রুপার্ট মারডক: মিডিয়া জগতের এক সব্যসাচীর গল্পগাঁথা
সময়কাল ১৯৫২ সাল। অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে জন্ম নেয়া সেই ব্যক্তির বাবা মারা যান যিনি ছিলেন পেশায় একজন সংবাদপত্র প্রকাশক এবং সেইসাথে অস্ট্রেলিয়ার এডিলেডের সংবাদপত্রের পুরো প্রকাশনার দায়িত্ব এসে পড়ে তাঁর ঘাড়ে। এভাবেই শুরু হয় তাঁর জীবনের একটি নতুন অধ্যায় এবং দ্বিতীয় দশকে এসে ফোর্বসের শীর্ষ বিলিয়নিয়ারদের স্থানে জায়গা করে নেন। বলছিলাম মিডিয়া জগতের একচ্ছত্র শাসক রুপার্ট মারডক সম্পর্কে যার জন্ম ১১ মার্চ, ১৯৩১ সালে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে।
অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের মিডিয়া দাপিয়ে শাসন করা একটি পরিবারের একজন সদস্য হতে পারাটা আসলেই রীতিমতো ভাগ্যের ব্যাপার। রুপার্ট মারডক তাঁর নাম সারাবিশ্বে এভাবেই চিনিয়েছেন যে অস্ট্রেলিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি এবোট বলেন, “অস্ট্রেলিয়ার অন্যান্য ব্যক্তিত্বের চেয়েও বরং মারডকের প্রভাব সারাবিশ্বে অনেক বেশি।”
কেমন ছিল মারডকের শৈশব?
শৈশব ছিল তাঁর অন্যদের চেয়ে একটু আলাদা রকমের, বিস্ময় জাগানিয়া। তাঁর পুরো নাম কেইথ রুপার্ট মারডক। তাঁর বাবা কেইথ মারডক ছিলেন একজন সাংবাদিক এবং “হেরাল্ড এন্ড উইকলি টিমস নিউজপেপার” নামের সংবাদপত্র প্রকাশক সংস্থার সিনিয়র এক্সিকিউটিভ অফিসার। মা এলিজাবেথ মারডক ছিলেন একজন মানবতাকর্মী। ১৯৫৩ সালে অক্সফোর্ড ওরচেস্টার কলেজ হতে শিক্ষাজীবন সম্পন্ন করেন। তাঁর পূর্বপুরুষগণ ছিলো ইংরেজ, আইরিশ এবং স্কটিশ। তাঁর ছিলো আরো তিন বোন।
ছোটবেলা হতেই মারডক ছিলেন উচ্চাবিলাসী। রাতের বেলা তিনি পানিতে থাকা বিশেষ প্রজাতির ইঁদুর শিকার করতেন এবং ছয় পেনি মূল্যে বিক্রি করতেন। খরগোশের বর্জ্য সার ব্যাগে করে সারা শহর ঘুরে বিক্রি করতেন। অতঃপর দিনশেষে উপার্জিত অর্থ জুয়া খেলে উড়াতেন।
ছাত্রাবস্থায় তাঁর জিলং গ্রামার বোর্ডিং স্কুলে’র সংবাদপত্রের সহ সম্পাদক ছিলেন তিনি। খেলাধুলায় ছিলেন বেশ দক্ষ। তাঁর একক নৈপুণ্যতায় স্কুল ক্রিকেট টিম ন্যাশনাল জুনিয়র ফাইনালে যায়।
১৯৫০ সালে ওরচেস্টার কলেজে রাজনীতি, দর্শন এবং অর্থনীতি বিষয়ে অধ্যয়নের জন্য গমন করেন।
বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের শুরু যেখান থেকে:
“এডিলেড নিউজ” নামের সংবাদপত্রে সাংবাদিকতার মাধ্যমে তিনি নিজের ক্যারিয়ারের প্রথম যাত্রা শুরু করেন।
সময় ৪ অক্টোবর, ১৯৫২ সাল। বাবার মৃত্যুতে তাঁর জীবনের সময়রেখা হতে মুছে যায় একটি অধ্যায়। তিনি ঘরে ফিরে আসেন এবং তাঁর বাবার প্রকাশনা ব্যবসা গোছাতে শুরু করেন।
