কুশান গানের অতীত-বর্তমান

6

বাংলাদেশে মানুষের সাংস্কৃতিক ভিত্তি নির্মাণে যে সকল উপাদানের সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে ঐতিহ্যবাহী নাট্যধারা সেগুলোর মধ্যে অন্যতম। এদেশের মানুষের যাপিতজীবনের সঙ্গে নাট্যরীতি প্রমাহমান। বাংলাদেশের মানুষ কখনো সাংস্কৃতিক এই উপাদানটির প্রভাবকে এড়িয়ে যেতে পারেনি। এর প্রাণবন্ত প্রবাহ সেই প্রাচীনকাল থেকে অদ্যবধি স্বতঃস্ফূর্ত আবেগে চলমান। বিবর্তনের অশেষ স্রোত তাকে দিয়েছে অকৃত্রিম এক গতিবেগ, যে গতির উপর ভর করে হিমালয় থেকে উৎপন্ন নদীর স্রোতধারার মতো এদেশের ঐতিহ্যবাহী নাট্যধারা সময়ের মহাসমুদ্রের দিকে নিরন্তর এগিয়ে চলেছে। আর এই গতিময় নাট্যধারার সম্মুখগামী শত সহস্র পদযাত্রা নদীর জীবন্ত স্রোতধারার মতো বৈচিত্রময় এবং তা নিত্যই নানান ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ভেতর দিয়ে পরিবর্তনশীল। সে পরিবর্তন সহজে চোখে পড়ে না। কিন্তু কালের মোচড়ে কখনো কখনো পরিবর্তনটা খুবই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আর তখনই একটি নাট্যধারার ঘটে পালাবদল। এই পরিবর্তনের সূত্র মেনে প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিক যুগের ঐতিহ্যবাহী নাট্যধারা বরাবর নতুন নতুন রূপ গ্রহণ করেছে। তবে, বিস্ময়ের ব্যপার এই যে, কোনো কালেই এদেশের ঐতিহ্যবাহী নাট্যধারা অনুশীলনের কোনো বিধিবদ্ধ ব্যবস্থা ছিল না এবং এখনও নেই। কীভাবে এটা রচনা করতে হয়, কীভাবে এটা স্মৃতিপথে রক্ষা করতে হয়, কিংবা কীভাবে এর সুর, তাল, নৃত্য, অভিনয় শিক্ষা লাভ করতে হয় তার সুনির্দিষ্ট কোনো পদ্ধতি আজও নেই এবং আমরা তা অন্বেষণও করিনি। যাঁরা এ নাট্যধারা আয়ত্ত করেন, তাঁরা সাধারণত স্বভাবদত্ত ক্ষমতার গুণে কেবল চোখে দেখে, কানে শুনে এবং নাট্যশিল্পীদের সঙ্গে মিশে গিয়ে আপনা হতেই তা আয়ত্ত করে থাকেন। আর এভাবেই এ ভূ-খণ্ডে সহস্র বছর ধরে ঐতিহ্যবাহী নাট্যচর্চার ধারা প্রচলিত রয়েছে। এর ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য কোনোদিন কোনো বর্হিমুখী পদ্ধতির প্রয়োজন পড়েনি।

বাংলাদেশে ধ্রুপদী মহাকাব্য রামায়ণের আখ্যান পরিবেশনা অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং বৈচিত্রপূর্ণ। রামায়ণের কেন্দ্রীয় চরিত্র রাম মূলত আর্য পৌরাণিক দেবতা। তবে এই আর্য পৌরাণিক রামচন্দ্রের সঙ্গে সাধারণত রামায়ণের আখ্যান পরিবেশনায় জনসমাজে প্রচলিত রামচন্দ্রের লোককথাকে যোগ করা থাকে। রামায়ণের আখ্যান পরিবেশনায় রামচন্দ্র মুখ্য চরিত্র হলেও একই সঙ্গে রামের ভাই লক্ষণ, স্ত্রী সীতা, পুত্র লব-কুশ, রাবণ ও রাবণ মেঘনাদ, বিভীষণ ও বিভীষণ পুত্র তরণীসেন এমনকি বাল্মীকি, হুনুমান ইত্যাদি চরিত্র সমধিক গুরুত্বের সাথে আসরে উপস্থাপন করা হয়। এদেশে রামায়ণ ও তার চরিত্রসমূহের মাহাত্ম্য প্রকাশক আখ্যান কুশান গান, রামলীলা, রামায়ন কীর্তন, রামমঙ্গল, ইত্যাদি বিচিত্র পরিবেশনারীতি নিয়মিতভাবে অভিনীত হয়ে থাকে। বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী নাট্যধারায় রামায়ণের আখ্যান নির্ভর পরিবেশনারীতির মধ্যে কুশানগান উল্লেখযোগ্য। এধরনের পরিবেশনারীতি মূলত উত্তরবঙ্গের কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাট অঞ্চলের রাজবংশীদের মধ্যে অধিক প্রচলিত।

