স্টোনহেঞ্জ রহস্য – ইংল্যান্ডের উইল্টশায়ারে অবস্থিত এক বিস্ময়!
প্রকৃতি তে রহস্যের যেমন অন্ত নেই তেমনি সেই রহস্যের দ্বার উন্মোচনের জন্য মানুষের চেষ্টার ও কমতি নেই। সৃষ্টির শুরু থেকেই প্রকৃতি নিজেকে বিভিন্ন রহস্যের আবরণে ঢেকে রেখেছে। আর কৌতূহলী মানুষ শত শত বছর ধরে সেই সকল রহস্যের সমাধানে নিজেদের সময়, শ্রম, অর্থ এমনকি জীবন পর্যন্ত বাজি রেখে আসছে। স্টোনহেঞ্জ তেমনি এক রহস্য যা বছরের পর বছর ধরে মানুষ কে আকর্ষণ করেছে আর করেছে প্রশ্নের সম্মুখীন। স্টোনহেঞ্জ এর সৌন্দর্য আর রহস্যময়তায় মুগ্ধ হয়ে সবাই জানতে চেয়েছে যে কারা এটা তৈরি করেছিলো, কিভাবে আর কেনই বা তৈরি করেছিলো এই বিশালাকার পাথরের স্তম্ভ। চলুন তাহলে জেনে নেয়া যাক স্টোনহেঞ্জের সে সকল রহস্য সম্পর্কে-
স্টোনহেঞ্জ ইংল্যান্ডের উইল্টশায়ারে অবস্থিত একটি প্রাগৈতিহাসিক স্মৃতিস্তম্ভ। নব্যপ্রস্তর যুগে তৈরিকৃত এই স্থাপনাটি এতই আগের যে এর সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য পাওয়া যায়না। এটি ইংল্যান্ড এর আধুনিক শহর অ্যামসবারি (Amesbury)থেকে ৩ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং সালিসবারি (Salisbury) থেকে ৮ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত। স্টোনহেঞ্জ মূলত খাড়া পাথরের তৈরি বলয়াকৃতির একটি স্মৃতিস্তম্ভ। বিভিন্ন গবেষণা থেকে দেখা যায় যে এই স্থান টি প্রায় 10,000 বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে বিবর্তিত হয়েছে। আমরা বর্তমানে “স্টোনহেঞ্জ” নামক যে কাঠামোটি দেখি বা জানি তার গঠন প্রায় 5000 থেকে 4000 বছর আগে নির্মিত হয়েছিল এবং এটি বৃহত্তর একটি পবিত্র স্থানের অংশ মাত্র। এর মূল কাঠামোটি বর্তমান “স্টোনহেঞ্জ” এর চেয়ে ১৫ গুন বড় ছিলো।
স্টোনহেঞ্জ কারা তৈরি করেছিলো?
স্টোনহেঞ্জ নিয়ে প্রায় শত শত পৌরাণিক কাহিনী এবং কিংবদন্তি রয়েছে। এই বিশালাকার স্তম্ভের নির্মাণে ডেন, রোমান, স্যাক্সন, গ্রীক, আটলান্টিয়ান, মিশরীয়, ফিনিসিয়ান কেল্ট, কিং অরেলিয়াস আম্ব্রোসিজ, মারলিন এবং এমনকি এলিয়েনরা জড়িত রয়েছে বলে অনেকে বিশ্বাস করে।
স্টোনহেঞ্জ নিয়ে সবচেয়ে জনপ্রিয় যে মত টি প্রচলিত রয়েছে তা হলো স্টোনহেঞ্জ ড্রুইডদের (প্রাচীন কেল্টিক জাতির একজন ধর্মযাজক) তৈরি। কেল্ট (Celt)দের এই উচ্চ যাজক বিভিন্ন উৎসর্গমূলক অনুষ্ঠানাদি পালনের জন্য এটি নির্মাণ করেন। জন অব্রে প্রথম স্টোনহেঞ্জের নির্মাণের সাথে ড্রুইডদের যুক্ত করেন। এছাড়াও, আরেকজন প্রত্নতত্ত্ববিদ ড. উইলিয়াম স্টকলিও স্টোনহেঞ্জ নিয়ে গবেষণা করেন এবং তিনিও দাবী করেন যে এটা ড্রুইডদের তৈরি। ড. উইলিয়াম স্টকলি জন অব্রে এর চেয়ে এক শতাব্দী পরে স্টোনহেঞ্জ নিয়ে গবেষণা শুরু করেন এবং তিনি ড্রুইডদের ধর্মের সাথে এতটাই যুক্ত হয়ে যান যে তিনি নিযেই তাদের একজন হয়ে উঠেন। স্টোনহেঞ্জ যে ড্রুইডদের তৈরি এই ধারনাটি জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে উনার এই কাজের ভূমিকা রয়েছে।