“বিস্তার করো নয়তো মরো” বাক্যের প্রতিজ্ঞা নিয়ে তিনি নেমে পড়েন জীবন যুদ্ধে।
- সময়কাল ১৯৫৬ সাল। পার্থে “সানডে টাইমস” সংবাদপত্র কেনার মাধ্যমে ব্যবসার প্রসার শুরু হয়। এরপর ডারউইনের ‘স্মল টাউন নিউজপেপার’ কেনার জন্যে চলে যান।
- সময় ১৯৬০ সাল। ‘ফেয়ার ফ্যাক্স’ হতে সিডনীর জনপ্রিয় সংবাদপত্র ‘ডেইলি মিরর’ এবং ‘সানডে মিরর’ এর মালিকানা চলে আসে তাঁর হাতে। দ্রুত কার্যসম্পাদন করতে থাকেন তিনি। মিরর সংবাদপত্রে ছাপানো হতে লাগলো উত্তেজক গল্প, যৌন উত্তেজক ছবি সম্বলিত কুরুচিপূর্ণ বিষয়ে প্রবন্ধ এবং সাথে দামী পুরষ্কার ঘোষিত প্রতিযোগিতার আয়োজনও করা হতো।
- দ্রুততর সময়ে আরো বেশি সংবাদপত্র ছাপানোর উদ্দেশ্যে তিনটি বড় শহরে মুদ্রণ কারখানা স্থাপন করেন। তাঁর সংবাদপত্র ‘হলুদ সাংবাদিকতা’ নামে পরিচিত ছিলো।
- সময়কাল জানুয়ারি, ১৯৬৪ সাল। নিউজিল্যান্ডে এক ভ্রমণে গিয়েছিলেন তিনি। সেখানে ‘দ্যা ডোমিনন” নিউজপেপার বিক্রির নিলাম চলছিলো। তিনি সেখানে সর্বোচ্চ মূল্য হাঁকিয়ে নিলামে সংবাদপত্রটির মালিকানা স্বত্ব জিতে নেন।
- ঠিক একই বছরে (১৯৬৪) তিনি প্রকাশ করেন অস্ট্রেলিয়ার প্রথম সংবাদপত্র “দ্যা অস্ট্রেলিয়ান’। তাঁর মা ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর সন্তান দলগত ভাবে দাপিয়ে বেড়ানোর চেয়ে একচ্ছত্রভাবে স্বত্ব ভোগ করার ক্ষেত্রে আগ্রহী বেশি।
- ১৯৬৮ সালে তিনি ব্রিটিশ সংবাদপত্র জগতে পদার্পণ করেন ‘নিউজ অফ দ্যা ওয়ার্ল্ড’ খরিদের মাধ্যমে।
- তাঁর মায়ের সূত্রধরে, ১৯৬৯ সালে সারাবিশ্বের সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা হাতে নিয়ে তিনি লন্ডনের একজন সংবাদপত্র প্রকাশক বনে যান। এরপরই তিনি প্রায় ৮ লাখ ডলার মূল্যে কিনে নেন ‘দ্যা সান’ সংবাদপত্র যা পরে ম্যাগাজিনে রূপান্তর করেন তিনি।
- সময়কাল ১৯৭২ সাল। বিজয় মুকুট হিসেবে তিনি স্যার ফ্রাঙ্ক পেকার্স হতে শীর্ষস্থানীয় ‘দ্যা ডেইলি টেলিগ্রাফ’ সংবাদপত্রটি কিনে নেন।
- ১৯৭৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে তাঁর শেকড় আরো বিস্তৃত করেন ‘সেন এন্টোনিও এক্সপ্রেস-নিউজ’ ক্রয় করে।
- ১৯৭৬ সালে আমেরিকার সর্ববৃহৎ সংবাদপত্র ‘দ্যা নিউইয়র্ক পোষ্ট’ কিনে নেন প্রায় ৩০ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে। তবে ১৯৮৮ সালে জনপ্রিয় ‘নিউইয়র্ক পোষ্ট’ সংবাদপত্র বিক্রি করে দেন আইনগত জটিলতার কারণে।
- এভাবে ১৯৮১ সালে তাঁর মালিকানায় চলে আসে ‘দ্যা টাইমস’ এবং ‘সানডে টাইমস’।
- ২০০৫ সালে মাইস্পেস ডট কম হতে ৫৮০ মিলিয়ন ডলার দিয়ে ইন্টারম্যাক্স মিডিয়া খরিদ করেন। তবে ২০১১ সালে ৩৫ মিলিয়ন ডলারে বিক্রি কর দেন।
