নার্সিসাস : গ্রীক পুরাণের আত্মপ্রেমি এক যুবকের উপাখ্যান

2

নার্সিসাস,নার্সিসিজম, নার্সিসিস্ট এই শব্দগুলোর সাথে কমবেশি আমরা সবাই পরিচিত ৷ মূলত আত্মপ্রেম বা আত্মমগ্নতাই নার্সিসিজম এর বৈশিষ্ট্য ৷ আজকাল অতিরিক্ত সেলফি রোগে আক্রান্ত লোক চোখে পড়ে প্রায় সবজায়গাতেই ৷ এরাই নার্সিসিস্ট হিসেবে খ্যাত ৷

আবার নার্সিসাস (Narcissus) বা নার্সিসিসি একটি ডেফোডিল জাতীয় ফুলের নাম । গ্রীক পুরাণ অনুসারে এই ফুলের জন্ম নার্সিসাস নামের একজন অপূর্ব সুন্দর যুবকের দেহ থেকে ৷ আজকের পর্বে আলোচনা করা হবে গ্রিক মিথলজির নার্সিসাসের চমকপ্রদ কাহিনী নিয়ে ৷

গ্রীক পুরাণের নদী দেবতা সিফিসাস এবং জলপরী লিরিউপির পুত্র নার্সিসাস ৷ অপূর্ব সৌন্দর্যের অধিকারী নার্সিসাসের রূপের বর্ণনা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব ছিল না ৷ আর এই রূপ মাধূর্যই তাকে অহংকারী আর আত্মগর্বিত যুবকে পরিণত করে ৷ যেকোন মেয়ে এমনি পরীরাও তাকে দেখামাত্রই তার প্রেমে পড়ে যেত ৷ নার্সিসাসের জন্মের পর তার মা তাকে নিয়ে গেলেন এক অন্ধ ভবিষ্যৎ-বক্তা টাইরেসিয়াসের কাছে ছেলের আয়ুষ্কালের ব্যাপারে জানতে । জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমার ছেলে কতদিন বাঁচবে?’ টাইরেসিয়াস বললেন, ‘এই ছেলে একটা লম্বা জীবন পাবে কেবল যদি সে নিজেকে কখনো না দেখে।’

নার্সিসাস
নার্সিসাস
Source: Thanasi’s Olympus Greek Restaurant

কিন্তু ছোটবেলা থেকেই নিজের রূপের প্রশংসা শুনতে শুনতে অদ্ভূত অহংকার জাগে নার্সিসাসের মনে ৷ সে শুধু নর নয় নারীদেরকেও তার তুলনায় রূপে নিকৃষ্ট ভাবা শুরু করে ৷ কারও ভালোবাসায় সাড়া দিতেন না বরং প্রত্যেকেই হয়েছিলেন প্রত্যাখ্যাত ও তার নিষ্ঠুরতার শিকার । তিনি মনে করতেন তার যোগ্য ও সমকক্ষ কেউ নেই। তিনি যখন জানতে পারতেন কোন অপ্সরী তার প্রেমে পড়েছে তাহলে সেই অপ্সরীকে তিনি ঘৃণাভরে অভিশাপ দিতেন বা হত্যা করতেন । একবার এমিনিয়াস নামক এক যুবক নার্সিসাসের প্রেমে মজেছিল ভীষণ রকম। এই এমিনিয়াস তার আরও পুরুষ অনুরাগীদের ইতোমধ্যে ফিরিয়ে দিয়েছে শুধুমাত্র নার্সিসাসকে পাওয়ার জন্য। কিন্তু নার্সিসাস ফিরিয়ে দিল তাকে এবং একটা ছুরি উপহার দিল। এর পেছনে ছিল এক গোপন ষড়যন্ত্র৷  নার্সিসাসের গোপন ইচ্ছাও পূরণ হলো সেদিন, যেদিন এমিনিয়াস সেই ছুরি দিয়ে আত্মহত্যা করল নার্সিসাসেরই দরজার সামনে ।

মিথলজিতে নার্সিসাসের নিষ্ঠুরতার সবচেয়ে বড় উদাহরন হিসেবে দেবী অপ্সরী ইকোর নামটি উল্লেখযোগ্য ৷ ইকো ছিলেন অপূর্ব মিষ্টি কন্ঠস্বরের অধিকারী। কিন্তু দূর্ভাগ্যক্রমে হেরা দেবীর অভিশাপে অন্যের কথার প্রতিধ্বনি ফিরিয়ে দেওয়া ছাড়া নিজে থেকে কোন কথা বলতে পারতো না ইকো ৷ তিনি বাস করতেন গভীর জঙ্গলে ও পাহাড়ে ৷ তার দুর্ভাগ্য আরো গাঢ়তর হয়ে গেল যখন সে নার্সিসাসের প্রেমে পড়লো ৷

