সূর্য পিরামিড এর শহর তিওতিহুয়াকান : মেসোআমেরিকান সভ্যতার এক অনন্য নিদর্শন

0

প্রাচীন মেসোআমেরিকান সভ্যতার একটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন তিওতিহুয়াকান নগরী। প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ এই শহরটি আধুনিক মেক্সিকো সিটি থেকে ৪০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে অবস্থিত। তিওতিহুয়াকান নগরীর আয়তন ২১ বর্গ কিলোমিটার। প্রাক-কলম্বিয়ান আমেরিকার সবচেয়ে বড় এ নগরীর সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দিক হলো এর মেসোআমেরিকান পিরামিড গুলো। এছাড়াও এই নগর জুড়ে ছড়িয়ে আছে আরো অনেক স্থাপনা যা কালের সাক্ষী হয়ে এখনো টিকে আছে।

তিওতিহুয়াকান এর ধ্বংসাবশেষ
তিওতিহুয়াকান এর ধ্বংসাবশেষ
Source: wallpaperstock.net

তিওতিহুয়াকান নগরীর প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে এখনো পর্যন্ত খুব একটা জানা যায়নি। কারা ছিলো এই শহরের প্রাচীন স্থপতি, কি ছিলো তাদের নাম, তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস এমন কি তাদের ভাষা সম্পর্কেও তেমন কিছু যানা যায়নি। ধারণা করা হয় যে, খ্রিষ্টপূর্ব ১০০ অব্দে রহস্যময় এই নগরীর স্থাপন কার্য আরম্ভ হয় এবং ২৫০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে এর বৃহদাকার ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা গুলোর নির্মাণ চলমান থাকে। শহরটি সম্ভবত ৭ম এবং ৮ম শতাব্দী পর্যন্ত টিকে ছিলো কিন্তু এর গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা গুলো ৫৫০ খ্রিষ্টাব্দের আশেপাশে কোনো সময়ে পুড়িয়ে ধ্বংস করে দেয়া হয়। আবার অনেক বিশেষজ্ঞদের ধারণা যে, ৭ম অথবা ৮ম শতকে বাইরের কোনো দখলদার বাহিনী শহরটিকে আক্রমণ করে ও পুড়িয়ে দেয়। তবে সাম্প্রতিক কিছু গবেষণায় উঠে এসেছে যে, পুড়িয়ে দেয়ার কাজটি শুধুমাত্র কিছু নির্দিষ্ট স্থাপনার মাঝেই সীমাবদ্ধ যেগুলো মূলত শাসন কর্তাদের আবাসস্থল ছিলো। এটা থেকে অনেকে ধারণা করে যে, আভ্যন্তরীণ কোন বিষয় থেকেই হয়তো গোলযোগের সৃষ্টি হয় যার ফলাফল ছিলো ঐ অগ্নিকান্ড।

তিওতিহুয়াকান
source: en.wikipedia.org

তিওতিহুয়াকান নামটি অ্যাজটেকদের দেয়া। শত শত বছর ধরে পরিত্যক্ত থাকার পর ১৪০০ খ্রিষ্টাব্দে অ্যাজটেকরা এই শহরটির সন্ধান পায় ও এর নামকরণ করে। তাদের দেয়া ‘তিওতিহুয়াকান’ নামটির অর্থ ‘ঈশ্বরের জন্মস্থান’। তবে তিওতিহুয়াকান এর আসল ইতিহাস বা সংস্কৃতি রহস্যই রয়ে গিয়েছে। ধারণা করা হয় যে, ১ম সহস্রাব্দে তিওতিহুয়াকান ছিলো প্রাক-কলম্বিয়ান আমেরিকার সবচেয়ে বড় নগরী এবং এর জনসংখ্যা ছিলো প্রায় ১,২৫,০০০ থেকে ২,০০,০০০ পর্যন্ত। জনসংখ্যার দিক থেকে বিবেচনা করলে ঐ সময়ে এটি ছিলো পৃথিবীর ৬ষ্ট বৃহত্তম নগরী। মেসোআমেরিকার সবচেয়ে শক্তিশালী ও গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে তিওতিহুয়াকানের সাংস্কৃতিক ও শৈল্পিক প্রভাব শুধুমাত্র এই অঞ্চলেই নয় বরং বহির্বিশ্বেও ছড়িয়ে পরে।

তিওতিহুয়াকান এর গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা গুলোর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো ক্যাটজাল্কোয়াটল মন্দির এবং জ্যামিতিক নকশায় তৈরি চন্দ্র ও সূর্য পিরামিড। এছাড়াও শহরটির স্থাপত্যশৈলীর কারণে এটি নৃতাত্ত্বিকভাবেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শহরটিতে রয়েছে যৌথ পরিবারের বসবাস উপযোগী বিশালাকার আবাসস্থল, সমাধিক্ষেত্র, অন্যান্য প্রয়োজনীয় ভবন এবং শহরের ছোট্ট একটি অংশে রয়েছে বর্ণীল কিছু দেয়ালচিত্র যা আশ্চর্যজনকভাবে এখনো টিকে আছে।

