ব্যবিলনের শূন্য উদ্যান: রাণীর জন্য রাজার উপহার

1

প্রাচীন পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্যের একটি অনন্য নিদর্শন ব্যবিলনের শূন্য উদ্যান।  এটি ব্যবিলনের ঝুলন্ত বাগান নামেও পরিচিত।  হেলেনীয় সভ্যতার এই স্থাপনাটির সৌন্দর্য আর মোহনীয়তা যে কারোর মনে রোমান্টিকতা জাগিয়ে তুলতে সক্ষম ছিলো। আকাশ থেকে নেমে আসা সারি সারি সবুজের স্নিগ্ধতা আর বাহারি ফুলের সৌরভ মনোমুগ্ধকর দৃশ্যের অবতারণা করতো তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।  সৌন্দর্য আর আশ্চর্য নির্মাণ শৈলীর গুণে ব্যবিলনের শূন্য উদ্যান স্থান করে নেয় পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্যের তালিকায়। তবে, বর্তমানে এই উদ্যানের অস্তিত্বের বিষয়টি প্রশ্নের সম্মুখীন। ব্যবিলনের ইতিহাসে এর উল্লেখ না থাকার কারণে অনেকের সন্দেহ রয়েছে যে আদৌ এর কোনো অস্তিত্ব বাস্তবে ছিলো কিনা। কারো কারো মতে এটা শুধু নিছক কবি মনের কল্পনা বা ইতিহাস, পুরাণের অংশ। তবে যাই হোক, আশ্চর্য এই স্থাপনার বিষয়ে জানার প্রতি কারো আগ্রহ তাতে কমে যায়নি। তাই চলুন আমরা জেনে নিই ঝুলন্ত বাগানের আদ্যোপান্ত–

শিল্পীর তুলিতে ব্যবিলনের শূন্য উদ্যান
শিল্পীর তুলিতে ব্যবিলন এর শূন্য উদ্যান Image source: livescience.com

ব্যবিলনের শূন্য উদ্যান কোথায় অবস্থিত  

ব্যবিলনের শূন্য উদ্যানটি প্রাচীন ব্যবিলন নামক নগর রাষ্ট্রে অবস্থিত ছিলো যার বর্তমান অবস্থান ইরাকের ব্যবিলন প্রদেশের হিল্লাহ এর নিকট। তবে কিছু প্রত্নতত্ত্ববিদের মতে উদ্যানটির অবস্থান ব্যবিলনে নয় বরং ব্যবিলন থেকে ৩৫০ কিলোমিটার দূরে নিনেভেহ নামক নগরীতে ছিলো। কোনো ধ্বংসাবশেষ না থাকায় এবং ইতিহাসের কোথাও উল্লেখ না থাকায় প্রত্নতাত্ত্বিক ভাবে এর নির্দিষ্ট কোনো স্থান নির্ধারণ করা যায়নি।  তাই ব্যবিলনের শূন্য উদ্যানের অস্তিত্ব নিয়ে তিনটি মতবাদ প্রচলিত রয়েছে। এক-এর অস্তিত্বের বিষয়টি সম্পূর্ণ পৌরাণিক।  দুই- এই যে বাগান টি ব্যবিলনেই ছিলো কিন্তু প্রথম শতাব্দীর আশে পাশে কোনো এক সময়ে এটি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। তিন- এই বাগানটি আসলে অ্যাসিরীয় সম্রাট সহ্নেরিব এর দ্বারা নির্মিত সুসজ্জিত একটি বাগান কে বোঝায় যা সে টাইগ্রিস নদীর তীরে তার রাজধানী শহর নিনেভেহ তে তৈরি করেছিলো।  তবে প্রত্নতাত্ত্বিক ভাবে ব্যবিলনের শূন্য উদ্যানের কোনো নিদর্শন না থাকলেও প্রাচীন গ্রীক ও রোমান লেখকদের বর্ণনায় এর উল্লেখ পাওয়া যায়।

রাজা নেবুচাঁদনেজার এর প্রাসাদ
রাজা নেবুচাঁদনেজার এর প্রাসাদ Image source: pinterest

ব্যবিলনের শূন্য উদ্যান কে গড়ে তুলেন

প্রাচীন লেখনীতে প্রথম ব্যবিলনের শূন্য উদ্যান এর উল্লেখ পাওয়া যায় বেরোসাস নামক একজন ধর্ম যাজকের লেখায়। খ্রিষ্টপূর্ব ২৮০ অব্দে লিখিত তার “ব্যবিলনিকা” নামক বইয়ে তিনি এই বাগানের কথা উল্লেখ করেন। তথ্যমতে, খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০ অব্দে রাজা নেবুচাঁদনেজার তার স্ত্রী আমিতিস এর জন্য উদ্যানটি নির্মাণ করেন। কিংবদন্তি অনুসারে, আমিতিস ছিলো মিডিয়া নগরীর মেয়ে। রাজনৈতিক কারণে নেবুচাঁদনেজারের সাথে তার বিয়ে হয় যা ঐ সময়ের একটি স্বাভাবিক বিষয় ছিলো। পাহার আর সীমাহীন সবুজের কোলে বেড়ে উঠা আমিতিস প্রায়ই নিজ জন্মভূমির জন্য স্মৃতিকাতর হয়ে উঠত। শুষ্ক সমতল ব্যবিলনে আমিতিসের মন খারাপ থাকত প্রায়ই। তাই

