ইতিহাসের রহস্যময় সেরা ১০টি প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার!
প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনসমূহের আবিষ্কার সবসময় আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় আমাদের পূর্বপুরুষদের সৃজনীশক্তির কথা। আর এই আবিষ্কারগুলোর বদৌলতে আমাদেরও সুযোগ হয় শতবর্ষ পুরনো সেই নিদর্শনগুলোর ব্যাপারে জ্ঞান অর্জনের। শতবর্ষী এই নিদর্শনগুলোকে ঘিরে থাকা রহস্যের সংখ্যাও কিন্তু নেহাত কম নয়। এমনই ১০টি রহস্যে ঘেরা নিদর্শন নিয়ে আজকের এই আয়োজন।
১০. ভোয়নিক ম্যানুস্ক্রিপ্ট (Voynich Manuscript)
একে বলা হয়ে থাকে “পৃথিবীর সবচেয়ে রহস্যময় ম্যানুস্ক্রিপ্ট”। ইতালির উত্তরে ১৯১২ সালে এই ম্যানুস্ক্রিপ্ট আবিষ্কৃত হয়। এই ম্যানুস্ক্রিপ্টের ভাষা, ব্যবহৃত বর্ণমালা বা এর লেখক সম্পর্কে এখন পর্যন্ত কোন প্রকার তথ্য খুঁজে বের করা সম্ভব হয়নি। প্রত্নতত্ত্ববিদদের মতে, ম্যানুস্ক্রিপ্টির বেশ কিছু পাতা খুঁজে পাওয়া যায় নি এবং সব মিলিয়ে বর্তমানে মোট ২৪০টি পৃষ্ঠা বিদ্যমান।
ম্যানুস্ক্রিপ্টে প্রাপ্ত লেখনীগুলোর মধ্যে সবচেয়ে আশ্চর্যজনক বিষয় হচ্ছে এর মধ্যে অংকিত বিভিন্ন ভেষজ উদ্ভিদের চিত্র। মজার ব্যাপার এই যে, ছবির গাছের সাথে মেলে এমন কোন গাছ আজ অবধি গবেষকবৃন্দ খুঁজে পাননি। ধরে নেয়া হয়, ভোয়নিক ম্যানুস্ক্রিপ্ট রচনার সময়কাল ১৫শ শতাব্দী। ভেষজ উদ্ভিদের অংশটি ছাড়াও ম্যানুস্ক্রিপ্টে বেশ কয়েকটি অংশ রয়েছে এবং তাদের মধ্যে জ্যোতির্বিদ্যা, জীববিদ্যা, সৃষ্টিতত্ত্ব এবং ওষুধবিদ্যা অন্যতম।
৯. মাউন্ট ওয়েন মোওয়া (Mount Owen Moa)
সময়টা ছিল ১৯৮৬ সাল যখন এক দল প্রত্নতাত্ত্বিক নিউজিল্যান্ডের এক গুহায় খনন করার সময় পাখির একটি দাঁড়া আবিষ্কার করে যে দাঁড়াটিতে হাড়ের সাথে তখনও মাংসপেশি সংযুক্ত ছিল। পরবর্তীতে পুরাতত্ত্ববিদগণ নিশ্চিত করেন যে, এই দাঁড়াটি বিলীন হয়ে যাওয়া পাখাবিহীন মোওয়া পাখির যা প্রায় ২০০০ বছর আগেই পৃথিবী থেকে বিলীন হয়ে গেছে। ডানা বিহীন মোওয়া পাখি ছিল বেশ ভারি প্রজাতির পাখি যা উচ্চতায় ১২ ফুট এবং ওজনে ২৫০ কেজি পর্যন্ত হত। মূলত, প্রাচীন মানবদের শিকারে পরিণত হওয়ার কারণেই পৃথিবী থেকে মোওয়া পাখি বিলীন হয়ে গেছে। মোওয়া পাখির সেই দাঁড়াটি বর্তমানে নিউজিল্যান্ডের ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামে (Natural History Museum of Newzeland) সংরক্ষিত আছে।
৮. সাকসাইয়ুমান (Sacsayhuaman)
