মঙ্গল পাণ্ডে: সিপাহী বিপ্লবের নেপথ্যের নায়ক
ভারতবর্ষ নানা জাতিগোষ্ঠীর পদচারণায় মুখরিত। হাজার বছরের চেয়ে পুরনো তার ইতিহাস।কখনো সে পরাক্রমশালী কখনো আক্রান্ত।নানা বর্ণ গোত্র, দার্শনিক মতবাদের পীঠস্থান এই ভারতবর্ষ প্রায় ২০০ বছরের মত ব্রিটিশদের পদানত ছিল। বলা হয়ে থাকে পলাশীর প্রান্তরে ভারতবর্ষের সূর্য অস্ত গিয়েছে। কিন্তু অস্তরবির ক্ষীণ আভা কখনোই মুছে যায়নি ভারতীয়দের মানসপট থেকে। তাই যখনই সুযোগ পেয়েছে বিদ্রোহ করেছে প্রতিবাদ করেছে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে সর্বাগ্রে আসে ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের কথা। কেউ কেউ একে বলে থাকেন ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ,মহাবিদ্রোহ, আবার কারো কাছে এটি ছিল গন অভ্যুত্থান। আর এই গন অভ্যুত্থানের নেপথ্যের নায়ক হিসেবে যিনি পরিচিত তিনিই মঙ্গল পাণ্ডে।
জন্মপরিচয়
ভারতীয়দের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম মুক্তিযোদ্ধা ও বীর শহীদ মঙ্গল পাণ্ডের জন্ম ১৮২৭ সালের ১৯ জুলাই। উত্তরপ্রদেশের বালিয়া জেলার নাগওয়া গ্রামে। অনেকের মতে তার জন্ম হয়েছিল ফৈজাবাদ জেলার সুরহুর গ্রামের একটি ব্রাহ্মণ পরিবারে। দিবাকর পাণ্ডের ঘরে। পড়াশোনার হাতেখড়ি পরিবারে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পড়াশোনা শেষ করে মাত্র ২২ বছর বয়সে ১৮৪৯ সালে তিনি ব্রিটিশ ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানিতে সিপাহী পদে চাকরি নেন। এখানে চাকরি করতে এসে তিনি অনেক রকম বৈষম্য আর অন্যায় দেখতে পান, যা মঙ্গল পাণ্ডেকে গভীরভাবে নাড়া দেয় এবং এর থেকেই উপনিবেশবাদী ব্রিটিশদের অত্যাচার-নির্যাতনের বিরুদ্ধে ভারত উপমহাদেশে সর্বপ্রথম প্রতিবাদে গর্জে উঠেছিলেন তিনি।
মঙ্গল পাণ্ডের বিদ্রোহী হওয়ার কারণ
১৮৫৭ সালের ভারতীয়দের বিদ্রোহের পেছনে রয়েছে অনেকগুলো রাজনৈতিক ও সামাজিক কারণ। মঙ্গল পাণ্ডের ইতিহাস বস্তুনিষ্ঠভাবে জানতে হলে এই কারণগুলোও আমাদের খতিয়ে দেখা দরকার।
সামাজিক কারণ
প্রাথমিকভাবে সৃষ্ট বিদ্রোহের জন্য বাংলায় উঁচু জাতের আধিপত্যকে অনেকে দায়ী করেন। ভারতীয় সিপাহীরা যখন কর্মরত থাকতেন, তখন কোনও ইংরেজ সিপাহী বা অফিসার দেখলেই অস্ত্র উত্তোলন করে সম্মান দেখানোর রীতি ছিল। কিন্তু ভারতীয় সিপাহী বা অফিসারকে ইংরেজ সিপাহীরা সম্মান দেখাতো না বরং বিমাতাসুলভ আচরণ করতো। ভারতীয় সিপাহীরা যদি কোনও স্থানে কোনও কারণে মারা যেতেন, তাহলে ওই পরিবারের কোনও খোঁজ-খবর ইংরেজ বাহাদুররা নিতো না। অবশেষে ওই পরিবারটি নিঃস্ব হয়ে যেত। আর ইংরেজ সিপাহীদের ক্ষেত্রে ছিল অফুরন্ত সুযোগ-সুবিধা।
অর্থনৈতিক কারণ