- ২০০৭ সালে ওয়াল স্ট্রীট সংবাদপত্র প্রকাশনী ‘ডো জনস’ খরিদ করেন।
অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকত্ব বাতিল:
সময়কাল সেপ্টেম্বর ০৪, ১৯৮৫ সাল। আমেরিকার টিভি চ্যানেল সম্প্রচার মালিকানা স্বত্ব পাওয়ার নিমিত্তে তিনি সবধরনের চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে আমেরিকার নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। তবে এই কার্যক্রমের মাধ্যমে তিনি নিজ মাতৃভূমি অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকত্ব খুইয়ে বসেন। তাঁর এই কর্মকাণ্ড সবাইকে হতবাক করে দেয়। শুধুমাত্র জীবনের স্থির লক্ষ্য সাধনের জন্য একজন মানুষ কিই না করতে পারে!
টিভি চ্যানেল সম্প্রচার মালিকানা স্বত্ব:
- সময়কাল ১৯৮৪ তে তিনি ‘20th Century Fox’ এবং ‘Metromedia Television’ এর ৫০ শতাংশ শেয়ার কিনে ফেলেন।
- পরবর্তী ১৯৮৬ এর অক্টোবর মাসে তিনি ‘Fox Broadcasting Company’ প্রতিষ্ঠা করেন।
- ডিসেম্বর ০১, ১৯৯০ সালে তাঁর সমকক্ষ অন্য স্যাটেলাইট সম্প্রচার কর্তৃপক্ষ ‘British Satellite Broadcasting’ কে বুঝিয়ে তাঁর চ্যানেল ‘Sky Television’ এর সাথে যৌথভাবে সম্প্রচারের নিমিত্তে তৈরি হয় ‘BSkyB’ স্যাটেলাইট কোম্পানি, যা তৎকালীন সময়ে প্রথম ভাগে ছিলো।
- ১৯৯৩ সালে তিনি এক বিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে রিচার্ড লি হতে হংকং বেইজড ‘স্টার টিভি’ চ্যানেল খরিদ করেন এবং সারা এশিয়া জুড়ে তাঁর অফিস স্থাপন করেন।
- ১৯৯৬ সালে ফক্স নিউজ চ্যানেল চালু করেন।
অন্যান্য খাতে সফলতা:
১. ‘Genie Oil and Gas’ নামের কোম্পানিতে তিনি বিনিয়োগ করেন যেখানে তিনি ছিলেন স্ট্রাটেজিক এডভাইজরি বোর্ডের একজন সদস্য। কোম্পানিটি মূলত কলোরাডো, মঙ্গোলিয়া এবং ইজরায়েল ইত্যাদি দেশে তেল সন্ধানের কাজ পরিচালনা করে।
২. মারডকের মালিকানাধীন মিডিয়ার প্রচুর প্রভাব ছিলো যা স্পষ্টতর ছিলো ব্রিটেনের রাজনীতিতে। একজন লেবার পার্টির সমর্থক হিসেবে তিনি সংরক্ষণশীল জোটের সাথে যোগ দেন এবং ৯২ সালে জন মেজরের বিজয়ের কৃতিত্ব বহন করেন।
৩. ১৯৯৮-২০০৪ সাল অবধি লস এঞ্জেলসের ‘ডজারস’ বেজবল টীমের মালিক ছিলেন।
ব্যর্থতা, খ্যাতি-বিচ্যুতি:
১. সময়কাল ১৯৯৮ সাল। মারডকের চোখ এখন খেলাধুলার রাজত্ব গ্রহণের দিকে। তবে ভাগ্য এখানে সহায় হয়নি তাঁর। ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগের অন্যতম সেরা দল ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড দলটিকে কেনার জন্য তাঁর স্কাই ব্রডকাস্টিং কোম্পানির পক্ষ হতে দেয়া ৬২৫ মিলিয়ন ডলারের নিলাম মূল্যের উপর স্থগিতাদেশ দেয় স্থানীয় সরকার। দর্শানোর জন্য কারণ হিসেবে বলা হয়, ফুটবল বিশ্বে আগ্রাসন ঠেকানোর নিমিত্তে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
