দাবাড়ুঃ এক যুদ্ধবন্দীর চমকপ্রদ গল্প!

1

কিছু গল্প মনে গভীর দাগ কেটে যায়। বছর দশেক আগে তেমনি একটা অনুবাদ গ্রন্থ পড়ার সৌভাগ্য হয়েছিলো।

খ্যাতনামা অস্ট্রিয়ান লেখক স্টেফান সেবাইগ-এর লিখা “দাবাড়ু”। গল্পটি বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় “The royal game”, “A chess story” কিংবা শুধু “Chess” নামেও অনূদিত হয়েছে।

গল্পের সময়কাল ছিলো সম্ভবতঃ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র ছিলেন তৎকালীন রাশিয়ান জারের পারিবারিক চিকিৎসক, গল্পে যাকে ডক্টর বি. নামে সম্বোধন করা হয়েছে। বিশ্বযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জারের পতন হয়। রাজপরিবারের অন্যান্য সদস্যের সাথে ডক্টর বি.-কেও বন্দী করে গোপন টর্চার সেলে নিয়ে যাওয়া হয়। তথ্য আদায়ের জন্য সেখানে তাঁর উপর অদ্ভুত এক মানসিক নির্যাতন চালানো হয়। জানালাবিহীন ছোট্ট একটা রূমে বন্দী করে রাখা হয় তাঁকে। সে ঘরে দিনরাত্রি বুঝার উপায় ছিলো না। মাথার উপর ২৪ ঘন্টা চোখ ধাঁধানো সাদা আলো জ্বালিয়ে রাখা হতো। সময় কিংবা দিন তারিখের হিসাব রাখার জন্য ছিলো না কোনো ঘড়ি কিংবা ক্যালেন্ডার। ঘরের দেয়াল ছিলো ধবধবে সাদা। বালিশ, বিছানার চাদর, কমোড, গায়ের কাপড় সবই ছিলো সাদা। এমনকি  যে প্লেট ও গ্লাসে করে দরজার ফাঁকে নিয়মিত খাবার ও পানীয় দেয়া হতো, তাও ছিলো সাদা রঙের।  ঘরে সামান্য আসবাবপত্রও ছিলো না, এমনকি কাগজ-কলমও নয়। দীর্ঘদিন পর পর অল্প কিছুক্ষণের জন্য তাঁকে জেরা করতে জেলারের রুমে নিয়ে যাওয়া হতো। দিনের পর দিন এরূপ মানসিক নির্যাতনের পর এক সময় হাল ছেড়ে দেন তিনি। স্থির করেন যা জানেন, সব ফাঁস করে এই নরকযন্ত্রণার অবসান ঘটাবেন।

দাবাড়ুঐদিন জেরা করার জন্য তাঁকে যখন জেলারের রুমে নিয়ে যাওয়া হয়, নিজেকে ঠান্ডা রাখার অপ্রত্যাশিত একটা সুযোগ পেয়ে যান তিনি। দেয়ালে ঝুলানো ওভারকোটের পকেট থেকে সবার অলক্ষ্যে একটি ছোট্ট বই চুরি করে লুকিয়ে রুমে নিয়ে যান। কিন্তু বইটি খুলে দেখেন যে, এটি আসলে দাবা খেলার নিয়ম সম্বলিত একটি পুস্তিকা। মনে মনে প্রচণ্ড হতাশ হলেও নিজেকে ব্যস্ত রাখার দুর্লভ এই সুযোগ হাতছাড়া করেন নি তিনি। দাবা খেলতে না জানলেও লুকিয়ে লুকিয়ে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বইয়ের সবটুকু পড়ে ফেললেন। তারপর আবার পড়লেন, তারপর আবার, এভাবে বারবার পড়তে পড়তে পুরো বইটা যখন তাঁর মাথায় ঢুকে গেলো, তখন বইয়ের পৃষ্ঠা ছিঁড়ে দাবার ঘুঁটি তৈরি করলেন। তারপর দুই দলে ভাগ করে নিজের সাথে নিজেই দাবা খেলতে শুরু করলেন। ঐদিকে তিনি এখনো ভেঙে পড়ছেন না দেখে সন্দেহবশতঃ তাঁর রুমে সার্চ টিম পাঠানো হলো। কেউ দেখার আগেই কাগজের ঘুঁটিগুলো কমোডে ফ্ল্যাশ করে দিতে সক্ষম হলেন তিনি। ধরা পড়লেন না, কিন্তু আবার শুরু হলো নিজেকে ধরে রাখার কঠিন লড়াই। এবার নিজের কল্পনায় দাবার ঘুঁটি সাজিয়ে খেলতে শুরু করলেন তিনি। কল্পনায় মাথার ভেতরে দাবার ছক সাজান, নিজের বিপক্ষে নিজে চাল দেন, আবার নিজের অগোচরে পাল্টা চাল দেন। ক্রমাগত নিজের সাথে দাবা খেলতে খেলতে একসময় তাঁর মধ্যে দুইটি ভিন্ন স্বত্বা তৈরি হয়ে গেলো। বন্দিত্বের বাকি সময়টা এভাবেই নিজেকে ব্যস্ত রেখে কাটিয়ে দেন তিনি। এদিকে কোনো ধরণের তথ্য উদ্ধার করতে না পেরে অবশেষে যুদ্ধ শেষে তাঁকে ছেড়ে দেয়া হয়।

