আপনি যদি হঠাৎ করে একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখেন যে আপনার পরাধীন দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে তাহলে অবশ্যই আপনি আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে পড়বেন । কিন্তু তার দুই দিন পর দেখলেন আপনি যে দেশটির জন্য আনন্দে উদ্বেলিত হয়েছেন সে দেশটিই আপনার নয় তাহলে কেমন হবে? অনেকের কাছেই একটু উল্টা -পাল্টা মনে হতে পারে । তবে আসল কথা হল ঠিক এমনটাই ঘটেছিল অনেক ভারতীয় ও পাকিস্তানীদের ভাগ্যে। শুধু একটি কলমের খোঁচায় ঠিক এমনটাই হয়েছিল ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তানীদের ভাগ্যে। হ্যাঁ আমি র্যাডক্লিফ লাইনের কথাই বলছি। যে লাইনটি ভারত পাকিস্তান কে দুইভাগে বিভক্ত করে। আজকের পর্বে র্যাডক্লিফ লাইনের সম্পর্কে সকল কিছু তুলে ধরব আপনাদের সামনে।
র্যাডক্লিফ লাইন
র্যাডক্লিফ লাইন হল ভারত-পাকিস্তান কে ভাগকারী সীমান্ত রেখা। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ভারত স্বাধীনতা নামে একটি আইন পাশ করে । এই আইনের মাধ্যমে সমগ্র ভারতবর্ষকে স্বাধীনতা দানের প্রস্তাব করা হয় । তার ফলশ্রুতিতে লর্ড মাউন্টব্যাটন সীমান্ত ভাগের জন্য একটি কমিশন গঠন করে। ব্রিটিশ আইনজীবী সিরিল র্যাডক্লিফকে প্রধান করে এই কমিশন গঠন করা হয় যাদের কাজ ছিল ভারতবর্ষকে ভাগ করে দুইটি আলাদা রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তান গঠন করা। এবং এই ভাগ করার একমাত্র মানদণ্ড হবে ধর্ম । ফলে সে অনুযায়ীই ১৯৪৭ সালের ১৭ই আগস্ট একটি সীমানা টেনে ভারত-পাকিস্তান কে ভাগ করে ফেলেন। এবং র্যাডক্লিফের নামে এই সীমারেখার নামকরণ করা হয় র্যাডক্লিফ লাইন।
র্যাডক্লিফের পরিচয়
র্যাডক্লিফ ছিলেন ব্রিটিশ চেন্সারী বারের একজন প্রখ্যাত আইনজীবী । আইন পেশার বাহিরে তার বলার মত অন্য কোন কাজের অভিজ্ঞতা ছিল না । এর আগে তিনি একবার মাত্র ব্রিটিশ তথ্য মন্ত্রণালয়ে কাজ করেছেন। কিন্তু তাকেই ভারত ভাগ কমিশনের প্রধান করে মাউন্টব্যাটন নিয়ে আসেন। যদিও র্যাডক্লিফের ভারত সম্পর্কে কোন আগ্রহই ছিল না। ফলে বলা যায় যে তিনি বরাবরই এই কাজে উদাসীন ছিলেন এবং দায়সারা কাজ করতে থাকেন। সর্বশেষ তিনি অনেকটা দায়সারা ভাবেই ভারতবর্ষ বিভক্তির কাজ সম্পন্ন করেন এবং তিনি চলে যাবার সময় তার সকল নোট পুড়িয়ে দিয়ে যান। তিনি ব্রিটেনে ফিরে যাবার পর এই কাজ করার পুরষ্কারস্বরুপ তাকে নাইট উপাধি দেয়া হয়।
র্যাডক্লিফ লাইন সৃষ্টির পটভূমি
