খানুয়ার প্রান্তর
১৬ মার্চ, ১৫২৭ সাল
পরাক্রমশালী রাজপুত কনফেডারেশনের ৮০,০০০ অশ্বারোহী, ১২০ জন সেনাপতি আর ৫০০ হস্তিবাহিনী চোখ রাঙাচ্ছে সদ্য ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনকারী বাবরের ক্ষুদ্র বাহিনীকে। বাবর বুঝতে পেরেছেন হিন্দুস্তানের এ যোদ্ধার দল অপরাপর বাহিনী থেকে আলাদা। এরা মরতে জানে তবু পিছপা হতে জানে না। তার একটি ছোটখাটো প্রমাণ এরইমাঝে বাবরের সৈন্যদল পেয়ে গেছে। খুব ধীরে তাই মুঘল সেনাবাহিনীর মধ্যে সঞ্চারিত হচ্ছে রাজপুত ভীতি। বাবর বুঝতে পারলেন অবস্থা সঙ্গিন। তিনি এও বুঝতে পারলেন এ যুদ্ধে তার পরাজয় ঘটলে হারাতে হবে পুরো ভারতের আধিপত্য। স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যাবে হিন্দুস্তান শাসনের। যে স্বপ্ন উঁকি দিয়েছিল পানিপথের প্রান্তরে তা কি এই খানুয়ার ময়দানে এসে ভেস্তে যাবে? না তা কিছুতেই হতে দিবেন না তিনি। তার রক্তে চেঙ্গিস খান আর তৈমুর লং তেজ বহমান। এত সহজে হাল ছাড়তে পারেন না তিনি। শুরু হল যুদ্ধ। অসম সাহসিকতায় বাবরের পঁচিশ হাজার সৈন্য রুখে দিল রাজপুত কনফেডারেশনের প্রায় লক্ষাধিক সৈন্যের বাহিনীকে। খানুয়ার এই ঐতিহাসিক যুদ্ধে জয়ী হোন বাবর। আর এরই সাথে পাকাপোক্তভাবে পুরো ভারতের বাদশাহ হয়ে সূচনা করেন উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজবংশ মুঘল সাম্রাজ্যের।

Source: Burffee
পাঠক, বাবরের পক্ষে কি এতই সহজ ছিল পুরো ভারতবর্ষের সম্রাট হওয়ার? খুব সহজেই তিনি হয়েছিলেন জয়ী পানিপথ আর খানুয়ার প্রান্তরে? কেমন ছিলেন হুমায়ূনের মহান এই পিতা? তার পুরো জীবন কিভাবে কেটেছে? ভারতে আসার আগেই বা তিনি কোথায় ছিলেন?
এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে আমাদের প্রবেশ করতে হবে বাবরের বর্ণাঢ্য জীবনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। তবে তার জীবনালোচনায় ঘুরেফিরে আসবে যুদ্ধের ইস্পাতকঠিন বর্ণনা কেননা তার জীবনের সবটুকু সময় কেটে গেছে যুদ্ধ ফেরি করে। প্রথমেই জানা যাক তার পরিচয় ও প্রাথমিক সংকট।
১৪৮৩ সালে বর্তমান উজবেকিস্তান (তৎকালীন রুশ-তুর্কিস্তান) এর ফরগনা নামক ক্ষুদ্র একটি রাজ্যে তার জন্ম হয়। তার ভাল নাম ছিল জহিরুদ্দিন মুহাম্মদ। বাবর ছিল তার ডাকনাম যার অর্থ বাঘ।তার পিতা উমর শেখ মির্জা ছিলেন ফরগনার শাসক। তার মাতা ছিলেন মোঙ্গল নেতা ইউনুস খানের কন্যা কুতলুঘ নিগার খানম। মাতার দিক হতে বাবর ছিলেন চেঙ্গিস খানের বংশধর এবং পিতার দিক হতে তৈমুর লং। বাবর তার আত্মজীবনী বাবুরনামাতে নিজেকে চাগতাই তুর্কি নামে নামাঙ্কিত করেছেন। উদ্দাম, তেজী ও শক্তিশালী বাবরের ছিল নানামুখী প্রতিভা। কিংবদন্তি আছে তিনি শুধুমাত্র ব্যায়াম করার জন্য দুই হাতে দুই সৈনিক অনায়াসে দেয়াল টপকাতে পারতেন। এছাড়া হিমাংকের নিচের বরফশীতল পানিতে গোসল করা ছিল তার কাছে সাধারণ ব্যাপার। কথিত আছে তিনি সাঁতরে দুইবার গঙ্গা নদী পাড়ি দিয়েছিলেন।

