আজ আপনাদের ইউরোপীয় ইতিহাসের এমন একজনের সাথে পরিচয় করিয়ে দেব যার কথা হয়ত আপনি কখনো শুনেনইনি। ৩৭০ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করা সেই ব্যক্তিটির নাম অ্যালারিখ। মাত্র ২০ বছর বয়সে তিনি ভিসিগোথের(একটি বিচ্ছিন্ন জার্মান গোত্র) শাসক হয়েছিলেন। এবং অল্প সময়ের মধ্যে তার কথা দিগ্বিদিক ছড়িয়ে যেতে থাকে।
অ্যালারিখ ৩৯৫ সালে গ্রীসের এথেন্স,কোরিন্থ এবং স্পার্টা বিজয়ের মাধ্যমে তার বিজয় যাত্রার সূচনা করেন। ৪০১ খৃষ্টাব্দে অ্যালারিখ তার সেনাবাহিনী নিয়ে ইতালী আক্রমন করেন । ৪১০ সালের আগস্টের মধ্যে প্রায় ১০,০০০ গোথিক কৃতদাসকে মুক্তি দিয়ে তাদের সাথে নিয়ে মাত্র তিন দিনে তিনি রোম দখল করেন। যদিও অ্যালারিখ এবং ভিসিগোথের অন্য কেউই আসলে রোম শহর লুন্ঠন এবং সেখানকার সাধারণ মানুষদের হত্যা করেননি কিন্তু অনেকেই অ্যালারিখের এই আক্রমনের ঘটনাকে পশ্চিমা রোমান সাম্রাজ্যের পতনের মূল কারন হিসেবে গন্য করে থাকেন।
রোম সফলভাবে বিজয় করে অ্যালারিখ তার সাম্রাজ্যের জন্য অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে সেখান থেকে দক্ষিণ দিকে অর্থাৎ উত্তর আফ্রিকার পথে এগোতে থাকেন। তবে ৬ষ্ঠ শতাব্দীর ইতিহাসবেত্তাদের মতে তিনি আফ্রিকার পথে বেশিদূর এগোতে পারেননি তার আগেই মারাত্মক জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু বরণ করেন। ভিসিগোথের প্রথাগত ধারা বিবেচনা করে বর্তমানে এটি অনুমান করা যায় যে, প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী অ্যালারিখের মৃতদেহকে বুসেনতো নদীর তলদেশে সমাহিত করা হয়েছিল।
অ্যালারিখের মৃতদেহ সমাহিত করার জন্য কৃতদাস শ্রমিকদের সহায়তায় সাময়িক বাঁধ নির্মান করে নদীর স্বাভাবিক গতিপথ পরিবর্তন করা হয়। নদীর গতিপথ সাময়িক পরিবর্তন করে তারপর তলদেশে সমাধি খনন করে সেখানে তাকে সমাহিত করা হয়। অ্যালারিখের মৃতদেহের সাথে ৭০ খৃষ্টাব্দে জেরুজালেমের মন্দির থেকে রোমানদের ছিনিয়ে আনা বিখ্যাত মেনোরাহ (সাতটি শাখা সমন্বিত স্বর্নের ঝারবাতি) ও সমাধিস্থ করা হয়। তাকে সমাহিত করার পর শ্রমিকরা অস্থায়ী বাঁধ সরিয়ে নেয়। ফলে পরিবর্তিত নদীর গতিপথ আবার পূর্বের ন্যায় স্বাভাবিক গতিপথে চলতে থাকে। ইতিহাসবেত্তাদের মতে এমনটি করা হয়েছিল যেন ইতিহাসে অ্যালারিখের সমাধিস্থলের কোন নিশানা না থাকে।
অ্যালারিখের মৃত্যুর কারন যুগের পর যুগ ধরে বিশেষজ্ঞদের ভাবিয়েছে। অ্যালারিখ সব সময়ই নিরোগ ছিলেন। এমনকি রোম বিজয়ের পরেও তিনি সুস্থ-সবল এবং বলিষ্ঠ ছিলেন এবং দক্ষিণে এগোনোর পরিকল্পনা করছিলেন। অনেকের মতে মৃত্যু বরন করার মতো তেমন কোন কঠিন রোগে তিনি ভূগছিলেন না। তাহলে এমন একজন সবল, বলিষ্ঠ ও ক্ষমতাধর সেনাপতির মৃত্যু আসলে কী কারনে হয়েছিল?