দাবাড়ুএবার আমরা চলে যাবো গল্পের একেবারে শুরুতে। বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে বেশ কয়েক বছর হলো। তৎকালীন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন এক দাবাডু জাহাজে করে নিউ ইয়র্ক থেকে বুয়েন্স আয়ার্সে যাচ্ছিলেন। সময় কাটানোর জন্য তিনি জাহাজের অন্যান্য সৌখিন দাবাড়ুদেরকে তাঁর সাথে দাবা খেলার আমন্ত্রণ জানান। একে একে সবাইকে অবলীলায় হারাচ্ছিলেন আর কৌতুকে ফেটে পড়ছিলেন দাম্ভিক ঐ চ্যাম্পিয়ন দাবাড়ু। ঠিক এরকম একটি গেমে চাম্পিয়ন সাহেবের প্রতিপক্ষ সৌখিন দাবাড়ু একটি চাল দিতেই এতোক্ষণ গম্ভীর হয়ে পাশে বসে থাকা এক ভদ্রলোক “ভুল চাল!” বলে চেঁচিয়ে ওঠেন। অথচ আপাতদৃষ্টিতে সেটি কোনো ভুল চাল ছিলো না। তখন ঐ ভদ্রলোক বলতে থাকেন কিভাবে এই নিরীহ চালের কারণে ৫/৬ টি চাল পরে ঐ সৌখিন দাবাড়ু হেরে যাবেন। উপস্থিত সবাই তখন গেমটি শেষ করার জন্য ঐ ভদ্রলোককে চ্যাম্পিয়ন দাবাড়ুর বিপক্ষে বসিয়ে দেন। সবাইকে অবাক করে দিয়ে নিশ্চিত হেরে যাওয়া গেমটি ড্র করে ফেলেন তিনি! বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন সাহেব তখন তাঁর সাথে একটি পূর্ণাঙ্গ গেম খেলতে ঐ ভদ্রলোককে চ্যালেঞ্জ করেন। খেলতে খেলতে নিজের জীবনের করুণ কাহিনী বলতে থাকেন ঐ ভদ্রলোক, যিনি আর কেউ নন, আমাদের গল্পের নায়ক ডক্টর বি.! অদ্ভুত ও দুর্বোধ্য সব চালে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নকে প্রায় হারিয়ে দিচ্ছেন, এমন সময় নিজেকে আর সামলাতে না পেরে গভীর কষ্টে আচ্ছন্ন হয়ে খেলা ছেড়ে উঠে চলে যান তিনি। অপেশাদার এক দাবাড়ুর কাছে নিশ্চিত পরাজয়ের লজ্জা থেকে রেহাই পান তৎকালীন বিশ্বসেরা দাবাডু!

সাহিত্যসমালোচকদের মতে, এই গল্পে মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বকে দাবার ছকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। গল্পকারের ভাষায়ঃ “A man reveals his character in a chess game…I know well enough from my own experience the mysterious attraction of ‘the royal game’, that game of games devised by man, which rises majestically above every tyranny of chance, which grants its victor’s laurels only to a great intellect, or rather, to a particular form of mental ability.”

সম্পূর্ণ ভিন্ন ধাঁচের এই গল্পগ্রন্থটি স্টেফান সেবাইগের সর্বশেষ সৃষ্টিকর্ম। প্রকাশকের কাছে পান্ডুলিপি জমা দেয়ার কয়েকদিন পরেই ব্রাজিলে নির্বাসিত এই গুণী লেখক আত্মহত্যা করেন।

Leave A Reply
1 Comment
  1. Exsgpd says

    purchase terbinafine online cheap – buy generic griseofulvin 250mg buy griseofulvin online

sativa was turned on.mrleaked.net www.omgbeeg.com

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More