মার্কো পোলোর ঘটনাবহুল ভ্রমণের কাহিনী

32

পৃথিবী বিখ্যাত পর্যটকদের তালিকায় মার্কো পোলো এক অনুপ্রেরণার নাম ৷ পায়ে হেঁটেই যিনি জয় করেছিলেন সমগ্র বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ। মাত্র ১৭ বছর বয়সে অভিযান শুরু করা মার্কোর ভ্রমণকাহিনী নিয়ে লেখা বইয়ের মাধ্যমে শুধু তাঁর দীর্ঘ ২৪ বছরের  অভিজ্ঞতা সম্পর্কেই জানা যায় না বরং মধ্যযুগের সমাজ ব্যবস্থা থেকে শুরু করে ইতিহাস এমনকি ভৌগোলিক ধারণাও পাওয়া যায় ৷ পশ্চিমাদের মধ্যে সিল্ক রোড পাড়ি দিয়ে চীন দেশে এসে পৌঁছানো লোকজনের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম।

তাছাড়া ক্রিস্টোফার কলম্বাসের আমেরিকা জয়ের  পেছনে রয়েছে মার্কো পোলোর দুঃসাহসিক জীবনের অনুপ্রেরণা এমনটাও মনে করা হয় ৷

মার্কো পোলো
Source: Hello World Civ

বাল্যকাল:

মার্কো পোলো আনুমানিক ১২৫৪ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ইতালির ভেনিসের কোনো একটি অংশে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা নিকোলো পোলো আর মায়ের নাম নিকোলি অ্যানা ডিফিউসে। বাবা ছিলেন ধনী ব্যবসায়ী ও পর্যটক। মার্কো পোলোর বাবা মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে ব্যবসা করে বেশ ধনসম্পদ অর্জন করেছিলেন। নিকোলো এবং তাঁর ভাই মাফেও মার্কোর জন্মের আগেই বাণিজ্য যাত্রায় রওনা দেন ৷ মার্কোকে ছোট্ট রেখেই মারা যান তাঁর মা। এ সময় তিনি চাচা-চাচির তত্ত্বাবধানে বড় হন এবং তাঁদের কাছ থেকেই যাবতীয় শিক্ষা গ্রহণ করেন৷

বাবার সাথে প্রথম সাক্ষাৎ:

পনের বছর বয়সে মার্কোর সাথে প্রথম দেখা হয় তাঁর বাবার কারণ তাঁর বাবা ও চাচা কনস্টান্টিনোপলে বাণিজ্যে গিয়ে ফিরে আসতে পারেননি এতদিন ৷ পুবের বণিকরা এসে পশ্চিমের বণিকদের সঙ্গে মিলিত হতেন এ নগরীতে ৷ মার্কো পোলোর বাবা ও চাচা যখন অনেক দূরে এমন সময় ভেনিসের সঙ্গে পাশের জেনোয়া নগরীর প্রচন্ড যুদ্ধ শুরু হয় ৷ এ পরিস্হিতিতে সাগরভ্রমণ মোটেও নিরাপদ ছিল না ৷ বাড়ি ফেরার চিন্তা বাদ দিয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন আরো দূরে যাবেন ৷ জাহাজ নিয়ে হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে একসময় তাঁরা চীন গিয়ে পৌঁছালেন ৷ সে যুগে ইউরোপীয়দের কাছে চীন ছিল এক লোভনীয় দেশ ৷ বিশেষ করে মশলা সামগ্রী এবং রেশম ব্যবসার জন্য ৷ রেশম এবং মশলার মতো লাভজনক পণ্যের লোভেই মূলত ইউরোপীয় বণিকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চীন যেতেন ৷ মার্কো পোলোর বাবা এবং চাচাও ছিলেন তাই ৷ ১২৬৯ সালে নিকোলো ও মাফেও বাড়ি ফিরে প্রথমবারের মত মার্কো পোলোকে দেখেন। দুজন ফিরে এসে সবাইকে তাঁদের দীর্ঘ প্রবাসজীবনের কথা জানান ৷ এও জানান যে চীনে বিখ্যাত কুবলাই খানের অতিথি হয়ে ছিলেন তাঁরা ৷ মোঙ্গল সম্রাট কুবলাই খান তখন চীনের শাসক ৷