অনেক ঐতিহাসিক, চিকিৎসা বিজ্ঞান ও মহামারি সংক্রান্ত গবেষণা একত্রিত করে গবেষক ফ্রান্সেসকোগালাসি এবং তার গবেষক দল এলারিকের মৃত্যুর কারন চিহ্নিত করেন। তাদের মতে, কোন নির্দিষ্ট কারন নয় বরং বেশ কিছু কারন একত্রিত হয়ে অ্যালারিখের মৃত্যু হয়। সম্ভবত তিনি হৃদ রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন যার কোন চিকিৎসা সেই সময় ছিলোনা। একই সময় আবার তিনি ফ্যালসিপেরাম ম্যালেরিয়ার দ্বারাও আক্রান্ত হন যার কারনে তার শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা একেবারেই হ্রাস পেয়ে তার মৃত্যু হয়।
দূঃখজনক হলেও সত্য অ্যালারিখের জীবনী নিয়ে ইতিহাসে তেমন কোন বিশদ তথ্য পাওয়া যায়না এবং জর্দানেস ই একমাত্র ইতিহাসবিদ যিনি অ্যালারিখের মৃত্যুর কথা বর্ণনা করেছেন। গালাসি এবং তার সহকর্মীরা জর্দানেসকে উদ্ধৃত করে বলেন যখন তিনি রোম বিজয়ের পর পরবর্তী ধাপে কি করবেন তা নিয়ে ভাবছিলেন সে সময় “একেবারেই হঠাৎ করে অসময়ের মৃত্যু এসে অ্যালারিখকে গ্রাস করে এবং হঠাৎ করেই তাকে না ফেরার দেশে নিয়ে যায়।” ছোট উদ্ধৃতাংশের মধ্যে মৃত্যুর আকস্মিকতার কথা বারংবার আসা এটিই প্রমাণ করে যে, অ্যালারিখের এমন মৃত্যু হতে পারে আগে কেউ এমন ধারনাও করতে পারেনি।
কিন্তু হঠাত এমন মৃত্যুই কি অ্যালারিখকে এতোটা ইতিহাসচ্যুত করেছিল? হৃদরোগ বা ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে যে কারও মৃত্যু হতেই পারে কিন্তু তাই বলে তার পারিবারিক ইতিহাস, ব্যক্তি জীবন, শাসনকার্য সম্বন্ধে বিশদ তথ্য এভাবে গায়েব হয়ে যাবে কেন? এটি এখনো ইতিহাসে রহস্য হয়ে রয়েছে।
ইতালিয় বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি অ্যালারিখের হারিয়ে যাওয়া সমাধিস্থল হিসেবে সম্ভাব্য পাঁচটি স্থান চিহ্নিত করেছেন। তাদের ধারণা এসকল স্থানে ১৬০০ বছর ধরে প্রায় ৭০০ মিলিয়ন ইউরো মূল্যের স্বর্ণ ভান্ডার লুকানো রয়েছে। তারা এটিকে “বাস্তব জীবনের ইন্ডিয়ানা জোনসের শিকার” বলে অভিহিত করেছেন। ভূতাত্বিকরা অ্যালারিখের সমাধিস্থল খুঁজে বের করার জন্য ড্রোন, পাতাল পর্যবেক্ষক রাডার এবং ইনফ্রা-রেড প্রযুক্তি ব্যবহার করবেন বলে জানিয়েছেন।
গবেষকরা বিশ্বাস করেন সে সময়ের (৫ম শতাব্দীর) হিসাব সঠিক এবং সে অনুযায়ী অ্যালারিখের সমাধিতে ২৫ টনের ও অধিক স্বর্ণ রাখা আছে। যার আনুমানিক মূল্য বর্তমান বাজার অনুযায়ী প্রায় এক বিলিয়ন (৭৩৫ মিলিয়ন) ইউরো বাংলাদেশী টাকায় যার মূল্য প্রায় ৭৩,৭০,৯৭,২৫,২৩০ টাকা। আরও অনেক রৌপ্য ও মূল্যবান রত্নের সাথে এই বিপুল পরিমান স্বর্ন এখনো পর্যন্ত আবিষ্কারের অপেক্ষায়।
