ভারতীয় গরুড়পুরাণ মতে, হীরা বা মণি-রত্ন মানুষের জন্য বয়ে আনে উন্নতি আর সাফল্য। কিন্তু গরুড়পুরাণ রচিত হবার সময় থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত ইতিহাস বলে ভিন্ন কথা। কেবল সাফল্য আর উন্নতি নয়, একটি দামী হীরার মালিকানা ডেকে আনতে পারে বিপদ, ষড়যন্ত্র এমনকি মৃত্যুও।
দুনিয়ার তাবৎ হীরাগুলোর মধ্যে কিছু হীরা খুব বিখ্যাত , নয়তো সেগুলোকে ঘিরে ঘটা নানারকম ঘটনার জন্য কুখ্যাত। হোপ ডায়মন্ড দ্বিতীয় দলে। এর বিশেষত্ব হলো এটি অনেক মালিকের অপমৃত্যু থেকে শুরু করে নানা দুর্ঘটনা ডেকে এনেছে। সেই কাকতালীয় দুর্ঘটনা কিংবা সর্বনাশের সংখ্যা এত বেশী যে, হোপ ডায়মন্ডকে বলা হয় অভিশপ্ত হীরা। আজকের নৈবেদ্য অভিশপ্ত হোপ ডায়মন্ডের আদ্যোপান্ত নিয়ে।
হীরাটি উত্তোলিত হয় ভারতবর্ষের গোলকুন্ডার কোল্লুর খনি থেকে (বর্তমান অন্ধ্রপ্রদেশে অবস্থিত)। একই খনি থেকে পাওয়া গিয়েছিলো বিশ্ববিখ্যাত কয়েকটি হীরা। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো রাশিয়ার অরলভ ডায়মন্ড, এবং ইংল্যান্ডের রাণীর মুকুটে শোভা পাওয়া বিশ্ববিখ্যাত কোহ-ই-নূর।
একে সর্বপ্রথম পশ্চিমাদের সমক্ষে আনেন বিখ্যাত ফরাসী পর্যটক ও রত্ন-ব্যবসায়ী জাঁ ব্যাপটিস্ট ট্যাভেনিয়ার। কথিত আছে, তিনি কোনো এক মন্দিরের মূর্তির চোখ থেকে হীরাটি সরিয়েছেন। সেখানকার পুরোহিতের দেয়া অভিশাপই হীরাটি বয়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু এরকমটা হয়ে থাকলে তো আরেকটি হীরা থাকার কথা, সেটি কোথায়? এর কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা গবেষকরা দিতে পারেন নি। ট্যাভেনিয়ার যখন হীরাটি সংগ্রহ করেন, তখন এর ওজন ছিলো প্রায় ১১২ ক্যারাট। এটি ছিলো ত্রিভুজাকৃতি। তিনি ১৬৬৮ সালে আরো ছোট-বড় চোদ্দোটি হীরার সাথে এই হীরাটিও বিক্রি করেন সম্রাট চতুর্দশ লুই এর কাছে। নীল দ্যুতিময় হীরাটি পরিচিত হয় ‘ফ্রেঞ্চ ব্লু’ নামে। ট্যাভেনিয়ার স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেন রাশিয়ায়। যেমন বিভ্রান্তি আছে তিনি হীরাটি কিনেছিলেন নাকি চুরি করেছিলেন, বিভ্রান্তি আছে তাঁর মৃত্যু নিয়েও। অনেকের মতে, তিনি বৃদ্ধ বয়সে কুকুরের আক্রমণে মারা যান।
রাজা চতুর্দশ লুইয়ের স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটে। হোপ ডায়মন্ডের সর্বনাশ শুরু হয় রাজা ষোড়শ লুই থেকে। উপযুক্ত প্রমাণবিহীন একটি দাবী আছে যে, রাজা সর্বপ্রথম তাঁর গোপন প্রেমিকা মাঁদাম দ্য মন্তেস্প্যানকে হীরাটি উপহার দেন। কিন্তু তিনি রাজা ও রাষ্ট্রবিরোধী কার্যক্রমে যুক্ত থাকায় হীরাটি পুনরায় ফিরে আসে রাজপ্রাসাদে। দরবারের রাজপুরুষ নিকোলাস ফুকে মাত্র একবার ধার করে এক পার্টিতে হীরাটি পরেছিলেন। এর পরপরই তিনি রাজার রোষের শিকার হন। তাকে ‘ক্ষমতা দখলের অপচেষ্টা’র অপরাধে যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত করা হয়। পনেরো বছর তার জেলেই কাটে। অনেকের ধারণা, ইনিই ‘ম্যান ইন দ্য আয়রন মাস্ক’। চরম দুঃশাসনের মাশুল গুণতে ফরাসী বিপ্লবের সময় ষোড়শ লুই ও তাঁর স্ত্রী আন্তোনেতঁ প্রাণ হারান গিলোটিনে। এরপর রাজপ্রাসাদের অন্যান্য মূল্যবান জিনিসপত্রের সাথে হীরাটিও চুরি হয়ে যায়। ফরাসী রাজদরবারে হীরাটি দুইবার কাটাই করে নতুন আকৃতি দেয়া হয়েছিলো।
