কিছুদিন আগেও একটা সময় ছিলো, যখন ফুটবল মাঠে শুধুমাত্র মেসি-রোনালদোর একক আধিপত্য ছিলো না । তখন সেরা হওয়ার লড়াই টা চলতো অনেকের মধ্যে। সেই সময়ের এক লিজেন্ড কে নিয়েই আজকের আমাদের কলাম, একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে যিনি মেসি রোনালদো কে পেছনে ফেলে বর্ষসেরার মুকুট পড়েছিলেন মাথায় । হ্যা, রিকার্ডো কাকা র কথাই বলছি।
ফুটবল ইতিহাসের কিছু খেলোয়াড় কে কখনো সর্বজনস্বীকৃত বিশ্বসেরা বলা হয় না । কিন্তু ফুটবল মাঠে তাদের সাফল্য এবং দৃষ্টিনন্দন খেলা তাদেরকে ইতিহাসের পাতায় অমর করে রাখে একজন কিংবদন্তী হিসেবে । কাকা ও তাদের মধ্যেই একজন ।
কাকা তার খেলোয়াড়ি জীবন শুরু করেন ব্রাজিলিয়ান ক্লাব সাউ পাওলো তে। প্রথম ম্যাচেই বদলি হিসেবে নেমে ১-০ তে পিছিয়ে থাকা দলকে জিতান পরপর দুই গোল করে । শুঁয়োপোকা থেকে প্রজাপতি হওয়ার গল্প টার শুরু এখানেই। প্রথম সিজনেই সবার নজর কাড়েন নিজের পারফর্মেন্সের মাধ্যমে । ২০০২ সালে জিতে নেন “Bola de oura” অর্থাৎ গোল্ডেন বল যা ব্রাজিলের ফুটবলার অফ দ্যা ইয়ারের সমতুল্য। একই বছর তিনি নিজের পজিসনের সেরা খেলোয়াড়ও নির্বাচিত হন । একজন উঠতি তরুণের এমন অতিমানবীয় পার্ফমেন্স চোখ এড়ায়নি তৎকালীন ব্রাজিলের কোচ স্কলারীর । জায়গা করে নেন ব্রাজিলের বিশ্বকাপ স্কোয়াডে ।

Source: Playbuzz
সাউ পাওলো এবং ব্রাজিলের হয়ে তার মন্ত্রমুগ্ধকর খেলা নজর কাড়ে রিয়াল মাদ্রিদ, এসি মিলানের মতো বড় ক্লাবগুলোর । সেই সুবাদেই ২১ বছর বয়সেই ২০০৩ এর গ্রীষ্মে যোগ দেন এসি মিলানে । সেসময় মিলানের মিডফিল্ড ছিলো রুই কস্তা, রিভালদো, পিরলো, সিডর্ফের মতো বিশ্বসেরা প্লেয়ার দের নিয়ে গড়া । তাই দলে জায়গা পাওয়াটাই ছিলো সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ । তবে কোচ কার্লো আনচেলত্তি ছিলেন পাকা জহুরী । রত্ন চিনতে ভুল করেন নি তিনি । প্রথম দিন ট্রেনিং গ্রাউন্ডে কাকার প্র্যাক্টিস দেখেই তিনি বুঝে যান দুই পা দিয়ে কি করার ক্ষমতা রাখেন এই ফুটবলার । অভিজ্ঞ রুই কস্তাকে বসিয়ে প্রথম একাদশে জায়গা করে দেন কাকাকে । কোচের আস্থার মূল্য দিতে দেরী করেননি তিনি । প্রথম ম্যাচেই শেভচেংকোকে দিয়ে করান ম্যাচজয়ী গোল । দ্বিতীয় ম্যাচে নিজেই করে ফেলেন ৩০ গজ দূর থেকে চোখ ধাঁধানো একটি গোল । এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয় নি । অল্প দিনেই হয়ে গিয়েছিলেন দলের অবিচ্ছেদ্য অংশ । প্রতি ম্যাচেই দিয়ে গেছেন নিজের যোগ্যতার প্রমাণ । প্রথম সিজনেই ইউরোপে করেন ১৪ টি গোল । দীর্ঘ ৪ বছর পর দলকে জেতান লিগ শিরোপা । প্রথম সিজনেই জিতে নেন “সিরিআ প্লেয়ার অফ দ্যা ইয়ার” । একই সাথে “সিরিআ ফরেইন প্লেয়ার অফ দ্যা ইয়ার” ও জিতে নেন এই তরুণ ফুটবলার ।

Source: Ekushey TV
