আমার বন্ধুর নাম রিপিং চাকমা, বাড়ি খাগড়াছড়ি। আমার নাম শরীফ, ডাক নাম মুন্না।
আমি আর রিপিং ফেনীতে একই কলেজে পড়ি। একদিন রিপিং আমাকে বলল, “আমি আমাদের বাড়ি যাবো, যাবা নাকি?”
আমার পকেটে তখন ভালই টাকা ছিলো, তাছাড়া পড়ালেখার কোন প্রেশার ছিলোনা, মাত্র নতুন একটি সেমিস্টার শুরু হয়েছে। অনেক আগে থেকেই খাগড়াছড়ি যাওয়ার ইচ্ছা ছিলো। রাজী হয়ে গেলাম যাওয়ার জন্যে।
রাত ১১:৩০ এর দিকে ফেনী বাস স্টেশনে পৌঁছলাম। আমাদের সিট একেবারে পিছনের দিকে পড়ল। রাত ১:৩০ এ বাস খাগড়াছড়ির দিকে যাত্রা শুরু করল।
প্রথমবার খাগড়াছড়ি যাচ্ছি, মনের মধ্যে অনেক উত্তেজনা কাজ করছে। পাহাড়ি রাস্তা অনেক আঁকাবাঁকা। গাড়ি একবার উপরের দিকে উঠে, আবার নিচের দিকে নামে। এ এক অন্য রকম অনুভূতি।
সকাল ৬ টায় আমরা খাগড়াছড়ি শহরে পৌছাই। সকালের নাস্তা করে আবার যাত্রা করলাম রিপিংদের বাড়ির দিকে।
এবার আমাদের যাত্রার সাথী চাঁদের গাড়ি। খাগড়াছড়ি ভ্রমণের রোমাঞ্চ এর শুরু এখান থেকেই।
চাঁদের গাড়িতে আমি একজন শুধু বাঙালি আর সবাই চাকমা, মারমা। যেদিকে তাকাই শুধু চাকমা, মারমা। এ যেন বাংলাদেশের মধ্যে অন্য আরেক দেশ। আমি যে মুগ্ধ হয়ে মানুষজন দেখছি রিপিং আমার দিকে বারবার তাকাচ্ছে।
অবশেষে অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো, আর মিনিট দশেক সামনে গেলেই ওদের বাড়ি। চেংগি নদী পার হয়ে যেতে হয়। বাঁশের সাকোর মাধ্যমে নদী পার হতে হয়। তারপর শুধু পাহাড় আর পাহাড়। পাহাড় ডিঙিয়ে এখন রিপিংদের ঘরের সামনে।
যে ঘর-বাড়ি, উপজাতি মানুষ এতদিন টিভি, পত্র-পত্রিকা, বই এর কাগজে দেখেছি তা এখন আমার চোখের সামনে। অন্য এক রোমাঞ্চ ছুঁয়ে যাচ্ছিল আমাকে। কে জানে আমার সাথে সাথে রিপিং ও কি তার জন্মভূমিকে নতুন করে দেখছে!
মাটির ঘর, ছিমছাম সাজানো গোছানো ঘর। রিপিং এর আম্মু সালাম দিলাম, উনি বাংলা তেমন বলতে পারেন না। উনি চাকমা ভাষায় রিপিংকে বললেন আমি যাওয়াতে অনেক খুশি হয়েছেন।
রিপিংদের বাড়ির পাশেই চেংগি নদী। দুজনে গোসল করতে গেলাম। নদীর পানি একেবারে স্বচ্ছ । রোদের আলো পড়ে পানিগুলো ঝিকমিক করছে। গোসল শেষ করে দুপুরে খাওয়া খেলাম। একটা কথা বলে রাখি, ওরা কিন্তু প্রচুর ঝাল খায়। আমি ঝাল খেতে অভ্যস্ত ছিলাম, তাই তেমন কোন সমস্যা হয় নাই। তাদের কোন কিছুই বাজার থেকে ক্রয় করতে হয় না। তারা ধান থেকে শুরু করে শাক-সবজি, ফল-মূল, হলুদ-মরিচ সবই চাষ করে।
দুপুরে বিশ্রাম করে বিকেলে ঘুরতে বের হলাম। ওদের বাড়ির পাশেই পানছড়ি শান্তিপুর অরণ্য কুটির।
বৌদ্ধদের জন্য পবিত্র একটি জায়গা। এই কুটিরে গৌতম বুদ্ধের বিশাল একটি মূর্তি রয়েছে। যেটি নির্মাণ করতে ব্যয় হয়েছে এক কোটি বিশ লক্ষ টাকা। খাগড়াছড়ির পর্যটন জায়গার মধ্যে এই কুটিরটি অন্যতম। বিশাল জায়গা। এখানে গৌতম বুদ্ধের মূর্তি ছাড়াও বৌদ্ধধর্মের অনেক ইতিহাসের সাক্ষী এই কুটির। ঘুরতে ঘুরতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এলো।
