইড উইংগার)।তারমানে দেখা যাচ্ছে, সব দলেই চেষ্টা করছে তাদের ফুলব্যাক থেকে বেস্ট আউটপুটটা নিয়ে আসতে।
এইবার ফিরে আসি, আবার আর্জেন্টিনা স্কোয়াডে। আর্জেন্টিনার স্কোয়াডে ফুলব্যাক হচ্ছে রোহো আর টালিফিকো। কিন্তু এই ২ জনের কেউ ওয়াইড এরিয়া এক্সপ্লয়েট করতে সিদ্ধহস্ত নয়। আবার দলে অন্যতম আরেক সমস্যা হল দুই উইংগার মারিয়া, সালভিও দুইজনেই কাট ইনসাইড করে ঢুকতে পছন্দ করে। মোট কথা হল, আর্জেন্টিনা ফরওয়ার্ড লাইনের সবাই সেন্টার রোল পছন্দ করে। দিবালা নাম্বার ১০ হিসেবে খেলতে পছন্দ করে, লে সেলসো নাম্বার ১০, আবার আগুয়ারো, হিগুয়েন সবাই ডিপে নেমে এসে নাম্বার ১০ পজিশনে চলে আসে। আর এইজন্য দেখা যায়, আর্জেন্টিনার আক্রমণে ধার কমে যায়। সব প্লেয়ার সেন্টারে এসে ওভারলোড করে ফেলে। যদি তাদের এই সময় দুইজন এটাকিং মাইন্ডেড ফুলব্যাক থাকত তারা খুব সহজে উইংগার দের ওভারল্যাপ করে স্পেসের সদব্যবহার করতে পারত।
উপরে ছবিতে দেখুন কত বড় স্পেস পরে আছে দুই উইং কিন্তু এইটা এক্সপ্লয়েট করার মত কোন প্লেয়ার নেই আর্জেন্টিনা দলে। প্রতিপক্ষের জন্য খুবই প্রত্যাশিত আক্রমণ। কোনভাবে ডিফেন্স লাইনে নিউম্যারিক্যাল সুপিরিওটি অর্জন করা সম্ভব হয় নি।
আর এইজন্য মাঝে মাঝে স্টাইকার আগুয়ারো কিংবা হিগুয়েন নিচে নেমে এসে ওয়াইড এরিয়া কভার দেয়। অথবা দুই মিড উপরে উঠে এসে ওয়াইড এরিয়া কভার দে। এতে আবার যে ঝামেলা হয় সেন্ট্রালে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে দল। মোটামুটি ৫ জন ম্যান ফরওয়ার্ড করেই সাম্পোলি কাজ আদায় করে নিতে চাচ্ছে মেসিকে খেলিয়ে। মেসি একাই ২-৩ জনকে সহজে ড্রিবল করতে সক্ষম তাই প্রতিপক্ষের ডিফেন্স লাইনে ১ বনাম ১ সিচুয়েশন সৃষ্টি না করেও মেসিকে দিয়ে সহজে ম্যাচ বের করে আনা যায়। আর ৫ জন আক্রমনের জন্য সাম্পোলি দুই ভাবে এইটি সৃষ্টি করতে পারে
১। স্টাইকার নেমে এসে ওয়াইড এরিয়া কভার দিবে
২। দুইটা মিড ওয়াইড এরিয়া কন্ট্রোল নিবে।
এবং দুই ক্ষেত্রেই সাম্পোলির মূল অস্ত্র মেসি। যেভাবেই হোক মেসি কে ফ্রী করে তাকে বল দাও।আর এইজন্য মেসি বাদে স্কোয়াডে তেমন কোন ভাল স্কোরার নেই। সবাই ক্লাবে ভাল খেললেও সিস্টেমজনিত কারনে দলে আর ভাল খেলতে পারে না। এই হল আক্রমণভাগে আর্জেন্টিনার অবস্থা।
এইবার একটু দেখে আসা যাক, সাম্পোলির হাই প্রেস আর কাউন্টার প্রেস নিয়ে । সাম্পোলি বিয়েসলার ম্যান ওরিয়েন্ডেড হাই প্রেস করতে পছন্দ করে পিচের হাই আপে। সাম্পোলির লক্ষ্য থাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বল উইন করা। এর একটা কারণ হচ্ছে তাদের ডিফেন্সিভ অরগানাইজেশনের সমস্যা।তাই সাম্পোলি চেষ্টা করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এবং প্রতিপক্ষের অর্ধে যেভাবে হোক বলটা উইন করা। সাম্পলি পজেশনাল ফুটবল খেলতে পছন্দ করে চেষ্টা করে যতটা সম্ভব পুরো মাঠে ট্রায়াঙ্গল সৃষ্টি করে বল পজেশন ধরে রাখতে। আর বল হারিয়ে ফেললে সাথে সাথে কাউণ্টার প্রেস। মোট কথা সাম্পোলি প্রতিপক্ষকে মাঠে একটু ও ছাড় দিতে ইচ্ছুক নই। তবে এইখানে ঝামেলাটা হল, আর্জেন্টিনা প্লেয়ারদের ফিটনেস ইস্যু(মেসি বাদে)। এরা বেশিক্ষণ স্টামিনা ধরে রাখতে পারে না। আর আমরা জানি, হাই প্রেস, কাউন্টার প্রেস দুইটাতেই আপনার প্রচুর স্টামিনা নষ্ট হয়। দেখার বিষয়, বিশ্বকাপে এই স্টামিনার ব্যাপারটি সাম্পোলি কিভাবে সামাল দে।
