গ্ল্যাডিয়েটর: অনবদ্য যোদ্ধাদের অজানা তথ্য

2

গ্ল্যাডিয়েটর, নাম শুনলেই চোখে ভেসে উঠে হলিউড ছবিতে রাসেল ক্রো এর হিংস্র প্রাণীর সাথে যুদ্ধরত দৃশ্যটি। পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে সাহসী এই যোদ্ধারা লড়াই করত অপর যোদ্ধা, হিংস্র প্রাণী এবং ভয়ংকর সব অপরাধীদের সাথে। রোমান সাম্রাজ্যে এই যোদ্ধাদের লড়াই চলত মৃত্যুর হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত। তারা তাদের মৃত্যু কে মেনে নিয়ে লড়াই করে মৃত্যুর মাধ্যমে হেরে যেত। তাদের এই লড়াই ছিল মানুষ কে আনন্দ দেওয়ার জন্য। কিন্তু সমাজ তাদের কে পৃথক করে রেখেছিল আইনি ও সামাজিক দিকে, মানুষ তাদের ঘৃণা করত মৃত্যু ঘটার পরেও। রোমান সাম্রাজ্যের এই সাহসী বীর যোদ্ধাদের নিয়ে অনেক সত্য মিথ্যা মিথ বা কাল্পনিক কাহিনী প্রচলিত রয়েছে,তবে আজ গ্ল্যাডিয়েটরদের বিষয়ে ১০ টি  সঠিক তথ্য তুলে ধরা হলো।

১. তাদের সকলেই দাস ছিল না

সকল গ্ল্যাডিয়েটরস কে বন্ধী  হিসেবে রঙ্গভূমি বা লড়াই করার স্থানে নিয়ে আসা হয় নি। যদিও প্রথম দিকের গ্ল্যাডিয়েটর যোদ্ধারা যেসব মানুষ বা ক্রীতদাসের বিপক্ষে জয়লাভ করেছিল তাদের কবর লিপি হতে দেখা যায় যে খ্রিষ্টাব্দ ১ম শতাব্দীর পর হতে যুদ্ধক্ষেত্রে জনসংখ্যা বা মানুষদের ধরণ হিসেবে পরিবর্তন দেখা যায়।  যুদ্ধক্ষেত্রের রোমাঞ্চ, জনতার হর্ষ-ধ্বনি,বিজয়ের মহিমা এবং প্রচুর অর্থের পুরষ্কারের আশায় সাধারণ বা মুক্ত মানুষেরাও গ্ল্যাডিয়েটর যোদ্ধাদের নামের তালিকায় নিজের নাম প্রবেশ করায়। এই ফ্রিল্যান্স যোদ্ধাদের মধ্যে কেউ হতাশাগ্রস্ত পুরুষ অথবা সাবেক দক্ষ সৈনিক ছিল কিন্তু এদের কিছু অনেকে ছিল অভিজাত পরিবারের যোদ্ধা। তাই অনেকে বলে থাকেন গ্ল্যাডিয়েটর যোদ্ধারা সকলে দাস ছিল। কিন্তু এ তথ্য ভুল।

গ্ল্যাডিয়েটর সিনেমার একটি দৃশ্য
গ্ল্যাডিয়েটর সিনেমার একটি দৃশ্য Source: hollywoodreporter.com

২. গ্ল্যাডিটোরিয়াল যুদ্ধ মূলত অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠানের অংশ

