মুভি রিভিউঃ গ্যাংস অফ ওয়াসিপুর

4

হলিউডের কাছে গর্ব করার মত অনেক সিনেমা আছে কিন্তু বলিউড তথা গোটা ভারতবর্ষে গর্ব করার মত সিনেমা খুব একটা বেশি না । কিন্তু সেই গুটি কয়েক সিনেমাগুলো হলিউডের অন্যসব মাস্টারপিসের সমপর্যায়ে। সেই পর্যায়ের একটি চলচ্চিত্র হচ্ছে “Gangs of Wasseypur”…

জিশান কাদরি- কিছুটা অচেনা একটি নাম, ২০০৯ সালে ওয়াসিপুর থেকে মুম্বাই আসেন “হিরো” হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে, যদিও পরবর্তীতে তার এই “লক্ষ্য” কয়েক লক্ষে বিভক্ত হয়ে পড়ে যখন তিনি বুঝতে পারেন “হিরো” হওয়া অতোটা সহজ কাজ না, যতোটা কল্পনা করে তিনি ওয়াসিপুর ছেড়ে মুম্বাই আসেন। এরপর তিনি প্রচুর সিনেমা দেখা শুরু করে দেন, এক সময় রিয়ালাইজ করেন “আরেহ এই রকম কাহিনী তো আমিও লিখতে পারি”, খাতা- কলম নিয়ে বসে পড়লেন “লেখার” জন্য। কিন্তু কি “লিখবেন”!! কোন কূল-কিনারা করতে না পেরে সিদ্ধান্ত নেন নিজের জন্মস্থান(ওয়াসিপুর) কে নিয়ে লিখবেন। অবশেষে কোন রকম ৮ পৃষ্ঠার মধ্যে গল্পের মূল কনসেপ্ট লিখে নিয়ে যান আনুরাগ কাশ্যাপের কাছে, আনুরাগ কাশ্যাপ সামারি পড়ার পর এই গল্প নিয়ে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। গল্প নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করায় জিশান এই ফাকে কাশ্যাপকে বলে দেন পর্দার সামনেও তিনি থাকতে চান, আনুরাগ কাশ্যাপ তাকে বলেন, অভিনয়ের চিন্তা আপাতত না করে পুরো স্ক্রিপ্ট লিখে নিয়ে আসতে

এরপর দীর্ঘ এক বছর গল্পের উপর কাজ করে ১৪০ পৃষ্ঠার স্ক্রিপ্ট নিয়ে হাজির হন আনুরাগ কাশ্যাপের সামনে। স্ক্রিপ্ট পড়ার সাথে সাথে ডিক্লেয়ার করে দেন এই স্ক্রিপ্ট নিয়ে তিনি কাজ করবেন। অন্যদিকে জিশানের মনে অভিনয়ের ইচ্ছা এখনও জীবন্ত প্রি-প্রোডাকশনের সময়-ই তিনি আনুরাগ কাশ্যাপকে বলে দেন, এই গল্পের “ডেফিনেট” নামে যে চরিত্রটি আছে, তা তিনি প্লে করতে চান। এতে আনুরাগ কাশ্যাপ রাজি হয়ে যান, যদিও এই চরিত্রের প্রথম শট নেওয়ার পর আনুরাগ কাশ্যাপ শট বাদ করে দেন আর জিশানকে বলেন ওজন কমাতে, প্রায় দশ কেজি ওজন কমানোর পর আবার রিটেক দেন

এতক্ষণ জিশান কাদরির কথা এর জন্য বললাম কারণ তার জন্য আজ এই রকম একটি মাস্টার ক্লাস চলচ্চিত্র
নির্মিত হয়েছে ।

“ওয়াসিপুর” হচ্ছে ভারতের ঝাড়খণ্ড রাজ্যের ধানবাদ জেলার একটি বিশাল এরিয়া, আর এই সিনেমার প্রেক্ষাপট
যখন থেকে শুরু হয় তখন ওয়াসিপুর ছিল ধানবাদের বাহিরে। এই সিনেমার মূল কাহিনী আবর্তিত হয় ওয়াসিরপুরকে নিয়ে-ই… গ্যাংস অফ ওয়াসিপুর মূলত সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত একটি চলচ্চিত্র। “নতুন” সিনেমা সবাই নির্মাণ করতে পারে না, বলিউডে খুব কম পরিচালক-ই আছেন যারা নতুন চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন, এখানে নতুন বলতে বোঝানো হয়েছে “চলচ্চিত্রের নতুনত্বকে”। আনুরাগ কাশ্যাপ বলিউডকে একদম নতুন একটি চলচ্চিত্র উপহার দিয়েছেন, এমন একটি সিনেমা যেখানে একজন অডিয়েন্স সম্পূর্ণ নতুন কিছুর স্বাদ পাবে, এমন কিছু যা কেউ কখন করে দেখায়নি, তারান্তিনো যেমন ভায়োলেন্সের ব্যাপারটি একদম আর্টের লেভেলে নিয়ে গেছেন ঠিক তেমনি আনুরাগ কাশ্যাপও গ্যাংস্টার জেনারের সাথে ভায়োলেন্সকে জোড়া লাগিয়ে একদম নতুন কিছু সৃষ্টি করে দেখিয়েছেন। কাস্টিং থেকে শুরু প্রতিটি সাইট ছিল একটু বেশি অসাধারণ।

