বর্গাকৃতির ৩২টি সাদা এবং ৩২টি কালো ঘরে রাজা, মন্ত্রী, গজ, ঘোড়া, নৌকা এবং বোড় নিয়ে যে খেলাটি তৈরি হয় তা হল দাবা, একটি বুদ্ধির খেলা। ভারতবর্ষে ষষ্টশতকে এই খেলাটির উৎপত্তি হয়ে আজ সারা বিশ্বে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। আমাদের দেশেও এটির জনপ্রিয়তা কোন অংশে কম নয়। দক্ষিণ এশিয়ার ১ম গ্রান্ড মাস্টার বাংলাদেশের নিয়াজ মোর্শেদ, যার কথা আমরা সবাই জানি। আবার এমন একজনের কথাও আমরা জানি যিনি প্রথম নারী পরপর তিনবার ব্রিটিশ ওম্যান চ্যাম্পিয়নশিপে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। যাকে আমরা একনামেই চিনি, তিনি হলেন ‘দ্যা কুনই অফ চেজ’ রানী হামিদ। আজ সেই দাবার রানিকে নিয়েই আমাদের এই আয়োজন।
১৯৪৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি সিলেট জেলায় এই কিংবদন্তী জন্মগ্রহণ করেন। পুরো নাম সৈয়দা জসিমুন্নেসা খাতুন এবং ডাক নাম রানী। বিয়ের পর স্বামী নৌ-বাহিনীর কর্মকর্তা মোহাম্মাদ আব্দুল হামিদের নামের সাথে মিল রেখে নামকরণ করেন রানী হামিদ এবং এই নামেই তিনি সমধিক পরিচিত। ১৯৬০ সালে সিলেট বালিকা বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। পরবর্তীতে ইডেন মহিলা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট এবং ডিগ্রী পাস করেন।
বাবার কাছে দাবা খেলার হাতে খড়ি হলেও মূলত স্বামীর অনুপ্রেরণায় রানী হামিদের প্রতিযোগিতামূলক দাবা খেলা শুরু হয়। ১৯৭৬ সালে প্রতিবেশী জাতীয় চ্যাম্পিয়ন ডঃ আকমল হোসেনের সহযোগীতায় মহসিন দাবা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন। এটাই ছিল তাঁর প্রথম কোন প্রতিযোগিতা মূলক খেলায় অংশগ্রহণ। এরপর নবদিগন্ত সংসদ দাবা ফেডারেশন কর্তৃক অয়োজিত দাবা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে ১৯৭৭, ১৯৭৮, ১৯৭৯ সালে তিনবারেই চ্যাম্পিয়ন হন। ১৯৮১ সালে প্রথম আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট খেলতে ভারতের হায়দ্রাবাদে অনুষ্টিত প্রথম এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে অংশগ্রহণ করেন।
১৯৮৪ সালে অনুষ্টিত চেজ অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণ করে রানী হামিদ প্রথম চ্যাম্পিয়ন হন। এরপর ১৯৮৬ এবং ১৯৯২ সালেও তিনি চেজ অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণ করে পরপর তিনবার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেন।
১৯৮৫ সালে আন্তর্জাতিক চেজ ফ্যাডারেশন FIDE ( Federation Internationale des Echecs ) থেকে ওম্যান ইন্টারন্যাশনাল মাস্টার খ্যাতাব লাভ করে আন্তর্জাতিক রেটিং অর্জন করেন । রানী হামিদের FIDE রেটিং হল- স্যান্ডার্ড ১৯৬৮ , রেপিড ২০২০ এবং ব্লিটস ১৯৪৫।
১৯৮৫ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত রানী হামিদ মোট ২৮৫ টি অন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করেন। এরমধ্যে ৮৭টিতে জয় লাভ করেছেন। আর ১৩৪টিতে পরাজিত হন এবং ৬৪টি ম্যাচ ড্র হয়।
সাদা নিয়ে তিনি ১৪৩ বার খেলে ৫১ বার জয় লাভ করেন এবং কালো নিয়ে ১৪২ বার খেলে ৩৬ বার জয়ী হন।
জুলাই, ২০১৫ সালে রানী হামিদ কমনওয়েলথ চেজে অংশগ্রহণ করে গোল্ড মেডেল অর্জন করেন ।
২০১৭ সালের ২৩ জুলাই তিনি তাঁর শেষ আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টটি খেলেন ভারতে কমনওয়েলথ চেজে আব্দুল মমীনের বিপক্ষে। তাঁর পজিশন ছিল কালো। ঐ বছর কমনওয়েলথ চেজে তিনি ৯টি টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করেন এবং ৬টিতে জয় লাভ করেন।
১৯৭৯ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত মোট ১৮ বার জাতীয় মহিলা দাবা চ্যাম্পিয়ানশিপে চ্যাম্পিয়ান হয়েছেন।
আধুনিক দাবা খেলা নিয়ে রানী হামিদ “মজার খেলা দাবা” এবং “দাবা খেলার আইন কানুন” নামে দুটি বই লিখেছেন ।
রানী হামিদ তাঁর পারিবারিক এবং কর্মজীবন উভয় ক্ষেত্রে সমান পারদর্শী। ব্যক্তি জীবনে রানী হামিদ তিন ছেলে এবং এক মেয়ের জননী। বড় ছেলে মুহাম্মদ কায়সার হামিদ বাংলাদেশের একজন সনামধন্য ফুটবল খেলোয়ার, মেজো ছেলে সোহেল হামিদ একজন ক্রিকেটার ও স্কোয়াস ফেডারেশনের সম্পাদক। ছোট ছেলে শাজাহান হামিদ একজন ইঞ্জিনিয়ার এবং মেয়ে জেবিন হামিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন।
রানী হামিদ এক অনুপ্রেরণার নাম । তৎকালীন বৈরী পরিবেশ উপেক্ষা করেই রানী হামিদ আজকের WIM Rani Hamid হয়েছেন । তাঁর এই বিশ্ব জয়ের গল্পই বর্তমান নারী সমাজের কাছে অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করছে এবং ভবিষ্যতেও করবে।
দাবা খেলায় শুধুমাত্র রানী হামিদ নিজেই কৃতিত্ব অর্জন করেননি বরং আমাদের তথা আমাদের দেশের জন্যও এনে দিয়েছেন সম্মান । তিনি আমাদের দেশের গর্ব । এই কিংবদন্তী দাবাড়ুর প্রতি রইল আমাদের গভীর শ্রদ্ধা এবং প্রাণঢালা ভালোবাসা । তাঁর সুস্থতা এবং সুদীর্ঘ জীবন কামনা করছি।
তথ্যসুত্রঃ
১. ratings.fide.com
৩. chessgames.com
৪. chesstempo.com
৬. protidinersangbad.com
৭. The Daily Sun
৮. gunijan.org.bd
৯. The Daily Star
terbinafine generic – buy generic fulvicin over the counter purchase grifulvin v pills