চীন অঞ্চলে কুবলাই খান শুধু ক্ষমতাবান ও শক্তিশালীই ছিলেন না তাঁর জ্ঞানও ছিল অগাধ ৷ বাইরের জগৎ সম্পর্কে জানার প্রবল আগ্রহ ছিল৷ মার্কো পোলোর বাবা ও চাচার কাছ থেকে ইউরোপের সভ্যতা এবং সংস্কৃতির ব্যাপারে জেনে সে অঞ্চলে প্রচলিত খ্রিস্টধর্মের প্রতি বেশ আগ্রহ জন্মায় কুবলাই খানের ৷ তিনি দু ভাইয়ের উপর দায়িত্ব অর্পণ করেন ইউরোপের পোপের কাছে একটি চিঠি পৌঁছে দেওয়ার জন্য যেখানে ইউরোপ থেকে একশ শিক্ষিত যাজক পাঠানোর অনুরোধ জানান তিনি ৷ কিন্তু দুভার্গ্যক্রমে ফেরার পথে তাঁরা জানতে পারলেন পোপ মারা গেছেন। নতুন পোপ নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত কিছুই করার নেই ৷ এদিকে ভেনিসে বসে থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে উঠেন পোলো ভ্রাতৃদ্বয় ৷ দুই বছর অতিবাহিত হয়ে গেলেও পোপ নির্বাচিত না হওয়ায় আবারও দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে চীন যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তাঁরা ৷ তবে এবার তাঁদের সাথে সফর সঙ্গী হিসেবে যুক্ত হল সতের বছর বয়সী মার্কো পোলো ৷

মার্কো পোলোর ভ্রমণ
মার্কো পোলোর ভ্রমণ
Source: GamersGate

চব্বিশ বছরের ভ্রমণ অভিজ্ঞতা:

১২৭১ সালে শুরু হয় মার্কো পোলোর পৃথিবী অভিযান ৷ একটানা সাড়ে তিন বছর ভ্রমণ করে পরবর্তীকালে পৃথিবীর সেরা পর্যটকদের তালিকায় স্হান করে নেন তিনি ৷ ভেনিস থেকে প্রথমে তাঁরা অ্যাড্রিয়াটিক সাগরের মধ্য দিয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে পৌঁছান আকর বন্দরে। ফিলিস্তিনের জেরুজালেমের কাছেই এ বন্দর ৷ সেখানে টিওব্যাল্ডো নামে একজন যাজকের সঙ্গে দেখা করেন৷ কিন্তু যেহেতু পোপ নির্বাচিত হয়নি তাই তিনিও কোন সাহায্য করতে পারলেন না ৷ তবে জেরুজালেমের কাছে আসায় কুবলাই খানের অন্য আরেকটি অনুরোধ রক্ষা করার সুযোগ পেলেন তাঁরা৷

কুবলাই খানের কাছে জেরুজালেমের সেপলক্যার গির্জার বিখ্যাত প্রদীপের গল্প করেছিলেন দু ভাই ৷ তাঁরা বলেন, হাজার বছর ধরে একটানা জ্বলছে প্রদীপটা ৷ কুবলাই খান এ প্রদীপের তেল আনতে অনুরোধ করেছিলেন তাঁদের ৷ সুযোগ পেয়ে নিকোলো এবং মাফেও পোলো মার্কোকে নিয়ে সেপলক্যার গির্জায় গেলেন ৷ প্রদীপের পবিত্র তেল নিয়ে আবার আকরে ফিরলেন ৷ কিন্তু তখনো নতুন পোপের কোনো খবর নেই ৷ টিওব্যাল্ডো একটা উপকার করলেন পোলোদের ৷ কুবলাই খানের উদ্দেশ্যে চিঠি লিখে জানিয়ে দিলেন পোলো ভাইদের যাজক নিয়ে না ফেরার অপারগতার কারণ ৷ তেল আর চিঠি নিয়ে মার্কো পোলোরা রওনা দিলেন আয়াসের পথে। সেখান থেকে যেতে হবে চীন দেশে। সেখানে গিয়ে খবর পেলেন নতুন পোপ নির্বাচিত হয়েছেন গ্রেগরি দশম। এবং কাকতালীয়ভাবে টিওব্যাল্ডোকেই পোপ হিসেবে নির্বাচিত করা হয়েছে৷ তাই তাঁরা আবার গেলেন তাঁর কাছে। পোপ সম্রাটের জন্য অনেক উপহার প্রদান করলেন কিন্তু একশো যাজকের পরিবর্তে কোনোক্রমে দুজন মঠের সন্ন্যাসী পাঠালেন তাঁদের সাথে। পাঁচজনের ছোট দলটা রওনা দিলেন আবার আর্মেনিয়া হয়ে চীন যাবার উদ্দেশ্যে ৷ এদিকে আর্মেনিয়া তখন রণক্ষেত্র ৷ ভয় পেয়ে সন্ন্যাসীরা পালিয়ে গেলেও পিছু হটলেন না পোলোরা ৷