অনেক পুরাতন কাহিনী অনুসারে মনে করা হয় রোমান এই খেলাটি ইট্রাসকানদের কাছে থেকে এসেছিল। কিন্তু অধিকাংশ ঐতিহাসিকেরা এটি মেনে নিতে নারাজ। তাদের মতে গ্ল্যাডিয়েটরিয়াল যুদ্ধ টি ছিল মৃত ব্যক্তিদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার অংশ। প্রাচীন রোমানরা মনে করত মৃত ব্যক্তির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠানে তার রক্ত ঝরালে তাদের আত্মার পরিশুদ্ধি ঘটে। সে জন্য যখন কোন অভিজাত ব্যক্তি মারা যেত তখন তাদের পরিবার তার কবরের পাশে দাস অথবা বন্দীদের মধ্যে লড়াই চালিয়ে দিত। একজন রোমান লেখক বলেছেন,অভিজাত ব্যক্তির আত্মার পরিশুদ্ধি করার বিশ্বাস থেকে তাদের দাস প্রাণ উৎসর্গ করতে হতো। জুলিয়াস সিজারের সময় এই ধারা টি আরও জনপ্রিয় হয়,স্বয়ং জুলিয়াস সিজার তার মৃত পিতা ও কন্যার সম্মানে প্রায় ১০০ জন গ্ল্যাডিয়েটরের মধ্যে লড়াইয়ের ব্যবস্থা। দর্শকেরা এই জীবনহানিকর রক্তাক্ত লড়াই গুলো পছন্দ করত বলে খ্রিস্ট পূর্ব প্রথম শতাব্দীর শেষের দিকে সরকারি ভাবে গ্ল্যাডিয়েটর লড়াই আয়োজন করা হতো।

লিবিয়া থেকে প্রাপ্ত খ্রিস্টপূর্ব ২০০ অব্দের একটি মোজাইকে গ্ল্যাডিয়েটররা
লিবিয়া থেকে প্রাপ্ত খ্রিস্টপূর্ব ২০০ অব্দের একটি মোজাইকে গ্ল্যাডিয়েটররা Source: histoy.com

৩. লড়াই মানেই মৃত্যু নয়

গ্ল্যাডিয়েটর যোদ্ধারা সব সময় মরার জন্য প্রস্তুত হয়ে লড়াই করত না কিংবা সব ম্যাচে ই একজনের মৃত্যু ঘটতে হবে এমনটা ছাড়াও ম্যাচ অনুষ্ঠিত হতো। যদিও হলিউড সিনেমা এবং টেলিভিশনে দেখানো হয় তারা সব সময় মরার জন্য লড়াই করত কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে এটা পুরোপুরি সত্য ছিল। এই খেলাটি একটি সুনির্দিষ্ট নিয়ম – কানুন অনুসারে হত। ম্যাচ পরিচালনার জন্য রেফারি থাকত। দুজন সম বয়সী সম দক্ষতা পূর্ণ দুজনের মধ্যে যুদ্ধ হত। যদি কোন একজন মারাত্মক ভাবে আহত হয়ে পড়ত তাহলে রেফারি অনেক সময় ম্যাচ বন্ধ করে দিত। আবার অনেক সময় দুজন যোদ্ধা কে সম্মান পূর্বক যুদ্ধের ময়দান ছাড়ার অনুমতি দেওয়া হত যদি তারা ভালো কিছু করতে পারতেন।

গ্ল্যাডিয়েটরদের জীবন নৃশংস এবং সংক্ষিপ্ত হলেও সব ম্যাচে ই ঘটবে এমন সঠিক নয়, তবে কিছু ম্যাচের নিয়ম ই ছিল মৃত্যু পর্যন্ত লড়াই।

