পাখিরা প্রাকৃতিক পরিবেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আমাদের চারপাশে আমরা বিভিন্ন ধরণের পাখি দেখতে পাই। আকার, আকৃতি বা রঙে এরা ভিন্ন ভিন্ন হয়। এদের কোনটি উড়তে পারে আবার কোনটি উড়তে পারেনা। তবে যাই হোক, পাখিরা সব সময়ই সুন্দর ও বিশ্ময়কর। আজকে আমরা জানব পৃথিবীতে টিকে থাকা কিছু সর্ববৃহৎ প্রজাতি সম্পর্কে-
১০. ওয়ান্ডারিং অ্যালবাট্রস :
সকল প্রজাতির পাখিদের মধ্যে ওয়ান্ডারিং অ্যালবাট্রস এর ডানার প্রসারতা পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি। উড়ার সময় এর ডানা ৮.৩ থেকে ১১ ফুট পর্যন্ত প্রসারিত হয়। সুন্দর, বৃহদাকার এই পাখিটির বসবাস দক্ষিণ ও উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে। অ্যালবাট্রস এর সর্বমোট ২৪ টি প্রজাতি রয়েছে। এদের মধ্যে ওয়ান্ডারিং অ্যালবাট্রস সবচেয়ে বড় আকৃতির এবং এদের ওজন সর্বোচ্চ ১২ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে।
৯. মিউট সোয়ান :
মিউট সোয়ান বৃহদাকার একটি জলচর পাখি। আকৃতিতে এরা ৫ থেকে ৮ ফুট পর্যন্ত হয় এবং এদের ওজন ১২ থেকে ১৩ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। সাধারণত ইউরোপের দেশ গুলোতে এই রাজহংসের দেখা মেলে। চমৎকার ‘S’ আকৃতির গলা যুক্ত এই রাজহাঁসের পাখার প্রসারতা ৮ ফুট পর্যন্ত হয়। ছোট জলজ উদ্ভিদ, পোকামাকড় ও ছোট ছোট মাছ খেয়ে এরা জীবন ধারণ করে। জলের নিচ থেকে দ্রুত খাদ্য সংগ্রহ করতে এদের লম্বা গলা খুব সাহায্য করে থাকে।
মিউট সোয়ানরা বুদ্ধিমান কিন্তু কিছুটা আক্রমণাত্মক প্রজাতির। মজার বিষয় হচ্ছে ,কেউ তাদের যত্ন করলে বা সাহায্য করলে সেটা তারা মনে রাখতে পারে। এরা সাধারণত বাসা তৈরির সময় আক্রমণ করে, কেউ যদি তাদের বিপদের কারণ হয় তাহলে এরা তাকে কামড়ে দেয়। এই ধরণের রাজহাঁসেরা নিজেদের বাসা, ডিম ও বাচ্চার খুব খেয়াল রাখে। প্রজননের সময় এরা সাধারণত ৫ থেকে ৬ টি ডিম পারে।
৮. ডালমেশিয়ান পেলিক্যান :
ওজনে ভারি হওয়া সত্যেও উড়তে পারে এমন পাখিদের মধ্যে ডালমেশিয়ান পেলিক্যান অন্যতম। ইউরোপ ও দক্ষিণ এশিয়ায় এদের বসবাস। বৃহদাকার এই পাখিটি ৬ ফুট পর্যন্ত দীর্ঘ হয় এবং এদের ওজন হয় ১২ থেকে ১৪ কেজি পর্যন্ত। পরিণত বয়সে একটি ডালমেশিয়ান পেলিক্যান এর পাখার প্রসারতা হয় ৯ ফুট পর্যন্ত। দেখতে ঠিক শ্বেত পেলিক্যান এর মত হলেও ডালমেশিয়ান পেলিক্যান আকারে অনেক বড়।
ডালমেশিয়ান পেলিক্যান এর গলার দৈর্ঘ্য ১৮ ইঞ্চি পর্যন্ত হয়ে থাকে। গলার দৈর্ঘ্যের দিক থেকে এটা পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম। এদিক থেকে অস্ট্রেলিয়ান পেলিক্যানদের অবস্থান প্রথমে। ডালমেশিয়ান পেলিক্যানদের প্রধান খাদ্য মাছ। প্রতিদিন এরা গড়ে ২ কেজি পর্যন্ত মাছ খায়। এদের খাদ্য তালিকায় রয়েছে ক্যাটফিশ, ঈল ও ইউরোপিয়ান পার্চ ইত্যাদি।
৭. অ্যান্ডিয়ান কনডর বা আন্দিজের শকুন :