মাচুপিচুতে (Machu Picchu) অবস্থিত প্রাচীরঘেরা প্রাচীন এক দুর্গ সাকসাইয়ুমান। ১৪৪০ সালে সম্রাট পাচাকুটির (Pachacuti) আমলে জটিল এই কাঠামোর সৃষ্টি শুরু হয় ১৪৪০ সালে। দুর্গটি পুরোপুরি তৈরি হতে ১০০ বছরেরও বেশি সময় নেয়। প্রাচীরটি তৈরি হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের পাথর দিয়ে যার মধ্যে আছে ডায়োরিট ব্লক, ইয়ুকা চুনাপাথর এবং ঘন অ্যান্ডেসাইট।
৬০০ মিটার লম্বা সাকসাইয়ুমান প্রাচীরের কাঠামো অনেকটা জিগজ্যাগ এর মত। এই প্রাচীরের প্রতিটি ব্লকের ওজন কয়েকশ টন। সাকসাইয়ুমান প্রাচীরের কারণে বিখ্যাত টাওয়ার মুয়ু মারকা (Muyu Marca), সালা মারকা (Sala Marca) ও পানা মারকা (Pana Marca) সুরক্ষিত ছিল। একই সাথে সুরক্ষিত ছিল একটি সূর্য মন্দির।
৭. নাজকা রেখা (Nazca Lines)
দক্ষিণ পেরুর মরুভূমির উপর দিয়ে যখন বিমানে করে উড়ে যাওয়া হয়, তখন মরুভূমির বুকে অস্বাভাবিক কিছু সাদা রেখা অবলোকন করা যায় আর অদ্ভুত এই রেখাগুলোই নাজকা রেখা হিসেবে পরিচিত। ইউনেস্কো কর্তৃক ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানগুলোর মধ্যে পেরুর এই স্থান অন্যতম। রহস্যময় প্রাচীন এই গঠন অনেকটা ট্রাপিজোয়েডাকার, আয়তাকার, ত্রিভুজাকার এবং স্ফুলিঙ্গের মত। যদি কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করা হয় তাহলে সেই নকশার মধ্যে ৭০ টি প্রাণী, গাছপালা এবং ৩০০ টি জ্যামিতিক আকৃতি খুঁজে পাওয়া যাবে। তবে এই রেখাগুলো কি কারণে আঁকা তা এখনও রহস্যই রয়ে গেছে।
প্রত্নতাত্ত্বিকদের ধারণা অনুযায়ী, নাজকা রেখাগুলো আঁকা হয়েছে খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ সাল থেকে ৭০০ খ্রিস্টাব্দ সময়কালের মধ্যে এবং এই রেখা গুলোর আঁকিয়ে ছিল নাজকা ইন্ডিয়ান আদিবাসীরা। অর্থাৎ প্রায় ২০০০ বছর ধরে অক্ষত আছে এই প্রাচীন অংকন। মানুষের একটি বিশাল সংখ্যা বিশ্বাস করে যে, সঠিক দিক নির্দেশের উদ্দেশ্য এলিয়েনদের দ্বারা এই রেখা গুলো অংকিত হয়েছে।
৬. গোবেক্লি তেপে (Gobekli Tepe)
তুর্কিতে অবস্থিত পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হল গোবেক্লি তেপে- এমন এক নিদর্শন যা সবাইকে মনে করিয়ে দেয় ১১০০ বছর আগে প্রস্তর যুগের মানুষদের উচ্চ পর্যায়ের শৈল্পিক ক্ষমতা সম্পর্কে। এতে ব্যবহৃত চুনাপাথরের থামগুলোর একেকটির ওজন ১৫ থেকে ২০ টন এবং থাম গুলো কাটা হয়েছে বিশাল বিশাল পাথরের ব্লক থেকে।
অভিযান চলাকালীন সময়ে প্রত্নতাত্ত্বিকরা ২০০ টি বিশাল স্তম্ভের সন্ধান পায়। এই নির্মাণটি প্রাচীন মানুষদের ভাঁড়ার ঘর অথবা মন্দির বলে ধারণা করা হয়। এই আবিষ্কার নিওলিথিক বিপ্লব (Neolithic Revolution) সম্পর্কে পুরাতত্ত্ববিদদের গবেষণায় সহায়ক হিসেবে কাজ করেছে।
৫. টেরাকোটা সৈন্যদল (Terracotta Army)