প্রায় ২০০০ এর অধিক একতলা বাসভবনের পাশাপাশি ধ্বংসপ্রাপ্ত এই শহরটিতে রয়েছে বিশালাকৃতির অনেক নগর চত্বর, মন্দির, খননকৃত খাল, ধর্মযাজক ও রাজ আমলাদের জন্য নির্মিত প্রাসাদ। প্রধান প্রধান দালান গুলো ১৩০ ফুট প্রশস্ত রাস্তা দিয়ে সংযুক্ত। এখানকার সমাধিক্ষেত্রটি ২.৪ কিলোমিটার দীর্ঘ।

নগর চত্বর
নগর চত্বর Source: Daily Rc’/Flickr

সূর্য পিরামিড তিওইহুয়াকান এর সর্ববৃহৎ স্থাপনা। এমনকি এটি মেসোআমেরিকার সর্ববৃহৎ স্থাপনাগুলোর মাঝেও একটি। এটি দেখতে অনেকটা মিশরের খুফু পিরামিডের মত। সূর্য পিরামিডের অবস্থান সমাধিক্ষেত্রের পূর্ব প্রান্ত থেকে প্রায় শহরের কেন্দ্রস্থল পর্যন্ত। ভূমি থেকে এর উচ্চতা ২১৬ ফুট এবং এর ভিত্তির পরিমাপ ৭২০/৭৬০ ফুট। এই পিরামিডের নির্মাণ কার্য শেষ হয় দ্বিতীয় শতকে। ধারনা করা হয় যে এর নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হতে ১০০ বছরেরও বেশি সময় লাগে এবং এটি তৈরি করতে প্রায় ১১ লক্ষ ঘন মিটার কাঁদা মাটির তৈরি রোদে শুকানো ইট ব্যবহৃত হয়েছে।

সূর্য পিরামিড
সূর্য পিরামিড Source: Pixdaus

সমাধিক্ষেত্রের উত্তরাংশ থেকে শুরু হয়েছে চন্দ্র পিরামিডের অবস্থান এবং এর দু পাশ জুড়ে রয়েছে অনেক প্লাটফর্ম আর ছোট ছোট পিরামিড। তিওতিহুয়াকান এর দ্বিতীয় বৃহত্তম স্থাপনা চন্দ্র পিরামিডের উচ্চতা ভূমি থেকে ১৪০ ফুট ও এর ভিত্তির পরিমাপ ৪২৬/৫১১ ফুট।

চন্দ্র পিরামিড
চন্দ্র পিরামিড Source: flick

তিওতিহুয়াকন এর তৃতীয় বৃহত্তম স্থাপনার বর্তমান নাম পালক যুক্ত সর্পমন্দির। এই স্থাপনার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে মন্দিরের তলায় ১৯৮০ সালে আবিষ্কৃত প্রায় একশত এর বেশি মৃতদেহ যাদের সম্ভবত উৎসর্গ করা হয়।

সর্পমন্দির
সর্পমন্দির source: flickr

তিওতিহুয়াকান এর এই তিনটি পিরামিডের সাথে আশ্চর্যজনক ভাবে মিশরের গিজার পিরামিড গুলোর মিল রয়েছে। গিজার ত্রয়ী পিরামিডের অবস্থানের সাথে তিওতিহুয়াকান এর ত্রয়ী পিরামিডের অবস্থানের হুবহু মিল রয়েছে । এমন কি এই দুটি স্থানেরই পিরামিড গুলোর অবস্থান কালপুরুষ নক্ষত্র পুঞ্জের তিনটি তারার সাথে মিলে যায়। এই বিষয়টি থেকে ট্রান্স-মহাসাগরীয় যোগাযোগের উল্লেখযোগ্য ও প্রশংসনীয় কিছু তত্ত্ব পাওয়া যায়। ধারণা করা হয় যে প্রাচীন একটি অতিমানবীয় জাতি জ্যামিতি ও জ্যোতিষবিদ্যা সারা বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে দেয়। এই অতিমানবীয় জাতি বিভিন্ন পশুর আকৃতি ব্যবহার করে প্রাক-ঐতিহাসিক আর্টওয়ার্কের মাধ্যমে তাদের উৎপত্তির ইতিহাস ও জ্ঞান বর্ণনা করে যান। অনেকের মতে, এই বিষয়টি থেকে সমগ্র আমেরিকা, মিশর, মেসোপটেমিয়া, ভারত ও দূরপ্রাচ্যের মনুষ্য বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন দেব-দেবীদের সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।

তিওতিহুয়াকান পিরামিড, কালপুরুষ নক্ষত্রপুঞ্জ ও গিজা পিরামিড
তিওতিহুয়াকান পিরামিড, কালপুরুষ নক্ষত্রপুঞ্জ ও গিজা পিরামিড source: Salik.biz

তিওতিহুয়াকান এর শিল্পকর্ম গুলো সংখ্যায় খুব বেশি নয় কিন্তু নিখুঁত সৌন্দর্য মণ্ডিত। এখানে প্রাপ্ত পাথরের মুখোশ গুলো তৈরি করা হয়েছে জেড, সবুজ পাথর, আগ্নেয় শিলা ইত্যাদি থেকে যা অত্যন্ত মসৃণ ভাবে তৈরি করা হয়েছে, বিশেষ করে চোখ গুলো তৈরি করা হয়েছে বিভিন্ন খোলস ও স্বচ্ছ পাথর থেকে।

