পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ফুটবল। আর তাই বিশ্বখ্যাত ফুটবল তারকাদের নিয়ে মানুষের মনে কৌতূহলের শেষ নেই। ফুটবল তারকা বলতেই আমাদের চোখ চলে যায় ইউরোপ বা ল্যাটিন আমেরিকার দিকে। কিন্তু আজ আপনাদেরকে এমন এক এশিয়ান ফুটবল লিজেন্ডের গল্প শোনাব, যিনি তার ফুটবল খেলার নৈপুণ্য দেখিয়ে এশিয়ার ফুটবলকে নিয়ে গেছে অন্যতম উচ্চতায়। পার্ক জি সুং, যিনি বর্তমানে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ক্লাবের শুভেচ্ছা দূত হিসেবে কাজ করছেন।

জন্ম ও বাল্যকাল:
১৯৮১ সালের ২৫ শে ফেব্রুয়ারি দক্ষিণ কোরিয়ার গোহেং শহরে পার্ক জি সুং জন্মগ্রহণ করেন। দক্ষিণ কোরিয়ার সুওয়ান শহরে বাল্যকাল অতিবাহিত করেন পার্ক জি সুং। ছোট বেলা থেকেই ফুটবলের প্রতি প্রবল আগ্রহ ছিল পার্ক এর। এজন্য তিনি ব্যাঙের জুস এবং হরিণের রক্ত খেতেন। পার্ক বিশ্বাস করত এই খাবার তাকে বেড়ে উঠতে এবং শক্তিশালী করে তুলতে সাহায্য করবে। হাই স্কুল শেষ করার পর, পার্ক দক্ষিণ কোরিয়ার মাইংজি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন।
পার্ক জি সুং এর স্বর্ণালী ক্যারিয়ারের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা:

পার্ক জি সুং এশিয়ান ফুটবলারদের মধ্যে সবচেয়ে সফল ফুটবলার। ইতিহাসে পার্ক জি সুং এর নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখা থাকবে। পার্ক তার ফুটবল ক্যারিয়ারে ১৯ টি ট্রফি জিতেছেন। এশিয়া থেকে খেলতে আসা তিনিই সর্বপ্রথম খেলোয়াড়, যিনি উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লীগের ট্রফি জিতেছেন। পার্ক মিডফিল্ডের যেকোনো জায়গায় খেলতে সক্ষম ছিলেন। পার্ক জি সুং এর অসাধারণ ফিটনেস লেভেল, শৃঙ্খলা, নৈতিক ফুটবল খেলা, দারুণভাবে এগিয়ে যাওয়ার নিমিত্তে তাকে “Three-Lungs” বা তিন শ্বাসতন্ত্রের অধিকারী বলা হতো।
পার্ক জি সুং মিয়ংজি ইউনিভার্সিটিতে অধ্যয়নরত সময় ইউনিভার্সিটির ফুটবল টীমে খেলে তিনি তার ফুটবল ক্যারিয়ার শুরু করেন। এই সময় পার্ক তার ফুটবল নৈপুণ্য দেখিয়ে সবাইকে মনমুগ্ধ করেন। যার ফলশ্রুতিতে ২০০০ সালে প্রথমবারের মত জাপানী ক্লাব কিয়োটো পার্পল সাঙ্গার বিপক্ষে খেলার জন্য জাতীয় দল থেকে ডাক পান। এর পরপরই তৎকালীন দক্ষিণ কোরিয়ার জাতীয় দলের ম্যানেজার হিদিঙ্ক নেদারল্যান্ডস চলে যান পিএসভি আন্ডোভেন ক্লাবের ম্যানেজার হিসেবে যোগ দিতে। দক্ষিণ কোরিয়াতে থাকাকালীন পার্ক জি সুং এর ফুটবল নৈপুণ্য হিদিঙ্ক এর মনে ধরে যায়, যার ফলে একবছর পর পার্ককে তিনি তার ক্লাবে যোগ দিতে বলেন। ক্লাব পিএসভি ২০০৪-২০০৫ মৌসুমে উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লীগের সেমিফাইনাল খেলে, এবং পার্ক জি সুং এর খেলা সবার নজর কাড়ে। পার্কের প্রতিভা ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ম্যানেজার স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন এর চোখে পরে, যার বদৌলতে ২০০৫ সালে ৪ মিলিয়ন পাউন্ডের বিনিময়ে ইংলিশ ক্লাব ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড পার্ক জি সুং কে কিনে নেয়। পার্ক ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে খেলার সময় চারবার প্রিমিয়ার লীগের শিরোপা জয় করেন।

