প্রতি বছর পৌষ সংক্রান্তিতে পুরান ঢাকার বাড়িতে বাড়িতে, ছাদে ছাদে বসে বিশাল এক উৎসব। সারাদিন ঘুড়ি ছেয়ে রাখে পুরো আকাশ। আর সন্ধ্যা হলেই ফানুশ, আতশবাজির ঝলকে পুরো আকাশ এক রঙিন আয়নার রুপ নেয়। উৎসবের নাম সাকরাইন উৎসব।
এ বছরও এই দিনটি চলে এসেছে। ১৫ জানুয়ারি, ২০১৮ তে পুরান ঢাকায় ফিরে আসছে এই দিনটি তার পুরো জৌলুস নিয়ে। আপনি হয়ত টেলিভিশনে বা পত্রিকায় দেখে থাকবেন সাকরাইনকে কিন্তু নিজে না এলে কখনোই ধরতে পারবেন না ঠিক কি কারণে এত মাতামাতি সাকরাইন নিয়ে।
সাকরাইন পুরান ঢাকার মাটিতে হয় না, হয় ছাদে ছাদে। সাকরাইনকে বুঝতে হলে তাই আপনার উঠে পড়তে হবে কোনো বাড়ির ছাদে। ছাদে উঠেই চমকে যাবেন নিশ্চিত। একটা এলাহীকান্ড বাধিয়ে ফেলেছে ছেলে-বুড়ো-বউ-নাতি-জামাই সবাই মিলে। একটা প্রতিযোগিতাও মনে হতে পারে সাকরাইনকে যদি আপনি ছাদ থেকে দেখতে থাকেন কোথায় কি হচ্ছে, কে কি করছে।
সব ধরণের ও রঙের ঘুড়িতে পুরো আকাশ ছয়লাব হয়ে যাবে দুপুর গড়াতেই। আকাশের নীল বা ধূসর ক্যানভাসে ভেসে উঠবে বেগুনী, কমলা, হলুদ, সবুজ, লাল সহ নানা উজ্জ্বল রঙ।

“মাঞ্জা” লাগানো সুতোর ধারে কেটে যাবে একটার পর একটা ঘুড়ি। ঘুড়ি কাটাকাটি খেলা মূল আকর্ষণ মনে হলেও মূল প্রতিযোগিতার জায়গাটি অন্য জায়গায়। কার ঘুড়ি কত সুন্দর, কত দামি-তা দেখানোর খেলা বলা চলে এটিকে। এ খেলায় কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম নেই। যে যার মত ঘুড়ি নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ছে আকাশে, দাপিয়ে বেড়াচ্ছে মহল্লার আকাশ, আবার আটকাও পড়ে যাচ্ছে অন্য হাতের নাটাইয়ের জাদুতে।
আপনারা জানেনই পুরান ঢাকার মানুষ উৎসব বলতেই পাগল। তাদের সবার পাগলামিটায় “মাঞ্জা” লেগে যায় পৌষসংক্রান্তির এই দিনে।
“তর গুড্ডি বাকাট্টা অইয়া গেচে গা”
“আরে বেডা দ্যাখ মাঞ্জার ধারডা কেমুন” এসব সংলাপ পাল্লা দিতে থাকবে একেকজনের ঘুড়ির মতই।
সন্ধ্যা হতে থাকলেই উৎসব মোড় নেয় আরেক দিকে। বিকাল থেকেই হল্কা দিয়ে ছুটবে অজস্র আতশবাজি ও ফানুশ। ছাদে ছাদে লড়াই কাকে বলে দেখতে পারবেন এ সময় থেকে।
ইদানিংকালে প্রায় প্রতি ছাদেই চলে ডিসকো পার্টি। কড়া আলোকসজ্জায় ঝকমক করে পুরো আকাশ। মুখে আগুনের ফুলকি নিয়ে ঘুরে বেড়ায় তরুণ-কিশোর।

সাকরাইন এর ঐতিহ্যগত একটি ইতিহাস আছে কিন্তু। বুড়াবুড়ি পূজো নামে একটি পূজোর আয়োজন হত আগে, পূজোর পরে ভোগ বিতরণ করে শুরু হত ঘুড়ি ওড়ানো। এ পূজোর আয়োজন হত আত্মার শুদ্ধির জন্য। খড় পুড়িয়ে খারাপ আত্মা তাড়ানোর একটা ধারণা কাজ করত আগুন ধরানোর পেছনে।
সময়ের সাথে সাথে খড় পোড়ানোর ব্যাপারটি উবে গিয়ে এখন জায়গা করে নিয়েছে আতশবাজি। আলাদা আলাদা বাড়ির ছাদ থেকে ছুটে আসা সংগীত ও তালের ঝংকারে এই পুরোনো শহর রুপ নেয় একটা বৃহৎ ডিসকোতে।
আতশবাজির লাল, সবুজ, কমলা, সোনালি আলোর বিস্ফোরণ চলে টানা চার-পাঁচ ঘন্টা ধরে। আপনাকে কেউ দাওয়াত দিয়ে না নিয়ে গেলেও পছন্দমত ছাদে উঠে যেতে পিছপা হবেন না। যথেষ্ট সমাদর পাবেন যদি মিশে যেতে পারেন উৎসবমুখর মানুষের সাথে। মাঝরাত পর্যন্ত চলবে এই উৎসব। উৎসব শেষে বাড়ি চলে যেতে না চাইলে আশেপাশের হোটেল কিংবা বন্ধুর বাসায় চলে যেতে পারেন। একবার এই উৎসবে শামিল হলে আপনি নিশ্চিতভাবে বারবার চলে আসতে যাইবেন প্রতি পৌষক্রান্তির সাকরাইন উৎসবে।
কিভাবে, কোথায় যাবেন:
হাতে সময় থাকলে দুপুরের পর পর বের হয়ে যাবেন। পুরান ঢাকার সব জায়গাতেই সাকরাইন হলেও মূল আমেজটা পাবেন লক্ষীবাজার, তাঁতিবাজার, সূত্রাপুর, গেণ্ডারিয়া এসব জায়গায়। শাঁখারিবাজার থেকে ঘুড়ি বা ফানুশ কিনে নিয়ে যেতে পারেন।
ফটোগ্রাফারদের জন্য টিপস:
অযথা এ বাড়ি ও বাড়ি না দৌড়িয়ে যেকোনো এক কি দু জায়গার ছাদে গিয়ে দাঁড়াবেন। মেমোরি কার্ডে পর্যাপ্ত জায়গা রাখবেন, ব্যাটারিতে রাখবেন পর্যাপ্ত চার্জ। ট্রাইপড রাখতে পারেন সাথে লং এক্সপোজার এ ছবি তুলতে চাইলে।
যা করবেন না:
যেকোনো ধরণের মাদক গ্রহণ থেকে বিরত থাকবেন। অপরিচিত ব্যক্তির সাথে যেচে গিয়ে ঢলাঢলি করবেন না।