হয়তো অনেকেরই চোখ কপালে উঠবে শুনে যে, ২.৬ টেরাবাইট ডাটাসমৃদ্ধ বিশ্বের সবচেয়ে বড় তথ্যসমৃদ্ধ নথি ফাঁসের ঘটনায় প্রায় ১০০ এর অধিক মিডিয়ার ৪০০ সাংবাদিক যার মধ্যে BBC, the Guardian and Le Monde এর মতো বিশ্বের নামকরা নাম করা মিডিয়া সম্পৃক্ত ছিলো যারা ৮০ টি বিভিন্ন দেশে নিয়োজিত ছিলো এ প্রকল্পের নিমিত্তে তথ্য সংগ্রহের লক্ষ্যে। এমন একটি নথি যার মধ্যে থাকা তথ্যের সত্যতা প্রকাশিত হলে পুরো বিশ্বজুড়ে কম্পন সৃষ্টিতে সক্ষম হবে।
এ থেকে অনেকটা আঁচ করা যায় এই “পানামা পেপার” নামক তথ্য প্রকাশের প্রকল্পটা কতো বড় ধাক্কা দিয়েছিলো সারা বিশ্বের এক বিশেষ গোষ্ঠীবর্গকে। জার্মান নিউজপেপার SüddeutscheZeitung এর মতে, ডাটাসমৃদ্ধির দিক দিয়ে পানামা পেপারস কেলেঙ্কারি প্রায় ১০০০ গুণ বেশি শক্তিশালী এবং বেশি তথ্যসমৃদ্ধ ছিলো উইকিলিকস হতে। উল্লেখ্য, উইকিলিকসের ডাটাসম্ভারের পরিমাণ ছিলো ১.৭ গিগাবাইট।
পানামা পেপারস আসলে কি?
“Panama Papers” হলো ১১.৫ মিলিয়ন ফাইল সমৃদ্ধ এক তথ্যভান্ডার যা ছদ্মবেশী সুত্র দ্বারা ফাঁসকৃত এক বহুল আলোচিত তথ্যফাঁসের একটি গোপন নথি । এটা মূলত পৃথিবীর চতুর্থ পানামারিয়ান আইন প্রতিষ্ঠান এবং যৌথ সেবা প্রদানকারী“Mossack Fonseca” নামক ল ফার্মের ডাটাবেজ হতে ফাঁস হয়েছিলো যারমধ্যে গোপনে সংরক্ষিত ছিলো বিশ্বের সব অখ্যাত নেতা ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা কিভাবে সুকৌশলে কর ফাঁকি দিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন সম্পর্কে তথ্য। পুরো বিশ্বের প্রায় ২০০ টি দেশের প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব, ৭২ জন সাবেক ও বর্তমান রাষ্ট্রপ্রধান, শ-কয়েক রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, ক্রীড়াব্যক্তিত্বের গোপন দূরভিসন্ধি বেরিয়ে আসে এই নথির মাধ্যমে যার কারণে এই নথির নামকরণ করা হয় “Crime of the Century” হিসেবে।

একটু জেনে নেয়া যাক অভিযুক্ত মোস্যাক জনসেকা সম্পর্কে যারা বিশ্বখ্যাত গোপনীয়তা রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠান নির্দিষ্ট বাৎসরিক ফি’র মাধ্যমে সেবা প্রদান করতো। উল্লেখ্য, উক্ত প্রতিষ্ঠানটির সারা বিশ্বে প্রায় ৪২ টিরও বেশি শাখা রয়েছে যার মধ্যে ৬০০ জন কর্মী কর্মে নিয়োজিত। বলাবাহুল্য, মোস্যাক ফনসেকা নামক প্রতিষ্ঠানটি নিজেদের প্রতিষ্ঠানের ব্র্যান্ড ভ্যালু ব্যবহার করতে দিতো তাদের ক্লায়েন্টদের যাতে লেনদেনে কোন ধরণের বাধার সম্মুখীন হতে না হয়।

