গ্রীক মিথলজি – দেবতাদের মানব সন্তানঃ দ্বিতীয় পর্ব (হারকিউলিস)

0

গত পর্বেই বলেছিলাম যে গ্রীক মিথলজিতে দেবতাদের মানব গর্ভে উৎপন্ন করা সন্তানের সংখ্যা নেহাত কম না। দেবতাদের মাঝে এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সন্তানের বাবা হচ্ছেন জিউস। আজ যাকে নিয়ে কথা বলব তাঁর পিতাও কিন্তু দেবরাজ জিউস। মজার ব্যাপার হচ্ছে আজকের দুনিয়ায় কেউ যদি জিউসের নাম নাও শুনে থাকেন তাও তার এই ছেলেটির নাম অবশ্যই শুনেছেন। জিউসের এই ছেলের নাম হচ্ছে হারকিউলিস। গ্রীক মিথলজিতে তাঁকে হেরাক্লিস নামে অভিহিত করা হয়েছে, যেটা রোমান মিথলজিতে এসে অপভ্রংশ হয়ে হারকিউলিস হয়ে গিয়েছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে এই হেরাক্লিস নামটারও একটা ইতিহাস রয়েছে, গল্পের কোন এক পর্যায়ে আমরা সেটাও জেনে নেব। তো এখন তাঁর জন্ম থেকেই গল্পটা শুরু করা যাক।

Alcmene: Amphitryon’s Wife

থিবিসের সেনাপতি এম্ফিত্রায়নের স্ত্রীর নাম ছিল আল্কামিনা। অসম্ভব রূপসী ছিলেন তিনি। তাঁর রূপে মুগ্ধ হয়ে গেলেন জিউস, সুযোগও পেয়ে গেলেন একদিন। এম্ফিত্রায়ন এক যুদ্ধে খুবই ব্যস্ত ছিলেন, তো সেই সুযোগে জিউস এম্ফিত্রায়নের ছদ্মবেশে মিলিত হলেন আল্কামিনার সাথে, এবং জিউসের ঔরসে আল্কামিনার গর্ভে জন্মানো ছেলেটি হল হারকিউলিস। এম্ফিত্রায়নের ঔরসেও আল্কামিনার এক সন্তান ছিল তার নাম ছিল ইফিক্লিস। আগেই বলেছি গ্রীক মিথলজি অনুযায়ী হারকিউলিসের নাম হচ্ছে হেরাক্লিস। হেরাক্লিস শব্দটি এসেছে hera+kleos থেকে। গ্রীক kleos শব্দটির মানে হচ্ছে glory। তার মানে হেরাক্লিস শব্দটির মানে হচ্ছে Glory of Hera অর্থাৎ কিনা হেরার মহিমা। হারকিউলিসের জন্মের পর আল্কামিনা যখন বুঝতে পারলেন যে হারকিউলিস জিউসের পুত্র তখন তাঁর মনে ভয় ঢুকল যে জিউসপত্নী হেরা সম্ভবত হারকিউলিসকে পছন্দ করবেন না, খুবই স্বাভাবিক স্বামীর জারজ পুত্রকে কেই বা সহ্য করতে পারে। হেরা হারকিউলিসের ক্ষতি করতে পারে এই ভয়ে হেরার সন্তুষ্টির জন্য হারকিউলিসের এইরকম নামকরণ করা হয়েছে। অবশ্য খুব একটা লাভ হয়নি তাতে। হেরার কোপের মুখে বার বারই পড়তে হয়েছে হারকিউলিসকে।