বিহার থেকে পানছড়ি বাজারে গেলাম। অনেক মানুষের সমাগম এখানে। পানছড়ি বাজারে অনেক বাঙালি চোখে পড়ল। বাজারে অনেকে সুন্দর সুন্দর হস্তশিল্প দেখলাম। হাতের ব্যাগ, চাদর, আরো অনেক কিছু। সত্যি এসব দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়।
রিপিংদের গ্রামে মোট ৬৫ টি পরিবার। পানছড়ি বাজার থেকে এসে কয়েকটা ঘরে গেলাম। তাদের সাথে কথা বলে অনেক ভাল লাগল। তারা খুবই সহজ-সরল আর অনেক আন্তরিক।
পরদিন আলুটিলা পর্যটন কেন্দ্রে ঘুরতে গেলাম। এখান থেকে পুরো খাগড়াছড়ি শহরটাকে দেখা যায়। কী অপরূপ দৃশ্য। চোখ জুড়িয়ে যায়। আলুটিলা পর্যটন কেন্দ্রের মূল আকর্ষণ হচ্ছে গুহা। যারা রোমাঞ্চ প্রিয় মানুষ তাদের জন্য আদর্শ জায়গা আলুটিলা। গুহার ভিতর ঘুটঘুটে অন্ধকার। হাতে মশাল নিয়ে ঢুকতে হয়। গুহার একপাশ থেকে অন্যপাশে বের হতে দশ মিনিট সময় লাগে। গুহার মাঝপথে সত্যিই অনেক ভয় লাগে। গুহা থেকে বের হয়ে মনে হয় এভারেস্ট জয় করে ফেলছি! আলুটিলা পর্যটন কেন্দ্র খাগড়াছড়ির পর্যটন কেন্দ্রসমূহের মধ্যে অন্যতম।
আলুটিলা থেকে গেলাম ঝুলন্ত সেতু দেখতে। খাগড়াছড়ি এমন একটা শহর যেখানে আপনি প্রতিনিয়ত অবাক হবেন। খাগড়াছড়ি এলে অবশ্যই এই সেতু দেখতে আসবেন। খাগড়াছড়ি শহর থেকে খুব বেশি দূর না।
ঝুলন্ত সেতু ঘুরে খাগড়াছড়ি মূল শহরে এলাম। খুবই সাজানো গোছানো একটি শহর।
এই দুইদিনে এই শহরটাকে আর এই শহরের মানুষগুলোকে অনেক আপন করে নিয়েছি। আর এই শহরে এত বেশি ঘুরবার জায়গা আছে যে আপনি এক সপ্তাহেও ঘুরে শেষ করতে পারবেন না।
সময় স্বল্পতার কারণে দীঘিনালা, সাজেক ভ্যালী যেতে পারিনি। আপনারা কিন্তু খাগড়াছড়ি গেলে জায়গাগুলো ঘুরতে মিস করবেন না।
দুই রাত তিনদিন থাকার পরে অনেকটাই তাদের ভাষা আর কালচার এর সাথে মানিয়ে গিয়েছি। এখন তাদের ভাষায় কিছুটা কথা বলতে পারি। যেমন- “তুহি হিক্কা গছ? মুই গমাগম। অর্থাৎ কেমন আছো? আমি ভাল আছি”।
এই কয়েকদিনে যা বুজেছি তা হল, পাহাড়ি মানুষগুলো অনেক সহজ-সরল, অনেক পরিশ্রমী, মানুষের প্রতি অনেক আন্তরিক।
আমি একজন বাঙালি আর ওরা চাকমা হয়েও আমার প্রতি যে ভালবাসা দেখিয়েছে এই স্মৃতি ভুলে থাকার নয়।
আসার সময় রিপিং এর আব্বু-আম্মুকে সালাম করলাম। রিপিং এর আব্বু আমার হাতে ১০০ টাকা দিয়ে বলল “বাবা এগুলো দিয়ে ফল কিনে খেয়ো”।
খাগড়াছড়ির মূল শহরে বাস কাউন্টারে বসে আছি। কিছুক্ষণ পর বাস ছাড়বে, এই কয়েকটা দিন স্বপ্নের মত গিয়েছে। বাস ফেনীর দিকে দ্রুতগতিতে ছুটে চলছে। আর আমি পিছনে ফেলে যাচ্ছি সুন্দর অনেকগুলো মুহূর্ত।
ফেনী গিয়ে আবার সেই যান্ত্রিক ব্যস্ততায় ডুবে যাব। কিন্তু বিশ্বাস করুন পাহাড়ি মানুষদের কাছ থেকে যে ভালবাসা পেয়েছি সেটা কখনোই ভুলব না।
prandin pills – buy repaglinide 1mg sale pill jardiance