উনিশ শতকের শুরুর দিকে হীরাটিকে ব্রিটেনে দেখা যায়। রাজা চতুর্থ জর্জ হীরাটি কেনেন। মৃত্যুর পর দেনা পরিশোধ করতে তাঁর সহায় সম্পত্তি বিক্রি করা হয়। সেই তালিকায় হীরাটিও ছিলো।
১৮৩৯ সালে স্যার উইলিয়াম ফিলিপ হোপ নামে এক ব্রিটিশ ব্যাংকার হীরাটি কেনেন। তখন হীরাটির ওজন ছিলো প্রায় ৪৬ ক্যারাট। তাঁর পরে হীরাটি হস্তগত হয় ভ্রাতুষ্পুত্র হেনরি থমাস হোপের কাছে। অভিশাপ নামে স্যার হেনরির ছেলে লর্ড ফ্রান্সিস হোপ এর উপর। উত্তরাধিকার সূত্রে বেশ ভালোই সম্পত্তি পেয়েছিলেন তিনি। জুয়ার নেশা আর বেহিসেবী খরচের কারণে ফ্রান্সিস দেউলিয়া হন। তাঁর স্ত্রী মেরি ইয়োহে তাঁরই প্রতিদ্বন্দ্বীদের একজনের সাথে পালিয়ে যান, পরবর্তীতে মৃত্যুবরণ করেন নিদারুণ দারিদ্র্যে। এই হোপ পরিবারের নামানুসারেই হীরাটির নাম এখন ‘হোপ ডায়মন্ড’।
বিংশ শতকের শুরুর দিকে সাইমন ফ্রাঙ্কেল নামক এক ব্যবসায়ী হীরাটিকে নিলামে তোলেন। এরপর তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্যের শেষ সুলতান দ্বিতীয় আবদুল হামিদের তোষাখানায় স্থান পায় হীরাটি। আবদুল হামিদ ওটি বিক্রির জন্য সব ব্যবস্থা করেন। কিন্তু কার্যক্রম সম্পূর্ণ হবার আগেই তিনি ক্ষমতাচ্যূত হন এবং হীরা বিক্রির একটি পয়সাও তার ভাগ্যে জোটে নি।
নানাজনের হাত ঘুরে এরপর হীরাটি গিয়ে ঠেকে আমেরিকান রত্নব্যবসায়ী পিয়েরে কার্তিয়ের কাছে। ততদিনে হীরাটি নিয়ে লোকমুখে কিছু গল্প চাউর হয়ে গেছে। আমেরিকায় একের পর এক নিলামে অনেকেই আগ্রহ দেখালেও কেউই কেনেন নি, কার্তিয়ে ছাড়া। তিনি কোনোরূপ সর্বনাশের শিকার হন নি। গবেষকদের অনেকেই কার্তিয়েকে দায়ী করেন হীরাটির ‘অভিশপ্ত’ তকমা জোটার পেছনে। তিনি সম্ভবত হীরাটির বাজার দর বাড়ানোর জন্য নানারকম গুজব ছড়িয়ে দিয়েছিলেন।
হীরাটি অভিশাপ বয়ে আনে এর পরবর্তী ক্রেতা ইভালিন ওয়ালশ ম্যাকলিন এর জন্য। ১৯১২ সালে ওয়াশিংটনের ম্যাকলিন দম্পতি হীরাটি কেনেন। ইভালিনের ছেলে গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যান, মেয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন। স্বামী অন্য একজন মহিলার পেছনে ছুটে ছুটে শেষে মারা যান এক উন্মাদ-আশ্রমে। হীরার তথাকথিত অভিশাপের ভুক্তভোগীদের মধ্যে ইভালিনের ক্ষতির তালিকাটাই সবচেয়ে বড়। ইভালিনের সর্বনাশের পর অভিশাপের একটি প্যাটার্ন স্পষ্ট হয়। যে মালিকের উপর বিপদ এসেছে, তার পরবর্তী জন কোনো ক্ষতির সম্মুখীন হয় না।
