ভারতীয় ইতিহাসে যে সকল রাজ্য বিজেতা নিজ যোগ্যতাবলে ইতিহাসের স্বর্ণ-সিংহাসনে আরোহণ করেছেন সুলতান মাহমুদ তাদের মধ্যে অন্যতম। সুলতান মাহমুদ গজনবী আফগান সিংহাসনে আরোহণ করার পর থেকে যে পরিমাণ অভিযান পরিচালনা করছেন এবং বিজয় লাভ করেছেন, এই পরিমাণ যুদ্ধ বিজেতা ইতিহাসে খুব কমই রয়েছে। তার কাছে যুদ্ধ পরিচালনা ছিল একধরনের সহজাত প্রবণতা যার কারণে তিনি ক্ষমতায় থাকাকালে প্রায় প্রতি বছরই কোন না কোন অভিযান পরিচালনা করেছেন পাশাপাশি বিজয়ও লাভ করেছেন। তার জীবদ্দশায় সর্বাধিক অভিযান পরিচালনা করেন ভারতের বিরুদ্ধে। শুধু ভারতেই তিনি ১৭ বার অভিযান প্রেরণ করেন এবং কাকতালীয় হলেও সত্য প্রতিবারই তিনি জয় লাভ করেন। আফগান ইতিহাসে সুলতান মাহমুদ একজন ধর্মভীরু সাহসী বীরযোদ্ধা। অপরদিকে ভারতীয় হিন্দু ইতিহাসে তিনি একজন দস্যু, শান্তি বিনষ্টকারী, লুণ্ঠনকারী ও নির্দয়, ক্ষমতার অপ-ব্যবহারকারী। সুতরাং সুলতান মাহমুদ ইতিহাসে দ্বৈত চরিত্রের এক উজ্জ্বল প্রতীক।
ইতিহাস বিখ্যাত বিজেতা সুলতান মাহমুদ ৯৭১ সালে বর্তমান আফগানিস্তানে সবুক্তগিন পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ছিল সবুক্তগিন। ৯৯৭ সালে তার পিতার মৃত্যু হলে সুলতান মাহমুদ তার অপর ভাই ইসমাইলের সাথে গজনবী সাম্রাজ্যের শাসনভার দখলের প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়। এতে মাহমুদ তার ভাইকে পরাজিত করে গজনির শাসন ক্ষমতা নিজ হাতে তুলে নেন। তখন গজনবী সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ছিল বর্তমান আফগানিস্তান ও খোরাসান বা পূর্ব পারস্য। এসময়ে এ-অঞ্চলে অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দেখা দিলে সুলতান মাহমুদ তা কঠোর হস্তে দমন করেন।
শাসন কার্যের শুরুতে সুলতান মাহমুদ সামানিদ বংশের আনুগত্য স্বীকার করে আমির উপাধি গ্রহণ করে শাসনকার্য শুরু করলেও ১০০০ সালের শুরুর দিকে সামানিদদের অধীনতা অস্বীকার করে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং সরাসরি আব্বাসী খলিফার আস্থা অর্জন করে নিজেকে আব্বাসী খিলাফতের অধীনস্থ শাসক হিসেবে ঘোষণা করে সুলতান উপাধি গ্রহণ করেন। এর পর থেকেই ইতিহাসে তিনি সুলতান মাহমুদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। সুলতান মাহমুদ দীর্ঘকাল শাসন কার্য পরিচালনার পর ১০৩০ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তার জীবদ্দশায় তিনি অসংখ্য বিজয়াভিযান পরিচালনা করেন এবং বীরত্বের সহিত সাফল্য লাভ করেন।
সুলতান মাহমুদ এর ভারত আক্রমন এবং বিজয়
সুলতান মাহমুদ গজনবী র সিংহাসনে আরোহণ করার পর পরই অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমন দিয়ে তার সামরিক অভিযানের সূচনা হয়। সাময়িক সফলতা লাভ করার পর নিজ সামরিক সক্ষমতার উপর আত্মবিশ্বাস অর্জন করায় ভারত আক্রমণের সংকল্প করেন। তার জীবদ্দশায় সর্বমোট সতের বার ভারত আক্রমণ করেন। তার ভারত অভিযান শুরু হয় ১০০০ সালে এবং ১০২৬ পর্যন্ত বার বার ভারত আক্রমণ করেন।