এইবার চলুন দেখে আসি, আর্জেন্টিনা ডিফেন্সিভ স্টাকচার কেমন। সাম্পোলি এখন পর্যন্ত অনেকগুলো ফরমেশনে খেলিয়েছ দলকে। ৪-৩-৩, ৪-৪-২,৩-৩-৩-১, ৪-২-৩-১ ,৩-৩-১-২। অন্যদগুলো ফরমেশন পরিবর্তন করে তাদের ট্যাক্টিক্যাল ভার্সেটেলাইটির জন্য। কিন্তু সাম্পোলির ফরমেশন পরিবর্তনের কারণ হল সব থেকে উত্তম ফরমেশন খুজে বের করা। ৩-৩-১-৩ কিংবা ৩-৩-৩-১ খুব সুন্দর ট্রায়াঙ্গল সৃষ্টি করলেও কোনটাই কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়নি।
এর কারণ হল, হাই প্রেসকৃত দলের বিপক্ষে তাদের রক্ষণভাগ খুবই দূর্বল। ওটামেন্ডি, রোহো কিংবা ফাজিও কেউ কিন্তু হাই প্রেসে সঠিকভাবে পাস দিতে পারে না। খুব তাড়াতাড়ি নার্ভাস হয়ে পড়ে। আর এই সব কিছু ভেবেই সাম্পোলি ঠিক করেছে সে ডিফেন্স নিয়ে চিন্তাই করবে না। উওর খুঁজে নিবে WM ফরমেশনে। ২-৩-৩-২
এখন এই ফরমেশনে যা হবে মাঝে একজন ডিপ লাইয়িং প্লেমেকার থাকবে । সেইটা হবে বানেগা। আর তার সামনে শাটার হিসেবে থাকবে সম্ভবত লো সিও আর মারিয়া। একচুয়েলি আর্জেন্টিনা পুরো দলটাই এতটা আনপ্রেডিক্টবল যে বয়াল সম্ভব হচ্ছে না কে বা কারা মেইন একাদশে থাকবে। যেইটা অবশ্য সাম্পোলির জন্য একটা প্লাস পয়েন্ট। সাম্পোলির মূল লক্ষ্য মেসিকে ফ্রী করা। আগের কোচ কিংবা বার্সাতে মেসি সেকেন্ড স্টাইকার হিসেবে খেলে। তবে সাম্পোলির WM সিস্টেমে অনেকটা মেইন স্টাইকার হিসেবেই খেলবে মেসি। এর আগ পর্যন্ত কখনো কেউ মেসিকে দিয়ে এই রিস্ক নিতে চায়নি। কারণ এতে তার উপর অতিরিক্ত প্রেশার পড়ে। তাকে নিচ থেকে শুধু খেলাটাই বিল্ড করতে হবে না উলটো বিল্ড করে খেল্টা শেষও করে আসতে হবে । সন্দেহ নেই যে, এই ফরমেশনে মেসি অনেক ফ্রী স্পেসে খেলতে পারবে।
তারপরেও কথা হল এতটুকু স্পেস কি সে কভার দিতে পারবে? তাছাড়া প্রতিপক্ষের কাছেও খুবই প্রেডিক্টবল হয়ে যাচ্ছে ব্যাপারটা।
সাম্পোলি WM সিস্টেম আক্রমণভাগে ধার কমে গেলেও রক্ষনভাগে অনেক সাহায্য করবে। বর্তমানে আগেই বলেছি সবাই ফুলব্যাকদের দিয়ে আক্রমণ করতে পছন্দ করে। এই ফরমেশনে খুব সহজে ওয়াইড ম্যান কে মার্ক করে রাখা যায়। আর এই ফরমেশনের সুবিধে হল, এইটাকে ভেঙ্গে অনেক ফরমেশন করা যায়। তাই ম্যাচে সাম্পোলি পিচে কোথাও সমস্যা দেখলে খুব দ্রুত ফরেমশন পরিবর্তন করতে পারবে।
এইছাড়া আর্জেন্টিনা চাইলে ক্রস ট্যাকটিস ব্যবহার করতে পারে। ওতামেন্ডি হেডিং একুরেসি খুবই ভাল। তবে এই দলে অন্যান্য দলের তুলনায় লং রেঞ্জ শুটার অনেক কম। আর সব থেকে বড় সমস্যা তাদের প্রীক্ষিত কোন ভাল গোলকিপার নেই।
সবেশেয়ে বলা যায়, সাম্পোলি এই বিশ্বকাপকে মূলত পরীক্ষা নীরিক্ষার জন্য ব্যবহার করবে। আমার ব্যক্তিগত ধারনা হল, সাম্পোলি প্রতি গ্রুপ ম্যাচেই তার ফরমেশন পরিবর্তন করবে। সে যতটা সম্ভব চেষ্টা করবে মেসি কে দিয়ে যাতে ম্যাচ বের করে আনা যায়। আর আর্জেন্টিনার কথা বলতে গেলে । থিউরীটিক্যালি তার ফরমেশন স্টাকচারের তেমন সমস্যা নেই। WM এ মেসি অবশ্যি অনেক সুযোগ পাবে। তবে সব কিছু নির্ভর করছে প্লেয়ারদের রেস্পন্সের উপর। আর বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার ভবিষ্যত বলতে গেলে বড় কিছু ও হতে পারে আবার বিশাল একটা ব্লান্ডার ও করতে পারে। কারণ থিউরীটা ‘৫০ এ হাঙ্গেরী পজেশনাল উথানের পর আর কখনো ব্যবহৃত হয়নি।