মানোজ বাজপাই কোন এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন বলিউডের সব’চে আমেজিং পরিচালক হলেন “আনুরাগ
কাশ্যাপ” বলিউডের টপ পরিচালকের লিস্ট ততোক্ষণ পর্যন্ত অপরিপূর্ণ থাকবে যতক্ষণ পর্যন্ত আনুরাগ কাশ্যাপের নাম না লেখানো হয়, রাজকুমার হিরানী, রাকেশ ওমপ্রকাশ মেহরার সাথে আনুরাগ কাশ্যাপের নাম সব সময় উচ্চারিত হবে শুধুমাত্র এই সিনেমার জন্য। আনুরাগ কাশ্যাপের ডিরেকশন মানে নতুন কোন চমক, এমন কিছু যা দেখার পর মুখ থেকে অটোমেটিক বেরিয়ে পড়বে “I’ve never seen it before”, সিনেমার স্ক্রিপ্ট নিয়ে তিনি ব্যাপক গবেষণা করেছেন, যা তার পরিচালনায় খুব সুন্দর ভাবে ফুটে উঠছে। সাধারণত একটি সিনেমাতে দেড়শ থেকে দু’শ এর মত সিন থাকে কিন্তু এই মুভিতে প্রায় সাতশ সিন রয়েছে। পুরো মুভির রান টাইম প্রায় সাড়ে পাঁচ ঘন্টা, সেই হিসেবে একটি সিনের জন্য এক মিনিটেরও কম সময় বরাদ্দ… এত কম সময়ে পুরো মুভিকে এতো সুন্দর ভাবে উপস্থাপনের জন্য-ই “গ্যাংস অফ ওয়াসিপুর” একটি মাস্টারপিস হয়েছে, হয়তো এর জন্য Cannes Film Festival এ মুভিটি প্রদর্শিত হয়েছে।

পুরো মুভির গল্পটি অনেক বড় হওয়ায় এটিকে দুই ভাগে ভাগ করে নির্মাণ করা হয়, সিনেমার ৮৫%-ই ছিল রিয়ালস্টিক আর বাকি ১৫% ফিকশন। প্রথম পার্ট একটু ধীর গতির ছিল কিন্তু দ্বিতীয় পর্বে বেশ জোরালো ভাবে কাহিনী এগিয়ে যায়। প্রতিটি টার্ন টুইস্ট সিট-বেল্টকে আরও শক্ত করে ধরে রাখবে। যখন এই সিনেমার স্ক্রিপ্ট ডেভলপিং-এর কাজ করা হচ্ছিলো তখন বেশ ধমকি মূলক ফোন কল পেয়েছিলেন মুভির কো-রাইটার আর আনুরাগ কাশ্যাপ, শত বাধাকে পেছনে ফেলে নিজের কাজ করে ফেলেছেন।

বড় কোন স্টারকে এই সিনেমায় কাস্ট করা হয়নি, জাস্ট সিনিয়র কিছু অভিনেতাদের কাস্ট করা হয়েছে… এই সিনেমার প্রতিটি ক্যারেক্টার-ই একটু অদ্ভুত ধরনের, সবার ভেতরে একটু সাইকো সাইকো ভাব আছে, আর এই সাইকোয়িক ভাব ব্যাপক ভাবে ফুটে উঠেছে কাস্টিং এর মাধ্যমে। সবাইকে পারফেক্ট চরিত্রে কাস্ট করা হয়েছে, এই সিনেমায় “আসগার” নামে একটি চরিত্র আছে যার জন্য প্রায় দেড় হাজার মানুষ অডিশন দিয়েছে, এর থেকে বোঝা যায় কতোটা সতর্কতার সাথে মুভির কাস্টিং করা হয়েছে, মুভির স্টোরি-লাইনে যে এটমস্ফিয়ার ক্রিয়েট করা তা পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে অডিয়েন্সের কাছে উপস্থাপিত হয়েছে ক্যামেরা ওয়ার্কের মাধ্যমে। সেকেন্ড পার্টে ফাইনাল সিকুয়েন্স ছিল পুরো সিনেমার বেস্ট সিকুয়েন্স।

সিনেমার মিউজিক কম্পোজার Sneha Khanwalker শুটিং শুরুর এক বছর আগে থেকে মিউজিক কম্পোজ করা শুরু করে দেন। এই সিনেমার মিউজিক এক কথায় “অদ্ভুত সুন্দর”। সিনেমার মত মিউজিকও একটু ডিফরেন্ট একশন সিকুয়েন্সের সাথে গানগুলো বেশ লেগেছে। প্রতিটি টার্নিং সিকুয়েন্সের আগে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের ব্যবহার একদম পারফেক্ট হয়েছে। এই সিনেমার কিছু এক্সেসিভ ভায়োলেন্সের সাথে কিছু ডায়ালগও সবার হয়তো হজম নাও হতে পারে, মারমার-কাটকাটে ভরপুর মুভির প্রায় প্রতিটা ডায়ালগ। ডায়ালগের জন্য মুভিটি আরও বেশি রিয়ালিস্টিক মনে হয়েছে।