দক্ষিণ কোরিয়া জাতীয় দলের হয়ে পার্ক তার ফুটবল ক্যারিয়ারে ১৩ টি গোল করেন এবং বিভিন্ন সময়ে জাতীয় দলের পক্ষ থেকে ১০০ টি মুকুট পান পুরষ্কার হিসেবে। ২০০২ সালের ফিফা ওয়ার্ল্ড কাপে দক্ষিণ কোরিয়ার জাতীয় দলের একজন সদস্য ছিলেন পার্ক। ২০০৬ সালের ফিফা ওয়ার্ল্ড কাপে পার্ক তার অসাধারণ খেলা দেখিয়ে সবার মন জয় করে নেয়, এসময় তিনি তার দেশে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। ২০১০ সালের ফিফা ওয়ার্ল্ড কাপে পার্ক জি সুং দক্ষিণ কোরিয়ার জাতীয় দলের অধিনায়ক ছিলেন। ২০১১ সালের এশিয়ান কাপের পর পার্ক ইন্টারন্যাশনাল ক্যারিয়ার থেকে অবসরের ঘোষণা দেন, এবং ২০১৪ সালের ১৪ই মে হাঁটুতে ইনজুরি থাকার কারণে সবধরনের ফুটবল থেকে অবসরের ঘোষণা দেন। ২০১৪ সালের ২ অক্টোবর পার্ক ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ক্লাবের ব্র্যান্ড এম্বাসেডর হিসেবে যোগদান করেন। তিনিই একমাত্র এশিয়ান, যিনি ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ক্লাবের ব্র্যান্ড এম্বাসেডর হয়েছেন।
আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার:

১৯ বছর বয়সে পার্ক জি সুং দক্ষিণ কোরিয়ার জাতীয় দলে মিডফিল্ডার হিসেবে যোগ দেন। ২০০০ সালের সিডনি অলিম্পিক খেলার জন্য তৎকালীন ম্যানেজার হহ জং-মু’র পার্ক জি সুং কে নির্বাচিত করেন। কিন্তু পার্ক ঐ অলিম্পিকে তার ফুটবল নৈপুণ্য দেখাতে ব্যর্থ হয়। পরবর্তীতে যখন গুস হিদিঙ্ক দক্ষিণ কোরিয়ার জাতীয় দলের ম্যানেজার হিসেবে যোগদান করেন, তখন তিনি পার্ককে তৎকালীন দক্ষিণ কোরিয়ার অন্যতম ফুটবলার উইঙ্গারের স্থানে স্থলাভিষিক্ত করেন, এবং পার্ক সব জায়গায় খেলতে সক্ষম ছিলেন, মিডফিল্ডের ডানে বামে, উইং ফরওয়ার্ডে। যার কারণে ম্যানেজার হিদিঙ্ক এর পছন্দের খেলোয়াড় ছিল পার্ক।
২০০২ ফিফা ওয়ার্ল্ড কাপ:
২০০২ সালের বিশ্বকাপে পার্ক জি সুং ছিল ফুটবলের এক বিস্ময়। বিশ্বকাপের মূল আসরে দক্ষিণ কোরিয়া শক্তিশালী পোল্যান্ড এর বিপক্ষে তাদের প্রথম ম্যাচেই জয় পায় এবং আমেরিকার বিপক্ষের ম্যাচটিতে ড্র করে। তৃতীয় ম্যাচটি ছিল শক্তিশালী পর্তুগালের বিপক্ষে। ২য় রাউন্ডে খেলার জন্য দক্ষিণ কোরিয়াকে পর্তুগালের বিপক্ষে জয় অথবা ড্র ছাড়া কোন বিকল্প ছিলোনা। তখন পর্তুগালের জাতীয় দলে লুইস ফিগো এবং রুই কোস্টার মত বিশ্বসেরা ফুটবলার ছিল। খেলাটি যখন শুরু হল, বিশ্ববাসীর কৌতূহলের শেষ ছিলোনা। স্টেডিয়ামে জায়গা না পেয়ে স্টেডিয়ামের বাহিরে লাখো কোরিয়ান অধীর আগ্রহ এবং টান টান উত্তেজনা নিয়ে শহরের বড় বড় পর্দায় খেলা দেখছিল।

শক্তিশালী পর্তুগাল কোনভাবেই দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষে পেরে উঠছিল না, যার ফলশ্রুতিতে পর্তুগালের খেলোয়াড়রা বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলো, এবং খেলার ৭০ মিনিটের মধ্যেই পর্তুগালের ২ ফুটবলারকে রেফারি লাল কার্ড দেখাতে বাধ্য হয়। খেলার ৭০ মিনিট পর ডি-বক্সের বাহির থেকে উড়ে আসা বলটিকে দারুণভাবে বুকের উপর রিসিভ করে পর্তুগীজ ডিফেন্ডার সেগিও কনসিয়েসোভাকে দারুণভাবে কাঁটিয়ে বাঁ পায়ের জোরালো এক শটে পর্তুগালের জ্বালে বল পাঠান পার্ক জি সুং। পার্ক জি সুং এর করা এই গোলেই প্রথমবারের মত নকআউট পর্বে খেলার সুযোগ পায় দক্ষিণ কোরিয়া। নকআউট পর্বে শক্তিশালী ইতালি এবং স্পেনকে পরাজিত করে প্রথমবারের মত এশিয়া থেকে আসা কোন দল সেমি ফাইনাল খেলার সুযোগ পায়। পার্ক জি সুং কোয়ার্টার ফাইনালে পেনাল্টি থেকে স্পেনের বিপক্ষে একটি গোল পায়। এই ম্যাচে ৫-৩ গোলে দক্ষিণ কোরিয়া স্পেনের বিপক্ষে জয় পায়।
২০০৬ ফিফা ওয়ার্ল্ড কাপ:

