এস্কিমোদের অদ্ভুত জীবনাচার
কিছুদিন আগেই একটি জার্নালে এস্কিমোদের সম্বন্ধে পড়েছিলাম। সেখান থেকেই আগ্রহ জাগলো এস্কিমোদের সম্বন্ধে জানতে আর ওখান থেকে ইতিবৃত্তর জন্য লেখার লোভটাও সামলাতে পারলাম না। অদ্ভুত এক জীবন প্রণালীতে ঠাসা এস্কিমোদের জীবন। এডভেঞ্চার প্রিয়রা পড়ে দেখতে পারেন। আশা করি খুব বেশি খারাপ লাগবেনা।
এস্কিমোরা অনেক নামে পরিচিত; যেমন:”Eskimos” “Inuit-Yupik” “Inuitpiat-Yupik” সহ আরো অর্ধ ডজন নামে। উত্তর মেরুতে এদের বসবাস। বরফ সমুদ্রে আমাদের মতো এদের না আছে দিন, না আছে রাত। একাধারে ৬মাস দিনের পর আসে ৬ মাস রাত। সেখানে বসবাস করা এস্কিমো বা ইনুইট জাতির মানুষ বাড়ি বানায় বরফ দিয়ে। তাদের খাদ্যাভ্যাসও আমাদের থেকে একদম ভিন্ন। বিভিন্ন ধরণের সামুদ্রিক মাছ আর জলজ উদ্ভিদ আর নানান পশু পাখির গোসতই তাদের প্রধান খাদ্য উৎস। চলুন এস্কিমোদের জীবন আচার সম্বন্ধে বেশ কিছু মজার তথ্য জেনে নেয়া যাক।
ছয় মাস দিন ছয় মাস রাত:
পৃথিবীর সবচেয়ে উত্তরতম বিন্দু উত্তর মেরু। আর্কটিক বরফ অঞ্চল। বরফের স্রোতে কখনোই স্থির থাকেনা উত্তর মেরু। এর নীচে কোন মাটি নেই, শুধু সমুদ্র আর সমুদ্র। আর্কটিক মহাসাগরের একদম মধ্যাংশে অবস্থিত এই উত্তর মেরু। যেখানে সারা বছরই থাকে ভয়ংকর বরফে আচ্ছাদিত। পৃথিবীর ৯০ ডিগ্রি অক্ষাংশ হল এই উত্তর মেরু। সুতরাং অবস্থানগত দিক থেকে এটি পৃথিবীর অন্যসব অঞ্চল থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। পৃথিবীর অন্য দেশগুলোতে যে প্রত্যহ দিন রাতের হিসেব তা এখানে কাজ করেনা। এখানে ঋতু বলতেই দুটি, তথা গ্রীষ্মকাল আর শীতকাল। উত্তর মেরুতে গ্রীষ্মকাল থাকে ১৮৭ দিন। গ্রীষ্মের এইদিনগুলিতে সবসময়ই রোদ থাকে। আর শীত থাকে ১৭৮ দিন। এ সময় একটানা রাত থাকে। কোন সূর্যের আলোর দেখা মেলেনা এসময়ে। এমনকি এখানে নেই কোন টাইম-জোনও। এখানে বাইরের লোকদের কাছে দিন রাত বলে কিছু নেই।
বরফের তলদেশে সমুদ্র:
আর্কটিক হল বরফের সমুদ্র। মহা-সমুদ্রের আস্তরণে সৃষ্টি উত্তর মেরুর। চারদিক পুরু বরফে ঘেরা। আর বরফের নিচেই বইছে উত্তাল সমুদ্র। এই বরফের মধ্যেই মাছও সংগ্রাম করে বেঁচে থাকে। যারা বেয়ার গিলসের “ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড” দেখেছেন তারা আরো ভালো জেনে থাকবেন। এই সমুদ্রে আছে সামুদ্রিক নাম না জানা উদ্ভিদ আর অপরিচিত সব প্রাণী। এই বরফের প্রাচীরের কোন শেষ নেই। কেউ জানেও না যে কোথায় এর শেষ। মাঝেমাঝে বড় বড় আইসবার্গও দেখতে পাওয়া যায়। অবশ্য এই বড় বড় আইসবার্গগুলো এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ভেসে বেড়ায়। বরফগুলো একদম ধূসর সাদা। অবশ্য এখানকার পানি বেশ বিশুদ্ধ হলেও এর লবণাক্ততার জন্য না ফুটিয়ে খেলে হাইপোথার্মিয়া হয়ে যাবার জোর আশঙ্কা রয়েছে। পৃথিবীর মোট বরফের ৯০% বরফ এখানে জমা থাকে। তাহলে বুঝুন যে এখানে কি ভয়াবহ পরিমাণে পানি জমা আছে।
সর্বোচ্চ তাপমাত্রা শূণ্য ডিগ্রি সেলসিয়াস:
গ্রীষ্মকালে আইসবার্গগুলো এলোপাথাড়ি ঘুরে বেড়ায় পুরো আর্কটিক জুড়ে। তবে শীতে এরা এক জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। এখানে দুই ঋতুর আবহাওয়া হলেও গ্রীষ্মে ছয় মাসের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াসের নীচে। আর শীতকাল এলে ছয় মাসের জন্য আধার নেমে আসে পুরো আর্কটিক জুড়ে। অর্থাৎ গ্রীষ্ম আর শীত নেই এখানে। সারাবছরই থাকে ভয়ংকর ঠাণ্ডার আবরণে পরিপূর্ণ। অবশ্য বিজ্ঞানীরা শীত গ্রীষ্ম ছাড়াও আরো শরৎ ও বসন্ত ঋতুর সন্ধান পেয়েছে। তবে এদের ব্যাপ্তি খুবই সংক্ষিপ্ত। এক সপ্তাহ থেকে ৩/৪ দিনেরও কম। শীতকালে আকাশ পরিষ্কার থাকে। সমুদ্র বরফে ঘেরা, জলীয় বাষ্প নেই, মেঘও নেই তাই বৃষ্টিও হয়না। শীতের শেষ দিকে অবশ্য কিছু তুষারপাত হয়। একটা তথ্য জেনে রাখা ভালো যে, শীতে উত্তর থেকেও রাশিয়ার কিছু অংশে বেশি ঠাণ্ডা পড়ে। বিশেষত প্রায় জন-মানবহীন সাইবেরিয়াতে।
শিকারি এস্কিমো:
আপনি যদি সংগ্রামী কোন মানুষ দল দেখতে চান আমি তাহলে বলব যে, এস্কিমোদের দেখতে আর্কটিক মেরুতে যান। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা ও প্রতিকূল পরিবেশের সাথে পাল্লা দিয়ে চলে তাদের জীবন। কোন স্থায়ী মাটি নেই বলে এরা কিছু ফলাতে পারেনা। বরফ গলিয়ে পানি তৈরি করেই নিত্য দিনের কাজ সারে এরা। এই ঠাণ্ডায়ও যেসব পশু উত্তর মেরুতে টিকে আছে তাদের শিকার করেই জীবনধারণ করে এই এস্কিমোরা। এখানে পাওয়া যায় আর্কটিক বল্গা প্রজাতির হরিণ, ভাল্লুক, হাঁস, খরগোশ, পাখি, ভেড়া, পেঙ্গুইন, শেয়াল আর কুকুর। মাছের মধ্যে সিল ও তিমি মাছ বেশ পরিচিত। শিকার করার জন্য তারা নিজেরা বিশেষ ধরণের বর্শা ও তীর তৈরি করে। পশুর দাঁত দিয়েই এসব তৈরি করা হয়। পোশাক হিসেবে পশুর চামড়াই তাদের প্রধান অবলম্বন। শীতের জন্য খাবার জমিয়ে রাখতে হয় গ্রীষ্মকালে নাহলে শীতে অভুক্ত থাকতে হয়। তাপমাত্রা কম থাকায় খাবার নষ্ট হয়না অনেক দিনেও। মাঝেমাঝে হিংস্র পশু শিকার করতে গিয়ে নিজেদেরও বিপদে পড়তে হয়। তবুও শতাব্দীকাল ধরে তারা চালিয়ে যাচ্ছে তাদের এই শিকারি জীবন। আর সামনেও কতকাল চলবে এভাবে তা বলা মুশকিল।