দুর্ভাগ্যবশত গবেষকরা স্টোনহেঞ্জ নির্মাণ সম্পর্কিত এই যুগান্তকারী তত্বটিকে ভুল প্রমাণ করেছে। আধুনিক রেডিও কার্বন ডেটিং কৌশল গুলোর মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা আবিস্কার করেছেন যে, কেল্টিকরা এই অঞ্চলে আসার প্রায় এক হাজার বছর পূর্বেই স্টোনহেঞ্জ নির্মিত হয়। আর এই তত্ত্বটিই স্টোনহেঞ্জ নির্মাণের সম্ভাবনা থেকে ড্রুইডদের দূরে সরিয়ে দেয়। ড্রুইডরা সাধারনত জলাভূমি বা বনের মধ্যে উপাসনা করত। কিন্তু এটা যাচাই করে দেখা গিয়েছে যে যখন তারা এই অঞ্চলে এসে বসবাস শুরু করে তখন উপাসনা বা উৎসর্গের জন্য স্টোনহেঞ্জকে উপাসনালয় হিসেবে ব্যবহার করত। আধুনিক ড্রুইডরা এখনো মধ্য গ্রীষ্ম সোলস্টিস (নিরক্ষরেখা থেকে সূর্য্যের দূরতম স্থানে অবস্থান) এ মাথা ঢাকা সাদা পোষাক পরে স্টোনহেঞ্জে সমবেত হয়।
অধিকাংশ বিজ্ঞানী আধুনিক তত্ত্বের সাথে একমত যে তিনটি উপজাতি তিনটি ভিন্ন সময়ে স্টোনহেঞ্জ নির্মাণ করেছে। আনুমানিক 3000 খ্রিস্টপূর্বাব্দে, এটি বিশ্বাস করা হয় যে, এই সাইটে কাজ করার জন্য প্রথম ব্যক্তিরা ছিল নব্যপ্রস্তরযুগীয় কৃষিবিদরা। পুরাতত্ত্ববিদরা তাদের নাম দেন উইন্ডমিল পাহাড়ের লোক হিসেবে যা স্টোনহেঞ্জের কাছেই অবস্থিত একটি স্থান।
দ্বিতীয় স্তরে যারা স্টোনহেঞ্জ এর নির্মাণ কাজ করেন তারা হচ্ছেন বীকার জাতির লোকেরা। বীকার জাতির লোকেরা নবোপলীয় সময়ের শেষে ইউরোপ থেকে এসেছিলেন এবং ২000 খ্রিস্টপূর্বাব্দে সালিসবারি সমতল ভূমি আক্রমণ করেছিলেন। তাদের নাম এসেছে তাদের প্রাচীন একটি ঐতিহ্য থেকে যা অনুযায়ী তারা মৃত ব্যক্তির সাথে বীকার বা পান পাত্র কবর দিয়ে দিতো। বীকার জনগোষ্ঠী অত্যন্ত সংগঠিত, মর্যাদাপূর্ণ, অত্যাধুনিক গাণিতিক ধারণা ব্যবহার করত এবং একটি সমাজপতির মাধ্যমে তাদের সমাজ পরিচালনা করত। তারা আরও বেশি আধুনিকভাবে ধাতুর ব্যবহার এবং জীবিকা নির্বাহ করে। বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন যে তারা সূর্যের পূজারী ছিলেন, যা স্টোনহেঞ্জকে নির্দিষ্ট কিছু সূর্য সম্পর্কিত ঘটনার সাথে যুক্ত করেছিল, যেমন মধ্য গ্রীষ্ম এবং শীতকালীন সোলস্টিস।