প্রতিষ্ঠানটি কর স্বর্গ বা ট্যাক্স হেভেন পরিচালনা করে সুইজারল্যান্ড, সাইপ্রাস, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডসহ বিভিন্ন স্থানে লেনদেনের স্বার্থে। যেহেতু তাদের নেটওয়ার্ক অত্যন্ত শক্তিশালী ছিলো পুরো বিশ্বে সেহেতু প্রায় তিন লক্ষাধিক কোম্পানীর হয়ে তারা আইনী পরামর্শ প্রদানের কাজ করতো।
ফাঁসকৃত “পানামা পেপারস” নথিতে ছিলো বিশেষ ব্যক্তিগোষ্ঠীর ব্যক্তিগত আর্থিক বিবরণী এবং সরকারী গুরত্বপূর্ণ তথ্য যা বিগত বহুবছর ধরে গোপনে রাখা ছিলো।
সময় ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ সাল
এক অজানা উৎস হতেজার্মান পত্রিকা SüddeutscheZeitung এর কাছে বার্তা আসে,“Hello, This is John Doe.”
কেউই এই তথ্যসুত্রের উৎস সম্পর্কে বিন্দুমাত্র জানতো না, ট্রেস করেও জানতে পারে নিই ঠিক কোন জায়গা হতে মেইলটি এসেছে।

প্রায় ১১.৫ মিলিয়ন ফাইল সমৃদ্ধ পানামা পেপারসের তথ্য SüddeutscheZeitung নামের জার্মান পত্রিকা একটি অজানা সোর্স হতে সর্বপ্রথম তথ্য পায়। পরে তারা The International ConsortiumOf Investigative Journalists (ICIJ) সংস্থাকে জানায়। পরবর্তীতে ICIJ পুরো তথ্য সম্পর্কে “The Guardian”, “BBC” এর মতো অন্যান্য বিস্তৃত নেটওয়ার্ক সম্পন্ন আন্তর্জাতিক মিডিয়া পার্টনারদের অবগত করলো।
সময় ৩রা এপ্রিল, ২০১৬ সাল। প্রায় এক বছর পর জার্মান পত্রিকা উক্ত নথি প্রকাশ করে যদিও ১১.৫ মিলিয়ন তথ্যসমৃদ্ধ নথির সবটুকু তথ্য তারা প্রকাশ করে নিই।

Source: Huffington Post
নথির মধ্যে মোস্যাক ফনসেকা নামক উক্ত আইনি প্রতিষ্ঠানটি সম্পর্কে অভিযোগ আসে তারা সম্পদ গোপন এবং কর ফাঁকি দিয়ে অপ্রদর্শিত আয়কে বৈধ করার পরামর্শ দিয়ে অর্থপাচার, আন্তর্জাতিক বাজারে নিষেধাজ্ঞা থাকা ব্যক্তিদের সরাসরি বিনিয়োগে সম্পৃক্ত এবং কর ফাঁকি দিতে সহায়তা প্রদান করে আসছিলেন। সরাসরি উল্লেখ ছিলো কোন পন্থায় এবং কিভাবে তারা উক্ত মক্কেলদের সম্পদের বিবরণে হেরফের করে কর ফাঁকি দেয়া যায় এবং কোন উপায়ে অর্থ পাচার করা উক্ত ফাঁসকৃত নথিতে।তবে উক্ত আইনী প্রতিষ্ঠানটির মতে, তারা প্রায় ৪০ বছর ধরে কোন ধরণের বাঁধা বিপত্তি ব্যতীত তাদের কার্যক্রম চালিয়ে আসছেন সম্মানের সহিত।
এবার জেনে নেয়া যাক পানামা পেপারস সম্পর্কিত সংবাদ সংগ্রহেসম্পৃক্ত থাকা সাংবাদিকদের দূরদশা সম্পর্কেঃ
কেয়ং কুয়ক- উয়েন(Keung Kwok-yuen): হংকংয়ের জনপ্রিয় সংবাদপত্র “Ming Pao” এর মুখ্য সম্পাদক কেয়ং কুয়ক-উয়েনকে বরখাস্ত করা হয় সংবাদপত্রের প্রথম পৃষ্ঠায় পানামা পেপারস কেলেঙ্কারিতে অর্থ পাচারে নাম আসা সাবেক বাণিজ্য সচিব, চলমান আইনসভার সদস্য, বিশ্বের অন্যতম ধনী ব্যক্তিত্ব এবং মার্শাল আর্ট স্টার জ্যাকি চ্যান সম্পর্কে সংবাদ প্রচার করায়।
আহিয়ানা ফিগুয়েরা (Ahiana Figueroa):ভেনিজুয়েলার সংবাদপত্র ÚltimasNoticiasএর সাংবাদিক আহিয়ানা ফিগুয়েরাকে বরখাস্ত করা হয় পানামা পেপারস নথিতে সম্পৃক্ত থাকার দরুণ।
তাছাড়া, ইকুয়েডরে নথিতে সম্পৃক্ত থাকায় সাংবাদিকদের ওই দেশের প্রেসিডেন্ট রাফায়েল করেয়ার সমর্থকেরা তাদের “mercenaries,” “rats,” “corrupt press,” and “lackeys of the empire.” আখ্যা দিতে থাকে।
পানামার দৈনিক সংবাদপত্র La Prensa এর সাংবাদিক যারা পানামার পেপারসের সাথে সম্পৃক্ত ছিলো তাদের কাছে অজ্ঞাতনামা টুইটার ব্যবহারকারী হতে বার্তা আসে, “ কি লাভ দেশকে ধ্বংস করে?”
একটি অনলাইন পুলের মাধ্যমে জানতে চাওয়া হয়, এসব “বিশ্বাসঘাতক সাংবাদিক”দের জেলে ভরে দেওয়া উচিত ছিলো অথবা পানামা সাগরে ডুবিয়ে মারা দরকার ছিলো।
ফিনল্যান্ডের কর কর্তৃপক্ষ পানামা পেপারসের সাথে জড়িত থাকা সাংবাদিকদের ঘর এবং কাগজাদি বাজেয়াপ্ত করার হুমকি প্রদান করে।