কুশ থেকে কুশান শব্দের উৎপত্তিলব ও কুশের ভূমিকায় দু’জন বালক মুলত গান করেন। উত্তরবঙ্গের উপভাষায় ‘কুশ’ নামটি কুশান হিসেবে উচ্চারিত। কুশের গান থেকেই কুশান গানের নামকরণ হয়েছে। আবার কোনো কোনো বিশেষজ্ঞের ধারণা, ‘সংস্কৃত কুশলীব শব্দ থেকে কুশান শব্দটি উৎপন্ন হয়েছে।’ এক্ষেত্রে গবেষক জানান, ‘কুশলীবই বাল্মীকির রামায়ণের প্রথম প্রচারক।’ তবে, বাংলাদেশের বিখ্যাত কুশান শিল্পী কৃপাসিন্ধু রায় জানান, ‘কু কথাকে রামায়ণের এ ধরনের গানে শান বা ধার দিয়ে মানুষের মঙ্গল কথা প্রকাশ করা হয় বলে এই গানকে কুশান বলে।’ রামায়ণের কাহিনী ছাড়া কুশান গান হতে পারে না। কুশান গানকে কেউ কেউ ‘ব্যাণা কুশান’ও বলেন। বেণা (ব্যাণা) সহযোগে কুশান গান গীত হয় বলে এর নাম ‘ব্যাণা কুশান’ হয়েছে। বেণা বা ব্যাণা ‘বীণা’ থেকে উদ্ভূত।

রামায়ণের কাহিনী হতে জানা যায় যে, নির্বাসিতা সীতার গর্ভে, বাল্মীকির আশ্রমে লব ও কুশ জন্মগ্রহণ করেন। বাল্মীকির শিক্ষায় লব ও কুশ রামায়ণ আয়ত্ত করেন। পরে মহর্ষির অনুমোদনক্রমে দুই ভাই রামচন্দ্রের সভায় এসে বীণা সহযোগে রামায়ণ গান পরিবেশন করেন। রামায়ণ গান প্রচলনের ধারাবাকিতা অনুসরণ করেই কুশান গানের সৃষ্টি হয়েছে বলে অনুমান করা হয়। কুশান গানের সঙ্গে শ্রীরামচন্দ্রের সভায় গীত রামায়ণ গানের সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। রামায়ণ গানই উত্তর বাংলার কুশান গান।

