লাহোর প্রস্তাবঃ স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নের বীজ

 

স্বাধীন বাংলাদেশকে যদি একটি ফলবান বৃক্ষের সাথে তুলনা করা হয় তবে নির্দ্বিধায় সে বৃক্ষের বীজ ‘লাহোর প্রস্তাব’৷ ১৯৪৭ এ দুই জাতি তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে দেশ ভাগ, ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে জয়লাভ, ১৯৬৪ তে মাওলানা ভাসানীর ৫ দফা দাবি, ১৯৬৬ তে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৬ দফা উত্থাপন, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জয়লাভ, সর্বোপরি ১৯৭১ এ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সবকিছুতেই ছিলো লাহোর প্রস্তাবের প্রত্যক্ষ প্রভাব৷

বাংলাদেশের স্বাধীনতার এই বীজ যার হাত দিয়ে বপন করা হয়েছিলো তিনি  হলেন আবুল কাশেম ফজলুল হক৷ ১৯৪০ সালের ২২ মার্চ পাঞ্জাবের রাজধানী লাহোরে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়৷ এটি ছিল ২৭তম অধিবেশন৷ এতে সভাপতিত্ব করেছিলেন  মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ৷ ফজলুল হক লাহোর সম্মেলনে পৌঁছালে উপস্থিত জনতা ‘শেরে বাংলা জিন্দাবাদ’ ধ্বনি দিয়ে সকলে দাঁড়িয়ে যায়৷ ফুলের মালা দিয়ে ফজলুল হককে ডুবিয়ে দেওয়া হয়৷

২৩ মার্চ বিকাল ৩.৪৫ মিনিটে শেরে বাংলা একে ফজলুল হক লাহোর প্রস্তাব উত্থাপন করেন৷  প্রস্তাবটি হল:

“নিখিল ভারত মুসলিম লীগের এই অধিবেশন এই মর্মে অত্যন্ত সুচিন্তিত অভিমত প্রকাশ করছে যে নিম্নোক্ত মৌলিক আদর্শসমূহকে ভিত্তি হিসেবে না ধরলে অপর যে কোন নীতি ও আদর্শের ভিত্তিতে প্রণীত শাসন-তান্ত্রিক পরিকল্পনা কার্যকরী এবং মুসলমানের জন্য গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হবে না৷ নিখিল ভারত মুসলিম লীগ তথা এ দেশের কয়েক কোটি মুসলমান দাবি করছে যে, যে সব এলাকা একান্তভাবেই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ যেমন, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এলাকা এবং ভারতের পূর্বাঞ্চল; প্রয়োজন অনুযায়ী সীমানার রদবদল করে ঐ সকল এলাকাকে ভৌগোলিক দিক দিয়ে এককভাবে পুনর্গঠন করা হোক যাতে স্বাধীন ও স্বতন্ত্র স্টেটস হিসেবে সংশ্লিষ্ট অঞ্চল-দ্বয় সম্পূর্ণ স্বায়ত্তশাসিত ও সার্বভৌমত্ব লাভ করতে পারে৷”

প্রস্তাবটি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়৷

লাহোর প্রস্তাবে ভারতের পূর্বাঞ্চল বাংলা-আসাম নিয়ে একটি স্বাধীন দেশ গঠনের পরিকল্পনা ছিলো৷ কিন্তু তা আর হয়নি৷ প্রস্তাবের শুরুতেই ‘একাধিক রাষ্ট্রের’ স্থলে একটি রাষ্ট্র শব্দ জুড়ে দিয়ে মুসলমান অধ্যুষিত ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের নেতাদের কাছে বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়৷ জনগণের মাঝেও এটা আলোড়ন তোলে৷ ১৯৪৬ সালের ৮ই এপ্রিল পশ্চিমাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চল রাষ্ট্রসমূহের পরিবর্তে  দুই ইউনিট নিয়ে একটি রাষ্ট্র গঠন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়৷

১৯৪৬ সালে সাধারণ নির্বাচন হলে স্বায়ত্তশাসন অর্জনের জন্য পূর্ব বাংলার মুসলিম জনগোষ্ঠীর মাঝে যে বিপ্লবের বীজ জন্ম নেয় তা পরবর্তীতে স্বাধীনতার দাবিতে পরিণত হয়৷ যার ফল স্বরূপ ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ হয়ে যায়৷ জন্ম নেয় পাকিস্তান নামক একটি নতুন রাষ্ট্র, যার মূলে ছিলো লাহোর প্রস্তাব৷

যে স্বপ্ন নিয়ে পূর্ব বাংলার জনগণ পাকিস্তান রাষ্ট্র কায়েম করেছিলো সে স্বপ্নের মোহভঙ্গ ঘটে পরবর্তীতে৷ তারা লক্ষ করলো পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য চরম আকার ধারণ করে আছে৷ তাই, পূর্ব বাংলার জনগণের মুক্তির লক্ষে লাহোর প্রস্তাব অনুযায়ী যুক্তফ্রন্ট তাদের নির্বাচনী ম্যানিফেস্টোর ১৯ নং দফায় পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের অঙ্গিকার করে৷ আওয়ামী মুসলিম লীগের নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্টের এই দফা জনগণ সমর্থন করে এবং নির্বাচনে বিপুল ব্যবধানে জয় লাভ করে৷

স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে মাওলানা ভাসানী ছিলেন আপোশহীন৷ তিনি ১৯৬৪ সালে ৫ দফা দাবি উত্থাপন করেন৷ তিনি বলেন, “ঐতিহাসিকগণ লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের জন্য আপোষহীন সংক্রমণের মধ্যেই পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার পর্বতপ্রমাণ অর্থনৈতিক বৈষম্য, আঞ্চলিকতা ও সর্বপ্রকার বৈষম্যমূলক আচরণ হতে সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত, ধনতান্ত্রিক শোষণ ষড়যন্ত্র হতে পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে পাঁচ কোটি তথা সারা পাকিস্তানের দশ কোটি মানুষের সত্যিকার মুক্তি নিহিত রয়েছে৷”

বাঙালীর মুক্তির সনদ ‘ঐতিহাসিক ৬ দফা’র প্রথম দফাটি প্রণয়ন হয় লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে৷ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লাহোরে এ দাবি উত্থাপন করেন যেখানে  পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের কথা বলা হয়েছে যা আসলে লাহোর প্রস্তাবের মূলকথা৷ যার ফলশ্রুতিতে পরবর্তীতে আগরতলা পরিকল্পনা মামলা ও ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান হয়৷

১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে জয় লাভ করে কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকরা বাঙালীদের হাতে ক্ষমতা দিতে গড়িমসি করে৷ বাংলার জনগণের হৃদয় তখন স্বাধীনতার জন্য ব্যাকুল৷ দীর্ঘ ২৩ বছরের পাকিস্তানি  শাসনের শিকল ছিন্ন করে ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টি করে৷ লাহোর প্রস্তাবে যা ভাবা হয়েছিল এত দিনে যেন সেটাই বাস্তবায়িত হয়ে গেল৷