তার আনন্দের জন্য ও তাকে সবুজে ঘেরা জন্মভূমির ছোঁয়া এনে দিতে রাজা এই উদ্যান টি নির্মাণ করেন।

ব্যবিলনের শূন্য উদ্যানের নির্মাণ শৈলী

শূন্য উদ্যান বা ঝুলন্ত উদ্যান নাম হলেও এটা কিন্তু শূন্যে ঝুলে থাকা কোনো বাগান না।  বাগানটি মূলত একটি কৃত্রিম পাহাড়ের উপর ধাপে ধাপে গাছ লাগিয়ে তৈরি করা হয়েছে। কৃত্রিম পাহারের বুকে অসংখ্য ধাপ তৈরি করে তা মাটি দিয়ে পূর্ণ করে তাতে গাছ লাগানো হয়।  মাটির তৈরি ইট রোদে শুকিয়ে বাগানের কাঠামো তৈরি করা হয়। তারপর তাতে মাটি ভরে গাছ রোপণের উপযোগী করা হয়।

ঝুলন্ত উদ্যানের ত্রিমাত্রিক চিত্র , ব্যবিলনের শূন্য উদ্যান
ঝুলন্ত উদ্যানের ত্রিমাত্রিক চিত্র Image source: pinterest

ডিওডোরাস সিকিউলাস নামক এক লেখকের বর্ণনা মতে, উদ্যানটি চতুর্ভুজ আকৃতির ছিলো যার প্রতিটি দিকের দৈর্ঘ্য ছিলো প্রায় ৪০০ ফুট।  বাগানটি সিঁড়ির মত ধাপে ধাপে তৈরি যার সর্বোচ্চ ধাপের উচ্চতা ছিলো প্রায় ৮০ ফুট । উদ্যানের ২২ ফুট পুরু দেয়াল তৈরি করা হয়েছিলো কাদামাটির ইট দিয়ে। প্রতিটি ধাপের তলদেশ যথেষ্ট গভীর ছিলো যাতে বড় বড় গাছ রোপণ করলেও তা শেখর ছড়াতে পারে। পার্শ্ববর্তী ইউফ্রেটিস নদী থেকে বাগানে পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়।

পাহাড়ি আমেজ আনতে রাজার নির্দেশে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে বিভিন্ন ধরনের গাছ-গাছড়া, লতা-গুল্ম, বিভিন্ন প্রজাতির বাহারি ফুল এনে বাগানটিকে সজ্জিত করা হয়।  সিঁড়ি বেয়ে পাহাড়ের মত বাগানটির চূড়ায় আরোহণ করা যেত। এছাড়া প্রতিটি ধাপ থেকে ঝুলে থাকে গাছের লতাপাতা দেখে নিচ থেকে মনে হতো যেন গাছ গুলো মাথার উপর শূন্যে ঝুলে আছে। এই কারণেই বাগানটির নাম হয়েছে ঝুলন্ত বা শূন্য উদ্যান।

মরুভূমির বুকে এই সবুজের আচ্ছাদনকে টিকিয়ে রাখতে সবচেয়ে বড় যে চ্যালেঞ্জ ছিলো সেটা হলো পানি। ব্যবিলনে খুব সামান্যই বৃষ্টি হতো। ফলে বাগানের গাছ গুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে নিকটবর্তী ইউফ্রেটিস নদী থেকে জল সেচনের ব্যবস্থা করা হয়। ওই সময় তেমন কোনো উন্নত প্রযুক্তি ছিলোনা। ফলে চেইন পাম্প দিয়ে নদী থেকে জল উত্তোলন করা হতো এবং তা বাগান পর্যন্ত নেয়া হতো। তারপর বাগানের চূড়ায় তা একটা পুল এ জমা করে রাখা হতো। পুল ভর্তি হলে তার গেইট খুলে দেয়া হতো যাতে করে জল গড়িয়ে ঝর্ণার মত ধীরে ধীরে নিচে নামে আর বাগানে জল সেচনের কাজও হয়ে যায়। এভাবেই মরুভূমির বুকে গড়ে উঠে সবুজের সমারোহ।