সেই প্যাটার্ন অনুসারেই বলা যায়, ম্যাকলিন এস্টেটের কাছ থেকে ১৯৪৫ সালে হীরাটি কিনে হ্যারী উইনস্টোন অভিশাপ এড়িয়ে যান। ১৯৫৮ সালে তিনি এটি বিক্রি করেন, মতান্তরে দান করেন স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটিউটের ‘ন্যাশনাল মিউজিয়াম অভ ন্যাচারাল হিস্ট্রি’কে। এই অব্দি মিউজিয়ামটি কোনো দুর্ঘটনার মুখোমুখি হয় নি। তবে যে পোস্টম্যান হীরাটি মিউজিয়ামে পৌঁছে দিয়েছিলো , সেই জেমস টড অত সৌভাগ্যবান ছিলেন না। তিনি ট্রাকের ধাক্কায় আহত হন, অল্প কিছুদিন পরেই তার স্ত্রী ও পোষা কুকুরটি মারা যায়। আরোও কিছু দিন পর তার বাড়িতে আগুন লাগে।
হীরাটির সান্নিধ্যে এসে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন এমন একজন মেরি লুই, তিনি ছিলেন রাণী আন্তোনেতেঁর সবচেয়ে বিশ্বস্তদের মধ্যে একজন। তিনি উন্মত্ত জনতার হাতে নৃশংস ভাবে খুন হন। ডাচ রত্ন-ব্যবসায়ী উইলিয়াম ফলস রত্নটির কাটাই করেছিলেন। তার ছেলে তাকে হত্যা করে আত্মহত্যা করে। গ্রীক ব্যবসায়ী সিমন ম্যানক্রাডিসও হীরাটির ছোঁয়া পেয়েছিলেন কিছুদিনের জন্য। তিনি সপরিবারে গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যান।
১৯৫৮ সাল থেকে হীরাটি কারো কোনো ক্ষতির সম্ভাব্য কারণ না হয়ে বহাল তবিয়তেই আছে স্মিথসোনিয়ান মিউজিয়ামে। এর বর্তমান ওজন প্রায় ৪৫.৫২ ক্যারাট। পিয়েরে কার্তিয়ের করা ডিজাইন অনুযায়ীই শেষবার হীরাটি কাটাই হয়েছে। গবেষকরা জানিয়েছেন এর নীলাভ দ্যুতির কারণ বোরন কণার উপস্থিতি। হীরাটিকে ঘিরে বসানো আছে ১৬ টি এবং গহনার চেইনে আছে ৪৫ টি সাদা হীরা। এই হীরা গুলো মিসেস ইভালিন ওয়ালশের। সম্প্রতি গবেষকরা জানিয়েছেন, ‘ফ্রেঞ্চ ব্লু’ কিংবা ‘ট্যাভেনিয়ার ব্লু’ নামে পরিচিত হীরাটির অদ্ভুত নীলাভ দ্যুতির কারণ এর আণবিক গঠনে বোরন কণার উপস্থিতি।
রহস্যময় নীল দ্যুতির সাথে যেন বিতর্কও ছড়ায় হীরাটি। হীরাটি আসলেই অভিশপ্ত কী না, কিংবা অভিশাপ বলে আসলেই কিছু আছে কী না সে নিয়ে তুমুল তর্ক চলে আজো। ট্যাভেনিয়ারের মৃত্যু রহস্যাবৃত, চতুর্দশ লুই ও তাঁর স্ত্রীর মৃত্যু হয়ত স্রেফ রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের কারণে হতে পারে। ফ্রান্সিস হোপ নিজেই সবচেয়ে দায়ী নিজের ধ্বংস ডেকে আনার জন্য। জেমস টডই বা কেন দুর্ঘটনার শিকার হবে? সে তো পোস্টম্যান বৈ কিছুই ছিলো না। তবে কী হোপ ডায়মন্ডের অভিশাপ বলতে যা আছে পুরোটাই ধুরন্ধর ব্যবসায়ী পিয়েরে কার্তিয়ের গুজব? কিন্তু ইভালিন ওয়ালশের পরিবার ধ্বংস হয়ে যাওয়া কিংবা দ্বিতীয় আবদুল হামিদের সিংহাসন হারানো বলতে চায় অন্য কথা।
রহস্য আরো ঘোলাটে করতে হীরাটি নিজেই যেন এর অভিশাপের প্যাটার্ন কয়েকবার ভঙ্গ করেছে। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে ১৯৫৮ সাল থেকে স্মিথসোনিয়ান মিউজিয়ামে আছে হীরাটি এবং এ পর্যন্ত মিউজিয়ামের কারো ক্ষতি ডেকে আনে নি। তবে কী হীরার অভিশাপ শুধু ব্যক্তির বেলায়ই খাটে? নাকি হীরাটির হাত বদলের ঘটনাগুলোর সাথে কাকতালীয়ভাবে কয়েকটা দুর্ঘটনার সময় মিলে গেছে? অন্যসব বড় বড় প্রশ্নের মত দুনিয়ার মানুষ এই প্রশ্নের উত্তরে দুই ভাগে বিভক্ত।
zetia side effects weight gain
lamisil cost – fulvicin without prescription grifulvin v tablet
lamictal and zyprexa
zofran abuse