শুরু হল তাদের এক কষ্টকর দীর্ঘ ভ্রমণ ৷ তখন স্থলপথে যান্ত্রিক কোনো বাহন ছিল না। কখনো পায়ে হেঁটে, কখনো খচ্চরে চড়ে, কখনো বা উটের পিঠে করে যেতে লাগলেন তাঁরা ৷ রাত কাটাতে লাগলেন খোলা আকাশের নিচে ৷ মার্কোর জন্য কষ্টের অভিজ্ঞতা এটাই প্রথম ৷ তবে মার্কো সেটা ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে উপভোগ করার চেষ্টা করেছেন ৷  যাত্রাপথের সব অভিজ্ঞতা সযত্নে টুকে রাখতেন ৷ মার্কো এক অদ্ভুত জায়গার বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছেন, তেলের ঝর্ণা রয়েছে সেখানে ৷ মাটি ফুঁড়ে তেল বেরুচ্ছে ফোয়ারার মতো ৷ দিন-রাত অবিরাম ঝরছে ৷ ভোজ্যতেল নয়, জ্বালানি তেল ৷ দূরদূরান্ত থেকে লোকজন আসে এ তেল নিতে ৷ সেই অদ্ভুত জায়গা এখন বিখ্যাত ‘বাকু তেলক্ষেত্র’ নামে পরিচিত৷ বিশ্বজুড়ে বিমান ও মোটরযানের জ্বালানি তেলের বিপুল চাহিদা মেটাচ্ছে এ তেলক্ষেত্র৷

মার্কো পোলো
Source: Help laetus-weblog.info

এছাড়াও এক এলাকার মানুষের কাছ থেকে তিনি জানতে পারেন, হযরত নূহ (আ:) এর সেই বিখ্যাত নৌকাটা মাউন্ট আরারাত নামে এক পর্বতচূড়ায় এখনো আটকে আছে৷ মহাপ্লাবনের পর নৌকাটা সেখানেই থেমেছিল ৷ এরকম লোকমুখে শোনা নানা গল্প নোট করে রাখতেন তিনি ৷ পরবর্তীতে তাঁর ভ্রমণকাহিনীতে সেগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয় ৷

আবারও তিন পোলোর ভ্রমণ অভিযানে ফিরে আসা যাক ৷ পারস্য উপসাগরের তীরে যাবার উদ্দেশ্যে রওনা হলেন তাঁরা৷ জাহাজে উঠে ভারত ঘুরে চীন যাবেন ৷ জলপথে গেলে বিপজ্জনক গোবি মরুভূমি পাড়ি দিতে হবে না ৷ সে যুগে রাস্তা ছিল খুবই খারাপ৷ এরপরও প্রতিদিন পায়ে হেঁটে প্রায় ২০ মাইল পথ পাড়ি দিতে লাগলেন৷ এই দীর্ঘ পদভ্রজ ভ্রমণে তাঁরা বিখ্যাত বাগদাদ নগরী প্রদর্শন করেন ৷ মার্কো বাগদাদকে ওই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় এবং জাঁকজমক পূর্ণ নগরী হিসেবে বর্ণনা করেছেন ৷ বাগদাদ ভ্রমণ শেষে তাঁরা রওনা হলেন কেরমান শহরের দিকে ৷ এ সময় ক্রীতদাস এবং প্রহরীদের নিয়ে একদল বণিক যোগ দেন তাঁদের সঙ্গে ৷ তখনকার দিনে ওই অঞ্চলে ডাকাতদের উপদ্রব ছিল বেশ ৷ বড়সড় একটা দলের সঙ্গে রওনা হওয়ায় সেই ভয় আর রইল না ৷ এবারের ভ্রমণে আরো বিচিত্র অভিজ্ঞতা হল মার্কোর৷ কখনো দুর্গম পাহাড় ডিঙিয়ে যেতে হল, কখনো বা ধু-ধু বালিতে ভরা মরুভূমি৷