সুলতান মাহমুদ ১০০০ সালে সীমান্তবর্তী অঞ্চলে অভিযানের মাধ্যমে ভারতীয়দের বিরুদ্ধে অভিযানের সূচনা হয়। এই অভিযানে খাইবার গিরিপথ অতিক্রম করে ভারতে অভিযান পরিচালনা করেন এবং সফলতা লাভ করেন। এর মাধ্যমে সুলতান মাহমুদের সফলতার যে ভিত রচিত হয় তার ধারাবাহিতায় ১৭ বার ভারতে অভিযান করেন এবং প্রত্যেকবারই সাফল্য লাভ করেন।
প্রথম অভিযানের অল্পকাল পরেই জয়পালের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে অভিযান প্রেরণ করে তাকে পরাজিত করেন এবং ধনদৌলত লাভ করেন। তৃতীয় ও চতুর্থ অভিযান প্রেরণ করেন ১০০৪ সালে ভীর এবং ১০০৬ সালে মুলতানের বিরুদ্ধে, উভয় যুদ্ধেই সুলতান মাহমুদ জয় লাভ করেন । এর পর একে একে ১০০৮ সালে আনন্দ পাল, কাংরা, নগরকোট, ১০০৯ সালে প্রতিরোধ মূলক ব্যবস্থা গ্রহণ, ১০১৪ সালে খানেশ্বর, ১০১৮ সালে কৌনজ ও মাথুরার বিরুদ্ধে এবং ১০২০ সালে গোয়ালিয়র ও কালিঞ্জরের বিরুদ্ধে অভিযান প্রেরণ করেন, তার জীবনের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ভারত অভিযান হল ১০২৬ সালে সোমনাথ মন্দিরে অভিযান পরিচালনা। আর জাঠদের বিরুদ্ধে ১০২৭ সালের অভিযানের মধ্যদিয়ে ভারতে তার অভিযানের সমাপ্তি সংঘটিত হয়।
সুলতান মাহমুদ কর্তৃক সোমনাথ মন্দির অভিযান
সুলতান মাহমুদ ভারতে যে অভিযানের জন্য বিখ্যাত এবং একই সাথে সমালোচিত বা বিতর্কিত হয়ে আছেন সেটি হল সোমনাথ মন্দির বিজয়। সোমনাথ মন্দিরটি কাথিয়াবাড়ের পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত ছিল। সুলতান মাহমুদ সোমনাথ মন্দিরের ধন-দৌলত ও ঐশ্বর্যের সংবাদ পেয়ে এটি বিজয়ের ইচ্ছা পোষণ করেন। এজন্য তিনি বিশাল এক সৈন্য বাহিনী নিয়ে সোমনাথের দিকে অগ্রসর হন। তার অগ্রসর হওয়ার সংবাদ পেয়ে গুজরাটের রাজাসহ বেশ কয়েকজন রাজপুত রাজা ও অসংখ্য রাজপুত সৈন্য সুলতান মাহমুদকে প্রতিরোধ করার জন্য কৃত-সংকল্পবদ্ধ হন। কিন্তু সুলতান মাহমুদের সামনে কোন বাধাই টিকতে পারল না। সুলতান মাহমুদের সাথে প্রতিপক্ষের তুমুল যুদ্ধ বাধে কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত বিশাল রাজপুত পরাজিত ও নিহত হয়। এতে প্রায় পাঁচ হাজারের অধিক রাজপুত নিহত হয়। ফলে সুলতান মাহমুদ জয়লাভ করে এবং সোমনাথ মন্দিরের প্রতিমা ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেয়।
এই মন্দির হতে তিনি প্রভূত ধন সম্পদ লাভ করেন, এই সম্পদের মধ্যে শুধু স্বর্ণের পরিমাণই ছিল প্রায় চল্লিশ মণ। কথিত আছে সুলতান মাহমুদ যখন মন্দিরের প্রতিমা ধ্বংস করছিলেন এর পূর্বে ব্রাহ্মণ রাজা প্রতিমা না ভাঙ্গার জন্য প্রচুর পরিমাণ ধন সম্পদ দিতে সম্মত হন কিন্তু সুলতান মাহমুদ এসব প্রত্যাখ্যান করেন। এর পিছনে সুলতান মাহমুদের বক্তব্য ছিল – ইতিহাস আমাকে প্রতিমা ব্যবসায়ীর চেয়ে প্রতিমা ধ্বংসকারী হিসেবে মনে রাখুক। তবে এ বক্তব্যের বিষয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মত পার্থক্য রয়েছে। তবে তিনি যে সোমনাথ মন্দিরের ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছেন এবং লুণ্ঠন করেছেন তা সত্য।
সুলতান মাহমুদ কেন বার বার ভারত আক্রমণ করেন