ইকো
ইকো
Source: Anita’s Notebook

নার্সিসাস বনে যেত শিকার করার জন্য আর বনপরী ইকোও তাঁর অপেক্ষায় পথ চেয়ে থাকতো ৷ সে নার্সিসাসের পেছনে পেছনে ঘোরে কিন্তু কথা বলতে পারে না তার সাথে ৷ একদিন সুযোগ পেয়ে গেল সে ৷ নার্সিসাস তার সঙ্গীদের ডাকছিল “কেউ এখানে আছে?” ইকো আনন্দিত স্বরে প্রতিধ্বনি করল শেষ শব্দটি, “আছে, আছে ৷” গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ইকোকে নার্সিসাস ডাকলো “এসো”৷ ইকো আবারও উৎফুল্ল হয়ে জবাব দিল “এসো” ৷ আর দুবাহু বাড়িয়ে বেরিয়ে এলো বন থেকে কারণ স্বয়ং নার্সিসাস তাকে ডেকেছে ৷ কিন্তু অহংকারী নার্সিসাস বিরক্তিতে ফিরিয়ে নিলো তার মুখ ৷ সে বললো, ‘’আমি বরং মারা যাবো কিন্তু তোমাকে কাছে আসতে দিব না ৷” ইকো তার লজ্জা লুকানোর জন্য প্রবেশ করলো এর নির্জন গুহায় ৷ তাকে সান্ত্বনা দেবার ক্ষমতা ছিল না কারো ৷ ধীরে ধীরে বেদনা আর কাতরতায় তার শরীরও লীন হয়ে গেলো। শুধু রয়ে গেলো তার কন্ঠস্বর, যা অন্যের উচ্চারিত শব্দকে অনুকরণ করে ।

ইকো এবং নার্সিসাস
ইকো এবং নার্সিসাস
Source: Thanasi’s Olympus Greek Restaurant

নার্সিসাস একইভাবে আরো অসংখ্য পরীকে আকৃষ্ট করে শেষে তাদেরকে তাচ্ছিল্যের সাথে দূরে সরিয়ে দিতো। এভাবে অপমানিত হয়ে তারা মন থেকে চাইত যে, ভালোবেসেও ভালোবাসা না পাওয়ার কষ্ট কেমন তা নার্সিসাস একবার বুঝুক। এমন প্রত্যাখাতদের মধ্যে একজন একবার প্রতিশোধের দেবী নেমেসিসের কাছে প্রার্থনা করলো, “হে দেবী নেমেসিস, নার্সিসাস যদি কখনো প্রেমে পরেও, সে যেন ভালোবাসা না পায়”। নেমেসিস প্রার্থনা শুনেছিলেন এবং নার্সিসাসের ভাগ্য নির্ধারণ করে ফেললেন।

নেমেসিস
নেমেসিস
Source: Anita’s Notebook

নার্সিসাসের নিয়তি নিয়ে নানান গল্প চালু আছে তবে সবচেয়ে অধিক প্রচলিত গল্পটি এরকম ৷

নার্সিসাস নিজের রূপ নিজ চোখে স্পষ্টভাবে কোনদিন দেখেননি । এই দেখাটাই তার জীবনে পরিণতি ডেকে আনে । হরিণ শিকার করার পর ক্লান্ত নার্সিসাস একদিন পানির আশায় একটি হ্রদের পাড়ে আসলেন যা জগতের সবচেয়ে স্বচ্ছ পানির হ্রদ যেখানে কোনদিন কেউ হাত দেয়নি, কখনো কোন পশু এর পানি পান করেনি। নার্সিসাস যখন পানির জন্য নিচু হলেন তখনি প্রথমবারের মত নিজেকে স্পষ্ট দেখতে পেলেন এবং পানিতে প্রতিফলিত নিজের রূপ দেখে মুগ্ধ বিস্ময়ে বার বার বলতে লাগলেন, “এত সুন্দর! এত সুন্দর!” নিজের প্রতিফলনকে ছুঁয়ে দেখার জন্য তিনি পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন এবং পানিতে ডুবে মারা গেলেন ।