কেরমানে দু ভাগ হয়ে গেছে চীন যাবার পথ৷ হয় আফগানিস্তানের উত্তরের পথ ধরে যেতে হবে অথবা দক্ষিণের পথ ধরে পৌঁছতে হবে হরমুজে ৷ পারস্য উপসাগরের শেষ মাথায় এ বন্দর ৷ তাঁরা প্রথমে হরমুজের পথ ধরলেন৷ কিন্তু হরমুজে যাওয়ার মাঝপথে বাঁধলো বিপত্তি৷ একসময় সত্যিই দস্যুদের হামলার মুখে পড়েন তাঁরা ৷ সেখান থেকে অনেক কষ্টে পালিয়ে গিয়ে প্রাণে বাঁচেন ৷ কয়েকদিন পর বাবা ও চাচার সঙ্গে হরমুজে পৌঁছলেন মার্কো ৷ পথে আর কোন ঝামেলায় পড়তে হয়নি ৷ কিন্তু বন্দরে গিয়ে হতাশ হতে হল ৷ ভারতের দক্ষিণ ঘুরে যাওয়ার মতো সুবিধাজনক কোন জাহাজ পাওয়া গেল না ৷ কোনটাই দীর্ঘ ভ্রমণের উপযোগী নয় ৷ নিকোলো ভেবে দেখলেন যে এত ঝুঁকি নিয়ে এমন নৌকায় যাওয়ার চেয়ে বরং আবার কেরমানে ফিরে গিয়ে অন্য পথ ধরে( ঊনবিংশ শতাব্দীতে এই রোডটিই সিল্ক রোড হিসেবে পরিচিতি পায়) স্হলপথে যাওয়া অনেক নিরাপদ ৷ হরমুজ ছেড়ে আসতে পেরে সবচেয়ে খুশি হলেন মার্কো ৷ সেখানকার গরমে খুব অস্বস্তি বোধ করছিলেন তিনি৷ ২০০ মাইল পথ পাড়ি দিয়ে আবার কেরমানে ফিরে যাওয়া ছিল এক মিশ্র অভিজ্ঞতা ৷ অবশেষে কেরমানে নিরাপদে পৌঁছে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়ে বলখ শহর হয়ে ‘পৃথিবীর ছাদ’ বলে পরিচিত সুউচ্চ পামির মালভূমি পাড়ি দেন তাঁরা ৷ এই সফরে কয়েকটা ব্যাপারে খুব অবাক হন তাঁরা ৷ মালভূমিতে কোন পাখি দেখা যায়নি ৷ কোনো মানুষজনও ছিল না ৷ পথজুড়ে ছিল বেজায় রকমের শীতের কষ্ট ৷ খাবার রান্না করার সময় আগুনে পর্যাপ্ত তাপ পাওয়া যায় নি৷ মার্কো পোলো তখন ভেবেছেন, প্রচন্ড হিমের কারণেই তাপ সৃষ্টি হয় নি ৷ কিন্তু বিজ্ঞানের কল্যাণে আজ আমরা জানি, মালভূমির মতো উঁচু স্হানে বাতাসে অক্সিজেন কম থাকে বলে এ সমস্যা দেখা দেয় ৷ রান্নাবান্নায় স্বাভাবিক সমতল ভূমির চেয়ে অনেক বেশি সময় লাগে ৷

মার্কো পোলো
Source: Sutori

পোলোরা পামির মালভূমি পেরিয়ে কাশ্মিরের উত্তরাঞ্চলীয় সীমানা পাড়ি দেন ৷ মার্কোর ভাষায় বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর এলাকাগুলোর একটি হচ্ছে কাশ্মির ৷ এরপর কাশগড় এবং খোতান পাড়ি দিয়ে হাজির হন মঙ্গোলিয়ার বিখ্যাত ‘গোবি মরুভূমিতে৷’ গোবিতে মরীচিকা দেখেন মার্কো ৷ সেখান থেকে নির্বিঘ্নেই তাঙ্গুত প্রদেশের সুচাওয়ে হয়ে পৌঁছান কানচাওয়ে ৷ এ শহরে থাকাকালে প্রথমবারের মতো চীনের মহাপ্রাচীর দেখার সৌভাগ্য হয় মার্কোর ৷