২০০২ সালের ফিফা ওয়ার্ল্ড কাপের মতই ২০০৬ সালেও পার্ক জি সুং এর সাফল্য অব্যাহত ছিল। বিশ্বকাপের মূল আসরে গ্রুপ পর্বের দ্বিতীয় ম্যাচে শক্তিশালী ফ্রান্সের সাথে ১-১ গোলে ড্র করে দক্ষিণ কোরিয়া। দলের হয়ে একমাত্র গোলটি করেন পার্ক জি সুং, এবং এই ম্যাচে “ম্যান অব দ্যা ম্যাচ” হয়েছিলো পার্ক। ২০০৬ বিশ্বকাপে পার্ক এর জার্সি নম্বর ২১ থেকে পরিবর্তন করে ৭ নম্বর দেয়া হয়, এবং ফুটবল ক্যারিয়ারের বাকি সময় তিনি ৭ নম্বর জার্সিই পরিধান করেন।
২০১০ ফিফা ওয়ার্ল্ড কাপ:

১১ অক্টোবর ২০০৮ সালে একটি বন্ধুত্বপূর্ণ ম্যাচে উজবেকিস্তানের বিপক্ষে প্রথমবারের মত দক্ষিণ কোরিয়ার জাতীয় দলের হয়ে অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন পার্ক জি সুং। ম্যাচটিতে দক্ষিণ কোরিয়া ৩-০ গোলে জয় পায়। ২০১০ সালের বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে দলের নেতৃত্ব দেন পার্ক। দলের হয়ে ৫ গোল করে তিনিই ছিলেন সর্বোচ্চ গোলদাতা। কোন রকম বাধা বিপত্তি ছাড়াই পার্ক জি সুং এর নেতৃত্বে ২০১০ সালের ফিফা ওয়ার্ল্ড কাপের মূল আসরে খেলার সুযোগ পায় দক্ষিণ কোরিয়া। বিশ্বকাপের মূল আসরে গ্রুপ পর্বের প্রথম ম্যাচেই গ্রীসকে ২-০ গোলে পরাজিত করে দক্ষিণ কোরিয়া। পার্ক জি সুং প্রথম এশিয়ান ফুটবলার, যিনি জাতীয় দলের হয়ে পর পর তিনবার ফিফা ওয়ার্ল্ড কাপের মূল আসরে খেলেছেন এবং তিনবারই দলের হয়ে সর্বোচ্চ গোলদাতা ছিলেন।
২০১১ এ এফ সি এশিয়ান কাপ:

২০১০ সালের ২৬শে ডিসেম্বর এ এফ সি এশিয়ান কাপের সেমি ফাইনালে জাপানের বিপক্ষে দক্ষিণ কোরিয়ার হয়ে পার্ক জি সুং তার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের ১০০ তম ম্যাচ পূর্ণ করেন। এই খেলাটিতে পার্ক দক্ষিণ কোরিয়ার জাতীয় দলের অধিনায়ক ছিলেন। যদিও খেলাটিতে দক্ষিণ কোরিয়া জাপানের কাছে ৩-০ গোলে হেরে যায়। পরবর্তী ম্যাচ ছিল উজবেকিস্তান এর বিপক্ষে তৃতীয় স্থান নির্ধারণের জন্য। ম্যাচটিতে দক্ষিণ কোরিয়া ৩-২ গোলে জয় পায়। এই খেলার পরপরই তৎকালীন দক্ষিণ কোরিয়া জাতীয় দলের কোচ চো কোয়াং রাই, পার্ক জি সুং এর অবসরে যাওয়ার কথা প্রকাশ করেন। ২০১১ সালের ৩১শে ডিসেম্বর পার্ক আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার থেকে অবসরের ঘোষণা দেন।
ব্যক্তিগত জীবন:

২০১৪ সালের ২৭শে জুলাই পার্ক জি সুং টেলিভিশন রিপোর্টার “কিম মিন জি” কে বিয়ে করেন, এবং ২০১৫ সালের নভেম্বর মাসে পার্ক জি সুং এর ঘরে এক ফুটফুটে কন্যা সন্তান এর জন্ম হয়।