নার্সিসাস
নার্সিসাস
Source: http://anitasnotebook.com

আরেকটি গল্প আছে যেখানে বলা হয়, একদিন অনেক রৌদ্রের সময় নার্সিসাস একটা জলাশয়ের ধারে এল। সে যখনই জলের দিকে তাকাল, দেখল এক অপূর্ব জলদেবতা জল থেকে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে বুঝতে পারেনি যে ওই প্রতিবিম্ব তারই এবং সাথে সাথেই সে তার প্রতিবিম্বের প্রেমে পড়ে গেল । নার্সিসাস নিচু হয়ে প্রতিবিম্বকে চুমো খেতে গেল । ওই প্রতিবিম্বও তাকে একইভাবে চুমো খেতে এল । এটাকে পারস্পরিক সম্মতি মনে করে নার্সিসাস তার প্রতিবিম্বকে জল থেকে টেনে তোলার জন্য হাত বাড়াল। জলে ঢেউ উঠতেই সেই অপূর্ব জলদেবতা চলে গেল । সে অস্থির হয়ে গেল। কোথায় চলে গেল তার ভালোবাসার মানুষ? যখন জল আবার স্থির হয়ে এল, জলদেবতাও ফিরে এল। নার্সিসাস তাকে জিজ্ঞেস করল, “কেনো? হে সুন্দর, কেনো তুমি আমার কাছে থেকে দূরে থাকো, কেনো আমাকে এড়িয়ে যাও ? আমার চেহারা নিশ্চয়ই তোমাকে চলে যেতে বাধ্য করে না! পরীরা আমাকে ভালোবাসে। আমাকে পাওয়ার জন্য তারা ব্যাকুল। তোমাকেও আমার প্রতি বিরক্ত দেখা যাচ্ছে না। যখন আমি আমার বাহু বাড়িয়ে দিই, তুমিও তাই করো। তুমি আমাকে দেখে হাসো এবং আমার মতো তুমিও মাথা নেড়ে সায় দাও”। আবার হাত বাড়ালো নার্সিসাস। জলদেবতাও আবার চলে গেল। জল ছুঁলেই জলদেবতা অদৃশ্য হয়ে যায়, এতে নার্সিসাস খুব ভয় পেয়ে গেল। সে আর জলের দিকে হাত বাড়াল না। একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকল তার প্রতিবিম্বের প্রতি।  হতাশায় নার্সিসাস শুধু কাঁদত। যেহেতু সে কাঁদত, ইকোও তার সাথে কাঁদত। সে নড়াচড়া করত না, খেত না, কোন কিছু পান করত না। শুধু হতাশায় নিমজ্জিত হতে থাকল । অলীক প্রেমিকের শোকে তার শরীর শুকিয়ে যেতে থাকল, তার সৌন্দর্য ম্লান হতে থাকল । যেসকল পরীরা তাকে ভালোবাসত তারা বারবার তাকে অনুরোধ করল সেই জলাধারের কাছ থেকে সরে আসতে। ইকোও তাদের সাথে সাথে অনুরোধ করল। কিন্তু নার্সিসাস যেন মন্ত্রমুগ্ধের মত অটল রইল। চিরদিনের মত সে জলাধারের পাশেই বসে থাকার ইচ্ছা দেখাল। এভাবে ভুগতে ভুগতে একসময় ইকোর মত নার্সিসাসও মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লো । ধীরে ধীরে তার শরীরও অদৃশ্য হয়ে গেল । পরীরা শোকে বিলাপ করতে থাকল। যেহেতু পরীরা বিলাপ করতে থাকল, ইকোও তাদের সাথে বিলাপ করতে থাকল। আর মাটিতে মিশে যাওয়া নার্সিসাসের শরীর থেকেই জন্ম নিল সেই ফুল গাছ যা ‘নার্সিসাস’ ফুল নামে পরিচিত ৷ বাংলায় অবশ্য একে  ‘নার্গিস’ ফুলও বলা হয় ৷

'নার্সিসাস' ফুল
‘নার্সিসাস’ ফুল
Source: John Scheepers

নার্সিসাসের এই স্বভাব থেকেই আত্মকেন্দ্রিকতা বা আত্মপ্রেম বোঝাতে ‘‘নার্সিসিজম’’ শব্দটি চালু হয়েছে । নার্সিসাস কমপ্লেক্সে ভোগা মানুষরা এই মোহ সহজে কাটিয়ে উঠতে পারে না ৷ নার্সিসিজম মূলত পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার বা ব্যক্তিত্বের সংকট ৷  এধরণের মানুষেরা এতই আত্মকেন্দ্রিক হয় যে তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করা খুবই কঠিন। একজন নার্সিসিস্ট মনে করেন তিনি বিশ্বের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ব্যক্তি । সবার মনোযোগ থাকা উচিৎ তার দিকে।

তথ্যসূত্র:

উইকিপিডিয়া

http://www.muktochintablog.com

http://myths.e2bn.org/mythsandlegends/userstory948-story-of-echo

Leave A Reply
2 Comments
  1. Bmqijp says

    buy rybelsus for sale – glucovance cheap order desmopressin spray

  2. Chudwg says

    terbinafine over the counter – lamisil drug purchase griseofulvin generic

sativa was turned on.mrleaked.net www.omgbeeg.com

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More