হঠাৎই মার্কোরা জানতে পারলেন, কুবলাই খান তাঁর উত্তরাঞ্চলীয় রাজধানী শাংতুতে রয়েছেন ৷ সেদিকে রওনা হলেন তাঁরা ৷ গন্তব্যে পৌঁছতে তখনো চল্লিশ দিন বাকি এমন সময় কুবলাই খানের দূতদের সঙ্গে তাঁদের দেখা ৷ সে যুগে টেলিফোন না থাকলেও চীনে দ্রুত খবর পাঠানোর বিশেষ ব্যবস্হা চালু ছিল ৷ সুপরিকল্পিত এ ব্যবস্হায় অনেক ঘোড়সওয়ার বার্তাবাহককে কাজে লাগানো হত ৷ দূরের কোন জায়গায় গুরুত্বপূর্ণ চিঠি পাঠানোর ক্ষেত্রে এক ডাকঘর থেকে একজন ঘোড়সওয়ার আরেক ডাকঘরের আরেক ঘোড়সওয়ারের কাছে যেত ৷ চিঠি বয়ে নেওয়ার ব্যাপারটা ছিল ঠিক যোগাযোগ দৌড়ের মতো ৷ এভাবে একদিনে ২০০ মাইলের বেশি দূরে খবর পৌঁছানো যেত ৷ এই ডাক ব্যবস্হার মাধ্যমেই কুবলাই খান শিগগিরই জানতে পারলেন ভেনিসের পোলোরা আসছেন তাঁর দরবারে ৷ পোলোরা তখনো খানের রাজপ্রাসাদ থেকে অনেক দূরে ৷ অবশেষে শাংতুতে পৌঁছানোর পর চমৎকার শহর দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল তাঁদের ৷ বিশেষ করে কুবলাই খানের প্রাসাদ ৷ কুবলাই খানের সাথে এই প্রথমবার দেখা হলো মার্কোর ৷ পোপের পাঠানো উপহার সামগ্রী এবং তেল পেয়ে খুব খুশি হলেন কুবলাই খান ৷

ভেনিস থেকে চীন
ভেনিস থেকে চীন
Source: Media Storehouse

ভেনিস থেকে চীন পৌঁছতে প্রায় তিন বছরের মতো সময় লেগে যায় মার্কোদের ৷ দীর্ঘদিনের এ সফরে তাঁরা যে শুধু একটানা চলার ওপর ছিলেন তা নয়, বাণিজ্য ছিল তাঁদের মূল লক্ষ্য ৷ কাজেই কোনো শহরে ব্যবসা করার সুবিধা হলে সেখানে কয়েক সপ্তাহ বা দু-তিন মাসও থেকেছেন ৷ এছাড়া মার্কো পোলো অসুস্হও ছিলেন দীর্ঘদিন৷ তিন পোলো যখন চীন পৌঁছেন মার্কো তখন বিশ বছরের তরতাজা তরুণ ৷ সেখানেই কেটে যায় সতেরটি বছর৷ চীন পৌঁছে কয়েকটা মাস কুবলাই খানের গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদে কাটান মার্কো ৷ এ সময় সম্রাটের সঙ্গে শিকারে যেতেন তিনি ৷ চীনের মূল রাজধানী ছিল খানবালিক, যা আজ বেইজিং নামে পরিচিত ৷ গরমকালটা শিকার এবং আমোদ-প্রমোদে কাটিয়ে নিজের আসল প্রাসাদে ফিরে আসেন কুবলাই খান ৷ মার্কোও আসেন তাঁর সঙ্গে ৷ সততা ও বিশ্বস্ততার গুণে মার্কো পোলো শিগগিরই খানের আস্হাভাজন হয়ে ওঠেন ৷ কুবলাই খান পরবর্তী সময়ে তাঁকে কূটনৈতিক কাজে নিয়োগ করেন ৷ এর অংশ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ কাজে তিন বছর হ্যাংচাউয়ে কাটান তিনি ৷

