পার্ল হারবার এর আকাশে ৭ ডিসেম্বর ১৯৪১ সালে হঠাৎ উড়ে আসে জাপানের ৪০৮ টি যুদ্ধ বিমান। যুদ্ধ বিমানের গোলা বর্ষণের আঘাতে কিছু বুঝে উঠার আগেই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান নৌঘাঁটি পার্ল হারবার। চারটি মার্কিন যুদ্ধ জাহাজ তাৎক্ষনিক অতল সাগরে তলিয়ে যায়। এই আকস্মিক আক্রমণের মধ্যে দিয়েই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ২য় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে এশিয়ার অন্যতম পরাশক্তি জাপান। যার ফলশ্রুতিতে জাপানকে মেনে নিতে হয় পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী দুটি পারমাণবিক বোমার আঘাত।
জাপানের পার্ল হারবার আক্রমণের কারণ:
এশিয়ার অন্যতম পরাশক্তি হয়ে উঠা জাপানের অর্থনীতি পার্শ্ববর্তী দেশ সমূহের উপর নির্ভরশীল ছিলো। জাপান তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি বৃদ্ধির জন্য পার্শ্ববর্তী দেশ সমূহে আক্রমণ করতে শুরু করে। জাপানের পার্শ্ববর্তী চীনের কিছু অঞ্চলের দিকে জাপান সর্বপ্রথম আক্রমণ করতে চায়, যা জাপানের অর্থনীতি সমৃদ্ধ করতে সহায়ক হবে বলে বিবেচনা করেছিলো জাপান। ইন্দো-চীনে প্রাথমিক আক্রমণ করে কিছু অঞ্চল দখল করে নেয় জাপান।
২য় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে চীন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সাহায্য চাইলে তারা এগিয়ে এসে জাপানের সাথে শান্তি চুক্তি করে। জাপান তবুও তার পার্শ্ববর্তী দেশ সমূহের উপর স্বেচ্ছাচারিতা চালাতে থাকলে যুক্তরাষ্ট্র জাপানে উড়োজাহাজ, মেশিনের যন্ত্রাংশ লোহা, স্টিলের পাত ও পেট্রোলিয়াম যন্ত্রের আমদানি পণ্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। জাপান পেট্রোলিয়াম যন্ত্রের কাঁচামাল, লোহা, স্টিলের পাত আমদানি তে যুক্তরাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীল ছিলো। জাপানের এভাবে পণ্য আমদানিতে হঠাৎ যুক্তরাষ্ট্র বাধা দেয়ায় জাপান যুক্তরাষ্ট্রের উপর ক্ষেপে উঠে।
এছাড়াও জাপানের দখলকৃত ডাচ ইস্ট ইন্ডিজ এবং মালয়ে প্যাসিফিক-ফ্লিট যুক্তরাষ্ট্র অধিগ্রহণ করে নিতে পারে বলে জাপানের বদ্ধমূল ধারণা ছিলো। যুক্তরাষ্ট্রের জাপান বিরোধিতার এমন মুখে এসে জাপান যুক্তরাষ্ট্রের সাথে করা শান্তিচুক্তি ভঙ্গ করে যুক্তরাষ্ট্রকে পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই আক্রমণের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে।
জাপানের পার্ল হারবার আক্রমণের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিলো প্রশান্ত মহাসাগরে জাপানের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা। প্রশান্ত মহাসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের একচ্ছত্র প্রভাবের কারণে জাপান প্রশান্ত মহাসাগরে প্রবেশ করতে পারেনি। এশিয়ার পরাশক্তি হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিস্তৃত প্রভাব জাপান মেনে নিতে পারেনি। এই আক্রমণের মধ্য দিয়ে জাপানের সামরিক অবস্থানকে আরো দৃঢ় করাই জাপানের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিলো। এবং জাপান চেয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আক্রমণের পর আক্রান্ত মার্কিন বাহিনী কিছুকাল পাল্টা আক্রমণে না গিয়ে সময় নেবে, সেই সময়ে জাপান তাদের নৌ-শক্তি বৃদ্ধি করার জন্য যে পর্যাপ্ত সময় পাবে, সেই সময়ে জাপান তাদের নৌ-শক্তি আরো বৃদ্ধি করে নেবে।
পার্ল হারবার আক্রমণের প্রস্তুতি:
পার্ল হারবার আক্রমণের অন্যতম প্রধান পরিকল্পনা ছিলো জাপান নেভির প্রধান সেনাপতি এডমিরাল ইসোরোকু ইয়ামামোতো। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সামরিক ও অর্থনৈতিক দ্বন্দ্বে জড়িয়ে যাওয়ায় জাপানের সামরিক ও অর্থনৈতিক দিকে বিস্তৃত প্রভাব পড়বে বিবেচনায় জাপানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এই চলমান সংকট নিরসনে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সরাসরি যুদ্ধের আহবান করেন। কিন্তু জাপান নেভির সেনাপতি ইসোরোকো ইয়ামামতো যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে জয়ের সম্ভাবনা নেই বলে যুক্তরাষ্ট্রে আকস্মিক আক্রমণের প্রস্তাব রাখেন। তাঁর প্রস্তাব অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের পার্ল হারবারে জাপান আকস্মিক আক্রমণ করতে প্রস্তুত হয়।
জাপানের বিমান বাহিনীর আকস্মিক যুদ্ধ বিমান প্রেরণ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান নৌ-ঘাঁটি পার্ল হারবার ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নেয় জাপান।
জাপানের অত্যাধুনিক ৬টি যুদ্ধজাহাজ ২৯ নভেম্বর ১৯৪১ সালে জাপানের উপকূল থেকে উত্তর-পশ্চিম হাওয়াইয়ের দিকে অগ্রসর হয়। ৬টি যুদ্ধজাহাজে সর্বমোট ৪০৮টি এয়ারক্রাফট বা যুদ্ধবিমান আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিলো। সবগুলো যুদ্ধবিমান কে একত্রিত করে পার্ল হারবারে দুই স্তরে আক্রমণের চূড়ান্ত পরিকল্পনা গ্রহণ করে জাপানের সেনা ও বিমান বাহিনীর দল।
প্রথম স্তরের বিমানের মাধ্যমে প্রাথমিক আক্রমণ করার পর দ্বিতীয় স্তরের বিমানগুলো আক্রমণ করে অবশিষ্ট কাজগুলো সম্পন্ন করবে। প্রথম স্তরের বিমানগুলো থেকে মূলত প্রধান যুদ্ধ জাহাজগুলোতে আক্রমণ করা হবে। অগভীর জলে রাডার সংযোগ ও উত্তাল তরঙ্গ বিরোধী প্রযুক্তিতে গড়া, বিশেষভাবে উপযোগী টাইপ ৯১ এ্যারিয়্যাল টর্পেডোর সাহায্যে এ আক্রমণ প্রক্রিয়া পরিচালিত করা হবে বলে সিদ্ধান্ত হয়।
আক্রমণের জন্য সকল যুদ্ধ বিমান চালককে বিশেষ নির্দেশনা দেয়া হয়। তারা যেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান নৌ-ঘাঁটির সবচেয়ে মূল্যবান লক্ষ্যবস্তুতে বিশেষত যুদ্ধজাহাজ এবং বিমানবাহী জাহাজে আঘাত হেনে ধ্বংস করার নির্দেশ দেয়া হয়। যুদ্ধবিমান গুলো অতি দ্রুত ধ্বংস করার জন্য বিশেষ গুরুত্বসহকারে নির্দেশ দেয়া হয়। যত দ্রুত যুক্তরাষ্ট্রের জাহাজ ও বিমান গুলো ধ্বংস করা সম্ভব হবে, ততই যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা আক্রমণের নিশ্চয়তা কমতে থাকবে।
পার্ল হারবার আক্রমণ:
১৯৪১ সালের ২৬ নভেম্বর। রবিবার। সরকারি ছুটির দিন। পার্ল হারবারে অবস্থিত সকল সামরিক কর্মকর্তা, দ্বীপের সাধারণ অধিবাসী সকলেই ছুটির দিনের ফুরফুরে মেজাজে অবস্থান করছেন। জাপানের দুই স্তরের বিমান বাহিনী এগিয়ে আসছেন পার্ল হারবারের দিকে। আমেরিকান সেনাবাহিনীর রাডারে দৃশ্যমান হয় কতগুলো বিমান। তখনো জাপানের আক্রমণ বাহিনীর প্রথম স্তরের বিমানগুলো ১৩৬ নটিক্যাল মাইল দূরে। আমেরিকান সেনাবাহিনী ভুলক্রমে ধারণা করে ঐগুলো আমেরিকান বোমারু বিমান। যেগুলো পার্ল হারবারের দিকে যাচ্ছে তাদের সামরিক অবস্থানের জন্য।
সময় সকাল ৭টা ৫৫মিনিট। হঠাৎ এগিয়ে আসা দুই স্তরের যুদ্ধবিমান থেকে জাপান পার্ল হারবারে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের নৌ ঘাঁটিতে আক্রমণ শুরু হয়। যুক্তরাষ্ট্রের সেনা নৌ কর্মীরা ছুটির দিনে তাদের স্বাভাবিক কাজকর্মে লিপ্ত ছিলো। কিছু বুঝে উঠার আগেই ধ্বংস হতে থাকে একের পর এক পার্ল হারবারের ঘাঁটিতে থাকা যুদ্ধজাহাজ, যুদ্ধবিমানসহ যুদ্ধে ব্যবহৃত নানান সমরাস্ত্র।