ফরগনার সিংহাসন লাভ
১৪৯৪ সালে পিতা উমর শেখ মির্জার মৃত্যু হলে কিশোর বাবর ফরগনার অধিপতি হোন। এ সময়ে এই ক্ষুদ্র রাজ্যেও তাঁকে মোকাবেলা করতে হয় অনেক ষড়যন্ত্রের। সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধার কাজে বাবর প্রথমেই বাধার সম্মুখীন হন উজবেক নেতা সায়বানী দ্বারা। বিদ্রোহী ও ষড়যন্ত্রকারী আত্মীয় স্বজনদের মোকাবেলা করে ১৪৯৬ খ্রিষ্টাব্দে তৈমুরের রাজধানী সমরকন্দ দখলের চেষ্টা চালান। প্রথমে তার এ অভিযান ব্যর্থ হয়। ১৪৯৭ সালে চৌদ্দ বছর বয়সে তার চাচার মৃত্যুর পর বাবর প্রথমবারের মত সমরকন্দ অধিকার করেন। সমরকন্দ দখলের অব্যবহিত পর বাবর অসুস্থ হয়ে পড়লে আবারো সমরকন্দ তার হাত ফসকে বেরিয়ে যায়। এই সুযোগ গ্রহণ করেন ফরগনার বিদ্রোহী আমির ওমরাহগণ। তারা বাবরকে মৃত ঘোষণা করে তার ছোটভাই জাহাঙ্গীরকে ক্ষমতায় বসান। সুস্থ হয়ে বাবর ফরগনা উদ্ধারের চেষ্টা করলেও তা আর সম্ভব হয়ে উঠেনি।
কাবুল দখল
পুনঃপুন ফরগনা ও সমরকন্দ দখলে ব্যর্থ হয়ে ভাগ্য বিতাড়িত বাবর নিজের অবশিষ্ট শক্তিমত্তা দিয়ে হিন্দুকুশ পর্বত অতিক্রম করে কাবুল অভিযান করেন। কাবুলের রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগ নিয়ে ১৫০৪ সালে সেখানে একটি ছোট্ট রাজ্যের গোড়াপত্তন করেন তিনি এবং নিজে ‘পাদশাহ’ উপাধি গ্রহণ করেন। ১৫০৪ থেকে ১৫২৬ এই পুরোটা সময়জুড়ে বাবর তার হারানো রাজ্য সমরকন্দ দখলের চেষ্টা চালান। শেষতক ব্যর্থ হয়ে দক্ষিণপূর্বে সামরিক অভিযানের পরিকল্পনা হাতে নেন।

ভারতে অস্থিরতা: বাবরের ফায়দা কুড়ানো
তুঘলক সাম্রাজ্যের শেষভাগে দিল্লির কেন্দ্রীয় ক্ষমতা হ্রাস পেতে থাকলে ভারতে কিছু ক্ষুদ্র রাজ্যের সৃষ্টি হয়। যার কারণে ভারতের রাজনৈতিক অবস্থা প্রায় ভংগুরপ্রায় হয়ে পড়ে। বাবুরনামাতে এ বিষয়ে বাবর বলেছিলেন,
” কাবুল জয় করার পর এখনো পর্যন্ত (১৫১৭) আমি হিন্দুস্থান দখলের দৃঢ়প্রতিজ্ঞা করি। কখনো আমার আমীরদের বিরুদ্ধাচরণ এবং আমার ভাইদের বিদ্রোহের জন্য বাধাপ্রাপ্ত হই। অবশেষে সব বাধা অতিক্রম করে আমি ১৫১৯ খ্রিষ্টাব্দে একটি সেনাবাহিনী নিয়ে বাজাউর ও সোয়াত অভিমুখে রওনা হই এবং সেখান থেকে ঝিলাম নদীর পশ্চিম তীর পর্যন্ত অগ্রসর হই”।
ওদিকে ভারতের রাজনৈতিক অস্থিরতা অব্যাহত থাকে। নতুন ছোট রাজ্য সৃষ্টির ফলে রাজনৈতিক ঐক্যের মূল উৎপাটন হয়ে যায়। তৈমুর লং এর আক্রমণে বিপর্যস্ত ভারত মুঘল আক্রমণের পূর্ব পর্যন্ত আর স্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারেনি।যার ফলে দিল্লীর খবরদারি শুধুমাত্র রাজধানীর ভেতরেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। হিন্দুস্তানের এমন টালমাটাল অবস্থা প্রত্যক্ষ করে বাবর কাবুলে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ভারত অভিযানের পায়তারা করতে থাকেন। সিকান্দার লোদীর পুত্র ইব্রাহিম লোদী তখন সিংহাসনে। পাঞ্জাবের শাসনকর্তা দৌলত খানের পুত্র দিলওয়ার খানকে ইব্রাহিম লোদী অপদস্থ করলে দৌলত খানের সাথে তার বিরোধ বাধে। দিল্লির আমির ওমরাহর পাশাপাশি লোদীর চাচা আলম খানও বাবরকে ভারত আক্রমণের আমন্ত্রণ জানান।
ভারতে প্রাথমিক অভিযান
বাবর ভারতবর্ষে পরীক্ষামূলকভাবে প্রথমদিকে বিক্ষিপ্তভাবে কিছু সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন। ইতিপূর্বে পার্বত্য অঞ্চলের উপজাতিদের দমন করে বাবরের সক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। ভারত জয়ের জন্য তিনি পাঁচবার অভিযান পরিচালনা করেছিলেন। তার আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন, ১৫১৯ সালে একদল সৈন্য নিয়ে প্রথমে বাজাউর ও ভেরা দখল করেন। অত:পর ১৫২৪ সালে এক বিশাল বাহিনী নিয়ে লাহোর অভিযান করেন। সেখানে আফগানদের হারিয়ে লাহোর দখল করেন। জলন্ধর ও সুলতানপুর দখল করার পর বাবুর দৌলত খানকে সেখানকার শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। কিন্তু তাতে দৌলত খান সন্তুষ্ট না হয়ে বিদ্রোহ করে বসেন। এই জায়গায় বাবর তার পুত্র দিলওয়ার খানকে ক্ষমতায় বসান। অচিরেই দৌলত খান তার পুত্রকে সেখান থেকে বিতাড়িত করেন এবং পাশাপাশি আলম খানের বিরুদ্ধেও একই ব্যবস্থা নেন। আলম খান বাবরের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করলে বাবুর পাঞ্জাবের আমিরদের আলম খানকে সাহায্য করার আদেশ দেন। কিন্ত তবুও আলম খান দৌলত খানের সাথে জোটবদ্ধ হয়ে ইব্রাহিম লোদীর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। যদিও এই যুদ্ধে ইব্রাহিম লোদী জয়ী হন।
পানিপথের প্রথম যুদ্ধ!
ভারতবর্ষের রাজনৈতিক অস্থিরতা যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে ঠেকল ঠিক তখন দৌলত খানের বিদ্রোহ ও আলম খানের বিশ্বাসঘাতকতা সহ ষড়যন্ত্রের কারণে বাবরের ভারত আক্রমণ এক নতুন বাঁক নেয়। এই বিশ্বাসঘাতক যুগলকে সমুচিত শাস্তি দিতে তথা ভারতে চূড়ান্ত অভিযান পরিচালনার মানসে বাবর ভারত অভিমুখে তার পঞ্চম ও শেষ অভিযান করেন। দিল্লি সালতানাতকে গুঁড়িয়ে দিয়ে ভারতের হরিয়ানা রাজ্যের পানিপথ গ্রামের নিকটে ১৫২৬ সালের ২১ শে এপ্রিল বাবর ভারতবর্ষে মুঘল সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন করেন। বাবরের পনেরো হাজার সৈন্যের যুদ্ধসাজে ভীত হয়ে দিল্লির সুলতান প্রায় ১ লক্ষ সৈন্য ও শখানেক হাতি নিয়ে পানিপথের দিকে অগ্রসর হোন। লোদীর বিশাল বাহিনীকে মোকাবেলা করতে বাবর চমৎকার কৌশল গ্রহণ করেন। ময়দানের কৌশলগত স্থানে তিনি পরিখা খনন করেন এবং সেই পরিখাগুলোর বাঁকে বাঁকে প্রায় শপাঁচেক