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও ছিল বৈষম্য। তৎকালীন ভারতে মোট সৈন্য এবং অফিসারের সংখ্যা ছিল প্রায় তিন লাখ। এই তিন লাখের মধ্যে ব্রিটিশ সৈন্য ও অফিসার ছিল মোট ৫০ হাজারের মতো। মোট সৈন্যের পেছনে বাজেট ছিল প্রায় ৯৮ লাখ পাউন্ড, যার মধ্যে ৫৬ লাখ পাউন্ডই খরচ হতো ৫০ হাজার ব্রিটিশ সিপাহী ও অফিসারদের লালসা মেটাতে। আর বাকি ৪২ লাখ পাউন্ড খরচ হতো প্রায় আড়াই লাখ ভারতীয় সেনা সদস্যের পেছনে। এদের প্রত্যেকের মাসিক বেতন ছিল মাত্র সাত রুপি। যুদ্ধে কোনও সেনা সদস্য নিহত হলে তার কোনও দায়ভারই ব্রিটিশ সরকার গ্রহণ করতো না। অন্যদিকে ব্রিটিশ সৈন্যের বেতন সম্পর্কে কোনও ধারণাই পেত না ভারতীয় সৈন্যরা। যুদ্ধে কোনও ব্রিটিশ সৈন্য মারা গেলে তাদেরকে দেয়া হত অসংখ্য সুযোগ সুবিধা।
ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কারণ
১৮৫৩ সালে তৈরি করা হয়েছিল ৫৫৭ ক্যালিবার এনফিল্ড (পি/৫৩) রাইফেল। এই রাইফেল ভারতীয় সিপাহীদের হাতে তুলে দেয় ব্রিটিশ সরকার। রাইফেলগুলোর কার্তুজ গরু ও শুকরের চর্বি দিয়ে তৈরি হতো। সৈন্যরা তাদের রাইফেলের কার্তুজ লোড করার সময় তা দাঁত দিয়ে খুলে লাগাতে হতো। গরু ও শুকরের চর্বি মুখে দেওয়া হিন্দু-মুসলিম সৈন্যদের জন্য অধার্মিক ও গর্হিত কাজ। ১৮৫৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে সিপাহীরা (ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে ভারতীয় সৈন্য) নতুন কার্তুজ ব্যবহার করতে অস্বীকার করেছিল। এর প্রেক্ষিতে নতুন কার্তুজ প্রতিস্থাপন করার প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সিপাহীদের কাছে এই প্রতিশ্রুতির কোন ফলাফল পৌঁছানো হয়নি।
এরকম আরও অনেক কারণ ধীরে ধীরে বিদ্রোহের সূচনা করে যা প্রথম প্রকাশিত হয় মঙ্গল পাণ্ডের মুখ থেকে । যাহোক, ঐ আগ্নেয়াস্ত্র তুলে দেয়ার জন্য ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীকে চরম মূল্য দিতে হয়েছিল। সম্মুখীন হতে হয়েছিল সিপাহী বিপ্লবের।
সিপাহী বিপ্লবের সূচনায় মঙ্গল পাণ্ডে
১৮৫৭ সালের ২৯ মার্চ কলকাতার একটি অঞ্চল ব্যারাকপুরে মঙ্গল পাণ্ডে সর্বপ্রথম ইংরেজদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে ধরেন যা পরবর্তীতে মহাবিদ্রোহে রূপ নেয়। ব্যারাকপুরের পঞ্চম ব্যাটালিয়নের বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্য ছিলেন তিনি । মহাবিদ্রোহ ১৮৫৭ কে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা আন্দোলন রূপে গণ্য করা হয়। ইংরেজ ইতিহাস গবেষকরা একে সিপাহী বিদ্রোহ বলেছেন। ইংরেজ সেনাবাহিনীর অন্তর্গত ভারতীয় সিপাহীরা ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে মূল ভূমিকা পালন করেন। ইংরেজ সরকার এই বিদ্রোহকে কঠোর হস্তে দমন করলেও এর মাধ্যমে ভারতে স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনা হয়। কত লাঞ্ছনা, কত অত্যাচার, কত অশ্রুমোচন, কত নির্যাতনের দীর্ঘ একশত বছর পর অনন্তকাল সমুদ্রের বুকে একটা সাইক্লোনের মত ছিল এই বিদ্রোহ। এটাকে অনেকে আবেগের সাথে পলাশীর প্রতিশোধও বলে থাকেন। “ ধ্বংস কর অত্যাচারী শ্বেতাঙ্গদের” বজ্রগর্ভ এই সঙ্কেত পৌঁছে দেয়া হয় জনে জনে, নগরে নগরে, গ্রামে গ্রামে।