স্বদেশ কাতর স্ত্রীর জন্য সেরা উপহার

নেবুচাঁদনেজার ২ খ্রিষ্টপূর্ব ৬০৫ থেকে ৫৬২ সাল পর্যন্ত ৪৩ বছর ব্যবিলন শাসন করেন। এই সময় রাজনৈতিক সহযোগিতা প্রসারিত করার লক্ষ্যে মিডিয়া নগরীর রাজকুমারী আমিতিস এর সাথে নেবুচাঁদনেজারের বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। বিয়ের পর ব্যবিলনের মত শুষ্ক মরুভূমিতে এসে রাণী মানিয়ে নিতে পারছিলেন না। ফলে তিনি বিষণ্ণতায় ভোগতে থাকেন। কারণ জন্মের পর থেকেই আমিতিস বড় হয়েছেন পাহাড়, উপত্যকা আর সবুজে ঘেরা মিডিয়ায়। তাই হঠাৎ করে এই পরিবর্তনের সাথে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারছিলেন না। রাজা স্ত্রীর এই বিষয়টি লক্ষ্য করে সিদ্ধান্ত নিলেন স্ত্রীর মন ভালো করতে তার জন্মভূমির মতই পরিবেশ তৈরি করে দিবেন। রাণীকে পাহাড় বনের ছোঁয়া এনে দিতে তাই রাজা মরুভূমিতেই বিশালাকার এই বাগান তৈরি করে ফেললেন। স্ত্রীর জন্য রাজার এই উপহার পরবর্তীতে পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্যের খাতায় স্থান করে নেয়।

ব্যবেল টাওয়ার কে পেছনে রেখে ঝুলন্ত উদ্যান
ব্যবেল টাওয়ার কে পেছনে রেখে ঝুলন্ত উদ্যান Image source: blogspot.com

ব্যবিলনের শূন্য উদ্যানের খোঁজে প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান

সাম্প্রতিক সময়ে পরিচালিত কয়েকটি প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানে ইরাকের কিছু প্রাসাদের ভগ্নাবশেষ পাওয়া গিয়েছে যেখানে খিলান ও কূপের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। তবে গ্রীক ইতিহাসবিদদের বর্ণনায় দেয়া ঝুলন্ত বাগানের অবস্থানের সাথে এর সাদৃশ্য পাওয়া যায়নি। তাদের মতে বাগানটি ছিলো ইউফ্রেটিস নদীর ধারে। কিন্তু অনুসন্ধানকারীদের পাওয়া ধ্বংসাবশেষ অনেক দূরে। কিন্তু আশার কথা হচ্ছে , সম্প্রতি ইউফ্রেটিস নদীর তীরে ২৫ মিটার পুরু মাটির তৈরি দেয়ালের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। কে জানে এটাই হয়তো হতে পারে সেই ঝুলন্ত উদ্যানের অংশ। যদিও অনেকে বিশ্বাস করে বাস্তবে বাগানটির অস্তিত্ব নেই, কিন্তু সম্ভাবনা তো থেকেই যায়।

প্রাচীন ব্যবিলনের ধ্বংসাবশেষ
প্রাচীন ব্যবিলনের ধ্বংসাবশেষ Image source:thewanderingscot.com

এক নজরে ব্যবিলনের শূন্য উদ্যান সম্পর্কে জেনে নিই

  • প্রাচীন সপ্তাশ্চর্যের অন্তর্ভুক্ত একমাত্র ব্যবিলনের শূন্য উদ্যানেরই কোনো বাহ্যিক অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি বা এর অস্তিত্ব প্রশ্নের সম্মুখীন।
  •  ব্যবিলনীয় ইতিহাসের কোথাও কোনো নথিপত্রে এর উল্লেখ নেই। এমনকি প্রত্নতাত্ত্বিক ভাবেও এর নিরেট কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
  •  রাজা নেবুচাঁদনেজার স্ত্রীকে খুশি করতে ঝুলন্ত উদ্যান তৈরি করেন।
  •  মরুভূমিতে কৃত্রিম পাহাড় তৈরি করে তার মাঝে ধাপে ধাপে গাছ লাগিয়ে এই বাগান তৈরি।
  • যদি সত্যি ই এই বাগান থেকে থাকতো তবে প্রতিদিন ৮২০০ গ্যালন পানি সরবরাহ করতে হতো বাগানের জন্য।
  • বাগানটির উচ্চতা ছিলো প্রায় ৮০ ফুট। ঐ সময়ে কোনো প্রযুক্তি ছাড়াই এতো উঁচুতে পানি পৌছাতে হতো যার জন্য নিযুক্ত ছিলো অসংখ্য জনবল।
  • ঝুলন্ত বাগানে গাছ গুলো ঝুলন্ত ছিলোনা বরং সিঁড়ির ধাপের মত ট্যারেস বা ব্যালকনিতে গাছ গুলো রোপণ করা হতো যা নিচ থেকে দেখলে ঝুলন্ত মনে হতো।
  •  অনেকে মনে করে, ঝুলন্ত উদ্যানটির অবস্থান ছিলো ইরাকের বাগদাদ শহরের পশ্চিমে।
  • ব্যবিলনে এই রকম বাগানের সন্ধান না পাওয়া গেলেও ব্যবিলন থেকে ৩০০ কিলোমিটার দূরে নিনেভেহ তে প্রায় একই রকম কিছু নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে।

Source Featured Image
Leave A Reply
1 Comment
  1. Sormpp says

    buy terbinafine – terbinafine 250mg tablet grifulvin v sale

sativa was turned on.mrleaked.net www.omgbeeg.com

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More