গরুর গাড়ি বেঁধে রাখেন। দুইটি গরুর গাড়ি অন্তর ম্যাচলকম্যানদের জন্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়। যার ফলে ঘোড়সওয়ারদের জন্য আক্রমণ করতে সুবিধা হয়। এ যুদ্ধে বাবর ‘তুঘলুমা’ যুদ্ধকৌশল অবলম্বন করেন। এই কৌশল দ্বারা পদাতিক সৈন্যদের ছোট ছোট ভাগে ভাগ করা যায় যার ফলে বড় দলকে সাহায্য করার জন্য প্রয়োজনীয় সাহায্য লাভ করা যায়। অত:পর যুদ্ধ শুরু হলে লোদীর বিশাল বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে ক্ষুদ্র মুঘল বাহিনীর উপর। প্রথমেই কোণঠাসা হয়ে গেলে লোদী বাহিনী তাদের শক্তিমত্তার জায়গা ব্যবহার করে। তাঁদের বিশাল হস্তিবাহিনী লেলিয়ে দেয় বাবরের সৈন্যদের উপর। কিন্তু তখনো পর্যন্ত ইব্রাহিম লোদী বুঝে উঠতে পারেননি তার জন্য কি আকাল অপেক্ষা করছে। তিনি চিন্তাই করতে পারেননি বাবরের ভাণ্ডারে থাকবে এমন অস্ত্র যা খুব সহজেই তাদের পরাজিত করতে সক্ষম হবে। হ্যাঁ বাবর এতক্ষণ পর্যন্ত লুকিয়েই রেখেছিলেন তার সেই শক্তিশালী অস্ত্র। ইব্রাহিম লোদীর হস্তিবাহিনীর উপর উপমহাদেশে এই প্রথম কামান ব্যবহার করা হয়। বাবরের গোলন্দাজ বাহিনীর আক্রমণে দিশেহারা হয়ে যায় দিল্লী সালতানাতের দল। কামানের শব্দে হাতিগুলো দিগ্বিদিক ছুটতে থাকে এবং দেখা যায় তাদের হাতির আঘাতেই পিষ্ট হয়ে মারা যায় লোদীর সৈন্যদের বিশাল এক অংশ। ইব্রাহিম লোদীর অপরিপক্ব সেনাদল যার অধিকাংশ সৈন্যই ছিল ভাড়া করা এবং যথাযথ পরিচর্যাহীন খুব স্বাভাবিকভাবেই তারা পরাজিত হয় অসম সাহসিকতাপূর্ণ মুঘল বাহিনীর হাতে। এই পানিপথের যুদ্ধের মাধ্যমেই বাবর দিল্লী ও আগ্রার অধিপতি হয়ে ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।

খানুয়ার যুদ্ধ
পানিপথের প্রথম যুদ্ধ ছিল বাবরের জন্য ভারতে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ মাত্র। একথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়না যে পানিপথের যুদ্ধেই ভারতে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা পেয়ে গিয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে বাবর পানিপথের যুদ্ধে জয়ী হয়ে শুধুমাত্র আগ্রা ও দিল্লির অধিপতি হয়েছিলেন, পুরো হিন্দুস্তানের নয়। কেননা তখনো বাবরকে টেক্কা দিতে বীরদর্পে বিরাজ করেছিল শক্তিশালী রাজপুত গোষ্ঠী। তার পাশাপাশি বিদ্রোহী আফগান নরপতির দল বাবরের জন্য আরো প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ালো। রাজপুত পুনর্জাগরণের নেতা রানা সংগ্রাম সিংহ ভারত আক্রমণের জন্য বাবরকে আমন্ত্রণপত্র পাঠালেও পরে তার ভোল পালটে যায়। রানা আশা করেছিলেন বাবর হয়তো অপরাপর ভারত বিজেতার মতই লুট করে চলে যাবেন। কিন্তু রানা যখন প্রত্যক্ষ করলেন বাবর তার সৈন্যবাহিনী সহ ভারত থেকে গেছেন এবং তার লক্ষ পুরো ভারত জয় তখন তিনি শংকিত হয়ে পড়েন এবং বাবরকে ভারত থেকে বিতাড়িত করতে রাজপুত রাজ্যগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করে বাবরের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ান।