দশ থেকে পনেরো-বিশজন লোক নিয়ে কুশান গানের দল তৈরি হয়। এর মধ্যে একজন মূল গায়েন। দু-জন পাছ (পার্শ) দোহার। একজন লব। একজন কুশ। বাকীরা প্রয়োজনে অন্যান্য ভূমিকায় অংশগ্রহণ করেন। ভূমিকা যখন থাকেনা, তখন বাদ্যযন্ত্র বাজান। কুশান দলের সকলেই আসরে দণ্ডায়মান হয়ে আসর রচনা করেন। মূল গায়েনের হাতে থাকে বেণা। তাছাড়া থাকে চামর। তিনি আসরের সম্মুখভাগের মাঝখানে দাঁড়িয়ে দল পরিচালনা করেন। তাঁকে দলের সূত্রধরও বলা যেতে পারে। তাঁর দু-পাশে দু-জন পাছ-দোহার তাঁকে সাহায্য করেন। দলের অন্যান্য সদস্যরা গুণানুযায়ী বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র নিয়ে আসরে অংশ নেন। প্রয়োজনে বিভিন্ন চরিত্রে অংশগ্রহণও করেন। লব ও কুশের ভূমিকায় দু-জন সুদর্শন বালক অংশগ্রহণ নেন। উত্তম বেশে সজ্জিত বালকদ্বয় আসরের মধ্যস্থলে দাঁড়িয়ে থাকেন। এঁরা সাধারণত সুগায়ক হর। দলের সুনাম, বদনাম, দুর্নাম সবকিছু এঁদের গানের উপর নির্ভর করে। সাধারণত বেণা বাজাতে এঁরা পারদর্শী। বেণায় পারঙ্গম হতে না পারলেও এদের হাতে বেণা থাকবেই। সুগায়ক বালকদ্বয় প্রায় সব গানগুলিই পরিবেশন করেন। তাছাড়া মূল গায়েনকে আরও অনেক কাজ করতে হয়। যতক্ষণ অনুষ্ঠান চলতে থাকে তার সারাক্ষণই মূল গায়েন বেণা যন্ত্রটি বাজিয়ে যান, তবে মধ্যে মধ্যে প্রয়োজনবোধে তিনি বেণা যন্ত্রটি নামিয়ে রেখে কোনো ধরনের পোশাক পরিবর্তন ছাড়াই নাট্য কাহিনীর একটি চরিত্র রূপদান করেন। মূলগায়েনের বর্ণনাত্মক অভিনয় অংশ যখন শেষ হয় তখন আবার তিনি মূলগায়ক বা গীদালের ভূমিকায় ফিরে এসে বেণা যন্ত্রটি কাঁধে করে বাজাতে থাকেন। এভাবে কুশান গানের মূল গায়ক কখনো বাদ্যকার, কখনো অভিনেতা রূপে আসরে অংশ নেন। প্রয়োজনে বিভিন্ন চরিত্রের অভিনয় সংযোজক অংশের সংলাপ, গান, বর্ণনাত্বক সংলাপ কথা ও গানের মাধ্যমে মূল গায়েনকে পরিবেশন করতে হয়।

বেণা যন্ত্রটি কুশান গানের মূল বাদ্যযন্ত্র। কাঠের বাটি ও বাঁশের দণ্ডযুক্ত একতারবিশিষ্ট যন্ত্র বেণা। তারের উপর ঘোড়ার লেজের চুল দিয়ে টেনে টেনে বেহালার মত বাজানো হয়। বেণা লম্বায় প্রায় দেড় ফুট। বাটিটির ব্যাস ছয় ইঞ্চি। কখনো কখনো কাঠের বাটির পরিবর্তে বাঁশের গুঁড়ি দিয়ে বাটিটি নির্মিত হয়। বেণা থেকে যে সুর বের হয়, তা সুমধুর। বেণা ছাড়া সাঁনাই, ঢোল, হারমোনিয়াম, খোল, বাঁশি, দোতারা, বেহালা ও করতাল ব্যবহৃত হয়।

বিভিন্ন পূজা-পার্বণ, মেলা, লোকউৎসব উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে শিল্পীদের দ্বারা কুশান গান বেশি পরিবেশিত হত। সাধারণত বাড়ির উঠান, মন্দির প্রাঙ্গণ বা কোনো খোলাস্থানে উৎসব উপলক্ষে কুশান গানের আয়োজন করা হত। এ গানের আসর সাধারণত সন্ধ্যার পর, একটু রাত হলে শুরু হত আর চলত ভোর পর্যন্ত। সমতল ভূমিতে বর্গাকার স্থানে আসর তৈরি করা হত। অভিনয় স্থানে গায়েন, দোহার, বাদ্যকার বসার জন্য পাটি বা চট বিছিয়ে দেয়া হত। মূলত অভিনয়ে অংশগ্রহণ করার জন্য বাদ্যকার, গায়েন, দোহার, ছোকরা অভিনয় স্থানে বৃত্তাকারে বসে এবং সেখান থেকে উঠে দাঁড়িয়ে চারিদিকে ঘুরে অভিনয়ে অংশ নেন। দর্শক-শ্রোতাগণ মঞ্চের চারিদিকে বসে সারারাত আসর উপভোগ করতেন। কুশান গানের দলে যে সকল কুশলীব অভিনয় করেন তাঁদের একেকটা করে নাম রাখা হয়। যে সকল কিশোর-যুবা শাড়ি পরে মেয়ে সেজে আসরে নেচে গেয়ে অভিনয় করেন তাঁদের বলা হয় ছোকরা। এছাড়া কুশান গানের দলে ভাঁড় ধরনের একজন কুশলীব হাস্যরসের তুফান তুলে অভিনয় করেন। অভিনয়কালে তার চলাফেরা কথাবার্তা এমনকি তাকে দেখলেই দর্শকরা হাঁসিতে ফেটে পড়েন। এই শ্রেণির অভিনেতার নাম দোয়াড়ি। দোয়াড়ি যে চরিত্রে অভিনয় করেন মূল গায়েন তার বিপরীত চরিত্রটি ধারণ করেন। রামায়ণের কাহিনী অবলম্বনে কুশান গানের পরিবেশনায় মূলগায়েন সাধারণত সাদাধুতি ও পাঞ্জাবি পরে একটা উত্তরীয় কাঁধে অভিনয় করেন। সীতা চরিত্র রূপদানকারী অভিনেত্রী ও ছোকরাগণ উজ্জ্বল শাড়ি, ব্লাউজ পরে অভিনয় করেন। লব ও কুশলীব চরিত্র সাদাধুতি ও হাফহাতা গেঞ্জি পরে অভিনয় করেন।