শকুন পরিবারের একটি গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হচ্ছে এই অ্যান্ডিয়ান কনডর। বৃহদাকার এই পাখিটির দেখা মেলে দক্ষিণ আফ্রিকার উপকূলভাগে এবং আন্দিজ পর্বতমালায়। এই পাখিটি উচ্চতায় প্রায় ৪ ফুট পর্যন্ত হয় এবং এদের ওজন হয় ১৫ কেজি পর্যন্ত। এছাড়া এদের পাখার প্রসারতার দৈর্ঘ্য ১০ ফুট পর্যন্ত হয়। পাখার এই বিশাল প্রসারতা এদেরকে ভারি শরীর নিয়ে উড়তে খুব সাহায্য করে।
অন্যান্য শকুনদের মত অ্যান্ডিয়ান কনডরও অন্যান্য প্রাণীদের মৃতদেহ ভক্ষণ করে জীবন ধারণ করে থাকে। এরা গৃহপালিত বা বন্য, যে কোন প্রাণীর মাংস খায়। উপকূলীয় অঞ্চলের মৃত সীল বা মৃত মাছও অ্যান্ডিয়ান কনডরদের প্রিয় খাবার। মাঝে মাঝে এরা ডিমের জন্য অন্যান্য পাখিদের বাসা আক্রমণ করে থাকে। বিপন্ন প্রজাতির এই শকুনের জীবনকাল ৭৫ বছর পর্যন্ত হয়ে থাকে।
৬. কোরি বাস্টার্ড :
কোরি বাস্টার্ড পৃথিবীর সর্ববৃহৎ পাখি যা উড়তে পারে। আফ্রিকায় বসবাসকারী এই পাখির ওজন হয়ে থাকে ২০ কেজি পর্যন্ত। পুরুষ পাখিদের ওজন স্ত্রী পাখিদের ওজনের চেয়ে দ্বিগুণ হয়। ৪ ফুট দৈর্ঘ্যের এই পাখিদের ডানার প্রসারতা ৯ ফুট পর্যন্ত হয়।
কোরি বাস্টার্ড এর প্রধান খাদ্য পোকামাকড়। এছাড়াও এদের খাদ্য তালিকায় রয়েছে টিকটিকি, সাপ, বিভিন্ন ধরণের বীজ ও রসালো ফল। মজার বিষয় হচ্ছে, এরা অন্যান্য পাখিদের মত পানি গিলে না ফেলে চুষে পান করে। এই পাখিরা তাদের বেশির ভাগ সময় ব্যয় করে স্থলভাগে পোকামাকড় ও তৃণভূমি খুঁজতে।
৫. গ্রেটার রিয়া :
দক্ষিণ আমেরিকার সর্ববৃহৎ পাখি গ্রেটার রিয়া। এই পাখিটি উড়তে পারেনা। এদের দৈর্ঘ্য হয় ৪.১ ফুট থেকে ৪.৫ ফুট পর্যন্ত এবং ওজন হয় ২৭ কেজি পর্যন্ত। এদের বিশালাকার ডানা রয়েছে কিন্তু এগুলো তাদের উড়তে সাহায্য করতে পারেনা। তবে এদের বিশাল পাখা দৌড়ানোর সময় শরীরের ভারসাম্য রক্ষায় সহায়তা করে । এছাড়াও দৌড়ানোর সময় দিক পরিবর্তনেও পাখা এদের সাহায্য করে থাকে।
সাধারণত জলাশয় বা তৃণভূমিতে গ্রেটার রিয়ার দেখা মেলে। এদের খাদ্য তালিকায় রয়েছে পোকামাকড়, টিকটিকি ও ছোট পাখি। উটপাখির মত গ্রেটার রিয়াদেরও দীর্ঘ এবং শক্তিশালী পা রয়েছে যা এরা বিপদের সম্মুখীন হলে আত্মরক্ষার্তে ব্যবহার করে। স্ত্রী পাখিরা আলাদা বাসা তৈরি করে তাতে ডিম পাড়ে এবং একেকটি বাসায় ৫০ টিরও বেশি ডিম পাড়ে।
৪. এম্পেরর পেঙ্গুইন :
পেঙ্গুইনদের মধ্যে সর্ববৃহৎ প্রজাতি হচ্ছে এম্পেরর পেঙ্গুইন। এদেরকে শুধুমাত্র অ্যান্টার্কটিকাতে দেখা যায়। এম্পেরর পেঙ্গুইন ৪৫ ইঞ্চি উচ্চতা পর্যন্ত দাঁড়াতে পারে এবং এদের ওজন হয় ৪৫ কেজি পর্যন্ত। খাবারের সন্ধানে এরা ৮০ কিলোমিটার পর্যন্ত ভ্রমণ করে এবং এরা সমুদ্রে ১৫০০ ফুট গভীর পর্যন্ত ডুব দিয়ে খাবার সংগ্রহ করতে পারে। এদের খাদ্য তালিকায় রয়েছে মাছ, স্কুইড ও ক্রিলস ইত্যাদি।
স্ত্রী পাখিরা ডিম পাড়ার পর পুরুষ পেঙ্গুইনরা সাধারণত ডিমের যত্ন নেয়। এই সময়টাতে পুরুষ পেঙ্গুইনরা দুই মাস পর্যন্ত একদম কিছু না খেয়ে থাকে। স্ত্রী পাখিরা এই সময় সমুদ্রে খাবারের সন্ধানে যায়। স্ত্রী পাখিরা খাবার গিলে ফেলে এবং পেটের ভেতরে জমা করে এগুলো নতুন জন্মানো বাচ্চাদের জন্য নিয়ে আসে।