খানুয়ার ময়দানে মুঘল ও রাজপুত কনফেডারেশন
বাবর যখন পানিপথের যুদ্ধে ব্যস্ত ছিলেন তখন রানা সংগ্রাম বিয়ানায় অভিযান পরিচালনা করে বিদ্রোহী আফগান নেতা হাসান ও মেওয়াটের সাথে চুক্তি করেন। হাসান খানের পুত্র বাবর পানিপথের যুদ্ধে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করলেও সেই হাসান খানের পুত্রই রানার সাথে মিত্রতা করে বসেন। এভাবে রাজপুত ও বিদ্রোহী আফগানগণ একজোট হয়। বাবর উপলব্ধি করেছিলেন রাজপুতদের সাথে তার যুদ্ধ অনিবার্য। তাই আমিরদের পরামর্শ উপেক্ষা করেও তিনি এদের সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। কারণ তিনি জানতেন আজ হোক কাল হোক রাজপুতদের সাথে যুদ্ধ করতেই হবে। ১৫২৭ খ্রিষ্টাব্দের ১১ ই ফেব্রুয়ারি বাবর তার ছোট্ট বাহিনী নিয়ে খানুয়ার অভিমুখে অগ্রসর হোন। উল্লেখ্য এই যুদ্ধে বাবরের সাথে তার কিছু হিন্দুস্তানি মিত্রও অংশ নিয়েছিল। যদিও বাবর তার সৈন্যবাহিনীর উপরই আস্থা রেখেছিলেন। ২৫ হাজার সৈন্যের এ ক্ষুদ্র বাহিনী প্রথমেই খানুয়ার পানির উৎস নিজেদের আয়ত্তে নিয়ে আসে। একটি কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে মূল যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে মুঘলদের একটি ক্ষুদ্র দল রাজপুতদের হাতে বাজেভাবে পরাজিত হয়। এই প্রাথমিক সংঘাতে প্রায় সকল মুঘল সৈন্যই নিহত হয়। যার ফলে অবশিষ্ট মুঘল সৈন্যদের মাঝে এক ধরণের ভয়ের সৃষ্টি হয়ে যায়। বাবর এমন অবস্থা প্রত্যক্ষ করে তার সেনাদের নিকট এক মর্মস্পর্শী ভাষণ প্রদান করেন। বাবরের এই ভাষণ সম্রাট হুমায়ূনের বোন গুলবদন তার হুমায়ূননামাতে লিপিবদ্ধ করেছেন ( আগ্রহী পাঠকরা পড়ে নিবেন)।
বাবরের এই ভাষণে সেনাদের মধ্যে নতুন করে যুদ্ধস্পৃহা শুরু হয়। ১৬ ই মার্চ শুরু হয় চূড়ান্ত যুদ্ধ। রাজপুত যুদ্ধবাজ লক্ষাধিক সৈন্যদের রুখে দাঁড়ানোর চেষ্টায় ছোট্ট মুঘল বাহিনী। বাবর এই যুদ্ধেও পানিপথের যুদ্ধকৌশল অবলম্বন করেন। পরিখা খনন করে তার বাঁকে বেধে রাখা হয় গরুর গাড়ি। আর তার ফাঁকে সুবিধাজনকভাবে বিন্যাস করা হয় পদাতিক সৈন্যদের। বাবর তার সেনাদলকে তিনটি ভাগে ভাগ করেন এবং নিজে মধ্যভাগের নেতৃত্ব দেন। যুদ্ধ শুরু হলে প্রথমদিকে মুঘলরা পিছিয়ে থাকে। তারপরই পানিপথের যুদ্ধের মত তাদের শ্রেষ্ঠ কৌশল তুঘলুমা ও কামানের ব্যবহার করে মুঘল বাহিনী। আর এতেই দিকভ্রান্ত হয়ে যায় রাজপুত বাহিনী। দমে যায় রাজপুত দম্ভ। বীরের বেশে বাবর হয়ে যান সমগ্র হিন্দুস্তানের বাদশাহ। নিজে উপাধি গ্রহণ করেন পাদশাহ।
খানুয়ার যুদ্ধে বাবর পরাজিত হলে কি হত?