২৯ শে মার্চ, ১৮৫৭। রবিবার অপরাহ্ণ। ব্যারাকপুরের প্যারেড ময়দানে অসময়ে মানুষদের ভিড় বাড়ছিল। ৩৪ নং ইনফ্যান্টটির সিপাহীরা দলে দলে একত্রিত হচ্ছিলেন । চাপা গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল চারদিকে। সিপাহীদের মধ্যে কেউ আসছে খালি হাতে, কেউ বন্দুক নিয়ে। সৈনিকদের ভিড় ক্রমেই বাড়ছিল। কেউ জানেনা কি ঘটতে চলেছে তবে এটুকু জানে যে রচিত হবে এক মহান ইতিহাস। মঙ্গল পাণ্ডে সমস্ত সৈনিকদের প্যারেড গ্রাউন্ডে ডাকেন ও সেখান থেকে বিদ্রোহের ডাক দেন,সকলকে দেশ স্বাধীন করার আহ্বান জানালেন। তার বক্তব্যের মাধ্যমে উৎসাহ দিতে লাগলেন বাকি সিপাহীদের। লাইন থেকে পঞ্চাশ কিংবা ষাট হাত দূরে মঙ্গল পাণ্ডে। বন্দুক কাঁধে নিয়ে টহল দিচ্ছেন। সবাই তার দিকে তাকিয়ে কানাকানি। সবাই শুধু গভীর আগ্রহে তার দিকে তাকাচ্ছে। ছয়ফুট দীর্ঘ দেহ। ধীর স্থির প্রকৃতির। সেই প্রতিদিনের পরিচিত মঙ্গল পাণ্ডে কি আজ এক নতুন মূর্তি নিয়ে দেখা দিয়েছেন। চিবুক আকাশের দিক তুলে গুলিভর্তি বন্দুক হাতে সামনে পেছনে পায়চারি করছে। হঠাৎ তীব্র চিৎকার,
“বেরিয়ে এসো ভাইসব। ফিরিঙ্গির পায়ের তলায় আর কত দিন থাকবে! ওরা আমাদের সোনার দেশ, গর্বের মাতৃভূমি লুটেপুটে যাচ্ছে। আর আমরা মরছি অনাহারে। ওরা আমাদের বেঁচে থাকার অস্তিত্বে হাত দিয়েছে। আমাদের করেছে জাতিভ্রষ্ট। ভাইসব এসব ফিরিঙ্গিদের মারো। “
এরই মধ্যে সেনানিবাসের দখল মঙ্গল পাণ্ডের হাতে। কিন্তু পাণ্ডেকে শায়েস্তা করার জন্য উদ্ধত মস্তকে ছুটে এলেন লেফটেন্যান্ট বর্গে। কিন্তু পাণ্ডে স্থির ও অবিচল। বন্দুকের নল লেফটেন্যান্টের দিকে সোজা তাক করে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছেন পাণ্ডে। লেফটেন্যান্ট তার ঘোড়াটি সরাসরি পাণ্ডের গায়ের ওপর চড়িয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে পাণ্ডে গুলি চালালেন। ঘোড়াটি মাঠে লুটিয়ে পড়ল। লেফটেন্যান্ট পাণ্ডেকে লক্ষ্য করে গুলি চালাল। কিন্তু ওই গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হল। পাণ্ডে একটু এগিয়ে গিয়ে তলোয়ার দিয়ে লেফটেন্যান্ট বর্গের মাথাটা আলাদা করে ফেলেন। লেফটেন্যান্টের পরে এসেছিল সার্জেন্ট। সার্জেন্টও পাণ্ডের তলোয়ারের কাছে ধরাশায়ী হলো। তারপর আসল ইংরেজদের দালাল পল্টু । মঙ্গল পাণ্ডেকে পেছন থেকে দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল। পল্টুও রক্ষা পেল না পাণ্ডের ধারালো তরবারির কাছে। নিজেকে মুক্ত করল পাণ্ডে। সবাই উত্তেজিত, সিপাহীদের মধ্যে উল্লাসধ্বনি। কিন্তু শেষ বিকেলে বিদ্রোহের সংবাদ পেয়ে সেনাপতি হিয়ার্সে চলে আসল সেনাক্যাম্পে। ততক্ষণে মঙ্গল