কুকুর টানা গাড়ি:
মূলত নর্থ আলাস্কা, কানাডা ও সাইবেরিয়াতে ইনুইটদের বসবাস। এখানে সবকিছুই বরফে ঢাকা কিন্তু নিচে সমুদ্র। তাই এখানে চলাচল ভীষণ বিপদজনক। তাই এখানে চলাচলের উপায় হল নৌকা ও কুকুরের গাড়ি। এস্কিমোদের ভাষায় এই কুকুরের গাড়িকে বলা হয় কামুতিক। খুব দ্রুত এরা বরফের উপর দিয়ে চলাচল করতে পারে। এই বিশেষ জাতের কুকুরদের কদর এস্কিমোদের কাছে ব্যাপক। যোগাযোগের উপায় হিসেবে ও শিকার করার জন্য কায়াক নামের ছোট নৌকাও ব্যবহার করে। মালামাল পরিবহণ ও যোগাযোগ রক্ষায় এদের ভূমিকা অনন্য।
বরফে তৈরি ইগলু ঘর:
উত্তর মেরুতে যেহেতু গাছপালা কম বা অল্প (যা আছে তা জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয়) তাই তাদের ঘরগুলো হয় অন্য উপাদানে তৈরি। এককথায় বরফের রাজ্যে বরফের তৈরি বাড়ি। শক্ত শক্ত বরফ খণ্ড দিয়ে তৈরি হয় এসব ঘর। পাঁচ ছয় ফুট উঁচু হয় এসব বাড়ি। অনেকটা গুহার মতো। অবশ্য শীত শেষে গ্রীষ্ম এলে এসব ঘরও গলে নদীতে চলে যায়। তখন এস্কিমোরা বাস্তুহারা হয়ে খোলা আকাশের নীচে থাকে। তাদের মধ্যে এভাবেই গড়ে উঠেছে এক ভিন্ন ধারার সভ্যতা।
কাদের দখলে উত্তর মেরু?
প্রধানত রাশিয়া, গ্রিনল্যান্ড, ডেনমার্ক, কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে এই উত্তর মেরু। মোটামুটি দেড় লাখের মতো এক্সিমোদের বাস এত বড় অঞ্চল জুড়ে। সমুদ্র আইন অনুযায়ী উপরোক্ত দেশসমূহ তাদের পার্শ্ববর্তী বরফ ঘেরা অঞ্চলে প্রভাব সৃষ্টিতে সচেতন ও সবাই অন্যদের সাথে বিবাদমান অবস্থায় আছে। বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কা ও রাশিয়ার অঞ্চলসমূহ ভূ-রাজনৈতিকভাবে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী মোতায়েন আছে জন-মানবহীম এসব অঞ্চলেও। অবশ্য রাশিয়া এদিক থেকে বেশ সফল। আরেকটা তথ্য জেনে রাখা ভালো যে, কানাডার পার্শ্ববর্তী আলাস্কা একসময় রাশিয়ার মালিকানায় ছিল। কিন্তু ১৮৭১ সালে রাশিয়া বিশাল টাকার মূল্যে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এটি বিক্রি করে দেয়। সাম্রাজ্যবাদের ছোবল থেকে রক্ষা পায়নি বরফে ঘেরা এই অঞ্চলও। বিশেষত শিল্পোন্নত দেশসমূহের পরিবেশ দূষণে আর্কটিকের বরফ গলছে তড়তড় করে যা আগামী পৃথিবীর ভবিষ্যৎকে হুমকির মুখে নিয়ে যাবে।
তথ্যসূত্রঃ
১. https://en.m.wikipedia.org/wiki/Eskimo
২. https://www.britannica.com › topic › Esk…
৩. 10 Fascinating Facts About Eskimos
rybelsus tablet – buy desmopressin cheap order DDAVP