একক কোন নির্দিষ্ট কারণে সুলতান মাহমুদ বার বার ভারত আক্রমণ করেন নি। এর পেছনে নানাবিধ কারণ বিদ্যমান। যদিও অনেকেরই ধারনা যে সুলতান মাহমুদ কেবল ভারতের ধন-সম্পদ লুণ্ঠন ও হিন্দু ধর্মের ধ্বংস করার উদ্দেশ্যেই ভারত আক্রমণ করেছন। তবে আধুনিক ঐতিহাসিক-গন এ-মতবাদকে এক পাক্ষিক ও সংকীর্ণ ইতিহাস বলে আখ্যায়িত করেন। তাদের মতে সুলতান মাহমুদের ভারত আক্রমণের পিছনে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উদ্দেশ্যই ছিল মুখ্য।
কেননা সুলতান মাহমুদ সিংহাসনে আরোহণ করার পূর্বেই রাজপুত-হিন্দু রাজাদের সাথে গজনবীর কর প্রদানের মত বেশ কিছু চুক্তি বিদ্যমান ছিল। কিন্তু সুলতান মাহমুদের সিংহাসনে আরোহণের পর যখন তিনি সাফাবিদ ও অন্যান্য অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহীদের দমনে ব্যস্ত ছিলেন তখন সুযোগ বুঝে রাজপুত রাজারা সকল চুক্তি অস্বীকার করে এবং সুলতানের আনুগত্য অস্বীকার করে। ফলে বাদ্য হয়ে সুলতান মাহমুদ তাদের বিরুদ্ধে অভিযান প্রেরণ করেন।
তাছাড়াও সুলতান মাহমুদ যখন অভ্যন্তরীণ সকল বিদ্রোহ দমন করে তার সামরিক দক্ষতার প্রমাণ দিতে সমর্থ হলেন, তার পর পরই তার সামনে অন্য আরেকটি চ্যালেন্স ছিল তার সামরিক দক্ষতাকে রাজ্যের বাহিরে প্রতিষ্ঠা করা ও তার রাজ্য বিজয়ের উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবে রূপদান করা। এরই ধারাবাহিকতায় সুলতান মাহমুদ তার সৈন্যবাহিনীকে গড়ে তোলেন এবং ভারত আক্রমণে উদ্বুদ্ধ হন।
সুলতান মাহমুদের ভারত আক্রমণের পিছনে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল গজনীর অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন। তখনকার সময়ে ভারত ছিল ধন-সম্পদে পরিপূর্ণ এক সমৃদ্ধ জনপদ। সুতরাং সুলতান মাহমুদ লক্ষ করলেন যে যদি গজনী ভারতের বিরুদ্ধে সামরিক সফলতা লাভ করতে পারে তা হলে ভারতের ধন সম্পদ সীমিত আকারে হলেও গজনীতে স্থানান্তরিত হবে ফলে এতে গজনীর অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন সাধিত হবে। এই লক্ষকে সামনে রেখে সুলতান মাহমুদ ভারত আক্রমণ করেন এবং সফলও হন। ফলে সুলতান মাহমুদ ভারত থেকে বহু ধন সম্পদ গজনীতে নিয়ে যান।
সুলতান মাহমুদের ভারত জয়ের পেছনে তার সামরিক দক্ষতার প্রমাণ ও ইতিহাসে একজন বিখ্যাত বিজেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করাও তার অন্যতম প্রধান লক্ষ ছিল। কেননা তিনি শুধু বিজয় অভিযান ও সফলতা লাভের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলেন, ভারতে কোন স্থায়ী শাসন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেননি। ফলে ভারতে তিনি কোন সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে পারেন নি।
যেসব কারণে সুলতান মাহমুদ ইতিহাসে বিখ্যাত