২. স্কটল্যান্ড রাজনৈতিক নেতা টমি শেরিডন ২০০৬ সালে মারডকের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র এবং মিথ্যাভাবে ভিডিওটেপ সাজিয়ে প্রচারের অভিযোগ আনেন। পরে শেরিডনের করা মামলায় বাদী জিতে যান।
৩. মারডকের বিরুদ্ধে অন্যতম আরেকটি অভিযোগ ছিলো ব্যক্তিগত ফোন হ্যাকিং, পুলিশকে ঘুষ দান এবং অতিরঞ্জিত খবর ছাপানোর। এরইপ্রেক্ষিতে তাঁর সংবাদপত্রে নিজ মৃত্যুর ভুয়া খবরও ছাপানো হয়েছিলো। পরে হত্যার শিকার মিলি ডোলারের পরিবারের সাথে দেখা করেন এবং মিলির ফোন হ্যাকিংয়ের দায় স্বীকার করে ক্ষমা চান।
৪. সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার ছিলেন মারডকের ভালো বন্ধু, তবে ব্লেয়ারের সাথে টর্ভের পরকীয়া সম্পর্ক আছে সন্দেশে পরবর্তীতে ব্লেয়ারের সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছেদ করেন।
ব্যক্তিগত জীবন:
তাঁর প্রথম স্ত্রী পেট্রেসিয়া বোকার ছিলেন একজন দোকানের সহযোগী এবং ফ্লাইট এটেন্ডেন্ট। ১৯৬৭ সালে তাঁদের বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে।
দ্বিতীয় স্ত্রী আন্না মারিয়াকে ১৯৬৭ সালে বিয়ে করেন এবং ১৯৯৯ সালে দেড় বিলিয়ন ডলার এবং সাথে ১১০ মিলিয়ন ডলার নগদে নিষ্পত্তিতে ডিভোর্স দেন। রুপার্ট মারডকের এই বিবাহবিচ্ছেদ বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল বিবাহবিচ্ছেদের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে।
- ২৫ শে জুন, ১৯৯৯ সালে তৃতীয় বিয়ে করেন ওয়েন্ডি ডেংকে এবং ২০১৩ সালের জুনের ২৩ তারিখ ডিভোর্স দেন।
- ৮৫ বছর বয়সে জানুয়ারির ১৬, ২০১৬ সালে বিয়ে করেন জেরি হলকে।
- তাঁর ছয় সন্তান এবং ১৩ নাতিনাতনি আছে।
- পোপ জন পল II কর্তৃক ১৯৯৮ সালে নাইট উপাধি পান।
- ফোর্বসের বিলিয়নিয়ার তথ্য মতে তাঁর বর্তমান সম্পদের মূল্য প্রায় ১৩.৫ বিলিয়ন ডলার এবং স্থান ৭৮ তম।
প্রজন্ম দুনিয়াকে প্রযুক্তির ছোঁয়ার প্রদর্শক হিসবে যদি স্টিভ জবসকে আদর্শ মানা যায় তবে মিডিয়া জগতের আদর্শ হিসেবেও রুপার্ট মারডক একজন আদর্শ। রুপার্ট মারডক এতো বয়সেও থেমে নেই। কাজ করে চলেছেন অবিরত, ছাপ রেখে যাচ্ছেন তাঁর অনুসারীদের জন্য। মারডক হতে শেখার আছে অনেক কিছুই।
wellbutrin and metformin interaction
buy terbinafine tablets – buy generic diflucan order grifulvin v pill
zofran dosing renal failure
benefits of zyprexa