আসর বন্দনা দিয়ে গান শুরু হয়। আসর বন্দনার পর রাম বন্দনা। রামকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। রামের কাছে অভয় প্রার্থনা করা হয়। বন্দনা শুরু করা হয় এইভাবে:

এইস ওগো প্রভু এইস আমার থানে।

অধমক্ তরাইতে প্রভু আইসেন ত গেলে।।

আমার আসর ছেইরে গো রাম অন্যের আসরে যাবো।

দোহাই নাগে বিশ্বামিত্রের কৌশলার মু- খাবো।।- ইত্যাদি।

বন্দনার পরের অংশের নাম ‘ভুলালি’। দেশ, বিভিন্ন দেবদেবী, গুরু ও আসরে সমবেত শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে প্রণাম নিবেদন করা হয়। আসর বন্দনা, দেব বন্দনা, রাম বন্দনা ইত্যাদির পর মূল গায়েন সেদিন কোন পালা গাইবেন তা জানিয়ে দেন। রামায়ণের বিশেষ ঘটনা অবলম্বন করে পালা রচনা করা হয়। রাজবংশীদের আঞ্চলিক উপভাষায়। এই পালা সাধারণত স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে গাওয়া হয়। এর ভাষা লৌকিক।

কুশান পালাগান যে ভাবে রচিত হয়, তাতে কাব্যগত উৎকর্ষ তেমন পাওয়া যায় না। সাধারণত গ্রামের প্রায় অক্ষরজ্ঞানশূন্য কিংবা স্বল্প অক্ষরজ্ঞান-সম্পন্ন রাজবংশী-সম্প্রদায়ের মানুষের মূল রামায়ণের কাহিনী অবলম্বনে পয়ার ছন্দে কথ্য ভাষায় পালা রচনা করেন। রচনা তাই স্বাভাবিকভাবেই রসোত্তীর্ণ হয়ে ওঠে না। আসর বসানোর জন্য অনেক সময় দু-একটি কাল্পনিক চরিত্রেরও আমদানি করা হয়। এই চরিত্রগুলি মূল গানের ফাঁকে গান ও কথার মাধ্যমে শ্রোতাদের একঘেঁয়েমি দূর করে। ফলে বেশ কিছু স্থুল রসিকতাও পরিবেশিত হয়। তবে এগুলি গৌণ। কুশান একান্তই রামায়ণের গান। মহাকাব্যের মূল ধারাটিই এখানেই প্রাধান্য লাভ করে।