পাণ্ডে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। তারপরও তিনি ব্রিটিশদের হাতে মরবেন না বলে মনে মনে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তাদের হাতে জীবন না দিয়ে আত্মমর্যাদার সাথে আত্মাহুতি দেবার চেষ্টা করেন মঙ্গল পাণ্ডে। হঠাৎ পাণ্ডের পিস্তল গর্জে ওঠে। নিজের মাথায় ঠেকিয়ে দেয় পিস্তল। গুলি ফসকে গেল। ধোঁয়া, বারুদ ও অগ্নিশিখার মধ্যে আহত রক্তাক্ত দেহ লুটিয়ে পড়ল। মুমূর্ষু পাণ্ডেকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। তাকে চিকিৎসা করালো ব্রিটিশ সরকার। এর উদ্দেশ্য ছিল সুস্থ করে নির্মমভাবে তাকে শাস্তি দেওয়া।
মঙ্গল পাণ্ডের পরিণতি
৬ এপ্রিল সিপাহী মঙ্গল পাণ্ডের বিচার। বিচারের নামে এটি ছিল একটি প্রহসনমাত্র। ফাঁসির দণ্ডাদেশ দেয়া হয় তাকে। মঙ্গল পাণ্ডে তখনো অসুস্থ,মুমূর্ষু অবস্থায় হাসপাতালে শুয়ে আছে । কিন্তু ৮ এপ্রিল সকালবেলা অসুস্থ মুমূর্ষু সৈনিক মঙ্গল পাণ্ডেকে ব্যারাকপুরে সমস্ত সৈনিকদের সামনে ফাঁসিরকাষ্ঠে ঝুলিয়ে দণ্ডাদেশ কার্যকর করে ইংরেজ সরকার। ওই দিন ঈশ্বর পাণ্ডেকেও ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। কারণ তিনি মঙ্গল পাণ্ডেকে গ্রেফতার করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। সামরিক আদালতের রায়ে ১৮ এপ্রিল মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের নির্দেশ দেওয়া থাকলেও নির্ধারিত সময়ের ১০ দিন আগে তাকে হত্যা করা হয়।
এ ঘটনা সারা ভারতবর্ষের সিপাহীদের মধ্যে প্রবল সাড়া জাগিয়েছিল। সিপাহী মঙ্গল পাণ্ডের আত্মদানে উজ্জীবিত ভারতীয় সিপাহীরা সংঘবদ্ধভাবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সেনানিবাসে ব্যারাকে আক্রমণকারীর ভূমিকায় সশস্ত্র বিদ্রোহ সংঘটিত করেছিল। মীরাট, দিল্লি, এলাহাবাদ, অযোধ্যা, লক্ষ্মৌ, কানপুর, ঝাঁসি, বারানসি, পাঙ্গনা, কেবলী ইত্যাদি স্থানে সিপাহী বিদ্রোহ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল। এমনকি এটা দেশজুড়ে চরম উত্তেজনা সৃষ্টি করেছিল। সিপাহী বিদ্রোহ সফল না হলেও এটি পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে ভারতীয়দের জন্য ছিল এক নতুন সূর্য।
মঙ্গল পাণ্ডের বীরত্বকে স্মরণ করে ভারতে একটি সিনেমা নির্মাণ করা হয়। ‘মঙ্গল পাণ্ডে: দ্য রাইজিং’ নামক সিনেমাটিতে নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন ভারতের অন্যতম জনপ্রিয় নায়ক আমির খান। মঙ্গল পাণ্ডের জীবনীর সাথে মিল রেখে নির্মিত এ সিনেমা মুক্তি প্রায় ২০০৫ সালে। সত্যিকার অর্থে মঙ্গল পাণ্ডের বুকের ভেতর লুকিয়ে ছিল স্বাধীনতার বীজ,আর আজকের এই স্বাধীন উপমহাদেশই হলো সে বীজের অঙ্কুরিত ফসল।
generic zetia
zofran pregnancy cramps
does wellbutrin cause energy
zyprexa 2.5
buy repaglinide paypal – order repaglinide 2mg for sale jardiance without prescription