মার্কো নতুন কিছু দেখলেই তার প্রতি আকৃষ্ট হতেন ৷ সঙ্গে সঙ্গে নোট করে রাখতেন ৷ তিনি সে যুগে চীনে ব্যবহৃত কাগজের টাকার কথা লিখেছেন ৷ পশ্চিম ইউরোপে কাগজের টাকার ব্যবহার শুরু হওয়ার কয়েকশ বছর আগেই চীনে এর প্রচলন শুরু হয় ৷ মালয়, সুমাত্রা, সিলন দ্বীপে ভ্রমণ করেন তিনি ৷ সিলনের মূল্যবান পাথর নীলকান্তমণির বর্ণনা রয়েছে তাঁর লেখায় ৷ মার্কোর ভ্রমণকাহিনীতে নরভোজীদের কথাও রয়েছে ৷

স্বদেশে প্রত্যাবর্তন:

সতের বছর চীনে কাটানোর পর প্রচুর ধনসম্পদের মালিক হয়ে যান মার্কো পোলো ৷ এবারে ভেনিসে ফিরে যাওয়ার কথা ভাবতে শুরু করেন ৷ মার্কোর বয়স তখন ৩৮ ৷ তাঁর বাবা ও চাচাও প্রায় বৃদ্ধ হয়ে গেছে ৷ যদিও কুবলাই খান তাঁদেরকে যেতে দিতে রাজি ছিলেন না ৷ অনেক চেষ্টার পর সুযোগ পেয়ে গেল মার্কোরা ৷ ১২৯২ সালে দেশের পথে রওনা হলেন তাঁরা ৷ পারস্য পৌঁছতে দু বছর লেগে যায় ৷ অবশেষে ১২৯৫ সালে ভেনিসে পৌঁছেন তাঁরা ৷ ঠিক দুই যুগ আগে ভেনিস থেকে চীনের পথে রওনা হয়েছিলেন তিনজন ৷

ভেনিস থেকে চীনের পথে
ভেনিস থেকে চীনের পথে
Source: Alamy

বাড়ি ফেরার পর শুরুতে ঝামেলায় পড়তে হয় পোলোদের ৷ এতদিন পর তাঁদের দেখে আত্মীয়স্বজন কেউ চিনতে পারেন নি ৷ তা ছাড়া দীর্ঘভ্রমণে সবার বেশভূষাও মলিন হয়ে গিয়েছিল ৷ তবে যে উদ্দেশ্য নিয়ে পোলোরা দেশ ছেড়েছিলেন এতে তাঁরা সফল হন ষোলোআনা ৷ মূল্যবান রত্নসহ অনেক দামি জিনিস নিয়ে ফেরেন ৷ অল্প সময়ের মাঝেই ভেনিসের ধনকুবের হিসেবে খ্যাতি ছড়ায় তাঁদের ৷

সাহিত্যকর্ম এবং জেলে বন্দি জীবন:

পোলোরা ভেনিসে ফেরার পরপরই ১২৯৮ সালে ভেনিসের সাথে জেনোয়ার (বর্তমানে ইতালির উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত একটি বড় শহর) যুদ্ধ শুরু হয় ৷

মার্কো পোলো জন্মভূমি ভেনিসের হয়ে এক রণতরীর নেতৃত্ব দেন ৷ যুদ্ধ চলাকালে মার্কো পোলো বন্দি হন জেলে । জেলে বন্দি থাকাকালীন আর একজন বন্দি রুস্টিচেলো দ্য পিসা কে তিনি তাঁর ভ্রমনের অভিজ্ঞতা খুলে বলেন। পরবর্তীতে রুস্টিচেলোই  পোলোর ভ্রমণের অভিজ্ঞতা সংকলিত করে ভ্রমণ সাহিত্য বের করেন যার নাম ‘দ্য ট্র্যাভেলস অব মার্কো পোলো’ ৷ এটি ‘দ্য ডেসক্রিপশন অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ নামেও পরিচিত ৷ মার্কো পোলোর এশিয়া হয়ে চীন পৌঁছানোর দুঃসাহসিক এই অভিযানের গল্প ইউরোপীয়ানদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলে দেয় ৷ এই ভ্রমণবৃত্তান্তটি মধ্যযুগের একটি দলিল হিসেবে গণ্য করা যায়। এজন্যই মার্কো পোলো আজকের যুগের অন্যতম এক পথপরিদর্শক। মার্কো পোলোর ভ্রমনকাহিনী বইটি লেখার ১৭৫ বছর পর কলম্বাস অ্যাটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দেবার পরিকল্পনা করেন। কলম্বাস ভেবেছিলেন তিনি মার্কো পোলো বর্ণিত জাভা, সুমাত্রা ও অন্যান্য পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে পৌঁছেছিলেন। আসলে তা নয়। তার বদলে কলম্বাস ক্যারিবিয় সমুদ্রের হাইতি ও কিউবা আবিষ্কার করেছিলেন। কাজেই কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের পেছনে মার্কো পোলোর অবদানকে অস্বীকার করা যায়না।