বর্তমানে রামায়ণের কোনো বিশেষ কাহিনী অবলম্বন করে যাত্রা বা পালার আকারে আজকাল কুশান গান পরিবেশন করা হয়। বিভিন্ন চরিত্রে অংশগ্রহণকারীরা চরিত্রানুযায়ী পোশাকে সজ্জিত হয়ে আসরে অভিনয় করেন। মূল গায়েন সূত্রধরের কাজ করেন। বর্তমানে কুশান গান পরিবেশনের জন্য বিভিন্ন পূজা-পার্বণ, মেলা, লোকউৎসব, উপলক্ষ প্রয়োজন পড়ে না। কুশান গান পরিবেশনে কোনো নির্দিষ্ট সময় থাকে না। যেকোনো সময় যেকোনো অনুষ্ঠানে কুশান গান গাওয়া হয়। কিন্তু, পূর্বে পূজানুষ্ঠানের সময় পূজা-প্রাঙ্গণে কুশান গানের আসর বসত। দেখা গেছে, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে বাংলা একাডেমি সীমিতভাবে কুশান গানের আয়োজন করছে। তবে সখের বসে, শুধু আনন্দ উপোভোগ করার জন্য গ্রামের কাউকে আজকাল কুশান গানের আসর করতে দেখা যায় না। তাছাড়া দেশের সামাজিক-রাজনৈতিক-ধর্মীয় দিক বিবেচনা করে কুশান দলের নিরাপত্তা বিধানে ব্যর্থ হচ্ছেন আয়োজকগণ। কুশান দলের অবস্থানের দিক বিবেচনা করলে দেখা যাবে, দেশের উত্তরবঙ্গের কুড়িগ্রাম অঞ্চল কুশান দলের শিল্পীগোষ্ঠীর বসবাস। কুশান গানের দলে শিল্পীদের সংখ্যা বেশি হওয়ায় এই গান আয়োজন ব্যয়সাধ্য। আবার একথাও ঠিক যে, শিল্পীদের নিজেদের আবাস থেকে দূরে নতুন কোনো স্থানে নিয়ে গান পরিবেশন করতে ব্যয়ের পরিমান অনেক বেশি পড়ে। এই ব্যয় গ্রামের নিম্নবিত্তের কোনো মানুষের পক্ষে এককভাবে নেয়া সম্ভব হয় না। তবে পূজা-পার্বণে কুড়িগ্রাম ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে মন্দির কমিটি কুশান গানের আসর করে এধরনের পরিবেশনরীতির পৃষ্ঠপোষকতা করে থাকেন।

যুগের চাহিদা অনুযায়ী কুশান গান বা পালা বিভিন্ন চরিত্রের মাধ্যমে যে ভাবে পরিবেশিত হতে শুরু করেছে তাতে আধুনিক নাটকের ছোঁয়া লাগছে। ফলে কুশান গানের সাঙ্গীতিক মাধুর্য ও লালিতা অনেকাংশে হ্রাস পাচ্ছে। আবার আধুনিক রুচিও বিকৃতভাবে প্রতিফলিত হওয়ার ফলে পালাগানের চরিত্রও বিঘ্নিত হচ্ছে। কুশান গানের লৌকিক চরিত্র বজায় রাখতে না পারলে এর নিজস্বতা রক্ষিত হবে না। আবার যুগের মর্জি বদলের সঙ্গে পালাগানেরও আঙ্গিকের পরিবর্তনকে অস্বীকার করবার উপায় নেই। এদিক থেকে কুশান গানের সাথে অন্যান্য পরিবেশনার তুলনা করলে দেখা যাবে, কৃষ্ণলীলার আসরে আদিতে রাধাকৃষ্ণ লীলার নাট্যরূপ প্রদর্শিত হলেও পরবর্তীতে তা চৈতন্যদেবের জীবনী মাহাত্ম্য প্রকাশক পরিবেশনারীতি হিসেবে পরিবর্তীত হয়েছে। একইভাবে গম্ভীরার ধর্ম নির্ভর পরিবেশনা ইসলামি রাষ্ট্র হিসেবে এ ভূখণ্ডের জন্ম লাভের কালে হয়ে উঠেছে ধর্মনিরপেক্ষ পরিবেশনা। এমনকি, কবিগান থেকে বিচারগান; ঢপকীর্তন থেকে ঢপযাত্রা; লীলানাট্য থেকে যাত্রা ইত্যাদি নাট্যধারার উদ্ভব হয়েছে সেই যুগ পরিবর্তনের সূত্র ধরেই। ঐতিহ্যবাহী নাট্যধারায় এখনো এই ধারাবাহিকতা বহমান। যেমন গত শতকের নব্বইয়ের দশকে কুষ্টিয়া অঞ্চলে প্রচলিত কিচ্ছা পরিবেশনা থেকে আখ্যান ও কিছু গানের সুর ধার নিয়ে গ্রামের সাধারণরাই উদ্ভব করেছেন নসিমন গান বা নসিমন যাত্রা, যা সারাদেশের শ্রমজীবী মানুষের কাছে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করে। ফলে ‘কুশান গান’ নাট্যরীতি থেকে নতুন নাট্যরীতির উদ্ভব কোনো বিস্ময়ের বিষয় নয়।