সিনেমার মাইট্রোকন্ডিয়া হচ্ছে প্রতিটি চরিত্রের ন্যাচারাল অভিনয়। বিশাল কাস্টিং হওয়ায় সবার নাম ধরে ধরে বলা সম্ভব না, যদিও সবাই তাদের বেস্ট অভিনয় করে দেখিয়েছেন, স্পেশালী যে চরিত্রগুলো সারাজীবন মনে থাকবে সেগুলো নিয়ে দুটি কথা। প্রথম পর্বে মানোজ বাজপাই তার জীবনের সেরা অভিনয় করে দেখিয়েছেন। জাস্ট “outstanding performance“। দুটি পর্বে-ই রিচা চাড্ডা দারুণ পারফরমেন্স করেছেন। কিন্তু কেকের উপর চেরি হয়ে ছিলেন নাওয়াজ উদ্দিন সিদ্দিকি। যার মাত্র এক মিনিটেরও কম সময়ের অভিনয় দেখে(সারফারোস মুভিতে) আনুরাগ কাশ্যাপ বুঝতে পেরেছিলেন “একে” দিয়ে কিছু হবে। এরপর যখন গ্যাংস অফ ওয়াসিপুরে লিড রোলে তাকে কাস্ট করা হল তখন প্রায় অনেকে অবাক হয়ে গিয়েছিলো সবাই, অবাক হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু না, কারণ আনুরাগ কাশ্যাপ এক হিসেবে বিশাল একটা রিস্ক নিয়ে ফেলেছিলেন তাকে কাস্ট করে, এমন দুঃসাহস খুব কম পরিচালক-ই দেখিয়েছেন। অবশেষে সকল প্রশ্নের জবাব তিনি দিয়ে দিলেন তার অভিনয়ের মাধ্যমে। এখনও অনেকে কম্পেয়ার করে কনফিউজড যে কার অভিনয় বেশি ভালো হয়ে মানোজ বাজপাই এর নাকি নাওয়াজ উদ্দিনের। দু’জন-ই তাদের এখন পর্যন্ত সেরা অভিনয় দিয়ে দিয়েছেন এই সিনেমায়। বলিউডের আরেক লিজেন্ডারি পরিচালক তিগমানসু ঢুলিয়া এই মুভিতে অভিনয় করেন, এই প্রথম তিনি ক্যামেরার সামনে আসেন, মানোজ বাজপাই আর নাওয়াজ উদ্দিনের সাথে পাল্লা দিয়ে তিনিও অসাধারণ অভিনয় করেছেন, সাপোর্টিং একট্রেস হিসেবে হুমা কুরাইসি ভালো করেছেন। সারদার খান আর ফাইজাল খানের পর ডেফিনিট আর পারপেন্ডিকুলারের অভিনয় খুব ভালো লেগেছে, তাদের অভিনয়ও অনেক দিন মনে থাকবে। প্রথম পার্ট থেকে ২য় পার্ট অনেক বেশি ইন্টারেস্টিং লেগেছে।

বি-টাউনের গডফাদার বলে বিবেচিত এই গ্যাংস্টার মুভি আমার দেখা সেরা গ্যাংস্টার মুভি লিস্টে প্রথমে থাকবে। পুরো সিনেমায় কোন কমেডি সিকুয়েন্স নেই, বেশির ভাগ-ই সিরিয়াস সিকুয়েন্স, কিন্তু তারপরও ব্যাপক হেসেছি , মুভির ট্রেড মার্ক কিছু সিকুয়েন্স আছে যা মাঝে মাঝে দেখা হয়। মুভিতে একটি সিকুয়েন্সে দেখা যায় ফায়জাল খান(নাওয়াজ উদ্দিন) মহসিনাকে(হুমা কুরাইসি) প্রেমের প্রস্তাব দিচ্ছে এই সময় হাত ধরাকে কেন্দ্রে করে খুব সুন্দর একটি সিকুয়েন্স আছে যা বাস্তবে-ই নাওয়াজ উদ্দিনের সাথে হয়েছে। এই সিনেমার জন্য নাওয়াজ উদ্দিন ন্যাশনাল এওয়ার্ড পান। ফুল অফ এন্টারটেইনমেন্টের পারফেক্ট উদাহরণ হচ্ছে এই সিনেমাটি…

পরিশেষে একটা কথা-ই বলবো “Gangs of Waseypur is already a Cult

Leave A Reply
4 Comments
  1. Oymavs says

    terbinafine pill – terbinafine online buy grifulvin v without prescription

sativa was turned on.mrleaked.net www.omgbeeg.com

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More