১৯৭৪ সালে চীনের জিয়ানে(Xian) একদল প্রত্নতাত্ত্বিক একটি খননকাজ পরিচালনা করে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ অন্ত্যেষ্টিক্রমা, টেরাকোটার সৈন্যদল আবিষ্কার করে। সম্রাট কিন শি হুয়াং (Qin Shi Huang) এর সমাধির নিচে হাজার হাজার পোড়ামাটির তৈরি সৈন্যদল পাওয়া যায়। সম্রাটের সমাধিতে পোড়ামাটির সৈন্যদের দেয়ার কারণ ছিল মৃত্যুর পর সম্রাটকে বিভিন্ন অপশক্তির হাত থেকে সুরক্ষা প্রদান করা। প্রাচীন এই নিদর্শনের বয়স প্রায় ২০০০ বছর।
পোড়ামাটির মূর্তিগুলোর পাশাপাশি সমাধির ভেতর বেশ কিছু অস্ত্র পাওয়া গেছে এবং অস্ত্রগুলো খুব সুন্দরভাবে আলাদা আলাদা খুপরিতে গোছানো ছিল।প্রত্নতাত্ত্বিক এই স্থানে মোট ৪ টি প্রধান কক্ষ রয়েছে যার মধ্যে ৩ টি কক্ষে পোড়ামাটির সৈন্য এবং একটি কক্ষ শূন্য। তবে সমাধির বেশির ভাগ অংশ এখনও পর্যন্ত অনাবিষ্কৃত রয়ে গেছে।
৪. মোওয়াই ভাস্কর্য , ইস্টার আইল্যান্ড (Moai Statues, Easter Island)
আজ পর্যন্ত যতগুলো প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে তাদের মধ্যে সবচেয়ে রহস্যময় এবং প্রতীকী নিদর্শনগুলোর মধ্যে অন্যতম ইস্টার দ্বীপপুঞ্জে অবস্থিত মোওয়াই ভাস্কর্য। চিলিতে অবস্থিত গাছবিহীন দুর্গম ইস্টার দ্বীপপুঞ্জের মূল আকর্ষণ এই ভাস্কর্যগুলোই। রাপা নুই (Rapa Nui) এর প্রাচীন অধিবাসীদের দ্বারা খ্রিস্টপূর্ব ১৩০০ থেকে ১৫০০ সালের মধ্যে এই ভাস্কর্যগুলো নির্মিত হয়েছিল। বিশাল বিশাল প্ল্যাটফর্মের উপর স্থাপিত মোট ২৮৮ টি মোওয়াই মূর্তির সন্ধান পাওয়া গেছে । মূর্তি গুলো উচ্চতায় ১৩ ফুট এবং ওজন প্রায় ৮০ টন। রাপা নুই এর জনগণ মৃত আগ্নেয়গিরির পাথর ব্যবহার করে মূর্তিগুলো নির্মাণ করেছে। প্ল্যাটফর্মের ‘ডি’ আকৃতির ফলে মোওয়াই মূর্তিগুলোকে শক্ত দড়ির সাহায্যে পাশাপাশি স্থান পরিবর্তন করা যায়।
৩. স্টোনহেঞ্জ (Stone Henge)
ইংল্যান্ড এর সালিসবারি (Salisburry) শহরে অবস্থিত ৫০০০ বছরের পুরনো প্রাগৈতিহাসিক এক নিদর্শন স্টোন হেঞ্জ। এই নিদর্শন নির্মিত হয়েছে ছোট বড় অনেকগুলো পাথর পর্যায়ক্রমে সাজানোর মাধ্যমে। সারসেন (Sarsen) নামধারী বড় পাথরগুলো উচ্চতায় ৩০ ফিট এবং ওজনে ২৫ টন পর্যন্ত। স্টোনহেঞ্জ নির্মাণের পেছনে মূল উদ্দেশ্য এখনো জানা যায়নি।
খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ থেকে ২০০০ সাল সময়ের মধ্যে স্টোনহেঞ্জ নির্মিত হয়েছিল। নির্মাণ কাজের জন্যে নির্মাণ স্থান থেকে ১৫০ মাইল দূরে অবস্থিত প্রিসেলি (Preseli) পর্বত থেকে বিশাল বিশাল পাথরের চাঁই আনা হয়েছিল। বলা হয় যে, স্টোনহেঞ্জ এর এলাকায় ২৪০ জনকে সমাধি দেয়া হয়েছে।
স্টোনহেঞ্জ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাইলে পড়ে ফেলুন – স্টোনহেঞ্জ রহস্য – ইংল্যান্ডের উইল্টশায়ারে অবস্থিত এক বিস্ময়!