তিউনিশিয়ায় অজ্ঞাতনামা হ্যাকার অনলাইন সংবাদমাধ্যম Inkyfada হ্যাক করে ধ্বসিয়ে দেয় পানামা পেপারস সম্পর্কে তাদের সম্পৃক্ততার কারণে।
এবার জেনে নেয়া যাক কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকায় পদত্যাগ করা ব্যক্তিবর্গ সম্পর্কেঃ
পানামা পেপারসে চিলির দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রধান গঞ্জালো দেলাভেউ (Gonzalo Delaveau) সম্পর্কে বিপুলপরিমাণ অর্থ পাচারের অভিযোগ আসলে তিনি পদত্যাগ করেন।
১৯৯২ সালে দুই মাস অফশোর কোম্পানীতে প্রশাসক থাকার তথ্য ফাঁসের পর স্পেনের ভারপ্রাপ্ত শিল্পমন্ত্রী সোহে ম্যানুয়েল সোরিয়া পদত্যাগ করেন।
সিগমুন্ড গুনলাগসন, আইসল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ২০১৬ এর ৫ এপ্রিল পদত্যাগ করেন কর ফাঁকি দেয়ার অভিযোগ সংক্রান্ত নথি ফাঁসের পরে যখন দেশটিতে বিক্ষোভ শুরু হয়।
চলতি বছরে কেলেঙ্কারিতে সংযুক্তির খবরে পদত্যাগ করেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ। তথ্যে প্রকাশিত হয় সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সন্তানেরা অফশোর একাউন্টের মাধ্যমে লন্ডনের জায়গাজমি খরিদ সংক্রান্ত দুর্ণীতিতে জড়িত থাকায়।