প্রকল্প পরিচালক ফ্রান্সেসকোসিচি বলেন, অ্যালারিখের সমাধির খোঁজে যুগযুগ ধরে অনেকেই এখানে এসেছেন এমনকি নাৎসি বাহিনীর হেনরিখ হিমলার হিটলারের সাম্রাজ্যের সম্পদ ভান্ডার সমৃদ্ধ করার উদ্দেশ্যে অ্যালারিখের সমাধি খুঁজতে ১৯৩৭ সালে এখানে এসেছিলেন। তিনি এখানকার একটি সোয়াবীয়দূর্গে অবস্থান করে সে সময়ের সর্বোচ্চ প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে অ্যালারিখের সমাধি খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন ।
গবেষকদল মনে করেন অ্যালারিখের মৃতদেহ, তার প্রিয় ঘোড়া এবং কাঙ্ক্ষিত স্বর্ণভান্ডার সম্ভবত মাটির ৮ মিটার গভীরে প্রোথিত রয়েছে। সম্ভবত নদী আরও গভীর হলেও কখনো যেন আলগা হয়ে অ্যালারিখের সমাধি এবং সম্পদসমূহ স্রোতে ভেসে হারিয়ে না যেতে পারে সে কারনেই এতো গভীরে সমাধিস্থ করা হয়।
চিহ্নিত পাঁচটি স্থানের মধ্যে একটি কোসেনজার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে । যা পার্শ্ববর্তী মেনডিসিনো অঞ্চলের দিকে কিছুটা বেঁকে ১.৫ মাইল বিস্তৃত গর্ত সদৃশ এলাকার সৃষ্টি করেছে।
এসকল স্থানের যেকোন একটিতে তারা জেরুজালেমের প্রাচীন মেনোরাহ (ইহুদীদের প্রাচীন ধর্মচিহ্ন) খুঁজে পাবেন বলে প্রবল আশাবাদী।
কোসেনজার মেয়র এবং অনুসন্ধানী প্রকল্পের অর্থের জোগানদাতা মারিও ওচ্চিউতো বলেন, “অ্যালারিখের গুপ্তধন খুঁজে বের করার সম্ভাব্য সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করে দেওয়ার জন্য অত্যাধুনিক প্রযুক্তিকে ধন্যবাদ”।
তিনি আরও বলেন, “অ্যালারিখের গুপ্তধনের কথা খামখেয়ালীপূর্ন মনে হলেও আসলে এখানে যে বাস্তবে কিছু আছে তা আমি বিশ্বাস করি কারন পূর্ববর্তী প্রত্নতাত্মিক জরিপেও এখানে কিছু থাকার সম্ভাবনার কথা শুনেছি। ট্রয়নগরী আবিষ্কারের (১৮৭০ সাল) পূর্ব পর্যন্ত শুধু মাত্র জনশ্রুত কিংবদন্তিই ছিল। পম্পের ক্ষেত্রেও ( ১৮ শতকে আবিষ্কার) আমরা একই রকম দেখতে পাই। অ্যালারিখের সমাধিস্থল আবিষ্কৃত হলে মানব জাতির ইতিহাসে এটিই হবে এযাবৎ কালের সবচে বড় গুপ্তধন আবিষ্কারের ঘটনা। এবং এটি একটি বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবেও বিশ্বব্যপি সমাদৃত হবে।”