২. পিরামিড (Great Pyramids)
পৃথিবীর সেরা স্থপতিশৈলীর নিদর্শন হিসেবে ধরা হয়ে থাকে প্রাচীনযুগে নির্মিত মিশরের পিরামিডকে। অনেক প্রাচীন সভ্যতা পিরামিড তৈরি করলেও মিশরের পিরামিডগুলো এক এবং অনন্য। পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্যের তালিকায় গিজার (Giza) পিরামিডের অবস্থান শীর্ষে। ধারণা করা হয় যে, মিশরীয়রা পিরামিড নির্মাণ করা শুরু করে খ্রিস্টপূর্ব ২৭০০ সাল থেকে মূলত রাজকীয় মরদেহের সমাধি হিসেবে।
মিশরের সবচেয়ে পুরনো এবং উঁচু পিরামিড হল গিজার পিরামিড যার উচ্চতা ৪৮১ ফিট। লক্ষ লক্ষ পাথর ব্যবহার করে ২০ বছর ধরে নির্মাণ করা হয় এই পিরামিড। পিরামিডের ভিতরে সংরক্ষিত ছিল রাজকীয় মমি এবং মহামূল্যবান সম্পদ। এছাড়াও পিরামিডের দেয়ালে সজ্জিত ছিল সুন্দর চিত্রকলা এবং নকশা।
১. আটলান্টিস শহর (Atlantis City)
প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারসমূহের মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে রহস্যময় আবিষ্কার হারানো শহর আটলান্টিস। প্লেটো (Plato) ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি খ্রিস্টপূর্ব ৩৬০ সালে প্রথম মহাসাগরের নিচে ডুবে যাওয়া এই শহরের ব্যাপারে ধারণা পোষণ করেন। গবেষণা থেকে ধারণা করা হয় যে, খ্রিস্টপূর্ব ১০ হাজার বছর আগে এক ভয়ানক জলোচ্ছ্বাসে আটলান্টিস শহরের সলিল সমাধি ঘটে। তবে এই শহরের সত্যতা আজ পর্যন্ত প্রত্নতাত্ত্বিকদের কাছে অজানা।
প্রাচীন কাহিনীগুলো থেকে জানা যায় যে, এশিয়া মহাদেশ থেকেও বড় আটলান্টিস শহর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সমুদ্র দেবতা পোসাইডন (Poseidon) । সমৃদ্ধ এই শহর পৃথক ছিল স্থলভূমি এবং জলাশয় দ্বারা। আটলান্টিকের কোন এক অংশে ডুবে আছে অতি প্রাচীন এই শহর। মূলত আটলান্টিকের বিশালতা ও গভীরতার কারণে আজ পর্যন্ত গবেষকেরা আটলান্টিস শহরের প্রকৃত অবস্থান বের করতে ব্যর্থ হয়েছেন।
terbinafine over the counter – fluconazole without prescription griseofulvin over the counter