৩. এমু :
অস্ট্রেলিয়ার সর্ববৃহৎ পাখি এমু এবং এরা উড়তে পারেনা। এদের উচ্চতা ৬ ফুট পর্যন্ত হয় এবং ওজনে ৬০ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে।এমু সাধারণত অস্ট্রেলিয়ার সাভানা বনভূমি ও অন্যান্য বনাঞ্চলে বসবাস করে। পোকামাকড়, বিভিন্ন ফল, বীজ, টিকটিকি বা ছোট ছোট উদ্ভিদ এদের খাদ্য তালিকায় রয়েছে। মজার বিষয় হচ্ছে, খাবার সহজে হজম করার জন্য এরা ছোট ছোট নুড়ি পাথর গিলে খায়।
লম্বা লম্বা পা যুক্ত এমু ঘণ্টায় ৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত দৌড়াতে পারে। এমু সাধারণত গ্রীষ্মকালে সঙ্গী বা সঙ্গিনীর খোঁজ করে এবং শীতকালে ডিম পাড়ে। এদের ডিমের রঙ গাঢ় সবুজ এবং প্রতিটি ডিমের ওজন ১ পাউন্ড পর্যন্ত হয়। এদের প্রতিটি বাসায় ৮ টি থেকে ১০ টি ডিমের ধারণ ক্ষমতা থাকে।
২. সাউদার্ন ক্যাসোওয়ারি :
ইন্দোনেশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার ক্রান্তীয় বৃষ্টিবহুল বনাঞ্চলে সাউদার্ন ক্যাসোওয়ারি বসবাস করে। এটি পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম পাখি। ৫.১ ফুট উচ্চতা সম্পন্ন এই পাখিদের ওজন হয় ৭৫ থেকে ৮০ কেজি পর্যন্ত। এছাড়াও এদের গলার দৈর্ঘ্য হয় ৭.৫ ইঞ্চি পর্যন্ত।
তিন আঙ্গুল বিশিষ্ট সাউদার্ন ক্যাসোওয়ারির পা খুবই পুরু ও বলিষ্ঠ হয়। কালো রঙের বৃহদাকার এই পাখি উড়তে পারেনা তবে ঘণ্টায় ৩০ মাইল বেগে দৌড়াতে পারে। পোকামাকড়, ঘাস বা ছত্রাক এদের প্রিয় খাবার। গ্রীষ্মকালে স্ত্রী পাখিরা ৮ থেকে ১০ টি গাঢ় রঙের বড় বড় ডিম পাড়ে। পুরুষ পাখিরা ৫০ দিনেরও বেশি সময় ধরে ঐ ডিমে তা দেয়।
১. উটপাখি :
পৃথিবীর সর্ববৃহৎ পাখি হলো উটপাখি। একটি পূর্ণবয়স্ক উটপাখির ওজন হয় ১৫০ কেজি পর্যন্ত এবং এদের উচ্চতা হয় ৬ ফুট পর্যন্ত। এছাড়াও সবচেয়ে দ্রুত দৌড়াতে পারে এমন পাখিদের তালিকায় উটপাখি প্রথম এবং জীবিত পাখিদের বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে উটপাখির ডিম সর্ববৃহৎ। শক্তিশালী পা যুক্ত উটপাখি ঘণ্টায় ৭০ কিলোমিটার পর্যন্ত দৌড়াতে পারে। উটপাখির বসবাস আফ্রিকা অঞ্চলে।
উটপাখিরা সাধারণত দূর্বাঘাস, বীজ, ফুল, ফল ও পোকামাকড় খেয়ে জীবন ধারণ করে। এমুর মত এরাও খাবার হজম করতে নুড়ি পাথর গিলে খায়। মজার বিষয় হচ্ছে উটপাখি পেটের মধ্যে ১.৩ কেজি পর্যন্ত নুড়ি পাথর ও বালু জমা করে রাখতে পারে। এছাড়াও পানি পান করা ছাড়াই এরা দীর্ঘদিন।
উটপাখির শক্তিশালী পা এদেরকে সম্ভাব্য আক্রমণকারী থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করে। এরা সাধারণত দল বেঁধে বাস করে এবং প্রতিটি দলে ১০ থেকে ৫০ টি পর্যন্ত পাখি থাকে। স্ত্রী উটপাখিরা বছরে ৬০টি পর্যন্ত ডিম দিয়ে থাকে। উটপাখির ডিমের গড় ওজন হয় ১.৪ কেজি পর্যন্ত ও ব্যাস হয় ৫.১ ইঞ্চি পর্যন্ত।