বাংলাদেশের ফোকলোরের অন্যান্য উপাদানের মতো লোকনাটকও অবহেলার শিকার। এগুলোর প্রতি রাষ্ট্রীয় বা জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনো আগ্রহ লক্ষ করা যায় না। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এগুলো শিক্ষা করার কোনো তাগিদও দেখা যায় না। একটি অন্যতম উপাদান হওয়া সত্ত্বেও দেশিও সংস্কৃতি প্রাতিষ্ঠানিক কোনো স্বীকৃতি পায়নি। ফলে এগুলো পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে দিন দিন বিলুপ্ত হতে বসেছে। এছাড়া আধুনিক বিভিন্ন নাটকের প্রতাপে এইসব পরিবেশনা হরিয়ে যাচ্ছে। প্রচার মাধ্যমে আধুনিক আঙ্গিকের নাটক পরিবেশনা, প্রচার-প্রচারণা যথেষ্ট। সেই তুলনায় লোকনাটক প্রচার মাধ্যমে গুরুত্ব পায় না। ফলে দেশিও নাটকের প্রতি মানুষের আগ্রহ তৈরি হচ্ছে না।

বাংলাদেশে ‘কুশান গান’ চর্চা অনেকটাই সংকুচিত। এধরনের পরিবেশনা দেশের পুঁজির সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে পারছে না, ব্র্যান্ডিং এর অভাব, বিদেশি সংস্কৃতির প্রভাব, মিডিয়ার প্রচারণা, বিদেশি আগ্রাসন, যন্ত্র নির্ভর পরিবেশনা বেড়ে যাওয়া প্রভৃতি কারণে কুশান গানের পরিবেশনা কমে যাচ্ছে। নতুন প্রজন্ম এইসব পরিবেশনার প্রতি খুব একটা আগ্রহ প্রকাশ করছেন না। আবার কুশান গান বিলুপ্তির অন্যতম কারণ হলো এর বিষয়-বৈচিত্র, আঙ্গিক এবং পরিবেশনরীতি সম্বন্ধে কোনো লিখিত নিয়মকানুন না থাকা। মুখে মুখে রচিত ও নাট্যগীতের আশ্রয়ে মৌখিকভাবে পরিবেশিত হয়ে থাকে। গ্রামের অশিক্ষিত বা অল্পশিক্ষিত মানুষ বংশপরাম্পরায় কিংবা মৌখিকভাবে এসব বহন করে আসছেন। ফলে তাদের মধ্যে এসবের স্থায়িত্ব নিয়ে কোন সচেতন প্রয়াস লক্ষ করা যায় না। কুশান গানে অংশগ্রহণকারী সদস্যগণ এর পরিবেশনরীতি লিখে রাখার প্রয়োজনবোধ করেন না। লক্ষ করলে দেখা যাবে, লোকনাটকের অন্যান্য পরিবেশনার মতো কুশান গানের পরিবেশনাও আঞ্চলিক। ভাষা ও পরিবেশনার দিক দিয়ে এ আঞ্চলিকতার সীমাকে অতিক্রম করতে পারছে না। যার কারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অঞ্চলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে। এদিকে কুশান গানের আঞ্চলিকতা আর এর প্রতি দেশের মানুষের চরম উন্নাসিকতার ফলে কুশান গানের চর্চা অনেকটাই ক্ষীয়মাণ। তবে, আঞ্চলিকতার সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে সর্বজনগ্রাহ্য পরিবেশনরীতি নিরূপণ করে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে পারলে ভবিষ্যতে এর উন্নতি সম্ভব।

এদেশে বেশ কয়েকটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান রয়েছে যেমন- বাংলা একাডেমি, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি ইত্যাদি। এসকল প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশের সংস্কৃতি নিয়ে চর্চা ও গবেষণা করে। এ বিষয়ে বাংলা একাডেমি লোকনাটক বিষয়ক কয়েকটি গ্রন্থ প্রকাশ করেছে। ঢাকার সেগুনবাগিচায় অবস্থিত জাতীয় শিল্পকলা একাডেমি আয়োজিত জাতীয় লোকনাট্য উৎসবে ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দে পরিবেশিত পরীক্ষণ নাট্যশালায় কুশান গানের আয়োজন করা হয়। আবার ঢাকার সেগুনবাগিচায় অবস্থিত মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের মুক্তমঞ্চে ১৩ ডিসেম্বর ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে কুশান গানের আয়োজন করা হয়। এছাড়া অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলো কুশান গান নিয়ে চর্চা করার প্রবণতা একেবারেই নগণ্য। তবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতা পেলে ভবিষ্যতে লোকসংস্কৃতির সমৃদ্ধ উপাদান হিসেবে কুশান গানের সমৃদ্ধি সম্ভব।