র্যাডক্লিফ লাইন দিয়ে ভারত পাকিস্তান কে ভাগ করা হয়েছে । কিন্তু কেন এই লাইন আর কেনইবা ভারত ভাগ ? হ্যাঁ এর পিছনে রয়েছে আরও ইতিহাস। ব্রিটিশরা ভারতবর্ষের ক্ষমতা দখল করার পর থেকেই সমগ্র ভারতবাসী তাদেরকে তাড়ানোর জন্য এক হয়ে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। কিন্তু তাতে ব্যর্থ হওয়ায় ভারতবাসীর মধ্যে একতা নষ্ট হয়ে যায়। এই কৌশলে ব্রিটিশরা ধনী হিন্দুদেরকে তাদের কাছে নিয়ে আসে। ফলে ১৮৮৫ সালে কংগ্রেস গঠিত হলে হিন্দুদের স্বার্থ বেশী করে রক্ষিত হতে থাকে। তাদের বিপরীত অবস্থানে দাঁড়িয়ে মুসলমানরা ১৯০৫ সালে মুসলিম-লীগ গঠন করে। ফলে এখান থেকেই হিন্দু-মুসলিমদের বিভাজন দৃশ্যমান হয়। পরবর্তী সময়ে তাদের মধ্যে এই বিরোধ আরও চরমে উঠে। সর্বশেষ ১৯৪৯ সালে জিন্নাহ দ্বিজাতি তত্ত্ব উপস্থাপন করলে মুসলমানদের জন্য আলাদা রাষ্ট্রের স্বপ্ন সামনে চলে আসে এবং মুসলিম-লীগ প্রচার প্রচারণা চালিয়ে আলাদা রাষ্ট্র গঠনের জন্য ব্রিটিশ সরকারের ম্যান্ডেট লাভ করে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশরা ভারত ছাড়ার দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ভারত স্বাধীনতা আইন পাশ করে । হিন্দুদের দাবিকে পাশ কাটিয়ে মুসলমানদের কে প্রাধান্য দিয়ে ধর্মের ভিত্তিতে ভারত পাকিস্তান নামে পৃথক দুইটি দেশকে স্বাধীনতা প্রদান করা হয়।
র্যাডক্লিফ লাইনের কার্যক্রম
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই ইংরেজরা দ্রুত ভারত ত্যাগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। পাশাপাশি নেহেরু ও জিন্নাহও তাদের কাজ দ্রুত করার জন্য তাগাদা দিতে শুরু করেন। কারণ তাঁদের মনে সন্দেহ ছিল যে ব্রিটিশরা যদি তাদের স্বীকৃতি দিতে বিলম্ব করে তা পরে আবার তাদের শাসন বহাল রাখার নীতিতে পরিবর্তিত হতে পারে । তাই লর্ড মাউন্ট ব্যাটেনও র্যাডক্লিফকে মাত্র ৫ সপ্তাহ সময় দেন সমগ্র ভারতবর্ষকে ভাগ করার জন্য। কিন্তু সমস্যা ছিল র্যাডক্লিফের নিকট কোন ভাল মানচিত্র এবং জনসংখ্যার ব্যাপারে কোন স্পষ্ট তথ্য উপাত্ত ছিল না। ফলে তিনি কলমের খোঁচায় ভারত পাকিস্তান কে ভাগ করে ফেলেন। তিনি ভাগ করার সময় হিন্দু অধ্যুষিত অঞ্চলকে ভারত এবং মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলকে পাকিস্তানের মধ্যে দিয়ে দেন। কিন্তু যেখানে হিন্দু-মুসলিম প্রায় সমান সেখানে কি হবে তার কোন সমাধান না করেই এসব অঞ্চলকে উভয়ের মধ্যে ভাগ করে দেন। ফলে পূর্বাংশে বাংলা ও পশ্চিম অংশে পাঞ্জাব কে দ্বিখণ্ডিত করা হয়। যার ফলে পাঞ্জাবের একটি অংশ পাকিস্তানের সাথে (পাঞ্জাব প্রদেশ) আরেকটি অংশ ভারতের সাথে (পাঞ্জাব স্টেট) হিসেবে গড়ে উঠে। অন্যদিকে বাংলার পূর্বাংশকে পাকিস্তানের সাথে এবং পশ্চিম বঙ্গকে ভারতের সাথে দিয়ে দেয়া হয় শুধুমাত্র ধর্মের ভিত্তিতে।