বই দ্য ট্র্যাভেলস অব মার্কো পোলো
বই দ্য ট্র্যাভেলস অব মার্কো পোলো
Source: Kumparan

মার্কোর ভ্রমণকাহিনী নিয়ে অনেকের মনে প্রশ্ন জাগে, কীভাবে এত বড় একটা কাহিনী লেখা হল?

ধারণা করা হয়, মার্কো ছিলেন প্রখর স্মৃতিশক্তির অধিকারী ৷ যা দেখতেন বা শুনতেন নির্ভুলভাবে তা মনে রাখার ক্ষমতা ছিল তাঁর ৷ তাছাড়া তিনি যেসব স্হানে গেছেন বিভিন্ন বিষয় পর্যবেক্ষণের ব্যাপারে নোট রাখারও সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় ৷

মার্কো সবকিছুর বিশদ বর্ণনা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন তাঁর বইয়ে ৷ সেখানে এমন কিছু স্হান এবং জিনিসের বর্ণনা রয়েছে পড়লে মনে হয় তিনি লোকমুখে শুনে এসব বর্ণনা দিয়েছেন৷ ভ্রমণকাহিনীতে তিনি প্রায়ই অতিবর্ণনা করেছেন ৷ যেমন, তিনি এমন কিছু আজব প্রাণীর কথা লিখেছেন যেসব প্রাণী পৃথিবীতে কোনোকালে ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায় নি ৷ এর মধ্যে ‘গ্রিফন পাখি’ একটা ৷ তিনি লিখেছেন, এই পাখি এত বড় যে হাতি পর্যন্ত খেয়ে ফেলতে পারে ৷ এমনকি এটাও ধারণা করা হয় যে, তিনি কখনো চীন ভ্রমণই করেননি ৷ অন্যদের ভ্রমণবৃত্তান্ত শুনে সেটাই তাঁর বইয়ে বর্ণনা করেছেন ৷ এসব কিছু কিছু কারণে তাঁর ভ্রমণকাহিনীটি অনেকের কাছে ঠুনকো মনে হয়েছে ৷ একারণেই তাঁর বইটিকে কেউ কেউ The Million Lies বলেও অভিহিত করে থাকেন ৷ তবে তিনি তাঁর বইয়ে বেশিরভাগ স্হান বা ঘটনার অনেক বিস্তারিত এবং নিঁখুত বর্ণনা দিয়েছেন ৷

মার্কো পোলোর জীবনাবসান:

মার্কো পোলো ১২৯৯ সালের আগস্ট মাসে বন্দিদশা থেকে মুক্তি পান এবং ভেনিসে ফিরে যান যেখানকার কন্ট্রাডা সান গিয়োভানি শহরে তাঁর বাবা এবং চাচা বৃহৎ আকারের একটি কোম্পানি কিনে রেখেছিল। তিনি এশিয়া এবং চীন অভিমুখে অনেক অভিযান পরিচালনার জন্য অর্থায়ন করেছিলেন কিন্তু নিজে আর কখনো ভেনিস ত্যাগ করেন নি। ১৩০০ সালে ভেনিসিয়ান ব্যবসায়ী ভিতাল বাদোরের মেয়ে দান্তা বাদোরকে বিয়ে করে স্হায়ীভাবে সংসারী হয়ে যান ৷ তিন কন্যার বাবা হন ৷ অবশেষে অসুস্থতাজনিত কারণে ১৩২৪ সালের ৮ জানুয়ারি জীবনাবসান হয় এই বিখ্যাত পর্যটকের ৷