সম্প্রতি বেশ কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সাংস্কৃতিক বিভিন্ন কর্মকান্ডকে গুরুত্ব দিচ্ছে। তবে সেখানে স্বতঃস্ফুর্তভাবে লোকনাটক চর্চার প্রবণতা বা চর্চাকারীদের গুরুত্ব দেওয়া অপেক্ষা তাদের বিজ্ঞাপণের কাজেই এগুলো ব্যবহৃত হচ্ছে। তা হলেও আশার কথা এই যে, প্রন্তিক এলাকার শিল্পীরা এইসব বহুজাতিক কোম্পানি দ্বারা কিছুটা হলেও অর্থনৈতিকভাবে উপকৃত হচ্ছে। আবার বিজ্ঞাপণের সফল প্রয়োগের ফলে এটাও লক্ষ করা যায় যে, দেশীয় নাটকগুলোর জনপ্রিয়তা এখনো কমেনি। বাংলাদেশের প্রচার মাধ্যমগুলোতে বরাবরই দেশীয় সংস্কৃতি উপেক্ষিত। কী প্রিন্ট মিডিয়া, কী ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া সকল ক্ষেত্রেই দেশীয় সংস্কৃতির উপাদানকে তুলে ধরার ক্ষেত্রে দেশের প্রচার মাধ্যমগুলোর চরম উদাসীনতা রয়েছে। এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রাথমিক, মাধ্যমিক কিংবা উচ্চমাধ্যকি পর্যায়ের পাঠ্যপুস্তকগুলোতে দেশীয় সংস্কৃতির উপস্থিতি যথেষ্ট নয়। দেশীয় সংস্কৃতিক উপাদানের উপস্থিতি না থাকায় প্রথম পর্যায়ে শিশুরা দেশীয় সংস্কৃতির প্রতি অনাগ্রহী হয়ে ওঠে। এ কারণে দেশের মানুষের অভিজ্ঞতা, ভূয়োদর্শন বা লোকজ্ঞানের প্রতি শিশুতোষ মনে কোনো প্রকার কৌতূহল তৈরি হয় না। ধীরে ধীরে তারা এ বিষয়ে অনাগ্রহী হয়ে ওঠে। এদিক দিয়ে কুশান গানের প্রচার প্রসার একেবারেই শুন্যের কোঠায়। তবে মিডিয়া প্রচারণা ও শিক্ষা ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক উপাদান হিসেবে লোকনাটকের গুরুত্ব পেলে কুশান গান চর্চার পথ ভবিষ্যতে ফলপ্রসূ হবে।

 

 

গ্রন্থপঞ্জি

১. সাইমন জাকারিয়া (এপ্রিল ২০০৮)। বাংলাদেশের লোকনাটক: বিষয় ও আঙ্গিক-বৈচিত্র। বাংলা একাডেমি। পৃ. ১৮৪-১৯৮।

২. জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘নাট্যকলা ও পরিবেশনা বিদ্যা বিভাগ’ কর্তৃক ১১ ডিসেম্বর ২০১৬ আয়োজিত কুশান গানের আসরে কুড়িগ্রামের বিখ্যাত শিল্পী কৃপাসিন্ধু রায়ের ব্যাখ্যা অনুসারে।

৩. আশুতোষ ভট্টাচার্য (২০০৫)। বাংলার লোকসংস্কৃতি। নয়াদিল্লি: ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট চতুর্থ মুদ্রণ। পৃ. ১৩৬।

৪. পবিত্রকুমার গুপ্ত (ডিসেম্বর ২০০০)। গ্রামীণ লোকনাটক: কুশান। সনৎ কুমার মিত্র [সম্পা.] বাঙলার গ্রামীণ নাটক। কলিকাতা। পৃ. ১৯১-১৯৫।

৫. আব্দুল ওয়াহাব (এপ্রিল ২০০৫)। ড. বরুণকুমার চক্রবর্তী [সম্পা]। বঙ্গীয় লোকসংস্কৃতি কোষ। কলকাতা। পৃ. ১০০।

 

Leave A Reply
6 Comments
  1. Qicpmv says

    purchase semaglutide pills – purchase glucovance online cheap DDAVP cost

  2. Wxtnqy says

    buy prandin 2mg online cheap – jardiance without prescription buy empagliflozin pills for sale

sativa was turned on.mrleaked.net www.omgbeeg.com

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More