আরমেনিয়ান আইনসেবা প্রধান মিহরান পঘোসিয়ান (Mihran Poghosyan) পদত্যাগ করেন পানামার কোম্পানী সিগটেম এবং হোপকিনটেন কোম্পানীর মালিকানাসত্ত্ব থাকায়। তবে তৃতীয় কোম্পানী ব্যাঙ্গিওর কতোটুকু অংশের মালিকানা তার ছিলো সে সম্পর্কে জানা যায় নিই।
ফুটবলের অভিভাবক সংস্থা ফিফাও রেহায় পায় নি পানামা পেপারসের কবল হতে। হুয়ান পেদ্রো দামিয়ানি নামের এক কর্মকর্তা নিরপেক্ষ নৈতিকতা কমিটি হতে পদত্যাগ করেন তার আইনী প্রতিষ্ঠান কমপক্ষে সাতটি অফ-শোর কোম্পানীর সাথে সংযুক্ত ছিলো।
সেই সাথে মিশরের সাবেক প্রেসিডেন্ট হোসনী মোবারক, লিবিয়ার সাবেক রাষ্ট্রপ্রধান মুয়াম্মার আল গাদ্দাফি এবং সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ, সৌদি আরবের রাজা, ফুটবল তারকা লিওনেল মেসি, বলিউড অভিনেতা অমিতাভ বচ্চন এবং অভিনেত্রী ঐশ্বরিয়া রায় বচ্চনের নামও উঠে আসে।
তবে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিভিন্ন ব্যক্তি ও কোম্পানী বেআইনীভাবে অফ-শোর একাউন্টে ২ বিলিয়ন ডলার লুকিয়ে রাখার অভিযোগ উঠলে তিনি তা অস্বীকার করেন এবং আসন্ন নির্বাচনে তার ভাবমূর্তি নষ্টে বিরোধীপক্ষের সূক্ষ্ম চাল হিসেবে আখ্যায়িত করে।
জড়িত থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে শুধুমাত্র অয়াকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের শাস্তি হয়েছে আর বাদবাকিরা এখনো তদন্তনাধীন রয়েছে।
এবার আসা যাক পানামা পেপারসে জড়িত বাংলাদেশীদের সম্পর্কে
ফাসকৃত নথিতে সর্বমোট ২৪ জন বাংলাদেশী ব্যক্তির নাম উঠে আসে যারা কর ফাঁকি দিয়ে বিদেশে অর্থ পাচারে সম্পৃক্ত ছিলো যার মধ্যে ২১ জন ব্যক্তি এবং তিনটি প্রতিষ্ঠান ছাড়াও ১৮ টি ঠিকানা প্রকাশ করে ICIJ কর্পোরেশন। তবে দেশের অভ্যন্তরীন দূর্নীতি দমন কমিটি অনুসন্ধান করেও ফলপ্রসু কোন সমাধান আজও দিতে পারে নিই। এমনকি কিভাবে, কোথায়, ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে কোন তথ্য বের করতে পারে নিই।
নথিতে প্রকাশিত বাঙালীরা হলো কফিল এইচ এস মুয়িদ, পেসিনা স্টেফানো, রুডি বেঞ্জামিন, ইউসুফ রায়হান রেজা, ইশরাক আহমেদ, নভেরা চৌধুরী, ফরহাদ গণি, মেহবুব চৌধুরী, বিলকিস ফাতিমা জেসমিন, রজার বার্ব, আবুল বাসার, জাইন ওমর, বেনজির আহমেদ, আফজালুর রহমান, সুধীর মল্লিক, জীবন কুমার সরকার, নিজাম এম সেলিম, মোকসেদুল ইসলাম, মোতাজ্জেরুল ইসলাম ও সেলিমুজ্জামান। এদের মধ্যে আফজালুর রহমান ও মোতাজ্জেরুল ইসলামের নাম দুবার করে রয়েছে।
আর বাকি তিনটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বাংলাদেশ বিমান ইনকোঃ, ইসলামিক সলিডারিটি শিপিং কোম্পানী বাংলাদেশ লিমিটেড এবং বাংলাদেশ টেক্সটাইল এজেন্সিজ লিমিটেডের নাম রয়েছে কিন্তু অতীব দুঃখের বিষয় হলো গত ১৫ মাসেও এসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কেউই আজও শনাক্ত করা সম্ভব হয় নিই।
আজপর্যন্ত জানা যায় নিই বিশ্বে তোলপাড় সৃষ্টিকারী এ নথি ফাঁসের পিছে থাকা অবয়ব কে? আর অন্যদিকে অভিযুক্ত আইনী প্রতিষ্ঠান মোস্যাক ফনসেকা কোন বিশদ অভিমত না জানালেও তাদের পক্ষে নিয়ে দ্যা গার্ডিয়ানকে বলে, তারা মানি লন্ডারিং বিরোধী আইন মেনে চলেছেন। সেদিকে খেয়াল রেখেই তারা ক্লায়েন্টদের সেবা দিয়েছেন। নিজেদের সেবার যে কোনও ধরনের অপব্যবহার রোধে তারা সচেষ্ট ছিলেন।

ICIJ এর ডিরেক্টর জেরার্ড রাইল আসলে যা বলেছিলেন তাই সত্য কারণ তিনি বলেছেন নথিগুলোতে প্রতিষ্ঠানটির (মোস্যাক ফনসেকা) সম্পর্কিত ৪০ বছরের সব কর্মকান্ডের তথ্যাদি সুষ্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে এবং যদি এসব তথ্যাদির সত্যতা নিশ্চিত হয় তবে তা পুরো দুনিয়াকে প্রকম্পিত করতে সক্ষম হবে।
দেখা যাক কি হয় … !!!
levaquin sale levaquin online order