ছোটবেলায় হারকিউলিস এবং ইফিক্লিসকে একসাথে দোলনায় ঘুম পাড়িয়ে আল্কামিনা নিজের ঘরে গেলে হেরার নির্দেশে দুইটি বিষধর সাপ তাকে মারতে আসে। ইফিক্লিস সাপ দেখে প্রচণ্ড ভয় পেয়ে যায়। কিন্তু হাজার হোক হারকিউলিস মহাশয় জিউসপুত্র, এত সহজে ভয় পেলে কি চলে! তিনি অবলীলায় তাঁর ছোট্ট দু’টি হাত বাড়িয়ে সাপ দুইটার গলা টিপে ধরলেন। ঐ ছোট্ট হাতের চাপের অক্কা পেল সাপ দু’টি। পরে আল্কামিনা ফিরে এসে ব্যাপার-স্যাপার দেখে বেশ ঘাবড়ে গেলেন। বেশ ভয় পেয়েই তিনি গেলেন তৎকালীন গ্রীসের নামকরা অন্ধ ভবিষ্যৎদ্রষ্টা টাইরেসিয়াসের কাছে। টাইরেসিয়াস আল্কামিনাকে বললেন যে এই ছেলে ভবিষ্যতে পৃথিবী বিখ্যাত হবে, সবাই তাঁর নাম স্মরণ করবে। কথিত আছে হারকিউলিস অস্ত্রবিদ্যা শিক্ষা করেন তৎকালীন সেন্টর(অর্ধেক ঘোড়া, অর্ধেক মানুষ) বীর গুরু চীরন (কিংবা কাইরন) এর কাছ থেকে (এখানেও একটা মজার ব্যাপার আছে, গ্রীক বীর একিলিসেরও শিক্ষাগুরুর নামও চীরন, কিন্তু দু’জনের সময়কাল মিলে না, হারকিউলিসের জন্ম অনেক আগে হয়েছে বলে মনে হয় মিথোলজিতে, এবং কোন কোন জায়গায় চীরনের মৃত্যু হারকিউলিসের হাতেই হয়েছে বলে লেখা আছে তাহলে একিলিসের গুরু চীরন কিভাবে হয়! যাই হোক এই বিষয়ে পরবর্তীতে বিস্তারিত আলোচনা হবে)। অস্ত্রবিদ্যা শিক্ষার পর হারকিউলিসের বীরত্বে মুগ্ধ হয় থিবিসবাসী। মিনিয়দের সাথে যুদ্ধে তাঁর বীরত্ব মুগ্ধ করে সবাইকে। তাঁর বীরত্বে মুগ্ধ হয়ে থিবিসের রাজা ক্রেয়ন তার কন্যা মেগেরাকে হারকিউলিসের সাথে বিয়ে দিলেন। হারকিউলিসের ঔরসে মেগেরার চার সন্তান জন্ম নেয়। বেশ আনন্দেই দিন কাটছিল হারকিউলিস মহাশয়ের। কিন্তু হারকিউলসের এত সুখ কি আর দেবী হেরার সহ্য হয়? কখনওই না। হেরা করলেন কি, হারকিউলিসের মাথায় গিয়ে বসলেন, এবং নিজের মায়ার প্রভাবে উন্মাদ করে দিলেন হারকিউলিসকে। এই উন্মত্ততার শিকার হলেন মেগেরা এবং তার চারসন্তান(কোন কোন জায়গায় মেগেরা পালিয়ে গিয়েছিলেন বলে বলা আছে)। হারকিউলিসের হাতে মারা গেলেন তারা। প্রকৃতিস্থ হওয়ার পর

Megara: Wife of Hercules

হারকিউলিস বুঝতে পারলেন কি ভয়ঙ্কর কাজ হয়ে গিয়েছে তাঁর হাতে। আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি, তখন তাঁর বন্ধু থিসিউস তাঁকে থামালেন। থিসিউসের পরামর্শে ডেল্ফির মন্দিরের পুরোহিতদের কাছে গেলেন প্রায়শ্চিত্তের উপায় জানার জন্য। পুরোহিতরা তাঁকে পরামর্শ দিলেন তাঁর চাচাত ভাই মাইসিনির রাজা ইউরেন্থিয়াসের কাছে যেতে। ইউরেন্থিয়াস হারকিউলিসকে পেয়ে ভাবলেন, “এইতো পেয়েছি, এখন এঁকে দিয়ে অসম্ভব কিছু কাজ করিয়ে নেয়া যাক, তাতে আমার বেশ নামডাক হবে”। ইউরেন্থিয়াস প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে ১২ টি অসম্ভব কাজ ঠিক করে দিলেন। এই ১২ টি কাজই হারকিউলিসের সেই বিখ্যাত ১২ টি অভিযান। আজ এখানে শুধু প্রথম অভিযানের কথাই বলব, বাকি গুলো অন্য পর্বে থাকবে।

প্রথম অভিযানে হারকিউলিসকে বলা হয় নেমিয়ার সিংহকে হত্যা করে তার চামড়া নিয়ে আসতে। ব্যাপারটা শুনতে যতটা সহজ মনে হচ্ছে কাজটা তত সহজ না। এই সিংহের চামড়া এতই শক্ত ছিল যে, কোন অস্ত্রই তা ভেদ করতে পারত না। আর দাঁত এবং নখ এতটাই ধারালো ছিল যে, তা দিয়ে লোহাও কাটা যেত। নেমিয়া অঞ্চলের অরণ্যে বাস করত এই সিংহটি, ঐ অঞ্চলের ত্রাস ছিল এই সিংহটি।