মার্কো পোলোর জীবনাবসান
Source: David Ramey, DVM

মার্কো পোলোর ভ্রমণকাহিনীতে তাঁর যুগের প্রাচ্যের জীবনধারা সবিস্তারে লেখা হয়েছে ৷ আর এ বই লিখেই  ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছেন তিনি ৷ বিশ্বের সর্বকালের সেরা পর্যটকদের তালিকায় চির উজ্জ্বল হয়ে আছে তাঁর নাম ৷

 

তথ্যসূত্র:

১. https://www.google.com/amp/s/www.biography.com/.amp/people/marco-polo-9443861

২. https://www.history.com/topics/exploration/marco-polo

৩. https://www.khanacademy.org/partner-content/big-history-project/expansion-interconnection/exploration-interconnection/a/marco-polo

৪. http://www.silk-road.com/artl/marcopolo.shtml

 

Source Featured Image
Leave A Reply
32 Comments
  1. RickyGrila says

    п»їbest mexican online pharmacies mexican pharmacy buying from online mexican pharmacy

  2. RickyGrila says

    top online pharmacy india buy medicines from India indian pharmacy paypal

  3. MichaelLIc says

    http://mexicoph24.life/# buying prescription drugs in mexico

  4. StevenJeary says

    mexican online pharmacies prescription drugs: Mexican Pharmacy Online – mexican drugstore online

  5. Wkaotm says

    semaglutide without prescription – order semaglutide for sale generic DDAVP

  6. RickyGrila says

    buying from online mexican pharmacy mexico pharmacy mexico pharmacies prescription drugs

  7. MarcelZor says

    http://canadaph24.pro/# canadian pharmacy world reviews

  8. RickyGrila says

    canadian neighbor pharmacy Large Selection of Medications from Canada canada rx pharmacy world

  9. MichaelLIc says

    https://mexicoph24.life/# п»їbest mexican online pharmacies

  10. RickyGrila says

    online shopping pharmacy india Generic Medicine India to USA cheapest online pharmacy india

  11. StevenJeary says

    canadian online pharmacy reviews: Prescription Drugs from Canada – canada discount pharmacy

  12. RickyGrila says

    canada discount pharmacy Certified Canadian Pharmacies best canadian online pharmacy reviews

  13. RickyGrila says

    mexican rx online mexican border pharmacies shipping to usa best online pharmacies in mexico

  14. MichaelLIc says

    https://indiaph24.store/# best india pharmacy

  15. RickyGrila says

    mexican drugstore online mexico pharmacy mexican mail order pharmacies

  16. StevenJeary says

    indianpharmacy com: Generic Medicine India to USA – Online medicine order

  17. RickyGrila says

    buying prescription drugs in mexico cheapest mexico drugs medication from mexico pharmacy

  18. MichaelLIc says

    http://canadaph24.pro/# cross border pharmacy canada

  19. RickyGrila says

    reputable indian online pharmacy indian pharmacy top 10 online pharmacy in india

  20. StevenJeary says

    cheapest online pharmacy india: mail order pharmacy india – indian pharmacy

  21. MichaelLIc says

    http://mexicoph24.life/# п»їbest mexican online pharmacies

  22. RickyGrila says

    pharmacy website india Generic Medicine India to USA online shopping pharmacy india

  23. RickyGrila says

    mexican border pharmacies shipping to usa mexican pharmacy mexico pharmacies prescription drugs

  24. MichaelLIc says

    https://indiaph24.store/# india online pharmacy

  25. RickyGrila says

    buying from online mexican pharmacy buying prescription drugs in mexico online mexico drug stores pharmacies

  26. RickyGrila says

    online shopping pharmacy india top 10 online pharmacy in india best india pharmacy

  27. MichaelLIc says

    http://indiaph24.store/# indian pharmacies safe

  28. RickyGrila says

    adderall canadian pharmacy Certified Canadian Pharmacies canadian pharmacy 365

  29. MarcelZor says

    http://indiaph24.store/# indian pharmacy

  30. MichaelLIc says

    http://canadaph24.pro/# canadian world pharmacy

  31. RickyGrila says

    vipps approved canadian online pharmacy Licensed Canadian Pharmacy legitimate canadian pharmacy

  32. […] বিখ্যাত ভেনিসিয় পর্যটক ও বণিক মার্কো পোলো-র এক লেখা অনুযায়ী অনেকে বিশ্বাস […]

sativa was turned on.mrleaked.net www.omgbeeg.com

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More