৪. “থাম্বস ডাউন” মানে ই মৃত্যু না

যখন কোন গ্ল্যাডিয়েটর মারাত্মক ভাবে আহত হয়ে যান এবং তিনি তার অস্ত্র নিচের দিকে ফেলে দিতেন তখন তার ভাগ্য নির্ভর করত দর্শকদের সিদ্ধান্তের উপর।  আর যদি কলিসিয়াম এর মধ্য খেলা টি হত তাহলে সম্রাট যা বলতেন তাই করা হত হেরে যাওয়া যোদ্ধার সাথে। সম্রাট সিদ্ধান্ত দিতেন  তাকে মারা হবে নাকি বাঁচিয়ে রাখা হবে। অনেকে মনে করতেন যদি সম্রাট থাম্বস ডাউন বা বৃদ্ধাঙ্গুলি নিচের দিকে নির্দেশ করতেন তাহলে ঐ যোদ্ধা কে মেরে ফেলা হবে। কিন্তু এই তথ্য টি সঠিক নয়। ঐতিহাসিকেরা মনে করেন যে থাম্বস ডাউন না বরং সম্রাট যদি দুই হাত প্রসারিত করে থাম্বস আপ করতেন তবে সেই যোদ্ধার মৃত্যু হত। আবার যদি সাদা রুমাল নাড়ানো হয় তবে যোদ্ধা কে মেরে ফেলা হবে না। আর যদি তাকে মেরে ফেলার নির্দেশ দেওয়া তাহলে বিজয়ী গ্ল্যাডিয়েটর তার বিপক্ষ প্রতিযোগীর দেহ ছিন্ন ভিন্ন করে ফেলতেন।

৫. তারা বিভিন্ন দল ও শ্রেণীকে বিভক্ত ছিল

৮০ খ্রিস্টাব্দের পরে কলোসিয়াম খোলার পর গ্ল্যাডিয়েটরদের লড়াই সুসংগঠিত রক্তাক্ত এক খেলা হয়ে ছিল। যোদ্ধাদের কে তাদের পূর্ববর্তী রেকর্ড,স্কিল লেভেল এবং অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করে তাদের কে গ্রুপে বিভক্ত করা হত। তাদের কে এক সেট অস্ত্র দেওয়া হত। এই দলগুলোর মধ্যে সেই সময় সবচেয়ে ছিল থারেসেস এবং মুরমিলোনস সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল যারা তলোয়ার আর ঢাল দিয়ে যুদ্ধ করত, এছাড়াও ইকুইটিস, যারা ঘোড়ার পিঠে করে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবেশ করত।

থাম্বস ডাউনের একটি প্রতীকী চিত্র
থাম্বস ডাউনের একটি প্রতীকী চিত্র
Source: The Vision

৬. হিংস্র প্রাণীর সাথে লড়াই

কলোসিয়াম এবং অন্যান্য রোমান যুদ্ধক্ষেত্রে গ্ল্যাডিয়েটর যোদ্ধারা হিংস্র প্রাণীদের সাথে লড়াই করত। পৃথিবীর ইতিহাসে একমাত্র এই যোদ্ধারা হিংস্র প্রাণীদেরও হারিয়ে দিয়েছে। “ভেনাতোরেস” এবং “বেস্টিয়ারি” নামক বিশেষ গ্ল্যাডিয়েটর যোদ্ধারা সিংহ, কুমির,ভাল্লুক এমন কি হাতিদেরও সাথে লড়াই করত। এই ধরণের ম্যাচের শুরু তে যোদ্ধাদের প্রাণী শিকার করতে হত। একটি কলোসিয়াম খোলার সময় ১০০ দিনে  প্রায় ৯ হাজার প্রাণী হত্যা করা হয় গ্ল্যাডিয়েটরদের মাধ্যমে। সম্রাট ট্রাজেনের ১২৩ দিনের এক অনুষ্ঠানে প্রায় ১১০০০ প্রাণী হত্যা করা হয়। গ্ল্যাডিয়েটররা এই দিক থেকে আজও অনন্য।

৭. মেয়ে গ্ল্যাডিয়েটর যোদ্ধা

পুরুষদের পাশাপাশি মেয়েরাও গ্ল্যাডিয়েটর হিসেবে যুদ্ধ করেছে। তবে অধিকাংশ মেয়েদের জোর করে এই খেলায় আনা হতো তবে কিছু স্বাধীন মেয়ে নিজের ইচ্ছায় তলোয়াের হাতে তুলে নিয়েছিল। ঐতিহাসিকেরা নিশ্চিত নন যে কখন থেকে মেয়েরা গ্ল্যাডিয়েটর যোদ্ধা হিসেবে এই লড়াই অংশগ্রহণ করতে শুরু করে। তবে ১ম শতাব্দীর মধ্যে ই এই মেয়েদের লড়াই এই খেলায় কমন একটি বিষয় হয়ে উঠেছিল। তবে নারী যোদ্ধা হিসেবে তারা রোমান সংস্কৃতিতে খুব বেশী গুরুত্ব পায়নি।