শুধু লিগ সেরা হয়েই ক্ষান্ত হননি তিনি । পরের সিজনে (২০০৪-০৫) লিগের পাশাপাশি চ্যাম্পিয়নস লিগেও নিজের প্রতিভার ছাপ রাখেন কাকা । গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ গুলোতে ম্যাচের মোড় ঘুড়িয়ে দলকে তুলেছিলেন ফাইনালে । ফাইনালে সতীর্থদের দিয়ে করিয়েছিলেন দুইটি গোল । যদিও স্রষ্টা সেদিন ইস্তাম্বুলের গল্প টা লিখেছিলেন অন্যভাবে । নয়তো লিভারপুলের সেই অসাধারণ কামব্যাক কে মিলানের দুর্ভাগ্য মেনে নিয়ে নিজেদের সান্ত্বনা দেয়া ছাড়া আর কিইবা করার ছিলো । চ্যাম্পিয়নস লিগ জিততে না পারলেও, টুর্নামেন্টের সেরা মিডফিল্ডার নির্বাচিত হন তিনি । সে বছর ব্রাজিলের হয়ে জিতেন কনফেডারেশনস কাপ । ফাইনালে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আর্জেন্টিনার বিপক্ষে গোল দিয়ে দলের জয়ে ভুমিকা রাখেন । মাঝমাঠ থেকে ড্রিবলিং করে নিয়ে যাওয়া সেই দুর্দান্ত গোলটি টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় সেরা গোল হিসেবে নির্বাচিত হয় ।
জীবনের সেরা সময় টা এসেছে ২০০৭ এ । বহু বছর পর এসি মিলান কে জিতান বহু আকাঙ্ক্ষিত চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা । গ্রুপ পর্বে একটি হ্যাট্রিক, কোয়ার্টার ফাইনালে একমাত্র গোল, সেমিফাইনালে শক্তিশালী ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিপক্ষে দুই লিগ মিলিয়ে ৩ গোল এবং গুরুত্বপূর্ণ কিছু এসিস্টের মাধ্যমে প্রায় একাই দলকে ফাইনালে টেনে নিয়ে যান । ফাইনালে ইনজাগী কে দিয়ে করিয়েছিলেন আরেকটি গোল । টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরষ্কার থেকে শুরু করে প্রায় সব ধরণের ব্যক্তিগত পুরষ্কারই জিতে নেন সে বছর । মেসি রোনালদো কে পিছনে ফেলে জিতে নেন মহা আরাধ্য ফিফা বর্ষসেরা খেলোয়াড়ের খেতাব । দ্বিতীয় হওয়া রোনালদোর চেয়ে পেয়েছিলেন ২০০ পয়েন্ট বেশী । আরো জিতেন “উয়েফা প্লেয়ার অফ দ্যা ইয়ার” এবং “ব্যালন ডি অর” । জায়গা করে নেন ফিফ প্রো একাদশে । এরপর উয়েফা সুপার এবং ক্লাব বিশ্বকাপের ফাইনালেও গোল করে প্রমাণ করেছিলেন নিজেকে বিগ ম্যাচ প্লেয়ার হিসেবে । জিতেছিলেন ক্লাব বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড়ের খেতাবও ।

Source: Twitter
২০০৯ এ আবারো ব্রাজিলের হয়ে জিতেন কনফেডারেশন কাপ । ট্যুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় হয়ে জিতে নেন “গোল্ডেন বল এওয়ার্ড”। ২০১০ বিশ্বকাপে হয়েছিলেন যৌথভাবে ট্যুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ এসিস্ট মেকার । যদিও ব্রাজিল নেদারল্যান্ডস এর কাছে ২-১ হেরে ট্যুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নেন ।
২০০৯ এ এসি মিলান থেকে যোগ দেন রিয়াল মাদ্রিদে । মাদ্রিদে যোগ দেয়ার পর ইঞ্জুরি যেনো ঘাড়ে চেপে বসে এই সাবেক বিশ্বসেরার । তাই নতুন ক্লাবে পার্ফমেন্সটা ঠিক কাকাসুলভ হয়নি । ইঞ্জুরিটা না থাকলে হয়তো ইতিহাস আজ অন্যভাবে লেখা হতো । মাদ্রিদে তাই সময়টা ভালো যায়নি তার । বেশীরভাগ সময় সাইড বেঞ্চে বসেই কাটাতে হয়। ২০১৩ তে আবারো পুরনো ক্লাব মিলানে ফিরে যান কাকা । ক্যারিয়ারের মোটামুটি ইতি এখানেই টানা যায় । কেননা মুখ ধুবড়ে পড়া সেই মিলান কিংবা পরে জয়েন করা অর্লান্ডো সিটি তে কাটানো সময় টা অনেকটা ঝরে পড়া ফুলের মতোই । তবে এর আগেই নিজের নাম ইতিহাসের পাতায় খোদাই করে ফেলেছিলেন তিনি । তাই শেষ টা ভালো না হলেও জীবন্ত কিংবদন্তীর স্বীকৃতি পেতে খুব একটা বেগ পোহাতে হয় নি তাকে ।