প্রথম স্তরের বোমারু যুদ্ধ বিমান থেকে পার্ল হারবারের নৌ-ঘাঁটি লক্ষ্য করে একের পর এক টর্পেডো নিক্ষিপ্ত হতে লাগলো। সাথে সাথে শুরু হলো যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধজাহাজ লক্ষ করে প্রচণ্ড বোমা নিক্ষেপ ও মেশিনগানের গুলিবর্ষণ। চারটি যুদ্ধজাহাজ তাৎক্ষণিকভাবে ডুবে যায়। অন্যান্য যুদ্ধজাহাজ মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পার্ল হারবারের বিমান ঘাঁটিতেও সমানভাবে আক্রমণ চালায় জাপান বিমান বাহিনী। বিমানবাহিনীর শতাধিক বিমান ধ্বংস হয়ে যায়। সর্বমোট ১৮৮টি মার্কিন বিমান ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
প্রায় ৯০ মিনিটের এই আক্রমণে পার্ল হারবার একরকম ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। হঠাৎ আক্রমণে মার্কিন বাহিনী কোনরকম পাল্টা আক্রমণ করতে পারেনি এবং তাৎক্ষণিক এই আক্রমণের প্রতিবাদও করতে পারেনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ৯০মিনিটের এই আক্রমণে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধজাহাজ, যুদ্ধবিমান ধ্বংসের সাথে সাথে প্রায় আড়াই হাজার সামরিক ও বেসামরিক মানুষের মৃত্যু হয়। এছাড়াও সহস্রাধিক মানুষ চরম ভাবে আহত হয়, যাদের অধিকাংশই পরবর্তীতে পঙ্গুত্ব বরণ করে।
জাপানের বিমান বাহিনীর খুব একটা ক্ষতি না হলেও মার্কিন নৌ-বাহিনীর তথ্য মতে জাপানের ৬০ টি যুদ্ধবিমান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। হামলাকারীদের মধ্যে থেকে ৬০/৬৫ এর মত নিহিত বা আহত হয়। ‘কাজু সাকামাকি’ নামক এক জাপানি নাবিক সর্বপ্রথম মার্কিন বাহিনীর হাতে আটক হয়।
পার্ল হারবার আক্রমণের ফলাফল:
জাপান থেকে প্রায় ৪,০০০ মাইল দূরে অবস্থিত আমেরিকার সবচেয়ে বড় নৌ-ঘাঁটি পার্ল হারবারের উপর এ ধরনের আক্রমণ হতে পারে, তা যুক্তরাষ্ট্রের কল্পনার বাইরে ছিলো। জাপান হঠাৎ আক্রমণ করে পার্ল হারবারে যে বিশাল ক্ষতি সাধন করে, তা জাপান যুদ্ধ ঘোষণা করে আক্রমণ করলে এত বিশাল ক্ষতি সাধন সম্ভব ছিলোনা। এ আক্রমণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। মার্কিনীদের জাতীয় সমর্থনের ভিত্তিতে দুই দেশের সম্পর্ক দ্রুতই শীতলীকরণ পর্যায়ে চলে যায়। এই আক্রমণে জাপান যুদ্ধকৌশল প্রয়োগ করে প্রাথমিক ভাবে জয়লাভ করলেও সামগ্রিক ফলাফলে জাপানের ইতিহাসের সবচেয়ে কলঙ্কজনক পরাজয়ের সম্মুখীন হতে হয়। জাপান কে সহ্য করতে হয় ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ দুটি পারমাণবিক বোমার আঘাত।
পার্ল হারবার আক্রমণের কিছুক্ষণ পর জাপানের প্রধানমন্ত্রী আনুষ্ঠানিক ভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।
৮ ডিসেম্বর ১৯৪১ মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট এক জরুরি সবা আহবান করেন। প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের ডাকা জরুরি সভায় সিনেটের সকল সদস্যদের সম্মিলিত সম্মতিতে জাপানের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ ঘোষণা করে। এর পরপরই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রপক্ষ যুক্তরাজ্যও জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এরই মধ্য দিয়ে রচিত হতে শুরু করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আরেক রক্তাক্ত কলঙ্কজনক অধ্যায়।
buy cheap generic prandin – repaglinide 1mg cheap empagliflozin 25mg us