প্রকল্পের নেতৃত্বদানকারী ভূতত্ববিদ আমেরিগো গিউ ওসেপরোটা বলেন, “অ্যালারিখের কথিত আয়তাকার সমাধি খুঁজে বের করার জন্য অত্যাধুনিক সব প্রযুক্তির সহায়তা নেওয়া হবে।” তিনি আরও বলেন, “আমাদের ধারণা অ্যালারিখকে তৎকালীন সময়ে ভূভাগ থেকে পাঁচ থেকে ছয় মিটার গভীরে সমাধিস্থ করা হয়েছিল কিন্তু বিগত ১৬০০ বছরে নদীতলের উচ্চতা আরও প্রায় ১.৫ মিটার বেড়ে গেছে সুতরাং সমাধিস্থলটি সম্ভবত এখন প্রায় ৮ মিটার নিচে রয়েছে।”
তিনি জানান অনুসন্ধান করতে হয়ত খুব বেশি খরচ হবেনা- হয়ত সর্বোচ্চ কয়েক হাজার ইউরো খরচ হতে পারে । ফলাফলও দ্রুত পাওয়ার ব্যাপারে তিনি বেশ আশাবাদী এ ব্যাপারে তিনি বলেন, “আমরা জরিপের প্রাথমিক ফলাফল প্রথম ছয় মাসের মধ্যেই পাবো বলে আশা করছি”।
অনুসন্ধানী দলটি তাদের অনুসন্ধান কাজে ইতালীয় নৌবাহিনীকে অন্তর্ভূক্ত করার ব্যাপারেও বেশ উৎসাহী। ইতালীয় নৌবাহিনীর কাছে উন্নত প্রযুক্তির উড়োজাহাজ রয়েছে যা উন্নত সেন্সরের সাহায্যে শত্রুপক্ষের লুক্কায়িত সাবমেরিনের অবস্থান সনাক্ত করতে পারে। তারা মনে করেন স্বর্ণের সন্ধানে সামরিক বাহিনীর সংযুক্ততা এই অনুসন্ধানে এক ভিন্ন মাত্রা সৃষ্টি করবে।
ইতালীয় কয়েকজন সংসদ সদস্য ইতোমধ্যে অনুসন্ধানী প্রকল্পে আরও বেশি অর্থায়ন করার ব্যাপারে রোমে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছেন। প্রকল্প সমন্বায়ক জনাব সিচি বলেন, “এ ব্যাপারে কোন দ্বিমত বা দ্বিধা নেই যে এখানে বিপুল সম্পদ সহ অ্যালারিখকে সমাহিত করা হয়েছিল । কিন্তু ঠিক কোন স্থানে এটি আছে তা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এতো বিপুল পরিমান গুপ্তধনের কথা জেনেও তা না খুঁজে বের করার চেষ্টা করাটাই এক ধরনের অপরাধ।”
অনেক পূরাতত্ববিদ সমালোচকদের মতে যদি অ্যালারিখের সমাধি থেকেও থাকে তবে তা খুঁজে বের করার চেষ্টা না করাই ভালো কারন তিনি কোন বিখ্যাত ব্যক্তিত্য ছিলেন না বরং তিনি ছিলেন একজন বর্বর আক্রমণকারী।
এই সমালোচক দলের মন্তব্যের প্রতিউত্তরে মেনডিসিনোর মেয়র এন্থোনিও পালেরমো (যিনি এলারিকের সমাধি খুঁজে বের করার পক্ষে) বলেন, “অ্যালারিখ ক্যালাব্রিয়ার তথা সমগ্র ইতালির ইতিহাসেরই একজন বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব। আপনি আপনার প্রয়োজনমতো ইতিহাসের কিছু অংশ গ্রহণ করবেন এবং কিছু অংশ গ্রহণ করবেন না তা ঠিক নয়। আমাদের অবশ্যই অ্যালারিখের সমাধিস্থল খুঁজে বের করা উচিৎ”।
তথ্যসূত্রঃ
১. www.forbes.com
২. www.ancient-origins.net/news-history-archaeology
৩. www.telegraph.co.uk