নেমিয়া অঞ্চলের দিকে যাত্রা শুরু করলেন হারকিউলিস, পথে ক্লিওন শহরে কয়দিন বিশ্রাম নেয়ার চিন্তা করলেন। ক্লিওন শহরে তিনি মলরকাস নামক এক ব্যক্তির আতিথ্য গ্রহণ করলেন। মলরকাস পেশায় শ্রমিক ছিলেন। যখন তিনি শুনলেন হারকিউলিস নেমিয়ার সিংহ মারতে যাচ্ছেন তখন তিনি হারকিউলিসের সাফল্য কামনায় জিউসের উদ্দেশ্যে একটি পশু উৎসর্গ করতে চাইলেন। তখন হারকিউলিস তাকে ৩০ দিন অপেক্ষা করতে বললেন। যদি তিনি এর মাঝে ফিরে আসেন তো জিউসের উদ্দেশ্যে পশু উৎসর্গ এবং আনন্দ উৎসব দুইজন মিলে করবেন, আর যদি তিনি না আসেন তাহলে যেন মলরকাস ধরে নেন যে তিনি আর বেঁচে নেই, তখন তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে যে এই পশুটি উৎসর্গ করা হয়।
তারপর হারকিউলিস প্রবেশ করলেন নেমিয়ার অরণ্যে। খুঁজে বার করলেন সেই হিংস্র সিংহের গুহা। এই গুহার ছিল দুইটা মুখ, হারকিউলিস তখন বিশাল এক পাথর দিয়ে গুহার এক মুখ বন্ধ করে দেন। তারপর প্রবেশ করেন গুহায়। সিংহকে দেখতে পেয়ে ছুড়ে মারেন তীর। কিন্তু সেই তীর সিংহের চামড়ায় লেগে ছিটকে পড়ে গেল, আঁচড়ও কাটতে

Hercules & Nemean Lion

পাড়ল না। তখন হারকিউলিস সিংহটিকে আচ্ছা মত গদাপেটা করতে লাগলেন, এবং সুযোগ পেয়েই পেছন থেকে জাপটে ধরলেন সিংহের ঘাড়। প্রবল চাপ প্রয়োগ করে শ্বাসরোধ করে হত্যা করলেন এই দানব সিংহকে। (এখানেও আরেকটা ভার্সন আছে গল্পটার, সেখানে বলা আছে সিংহটি হা করে যখন ছুটে আসছিল হারকিউলিসের দিকে, তখন মুখের ভেতর তীর মেরে হত্যা করা হয় তাকে, কারণ মুখের ভিতর চামড়া ছিল না, সেখানে সহজেই তীর বিদ্ধ হয়েছিল)। মারার পর আর এক সমস্যায় পড়লেন হারকিউলিস। এই সিংহের চামড়া তো অভেদ্য, কোন অস্ত্র দিয়েইবতা ভেদ করা যায় না। তাহলে তিনি চামড়া ছাড়িয়ে নিবেন কি দিয়ে। এই সমস্যা সমাধানে এগিয়ে গেলেন দেবী এথেনা। তিনি হারকিউলিসকে বুদ্ধি দিলেন, সিংহের নখ দিয়েই সিংহটির চামড়া ছাড়াতে। তো এইভাবে চামড়া নিয়ে তিনি হাজির হলেন ইউরেন্থিয়াসের দরবারে। তাঁকে দেখে বেশ ঘাবড়ে গেলেন ইউরেন্থিয়াস। তড়িঘড়ি করে দ্বিতীয় কাজ গছিয়ে দিলেন হারকিউলিসকে। কিন্তু সে গল্প আজ না, আরেকদিন হবে, অন্যপর্ব গুলোতে পুরো কাহিনীই আমি

লিখার আশা রাখি। সবাই ভাল থাকবেন, সুস্থ থাকবেন।

(হারকিউলিসের কাহিনীর অনেক গল্পের বিভিন্ন ধরনের কাহিনী লিখা রয়েছে বিভিন্ন রেফারেন্স এ। আমি এখানে তুলনা মূলক অধিক প্রচলিত এবং সর্বজনগৃহীত ভার্সনটুকুই লেখার চেষ্টা করেছি। সকলকে ধন্যবাদ )

 

প্রথম পর্বে পারসিয়াস এর কাহিনী পড়তে এখানে ক্লিক করুন – গ্রীক মিথলজি – দেবতাদের মানব সন্তানঃ প্রথম পর্ব (পারসিয়াস)

তৃতীয় পর্বটি পড়তে এখানে ক্লিক করুন – গ্রীক মিথলজিঃ দেবতাদের মানব সন্তান, তৃতীয় পর্ব (হারকিউলিসের দ্বিতীয় অভিযান)

Leave A Reply
sativa was turned on.mrleaked.net www.omgbeeg.com

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More