আমেরিকার গৃহযুদ্ধঃ অতঃপর দাসপ্রথার মুক্তি

2

 

উত্তর ও দক্ষিণের রাজ্যসমূহের মধ্যে অনেক বছরের কোন্দলের পর ১৮৬১ সালে ইতিহাসের বিখ্যাত আমেরিকার গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধের মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল দাস ব্যবসা, উত্তরের রাষ্ট্রগুলোর আধিপত্য ও শোষণকে কেন্দ্র করে। ১৮৬০ সালে আব্রাহাম লিংকন রিপাবলিকান দলের হয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। পথিমধ্যেই দক্ষিণের সাতটি দেশ মিলে আমেরিকান কনফেডারেশন গড়ে তোলে। পরপরই তাদের সাথে আরো চারটি দেশ যুক্ত হয়। ১৬৬১ সাল নাগাদ উত্তরের দেশসমূহের সাথে পুরোদমে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায় এবং ১৮৬৫ সাল নাগাদ কনফেডারেশনের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে ১৮৬৫ সালে গৃহযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। কম করে হলেও ছয় লক্ষ সৈন্য নিহত হয় এবং আরো হাজার হাজার পঙ্গুত্ব বরণ করে। যুদ্ধ শেষে মোটামুটি দক্ষিণের দেশ সমূহ একপ্রকার ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়।

ম্যাপে ভৌগলিক অবস্থান নির্দেশ
ম্যাপে ভৌগলিক অবস্থান নির্দেশ
Source: History.com

গৃহযুদ্ধপূর্ব আমেরিকাঃ

ব্রিটিশ শাসনের নাগপাশ থেকে মুক্তি পেয়ে আমেরিকা খুব দ্রুত প্রবল উন্নতি করে। তবে সম্পদের বণ্টনে রয়ে যায় প্রবল ফারাক। স্বভাবতই উত্তরের দেশসমূহ ছিল অধিক উন্নত ও সমৃদ্ধ কিন্তু সে তুলনায় দক্ষিণের দেশসমূহ ছিল পশ্চাৎপদ অনগ্রসর ও অনুন্নত অবকাঠামোর অধিকারী।

অর্থনীতি দাস নির্ভর
অর্থনীতি দাস নির্ভর Source: Britinica

উত্তর অংশে লেগেছিল শিল্প-বিপ্লবের ছায়া। আধুনিক কল কারখানা স্থাপিত হয়। দ্রুত নগরায়ণের প্রসার ঘটে। কৃষিক্ষেত্রও ছিল সঙ্কুচিত। কিন্তু দক্ষিণের দেশ সমূহ ছিল পুরোটাই কৃষি নির্ভর। উত্তর যেখানে যন্ত্র নির্ভর শ্রম ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল আর দক্ষিণ সেখানে কায়িক শ্রম ভিত্তিক শিল্প গড়ে তুলেছিল। মূলত নিগ্রোদের ব্যবহার করেই এর কাজ চলত। বিশেষত  শস্য, কটন ও তামাকে উৎপাদন ছিল দক্ষিণের মূল অর্থনৈতিক শক্তির চাবিকাঠি। কিন্তু ১৮০৮ সালেই দাসবৃত্তির বিরুদ্ধে আমেরিকায় আইন পাশ হয় এবং ১৮৩০ সাল থকে উত্তরের রাজ্য সমূহ তা বাস্তবায়ন করতেও শুরু করে এবং দক্ষিণের রাজ্য সমূহেও তা বাস্তবায়নে তৎপর হয়ে ওঠে । সুতরাং স্বভাবতই দক্ষিণের প্রভাবশালী দাস মালিকরা দাসবৃত্তি উঠে যাবার ভয়ে থাকেন। কেননা দাসকে কেন্দ্র করেই দক্ষিণের অর্থনীতি পরিচালিত হচ্ছিল। দাসবৃত্তি উঠে যাবার মানেই ছিল দক্ষিণের অর্থনীতি ধসে যাওয়া।

দাসদের মুক্ত করে অধ্যাদেশ
দাসদের মুক্ত করে অধ্যাদেশ Source: history.com

১৮৫৪ সালে আমেরিকার কংগ্রেস দাস বৃত্তির বৈধতা নিয়ে “কানসাস-নেবারাসকা নামে একটি আইন পাশ করে। কিন্তু আমেরিকার বিভিন্ন প্রদেশজুড়ে এর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হয়। বিশেষত উত্তরের সভ্য প্রগতিশীল সমাজের মধ্যে দাস বিরোধী মনোভাব ছিল প্রবল। ১৮৫৭ সালে সুপ্রিম কোর্টেও দাস বৃত্তির বৈধতা নিয়ে তুমুল বাগবিতণ্ডা হয়। উত্তরের রাজ্যগুলোর প্রবল বিরোধিতা দক্ষিণের রাজ্য সমূহের মনে দাগ কাটে এবং ব্যথিত করে। রিপাবলিকান দলও ছিল দাস বিরোধী অবস্থানে। ১৮৬০ সালে আব্রাহাম লিংকনের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবার মধ্য দিয়েই উত্তর-দক্ষিণ বিরোধ তুঙ্গে ওঠে এবং তিন মাসের মধ্যেই দক্ষিণের সাতটি দেশ সাউথক্যারোলিনা, মিসিসিপি, ফ্লোরিডা, অ্যালবামা, জর্জিয়া, টেক্সাস ও লুসিয়ানা যুক্তরাষ্ট্র ত্যাগ করে  একত্রিত হয়ে গড়ে তোলে আলাদা কনফেডারেশন। সুতরাং ফেডারেল বনাম কনফেডারেন্স বিপরীতমুখী অবস্থান নেয়।