একনজরে দেখে নেই তাই দলীয় এবং ব্যক্তিগত অর্জনগুলোঃ
ক্লাবঃ
- সিরি আ (২০০৩-০৪)
- সুপার কোপা ইটালিয়ানা (২০০৪)
- উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ (২০০৬-০৭)
- উয়েফা সুপার কাপ (২০০৭)
- ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপ (২০০৭)
- কোপা দেল রে (২০১০-১১)
- লা লিগা (২০১১-১২)
জাতীয়ঃ
-
- ফিফা বিশ্বকাপ (২০০২)
- কনফেডারেশনস কাপ (২০০৫,২০০৯)

Source: WWW.DARARWEYNE.TK – WordPress.com
ব্যক্তিগতঃ
- বোলা ডি অউরো (২০০২)
- বোলা ডি প্রাটা (২০০২)
- সাউথ আমেরিকান টিম অফ দ্যা ইয়ার (২০০২)
- CONCACAF গোল্ড টিম বেস্ট ইলেভেন (২০০৩)
- সিরিআ ফরেইন প্লেয়ার অফ দ্যা ইয়ার (২০০৪,২০০৬,২০০৭)
- সিরিআ প্লেয়ার অফ দ্যা ইয়ার (২০০৪, ২০০৭)
- উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ টপ এসিস্ট প্রোভাইডার (২০০৪-০৫, ২০১১-১২)
- উয়েফা ক্লাব মিডফিল্ডার অফ দ্যা ইয়ার (২০০৪-০৫)
- উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ ব্রোঞ্জ ফুট (২০০৫-০৬)
- উয়েফা টিম অফ দ্যা ইয়ার (২০০৬, ২০০৭, ২০০৯)
- ফিফ প্রো ওয়ার্ল্ড ইলেভেন (২০০৬,২০০৭,২০০৮) Pallone d’Argento (২০০৬-০৭)
- উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ টপ স্কোরার (২০০৬-০৭)
- উয়েফা ক্লাব ফরওয়ার্ড অফ দ্যা ইয়ার (২০০৬-০৭)
- উয়েফা ক্লাব ফুটবলার অফ দ্যা ইয়ার (২০০৬-০৭)
- ব্যালন ডি অর (২০০৭)
- ফিফা ওয়ার্ল্ড প্লেয়ার অফ দ্যা ইয়ার (২০০৭)
- ফিফা প্রো ওয়ার্ল্ড প্লেয়ার অফ দ্যা ইয়ার (২০০৭)
- ওয়ার্ল্ড সকার প্লেয়ার অফ দ্যা ইয়ার (২০০৭)
- IFFHS ওয়ার্ল্ড বেস্ট মিডফিল্ডার অফ দ্যা ইয়ার (২০০৭)
- IAAF ল্যাটিন স্পোর্টসম্যান অফ দ্যা ইয়ার (২০০৭)
- Onze d’Or (২০০৭)
- ফিফা ক্লাব ওয়ার্ল্ড কাপ গোল্ডেন বল (২০০৭)
- ফিফা ক্লাব ওয়ার্ল্ড কাপ মোস্ট এসিস্ট (২০০৭)
- টাইমস ১০০ (২০০৮, ২০০৯)
- মারাকানা হল অফ ফেম (২০০৮)
- Samba d’Or (২০০৮)
- মার্কা লিজেন্ড এওয়ার্ড (২০০৯)
- ফিফা কনফেডারেশনস কাপ গোল্ডেন বল (২০০৯)
- ফিফা কনফেডারেশনস কাপ বেস্ট ইলেভেন (২০০৯)
- ফিফা ওয়ার্ল্ড কাপ টপ এসিস্ট প্রোভাইডার (২০১০)
- এসি মিলান হল অফ ফেম (২০১০)
- এমএলএস অল স্টার (২০১৫,২০১৬,২০১৭)
- উয়েফা আল্টিমেট টিম অফ দ্যা ইয়ার (২০১৫)
কাকা এমন একজন খেলোয়াড় ছিলেন যাকে শুধু পরিসংখ্যান দিয়ে পরিমাপ করলে তার খেলার গভীরতা বুঝা যাবে না । আপনাকে দেখতে হবে ফুটবলীয় দৃষ্টিশক্তি দিয়ে। তিনি দেখিয়ে গেছেন কিভাবে গোলের পর গোল না করেও নিজেকে সেরা হিসেবে প্রমাণ করা যায় । শুধু খেলোয়াড় হিসেবে নন, নিজের সুন্দর ব্যক্তিত্বের কারণে এখনও সব ধরণের সমর্থকদের কাছে এক ভালোবাসার নাম রিকার্ডো কাকা । তাই তো কিছুদিন আগে যখন ফুটবলকে বিদায় জানালেন, তখন চোখের পানি ধরে রাখতে পারে নি পৃথিবীর সব ফুটবল সমর্থকরা । ফুটবল থেকে বিদায় নিলেও সবার মনে আজীবনের জন্য জায়গা করে নিয়েছেন নিজের সৃষ্টিশীল খেলার মাধ্যমে, যেখান তিনি থেকে যাবেন আজীবন। কোন বিদায় ছাড়াই…!!!