ওয়েজেক্স এর লোকেদের স্টোনহেঞ্জের সাইটে কাজ করা তৃতীয় এবং চূড়ান্ত ব্যক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তারা প্রায় ১৫০০ খ্রীস্টপূর্বাব্দে ব্রোঞ্জ যুগের মাঝামাঝি সময়ে এই এলাকায় পৌছায়। ঐ সময় তারা ভূমধ্যসাগরের বাইরের সবচেয়ে উন্নত সংস্কৃতির একটি ছিল। মনে করা হয় যে স্টোনহেঞ্জের “sarsens”নামক পাথর গুলোতে অঙ্কিত ব্রোঞ্জের তলোয়ার এর চিত্র তারাই খোদাই করেছিল এবং এখন আমরা যে স্টোনহেঞ্জ দেখি তা তাদের হাতেই পূর্ণতা পেয়েছিল।
স্টোনহেঞ্জ নির্মাণের রহস্যঃ
স্টোনহেঞ্জের সবচেয়ে বড় পাথর গুলো যা “সারসন”(sarsen) নামে পরিচিত সেগুলোর গড় উচ্চতা প্রায় ৩০ মিটার এবং ওজন প্রায় ২৫ টন। বিশ্বাস করা হয় যে এ পাথর গুলো স্টোনহেঞ্জ থেকে ৩২ কিলোমিটার উত্তরের মার্লবরো (Marlborough) নামক স্থান থেকে সেখানে আনা হয়েছে।ছোট পাথর গুলো যা নীল পাথর(blustone) নামে পরিচিত সেগুলোর ওজন প্রায় ৪ টন পর্যন্ত। পাথর গুলোর নাম “ব্লুস্টোন”(blustone) কারণ সেগুলো ভাঙলে বা ভেজালে নীলচে আভা দেখা যায়।এই পাথর গুলো ২২৫ কিলোমিটার দূর থেকে পশ্চিম ওয়েলস (Wales) এর বিভিন্ন স্থান থেকে আনা হয়। কিন্তু এই বিষয়টি এখনও অজানা যে এত পূর্বে কোন প্রযুক্তি ছাড়া কিভাবে এই পাথর গুলো তারা এত দূর থেকে এনেছে।
সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, এক ডজন লোকের দ্বারা কাঠের ট্র্যাকওয়ে ব্যবহার করে ১ টনের একটি পাথর সরানো সম্ভব, তবে এই কৌশলটি আসলে প্রাচীন স্থপতিদের দ্বারা ব্যবহৃত হয়েছিলো কিনা তা অনিশ্চিত। বিজ্ঞানীরা এই সম্ভাবনাও উত্থাপন করেছেন যে, শেষ বরফ যুগের হিমবাহ এই পাথর গুলোকে স্টোনহেঞ্জ এলাকার কাছাকাছি বয়ে এনেছে যার ফলে স্টোনহেঞ্জের স্থপতিদের এগুলো ওয়েলস থেকে এত দূর পর্যন্ত বহন করতে হয়নি। অন্য আরেকটি পদ্ধতির কথাও বলা হয়েছে যে বন্যার পানিতে পাথরগুলো ভেসে এসেছে। তবে এই পদ্ধতিটির ও সত্যতা পাওয়া যায়নি।
স্টোনহেঞ্জের গঠন কিছুটা জটিল। প্রাথমিক পর্যায়ে যখন এই স্তম্ভের নির্মাণ কাজ শুরু হয় তখন প্রথমে এর বাইরের অংশে গভীর করে খাল খনন করে এবং বাধ নির্মাণ করে। তারপর এই বাধের ভেতরে বৃত্তাকার ভাবে পাথর গুলো স্থাপন করা হয়। প্রথমে ব্লুস্টোন গুলো সাজানো হয় এবং এর প্রায় ১০০ বছর পরে সারসন নামক পাথর গুলো স্থাপন করা হয়। এই বৃহদাকার পাথর গুলো কে খাড়া ভাবে স্থাপন করা হয় এবং পাশাপাশি দুটো পাথরকে যুক্ত করতে আরেকটি পাথরকে আড়াআড়ি ভাবে স্থাপন করা হয়। আর এভাবেই গড়ে উঠে স্টোনহেঞ্জের মূল স্তম্ভ।
স্টোনহেঞ্জ বৃহদাকার একটি পবিত্র স্থানের ক্ষুদ্র অংশ মাত্র যেখানে কাঠ এবং পাথরের তৈরি আরও অনেক কাঠামো এবং সমাধি রয়েছে। বিজ্ঞানীদের মতে, স্টোনহেঞ্জ তৈরি হওয়ার অনেক আগে থেকেই সালিসবারির সমভূমি একটি পবিত্র স্থান হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। প্রায় ১০,৫০০ বছর পূর্বে থেকেই এই স্থানে বিভিন্ন উপাসনা এবং পূজা অর্চনা হয়ে আসছিলো।