র্যাডক্লিফ লাইনের ফলাফল
র্যাডক্লিফ লাইন আকার ফলাফল ছিল অত্যন্ত ভয়াবহ। কারণ তিনি অতি অল্প সময়ের মধ্যে কলমের দ্বারা রেখা টেনে একটি মানচিত্রকে ব্যাবচ্ছেদ করেন এবং সাথে সাথে ভাগ করেন ৪০ কোটি মানুষের পরিচয় কে। এতকাল যে সব মানুষ একসাথে পাশাপাশি বসবাস করে আসছিল তাদেরকে শুধু কলমের দ্বারা দাগ কাটার সাথে সাথে তাদেরকে আলাদা করে ফেলেন। এই কলমের নিচে সরাসরি বলি হয়েছে প্রায় ১ কোটি ২০ লক্ষ মানুষ।
১৯৪৭ সালের ১৭ আগস্ট র্যাডক্লিফ তার পূর্নাঙ্গ মানচিত্র প্রকাশ করেন এবং গেজেট প্রকাশ হবার সাথে সাথে পাঞ্জাব ও বাংলার গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পরে দাঙ্গা কারণ যেসকল হিন্দু পাকিস্তানের ভূমিতে পরেছে তারা ভারতের অংশে চলে যেতে শুরু করে পাশাপাশি মুসলমানদের সাথে বিবাদেও জড়িয়ে পড়ে। অন্যদিকে যেসব মুসলমান ভারতের অংশে পড়েছে তাদেরকেও পাকিস্তান অংশে চলে যেতে বাধ্য করা হয়। ফলে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে বিবাধ চরম পর্যায়ে পৌঁছায় এবং তাদের মধ্যে সরাসরি একে অপরের মধ্যে কচুকাটা হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়। এতে প্রায় ৫ থেকে ১০ লক্ষ হিন্দু-মুসলমান প্রাণ হারায়। এবং লাখ লাখ মানুষ তাদের পৈত্রিক ভিটা-বাড়ি ছেড়ে পাড়ি দিতে হয় অন্যত্র অচেনা /অপরিচিত জায়গায় যে চিত্র ছিল অত্যন্ত হৃদয়বিদারক।
তাছাড়া শহর থেকে গ্রাম সর্বত্র শুরু হয় উভয়ের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ভেঙ্গে-ফেলা পার্থ-নালয় জ্বালিয়ে দেয়া। নির্যাতিত হতে থাকে হাজারো নারী, ধারনা করা হয় শুধু ঐ সময়েই ৭০ হাজার নারী নির্যাতিত হয়েছিল এবং সীমান্ত অঞ্চল সমূহে নেমে আসে শরণার্থীদের ঢল। কেবলমাত্র ব্রিটিশ সাংবাদিকদের হিসাব অনুযায়ীই ৬০০ শরণার্থী শিবির গড়ে উঠে। কিন্তু এই সংখ্যা হাজার ছাড়িয়েছে বলে অনেকে মনে করেন।
র্যাডক্লিফ লাইনের দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা
ভারত ভাগ হবার পর পরই ১৯৪৭ সালের ২২ অক্টোবর রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায় এবং এই যুদ্ধ ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত স্থায়ী হয়। পরবর্তীতে ১৯৬৫ সালে সীমান্ত উত্তেজনা কেন্দ্র করে উভয়ের মধ্যে যুদ্ধ লেগে যায়। যাতে বেশকিছু প্রাণহানি হয়। সর্বশেষ ১৯৯৯ সালে কাশ্মীরের কার্গিলে আবার উভয়ের মধ্যে যুদ্ধ বাঁধে। যার পিছনে প্রধান কারণ হল সীমান্ত সমস্যা। সীমান্ত সমস্যার কারণে আজও কাশ্মীরে নিয়মিত রক্ত ঝরছে। বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের ছিটমহল সমস্যা গত ২০১৫ সালে ভারত-বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে সমাধান হয়। কিন্তু তার পূর্ববর্তী সময় পর্যন্ত এই ছিটমহল বাসির জীবন ছিল অত্যন্ত মানবেতর। যার পিছনে একমাত্র দায়ী ছিল র্যাডক্লিফ ও তার দায়িত্ব-জ্ঞানহীনতা।
যার রেশ পাকিস্তান-ভারতের মাটিতে বিদ্যমান । খেলার মাঠ থেকে শুরু করে বাণিজ্য,রাজনীতি,কূটনীতি সব জায়গায় উভয়ের মধ্যে এক বিরোধপূর্ণ প্রতিযোগিতা বিরাজ করছে।তাছাড়া পারমাণবিক অস্ত্র ও সামরিক প্রতিযোগিতা উভয়ের মধ্যে এক তীব্র আকার ধারণ করে আছে। যদিও উভয়ে পারমাণবিক চুক্তিতে সই করার জন্য পারমাণবিক প্রতিযোগিতা অনেকটা হ্রাস পেয়েছে কিন্তু সামরিক প্রতিযোগিতা সর্বদা বিরাজমান। অনেকটা স্নায়ু যুদ্ধের-মত।
র্যাডক্লিফ লাইনের অনেক খারাপ দিক থাকলেও এর সাথে কিছু ভাল দিকও আছে। ঐসময় ব্রিটিশরা যদি এই র্যাডক্লিফ লাইন না একেই ভারত ত্যাগ করত এবং ভারত-পাকিস্তান নামে দুইটি দেশকেই স্বাধীন ঘোষণা করে চলে যেত তাহলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করত এবং বাংলাদেশও হয়ত স্বাধীনতা লাভ করতে পারত না। যদি বাংলাদেশকে ভারতের সাথে রেখে যেত তাহলে হয়ত আমাদের স্বাধীনতা লাভ করা এত সহজ হত না। এর পাশাপাশি পাল্টা যুক্তিও রয়েছে যে তারা ঐ সময় ইচ্ছা করলে সমগ্র বাংলাকে একত্র করে স্বাধীন হিসেবে ঘোষণা করত তাহলে হয়ত আমরা আরও বহু আগেই স্বাধীনতা লাভ করতে পারতাম ও বাংলাও একত্র থাকত। সিরিল র্যাডক্লিফ এই পরিস্থিতি অনুধাবন করতে পারেন নি এমনটা নয়। ভারত ত্যাগ করার পূর্বে তিনি নিজেই বলে ছিলেন যে এই কাজের ফলে অন্তত ৮/১০ কোটি মানুষ আমাকে দেখবে অত্যন্ত নেতিবাচক চোখে। তাই আমরা পরিশেষে বলতে চাই যে র্যাডক্লিফ যে একাই ভুল করেছেন এমনটা নয়। আমাদের পরবর্তী রাজনৈতিক নেতারাও এর জন্য যথেষ্ট পরিমাণ দায়ী কারণ তারা এই সমস্যা সমাধানের জন্য সম্মেলিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারেননি।
বরং উত্তেজনা কে আরও উস্কে দিয়েছে। তাই বর্তমান সীমান্ত জটিলতা নিরসনের জন্য রাজনৈতিক স্বদিচ্ছাই একমাত্র উপায়। যাতে পুনরায় ফিরে আসতে পারে ভারতীয় উপমহাদেশের শান্তি।
তথ্যসূত্রঃ
২. https://www.thequint.com/news/india/partition-of-india-pakistan-cyril-radcliffe-line
purchase lamisil sale – lamisil 250mg for sale buy generic grifulvin v over the counter