ঐতিহাসিকগণ পানিপথের যুদ্ধ অপেক্ষা খানুয়ার যুদ্ধকেই সর্বাপেক্ষা গুরুত্ব দিয়েছেন। ভারতের ইতিহাসের মোড় পরিবর্তনকারী এ যুদ্ধে বাবরের পরাজয় হলে উপমহাদেশের ইতিহাস অন্যভাবে লিখিত হত। কেননা পানিপথের যুদ্ধের পর বাবর হয়েছিলেন শুধুমাত্র দিল্লি ও আগ্রার শাসক। আর খানুয়ার যুদ্ধে জয়ের মাধ্যমে হন পুরো ভারতের শাসক। সম্ভাব্য শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী রাজপুত কনফেডারেশন এখানেই গুঁড়িয়ে যায় এবং তার পরবর্তী শতাব্দী পর্যন্ত তারা আর তেমনভাবে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি।
গোগরার যুদ্দ; ১৫২৯

বাবর তার জীবনের শেষযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন গোগরার প্রান্তরে ১৫২৯ সালে। দিল্লির পরাজিত রাজপরিবার লোদী পরিবারের সদস্যগণ মুহাম্মদ লোদীর নেতৃত্বে বিহার এবং তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল দখল করে। বাবর এদের দমন করতে তার পুত্র আসকারীকে তথায় প্রেরণ করেন এবং তার কিছুদিন পর তিনি নিজে যুদ্ধযাত্রা করেন। এলাহাবাদ, চুনার অতিক্রম করে বক্সারে পৌঁছলে কিছু আফগান সর্দার বাবরের বশ্যতা স্বীকার করে। মুহাম্মদ লোদী বাংলায় নসরত শাহের আশ্রয় নিলে ১৫২৯ সালে বাবর সেথায় আক্রমণ করেন এবং গোগরার যুদ্ধে আফগানদের পরাজিত করেন।
বাবরের মৃত্যু
বাবরের মৃত্যু বিষয়ে প্রায় সবারই জানা এই আশ্চর্য ঘটনার কথা। ১৫৩১ সালের দিকে পুত্র হুমায়ূন যখন হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে যান, রাজ্যের বড়সড় চিকিৎসক দিয়েও যখন কোন কূলকিনারা পাওয়া যাচ্ছিল না এমনই একদিন শয্যাশায়ী অসুস্থ পুত্রের চারদিকে প্রদক্ষিণ করে আল্লাহর কাছে বাবর ফরিয়াদ জানান তার প্রাণের বিনিময়ে যেন হুমায়ূনকে তিনি বাঁচিয়ে দেন। আর এর কিছুদিন পরই অসুস্থ হয়ে পড়েন বাবর আর পুত্র হুমায়ূন ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠেন। এই রোগেই মারা যান মুঘল সাম্রাজ্যের এই প্রতিষ্ঠাতা। এই ঘটনার স্বপক্ষে মত দিয়েছেন সমসাময়িক ঐতিহাসিক আবুল ফজল। তবে আধুনিক ঐতিহাসিকগণ এই ঘটনাকে স্রেফ অলীক বলে মত দিয়েছেন। ইতিপূর্বে ইব্রাহিম লোদীর মাতা বাবরকে বিষপ্রয়োগে হত্যা চেষ্টা করেন এবং তার মৃত্যু হতে পারে সেই বিষক্রিয়ার ফল। গুলবদন হুমায়ূন নামায় এই কথা উল্লেখ করেছেন। এছাড়া হুমায়ূনের অসুস্থতার আগ থেকেই বাবর পেটের পীড়ায় ভুগছিলেন। সুতরাং এই ব্যাপারগুলো তার মৃত্যুর যৌক্তিক কারণ হিসেবে ধরা যায়। ১৫৩০ সালের ৩০ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন এই মহান পুরুষ। আগ্রার নিকটে আরামবাগে প্রথমে তাকে সমাহিত করা হলেও পরে তার শেষ ইচ্ছায় কাবুলে তার মরদেহ স্থানান্তর করা হয়।
তথ্যসূত্র :
১. দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস, মুঘল যুগ- পৃষ্ঠা- ৩২-৪৬, অধ্যাপক ড. সৈয়দ মাহমুদুল হাসান
২. মোগল সাম্রাজ্যের খণ্ডচিত্র-পৃষ্ঠা-১১-১৯- হাসান শরীফ
৩. http://bn.banglapedia.org/index.php?title=বাবুর
order levaquin buy levofloxacin 250mg without prescription