প্রতীকী নারী গ্ল্যাফিয়েটর
প্রতীকী নারী গ্ল্যাফিয়েটর
Source: IMDb

৮.  ইউনিয়ন গঠন

গ্ল্যাডিয়েটরেরা যদিও নিয়মিত ভাবে জীবন ও মৃত্যুর সম্মুখীন হত। একজন গ্ল্যাডিয়েটর অপর জন কে মেরে ফেলত। তবু কিছু গ্ল্যাডিয়েটর তাদের ভ্রাতৃত্ব বোধ থেকে একটি  ইউনিয়ন বা কলেজিয়া গঠন করেছিল। যুদ্ধক্ষেত্রে কোন যোদ্ধা পরাজিত হলে এই ইউনিয়ন নিশ্চিত করত যে, পরাজিত যোদ্ধার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া যেন যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে করা হয় এবং তার অর্জন গুলো কবরে খোদাই করে দেওয়া হয়। যোদ্ধার কোন স্ত্রী সন্তান থাকলে তাদের কে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থা করাও ইউনিয়নের কাজ ছিল।  যদিও অধিকাংশ গ্ল্যাডিয়েটর দাস হলেও এই ইউনিয়নের দ্বারা তারা সংঘবদ্ধ হয়েছিল।

৯. গ্ল্যাডিটোরিয়াল বিটসে যোদ্ধা হিসেবে রোমান সম্রাট

অনেক রোমান সম্রাট নিজেকে গ্ল্যাডিটোরিয়াল বিটসে উপস্থাপন করেছেন। গ্ল্যাডিয়েটর লড়াই এর ম্যাচ আয়োজন করে রোমান সম্রাটরা খুব সহজেই জনপ্রিয় হতে পারতেন কিন্তু কিছু সম্রাট এর থেকেও বেশী কিছু করেছেন। তারা সত্যি সত্যি নিজেকে লড়াইয়ের মঞ্চে নিয়ে গেছেন। বেশ কয়েক জন রোমান সম্রাট বিশেষ করে ক্যালিগুলা,টিটুস,হাদরিয়ান নামক সম্রাটেরা রণক্ষেত্রে লড়াই করেছেন তবে কঠোর নিয়ন্ত্রিত শর্তের মাধ্যমে তবু আবার বোঁতা ব্লেডের অস্ত্র থাকত প্রতিপক্ষের কাছে।

১০. তারকা হওয়া

যদিও গ্ল্যাডিয়েটরদের কে সম্মান দেওয়া হত না কিন্তু তারা অনেক খ্যাতি অর্জন করেছিল। তাদের ছবি বিভিন্ন স্থানে ঝুলানো থাকত। বাচ্চারা তাদের অর্জন গুলোর সংখ্যা নিয়ে খেলত। এমনি কি আজকের আধুনিক যুগের মত তারা পণ্যের প্রচার করতেন এবং আধুনিক যুগের মত ই তখন মেয়েরা গ্ল্যাডিয়েটরদের প্রেমে হাবু-ডুবু। নারীরা তাদের সাথে সখ্যতা গড়ে তুলেছিল।

তথ্যসূত্র :  history.com

Leave A Reply
2 Comments
  1. Caeqst says

    order semaglutide 14 mg pill – glucovance without prescription cheap DDAVP

  2. Eeqzwo says

    repaglinide 2mg ca – order generic prandin 1mg empagliflozin 25mg price

sativa was turned on.mrleaked.net www.omgbeeg.com

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More