যে কারণে স্টোনহেঞ্জ নির্মাণ করা হয়ঃ
স্টোনহেঞ্জ কেন নির্মাণ করা হয়েছিল এর উত্তরে অনেক তত্ত্বের প্রবর্তনা হয়েছে এখন পর্যন্ত। স্টোনহেঞ্জ সম্পর্কে বছরের পর বছর ধরে গবেষণার ফলে যে সকল তত্ত্ব পাওয়া গিয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য তিনটি কারণ হচ্ছেঃ
১) একটি পবিত্র সমাধিস্থল।
২) জ্যোতির্বিজ্ঞান সংক্রান্ত কাজের জন্য।
৩) আরোগ্য লাভের স্থান হিসেবে।
স্টোনহেঞ্জ যে একটি সমাধিস্থল ছিলো তার প্রমান পাওয়া যায় এর আশেপাশের এলাকা থেকে পাওয়া হাড় এবং কঙ্কাল থেকে। এ থেকে ধারণা করা হয় যে, বিভিন্ন দূরবর্তী এলাকা থেকে লোকজন এই পবিত্র সমাধিস্থলে উপাসনার জন্য আসতো। এছাড়াও সম্প্রতি কয়েক বছরে স্টোনহেঞ্জে ৬৩ জন মানুষের হাড়ের টুকরো খুজে পাওয়া গিয়েছে।
কিছু মানুষের ধারণা যে, স্টোনহেঞ্জে উন্নত জ্যোতির্বিদ্যা বা জ্যোতির্বিজ্ঞান অনুশীলন করা হতো। এটা স্পষ্ট যে, স্টোনহেঞ্জের সাথে জ্যোতির্বিজ্ঞান কোন না কোন ভাবে সম্পৃক্ত। সেই সময় এটি মানমন্দির এবং ঋতু নির্ণয়ের কাজে ব্যবহৃত হতো । তবে স্টোনহেঞ্জে যে সকল বিষয়ে পর্যবেক্ষন হতো তা মূলত শাস্ত্রীয় আচার অনুষ্ঠান পালন সম্পর্কিত।
স্টোনহেঞ্জ এ সূর্যাস্ত
স্টোনহেঞ্জের নীল পাথর (blustone) গুলোর রোগ নিরাময় ক্ষমতা রয়েছে বলে মনে করা হতো। ঐ স্থানে প্রাপ্ত মানব কঙ্কাল গুলোতে কিছু আঘাতের চিহ্ন দেখা গিয়েছিল যা থেকে ধারণা করা হয় যে লোকজন বিভিন্ন শারীরিক আঘাত বা রোগ নিরাময়ের জন্য এখানে আসত। বিশ্বাস করা হতো যে ঐ পাথর গুলোর অলৌকিক নিরাময় ক্ষমতা রয়েছে।
বর্তমানে, পৌত্তলিক ধর্মের লোকেরা তীর্থস্থান হিসেবে এই স্থানটিকে ব্যবহার করে। ড্রুইডরাও প্রায়ই এই স্থানটিকে বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতা পালনের জন্য ব্যবহার করে থাকে। আর পর্যটকদের কাছে এই স্টোনহেঞ্জ রহস্যে ঘেরা এক অপার বিস্ময়ের নাম এবং এই রহস্য এখনও অমিমাংসিত। ১৯৮৬ সালে ইউনেস্কো এই স্থানটিকে “ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট” হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
তথ্য সূত্রঃ
https://www.londontoolkit.com/whattodo/stonehenge_mystery.htm
https://www.livescience.com/22427-stonehenge-facts.html
https://www.thoughtco.com/stonehenge-wiltshire-uk-2562649
oral lamisil 250mg – buy griseofulvin 250mg without prescription buy grifulvin v no prescription
order semaglutide without prescription – buy DDAVP generic buy desmopressin generic