ইতিহাসে সুলতান মাহমুদ বহুমাত্রিক প্রতিভাধর হিসেবেই সমধিক পরিচিত। তিনি একাধারে ছিলেন ধর্মভীরু, বীর যোদ্ধা,দক্ষ প্রশাসক, শিল্পসাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক, ন্যায় বিচারক ও রাজ্য বিজেতা। সুলতান মাহমুদের ধর্মভীরুতা সম্পর্কে বহু কল্প-কাহিনী রচিত হয়েছে। তিনি নিয়মিতভাবে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতের সহিত আদায় করতেন এছাড়াও প্রচুর নফল নামাজ আদায় করতেন। কথিত আছে তিনি ফরজ-সুন্নত নামায আদায় করার পরও দৈনিক একশত রাকাত নফল নামায আদায় করতেন। তাছাড়াও তিনি নিয়মিত কুরান পাঠ করতেন এবং অন্যান্য ধর্মীয় কর্মকাণ্ড যথাযথ পালন করতেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত ধর্মভীরু ও সর্বদা আল্লাহর উপর আস্থা স্থাপনকারী।
এসব গুন থাকার পরও তার যে গুন তাকে সমধিক পরিচিতি এনে দিয়েছে সেটি হল তার সামরিক দক্ষতা। তিনি সমগ্র জীবনই অতিবাহিত করেছেন যুদ্ধ -বিগ্রহের মধ্যে দিয়ে। কেননা সিংহাসনে আরোহণ করে প্রথমেই তাকে অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমনে ব্রতী হতে হয় এবং পরবর্তীতে বাহিরের অন্যান্য শত্রুদের মোকাবেলা করতে হয়। এর মধ্যে সামানিদ ও ভারতীয়দের মত প্রশিক্ষিতসব সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে সফলতা লাভ করতে হয়। তিনি জীবনে যুদ্ধে পরাজয়ের স্বাদ খুব কমই ভোগ করছেন। কেননা মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত ভারতের বিরুদ্ধেই সর্বাধিক যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন যেখানে তিনি পরাজয় বরন করেননি বললেই চলে।
সুলতান মাহমুদের আর একটি গুন তাকে মহান করে রেখেছে সেটি হল জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা দান। তার সময়ে গজনীর দরবার জ্ঞানী -গুনিদের মিলনস্থলে পরিণত হয়। সুলতান মাহমুদ নিজে বিভিন্ন সাহিত্য আলোচনা সভায় উপস্থিত থাকতেন। তার দরবারে শাহনামার রচয়িতা ফেরদৌসি, দার্শনিক ফারাবী, ঐতিহাসিক উৎবী, আখ্যান রচয়িতা বাইহাকী, কবি আলগারী, উজারী প্রভৃতি জ্ঞানী-গুনিদের দ্বারা অলংকৃত ছিল। তাছাড়া বিখ্যাত আল বিরুনিও তার দরবারে কিছুদিন পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন। ভারত থেকে বহু মূল্যবান বই-পুস্তক ও পাণ্ডুলিপি তার দরবারের জ্ঞান বিজ্ঞানের পথকে অনেকটা সুপ্রসিদ্ধ করে।
একজন শ্রেষ্ঠ বিজেতা হিসেবে ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। তাকে গজনীর নেপোলিয়ন বলে আখ্যায়িত করা হয়। তবে নেপোলিয়নের মত সফলতা তিনি লাভ করতে পারেন নি। কেননা তিনি শুধু যুদ্ধের মাধ্যমে রাজ্য জয়ই করেছেন কিন্তু কোন স্থায়ী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে পারেন নি। তার বিরুদ্ধে পরধর্ম সম্পর্কে অসহিষ্ণুতার অভিযোগ থাকলেও তা পুরোপুরি সত্য নয়। কেননা তিনি যুদ্ধবিগ্রহ ছাড়া অন্য ধর্মের কোন জনসাধারণের উপর অত্যাচার করেননি । সুলতান মাহমুদের চরিত্রে ভিন্নতা থাকলেও তিনি সাহসী বীর যোদ্ধা হিসেবেই ইতিহাসে সমধিক পরিচিত হয়ে আছেন। তিনি ভবিষ্যতেও সকল বীর যোদ্ধাদের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবেন।
order rybelsus 14mg pills – order DDAVP spray desmopressin for sale
lamisil uk – order lamisil sale purchase griseofulvin pills