বর্তমানে এখান থেকে বেশিরভাগ শিল্প কর্মই মেক্সিকো সিটির জাদুঘরে স্থানান্তর করা হয়েছে।

সবুজ পাথরে মুখোশ
সবুজ পাথরের মুখোশ Source: flickr

প্রত্নতাত্ত্বিক সুত্র থেকে ধারণা করা হয় যে, তিওতিহুয়াকান একটি বহুজাতিক শহর ছিলো। শহরের বিভিন্ন অংশে ওটোমি, জ্যাপোটেক, মিক্সটেক, মায়া, ও নাহুয়া গোষ্ঠীর লোকজনের বসবাস ছিলো। টোটোন্যাকদের সব সময় এই শহরের স্থপতি বলে ধরা হয়েছে এবং অ্যাজটেকরাও একই কথা বলেছে। তবে প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা থেকে এর পক্ষে কোন সমর্থন পাওয়া যায়নি।

বিভিন্ন সুত্র থেকে ধারণা করা হয় যে, তিওতিহুয়াকানদের প্রধান দেবতা একজন মহিলা ছিলো যাকে বিশেষজ্ঞরা নাম দিয়েছেন ‘স্পাইডার ওম্যান’ নামে। এছাড়াও এখানে জলদেবী সহ আরো অনেক দেবীর চিত্রাঙ্কিত রয়েছে। অন্যান্য দেব-দেবীদের মধ্যে রয়েছে বৃষ্টির দেবতা, ক্যাটজাল্কোয়াটল, পালকযুক্ত সাপ, সূর্য দেবতা, চন্দ্র দেবী এবং ফসল ফলানোর দেবতা জাইপ টোটেক।

সম্পূর্ণ তিওতিহুয়াকান শহরটি জ্যোতিষবিদ্যার সাথে সম্পর্কযুক্ত। শহরটির সব স্থাপনা ই উত্তর থেকে ১৫-২৫ ডিগ্রি পূর্ব দিকে মুখ করে অবস্থিত এবং সূর্য পিরামিড দিগন্ত রেখার সাথে সমকোণে স্থাপিত, বিষুবরেখার ঠিক যেখানে সূর্য অস্ত যায়। অন্যান্য আনুষ্ঠানিক স্থাপনা সমূহ ও সূর্য পিরামিডের সাথে সঠিক কোণে অবস্থিত। সমাধিক্ষেত্রটির অবস্থান কৃত্তিকা নক্ষত্র পুঞ্জের অবস্থানের সাথে মিল রেখে করা হয়েছে। এছাড়াও এর আরো একটি মিল রয়েছে কুকুরমুখো নক্ষত্রপুঞ্জ লুব্ধক এর সাথে যা প্রাচীন মিশরীয়দের কাছে পবিত্র বলে বিবেচিত হতো। এই বিষয়টি থেকে ধারণা করা হয় যে মিশরীয় ও মেক্সিকান পিরামিড গুলোর মধ্যে কোনো না কোনো যোগাযোগ রয়েছে।

স্পাইডার ওম্যান
স্পাইডার ওম্যান Source: en.wikipedia.org

প্রাথমিকভাবে শহরটির খনন কার্য শুরু হয় ১৮৮৪ সালে। তবে ১৯৬০-৭০ সালের দিকে প্রথম নিয়ম শৃংখলাবদ্ধভাবে জরিপ শুরু করেন আমেরিকার প্রত্নতত্ত্ববিদ রেনে মিলন, এবং ১৯৮০-৮২ সালের মধ্যে মেক্সিকান প্রত্নতত্ত্ববিদ রুবেন কাস্ত্রোর নেতৃত্বে শত শত শ্রমিক খনন কার্যে অংশ নেয়। তারপর ১৯৯০ সালে শহরটির ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গ গুলোর দিকে মনোযোগ দেয়া হয় যেগুলোতে চমৎকার সব দেয়াল চিত্র অঙ্কিত ছিলো।

তিওতিহুয়াকান শহরটিকে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে ঘোষণা করেছে। এই স্থানটি মেক্সিকোর সবচেয়ে বেশি পরিদর্শনকৃত প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান। তিওতিহুয়াকান এর এই বিশালাকার ধ্বংসস্তূপ সম্পর্কে তেমন কিছু জানা না গেলেও এর ইতিহাস কখনো হারিয়ে যায়নি। শহরটির পতনের পর আরো অনেক সম্প্রদায়ের লোকজন এখানে এসে বসবাস করেছে। অ্যাজটেকদের সময়ে এই শহরটি তীর্থস্থান হিসেবে বিবেচিত ছিলো এবং তাদের ধারণা ছিলো যে এখানেই সূর্যের জন্ম হয়েছে।

 

Source history.com Source 02 Source 03
Leave A Reply

Your email address will not be published.

sativa was turned on.mrleaked.net www.omgbeeg.com

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More