মহান নেতা আব্রাহাম লিংকন
মহান নেতা আব্রাহাম লিংকন Source:wikipedia

গৃহযুদ্ধের সূচনাঃ

লিংকন ক্ষমতায় বসতে বসতে মার্চ মাস চলে আসে। এমন সমস্যা নিরসনে এবং অখণ্ড যুক্তরাষ্ট্র বজায় রাখতে উত্তরের রাষ্ট্র সমূহ দক্ষিণের নতুন কনফেডারেশনের হুমকি উপেক্ষা করে যুদ্ধ  প্রস্তুতি নেয় এবং দক্ষিণ ক্যারোলিনায় সৈন্য সমাবেশ ঘটায়। ১২ এপ্রিল দক্ষিণ ক্যারোলিনায় সর্বপ্রথম কনফেডারেশন হামলা চালালে গৃহযুদ্ধের সূচনা হয়। দক্ষিণ ক্যারোলিনার সেনাপ্রধান দুইদিন ধরে যুদ্ধ করে কনফেডারেন্সির সেনাপ্রধান বেউরগার্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন। এরমধ্যেই কনফেডারেন্সির সাথে এসে যুক্ত হয় ভার্জিনিয়া, আলাস্কা, উত্তর ক্যারোলিনা ও টেনেসি। মৌসুরি, ম্যারিল্যান্ড কনফেডারেন্সির সাথে সরাসরি যুক্ত হয়নি কিন্তু সমর্থন ছিল। ওদিকে প্রাথমিক ব্যর্থতা কাটিয়ে উত্তরের ২৩ টি দেশ দক্ষিণের প্রতিরোধে এগিয়ে আসে। শক্তির দিক থেকে উত্তর ছিল যোজন যোজন এগিয়ে। অধিক জনসংখ্যা, আধুনিক প্রযুক্তি, রেলওয়ে ছিল উত্তরের জন্য সবচেয়ে বড় সুবিধের। কিন্তু সে তুলনায় কনফেডারেন্সির অত কোন সুবিধা ছিল না। তবে তাদের একমাত্র শক্তি ছিল শক্তিশালী সেনাবাহিনী। প্রথম বড় ধরণের যুদ্ধ ছিল “বুল রান” যা কিনা ২১ জুলাই শুরু হয়। ৩৫ হাজার কনফেডারেন্সের সৈন্য টমাস জনাথনের নেতৃত্বে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তারা খুব সহজেই ফেডারেল অর্থাৎ উত্তরের সৈন্যদের পিছু  হটতে বাধ্য করে। আব্রাহাম লিংকন তাৎক্ষণিকভাবে আরো পাঁচ লক্ষ সৈন্য মোতায়েনে বাধ্য হন। এ থেকেই বুঝা যায় যে, যুদ্ধটা অত সহজ হবেনা।

কনফেডারেন্সির নেতা কমান্ডার লি
কনফেডারেন্সির নেতা কমান্ডার লি Source: Wikipedia.com

ফেডারেল এর নতুন সেনাপতি হন ম্যাকক্লেন ।  ১৮৬২ সালের মে মাসে তার সৈন্যরা নিউইয়র্ক দখল করতে সক্ষম হয়। তবে তা স্থায়ী হয়নি। সাত দিন ব্যাপী যুদ্ধে কনফেডারেন্সের সৈন্যরা ম্যাকক্লেনের সৈন্যদের ফেরত পাঠাতে সক্ষম হয়। ম্যাকক্লেন যদিও আরো নতুন সৈন্য নিয়ে আক্রমণ চালাতে ইচ্ছুক ছিল কিন্তু আব্রাহাম লিংকন তাতে সম্মতি দেননি। ওদিকে ক্যাপ্টেন লি এর নেতৃত্বে কনফেডারেন্সি দ্বিতীয় বুল রানের যুদ্ধে উত্তরের ভুমি দখল করতে সক্ষম হন। নানান প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে ম্যাকক্লেন আবার সৈন্যদের একত্রিত করে ম্যারিল্যান্ডে হামলা চালিয়ে ক্যাপ্টেন লি এর উচ্চাভিলাষীতায় ছেদ টানেন ও রক্ষণাত্মক হতে বাধ্য করেন। এরপরই সেপ্টেম্বরে এন্টিতামে ক্যাপ্টেন লি এর বিরুদ্ধে দ্বিতীয় হামলা আসে। এ দিনটি ছিল গৃহযুদ্ধের সবথেকে ভয়াবহ দিন। ফেডারেল বাহিনীর প্রায় ৬৯,০০০ হাজার এবং ফেডারেল এর ৫২,০০০ হাজার কনফেডারেন্সির সৈন্য নিহত হয়। অবশ্য ফেডারেল বাহিনীই বিজয় লাভ করে লিকে ভার্জিনিয়ায় ফিরে যেতে বাধ্য করে। ম্যাকক্লানকে বদলি করে বার্ন্সাইডকে সেনাপতি করলে তিনি লি এর বিরুদ্ধে পরাজয় বরণ করেন এবং আব্রাহাম লিংকন কর্তৃক অপসারিত হন।

গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত অঞ্চলের অবস্থা
গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত অঞ্চলের অবস্থা Source: alamy.com

দাসত্ব বিলুপ্তি ঘোষণাঃ

আব্রাহাম লিংকন ১৮৬৩ সালে দাসদের মুক্ত ঘোষণা করেন
আব্রাহাম লিংকন ১৮৬৩ সালে দাসদের মুক্ত ঘোষণা করেন Souce: alamy.com

১৮৬৩ সালের ১ জানুয়ারি আব্রাহাম লিংকন দাস মুক্তি দিবস ঘোষণা করেন। এই ঘোষণার ফলে প্রায় বিশ্ব জনমত কনফেডারেন্সির বিরুদ্ধে চলে যায়। রাতারাতি দক্ষিণের প্রায় ১ লক্ষ ৮০ হাজার কৃষ্ণাঙ্গ এসে ফেডারেল বাহিনীতে যোগ দেয়। এবং যুদ্ধের শেষ পর্যন্ত প্রায় ৩৮ হাজার প্রাণ বিসর্জন দেয়। যাহোক ফেডারেলের শক্তি দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়াতে নতুন কমান্ডার হুকার ক্রমাগত আক্রমণ চালিয়ে লি বাহিনীকে টালমাটাল করে দেয় এবং ফেডারেলের জন্য একটি প্রতিকূল অবস্থা তৈরিতে সক্ষম হয়।

লির আত্মসমর্পণেরর একটি মুহূর্ত
লির আত্মসমর্পণেরর একটি মুহূর্ত Source: history/com

ফেডারেলের চূড়ান্ত বিজয় ও কনফেডারেন্সির আত্মসমর্পণঃ

১৮৬৪ সালে লিংকন কমান্ডার হিসেবে নিয়োগ দেন গ্রান্টকে। শেরম্যান ছিলেন পশ্চিমের দায়িত্বে। গ্রান্ট ওয়াশিংটনের দিকে এগিয়ে পোর্ট্রক থেকে ব্যাটেল অব উইলদারনেস  ও স্পটসালভেনিয়ার যুদ্ধের মধ্য দিয়ে  লি এর সৈন্যদের বিতাড়িত করেন। ওদিকে আটলান্টায় শেরম্যান কনফেডারেন্সির সৈন্যদের পরাজিত করেন। পরপর কয়েকটি আক্রমণের মাধ্যমে গেটিসবার্গ দখল করে নেয় ফেডারেল বাহিনী। মার্চে শেষবারের মতো লির বাহিনী কয়েকটি অঞ্চল দখল করে নিলেও ফেডারেলের বিরুদ্ধে কনফেডারেন্সি আর সুবিধা করে উঠতে পারেনি। অবশেষে ৯ এপ্রিল ১৯৬৫ সালে চারদিক থেকে অবরুদ্ধ হয়ে লি কমান্ডার গ্রান্টের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। ২৬ এপ্রিল ক্যারোলিনায় কনফেডারেন্সির অপর সেনাপতি জনস্টোন আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে গৃহযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।

গেটিসবার্গে আব্রাহাম লিংকন
গেটিসবার্গে আব্রাহাম লিংকন Source: study.com

১৪ এপ্রিল গুটেসবার্গে আব্রাহাম লিংকন জন উইলকেস নামের এক আততায়ীর হাতে নিহত হন। এখানেই আব্রাহাম লিংকন তাঁর ২ মিনিটের সেই বিখ্যাত ভাষণেই বলেছিলেন “Democracy is the government of the people, by the people and for the people.”

রেফারেন্সঃ

১.উইকিপিডিয়া

২.আমেরিকার ইতিহাস

৩.ব্রিটিনিকা

৪.হিস্ট্রি চ্যানেল

Leave A Reply
2 Comments
  1. Mtzmjd says

    semaglutide 14mg brand – buy DDAVP medication buy desmopressin cheap

  2. Khhfii says

    order repaglinide sale – purchase repaglinide generic buy empagliflozin pills for sale

sativa was turned on.mrleaked.net www.omgbeeg.com

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More