মুসলমানদের স্পেন বিজয় ও মুসলিম আধিপত্য

2

মুসলমানদের স্পেন বিজয় ইসলামের ইতিহাসে একটি তাৎপর্যময় ঘটনা। ৭১১ খ্রিষ্টাব্দে মুসা বিন নুসাইর এবং তারিক বিন জিহাদ এর নেতৃত্বে এক ঐতিহাসিক অভিযানে মুসলিমরা স্পেন জয় করে।

৮ম শতক থেকে শুরু করে ১৫ শতক পর্যন্ত  প্রায় ৮শ’ বছর মুসলমানদের শাসন স্পেনকে সভ্যতা ও সংস্কৃতির উচ্চস্থানে উন্নীত করেছিল। আজ মুসলমানদের স্পেন বিজয়ের আদ্যোপান্ত দেওয়া হল।

স্পেনে মুসলমানদের আগমন
স্পেনে মুসলমানদের আগমন Source: pinterest.com

স্পেনের পরিচিতি:

মধ্যযুগীয় ইউরোপের অগ্রযাত্রায় স্পেনই পথ প্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেছে। স্পেন তিনদিকে সমুদ্র দ্বারা বেষ্টিত। পূর্ব দিকে ভূমধ্যসাগর, দক্ষিণে জিব্রাল্টার প্রণালী ও পশ্চিমে আটলান্টিক মহাসাগর।স্পেন আফ্রিকার সাথে ইউরোপ মহাদেশের যোগসূত্র রচনা করে। স্পেনের সাথে ফ্রান্সের যে ভূখণ্ড সংযোগ রক্ষা করেছে তা হচ্ছে পিরেনীজ পার্বতমালা যা প্রায় তিনশত মাইল পূর্ব পশ্চিমে বিস্তৃত। স্পেনের উত্তর ও উত্তর পশ্চিমের উপকূল পর্বতমালা দ্বারা আবৃত থাকলেও এ বিস্তীর্ণ অঞ্চলে তারাগোনা, কাসটেলন ভ্যালেন্সিয়া প্রভৃতি সমৃদ্ধশালী সমুদ্রপথ ছিল। স্পেনের মধ্যবর্তী অঞ্চলটি মেসেটা নামে পরিচিত।

স্পেনের ভৌগলিক অবস্থান
স্পেনের ভৌগলিক অবস্থান source: freeworldmaps.com

ইউরোপ মহাদেশের দক্ষিণ পশ্চিমাংশে অবস্থিত স্পেন আইবেবিয়ান উপদ্বীপের ৮৫ ভাগ ভূমি দখল করে আছে। স্পেনের বর্তমান আয়তন ১,৯৪,৯০০ বর্গমাইল বা ৫,০৪,৭৮২ বর্গকিলোমিটার, স্পেন মুসলিম আমলে আন্দালুস নামে পরিচিত ছিল। মুসলমানদের আগমনের পূর্বের স্পেন গথিক রাজাদের অধীনে প্রায় ৩০০ বছর ছিল। তখন স্পেনে জনগণের কোনও কল্যাণ হয়নি বরং তারা ছিল নানা সমস্যায় জর্জরিত। শাসক গোষ্ঠীর অত্যাচারে ভূমিদাস, ক্রীতদাস, বর্গাদার ও ইহুদিদের মধ্যে করুণ অবস্থার সৃষ্টি হয়। ফলে দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় রাজনৈতিক অবস্থা এক শোচনীয় পর্যায় উপনীত হয়। এরূপ নাজুক ও ভয়াবহ অবস্থায় উমাইয়া বংশের শ্রেষ্ঠ খলিফা

মুসলমানদের আগমনের সময় অরাজকতায় পূর্ণ স্পেন
মুসলমানদের আগমনের সময় অরাজকতায় পূর্ণ স্পেন source: pinterest.com

আল ওয়ালিদের শাসনামলে স্পেনের বিরুদ্ধে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ অভিযান পরিচালিত হয়। এ অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছিল মুসলিম সেনাপতি তারিক বিন যিয়াদ ও মুসা বিন নুসাইর। মুসলমানদের অভিযানের আগমনের পূর্বে স্পেনে কেন্দ্রীয় শাসন ছিল খুবই দুর্বল। রাজ পরিবারগুলোর মধ্যে গোত্রীয় কলহ, যা সামগ্রিকভাবে রাজনৈতিক অবস্থাকে দুর্বিষহ করে তোলে। মুসলিম বিজয়ের পূর্বে গথিক রাজা রডারিক পূর্ববর্তী রাজা উইটিজারকে হত্যা করে সিংহাসন দখল করে, ফলে উইটিজার ভ্রাতা, পুত্র, জামাতা সবাই বিরোধী হয়ে ওঠে।

রাজা রডারিক
রাজা রডারিক source: pinterest.com

অপরদিকে কাউন্ট জুলিয়ানের কন্যা ফোরিন্ডা রাজা রডারিক কর্তৃক শ্লীলতাহানির শিকার হন, যার ফলে কাউন্ট জুলিয়ান রাজা রডারিকের প্রতিশোধ গ্রহণকল্পে উত্তর আফ্রিকার মুসলিম গভর্নর মুসা বিন নুসাইরকে স্পেন আক্রমণের আহ্বান জানায়। তবে মুসলমানদের স্পেনে আগমনের ক্ষেত্রে তৎকালীন ধর্মীয়ব্যবস্থাও অনেক সুযোগ করে দিয়েছিল। তৎকালীন স্পেনের রাজা আদেশ জারি করেছিল যে, ইহুদিগণ হয় খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করবে, নতুবা স্পেন ত্যাগ করবে। অন্যথায় তাদেরকে হত্যা করা হবে। এক তথ্য থেকে জানা যায় যে, ৬১২ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ৬২০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে প্রায় ৯০ হাজার ইহুদিকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করা হয়।

স্পেন বিজয়ের বিবরণঃ

প্রথম অভিযান হলো সিউটার গভর্নর কাউন্ট জুলিয়ান ও উত্তর আফ্রিকার স্পেনীয় উদ্বাস্তুদের অনুরোধে মুসা বিন নুসাইর স্পেনের প্রাথমিক অবস্থা জরিপের জন্য অধীনস্থ সেনানায়ক তারিক বিন যিয়াদকে ৭১০ খ্রিষ্টাব্দে চারখানা যুদ্ধজাহাজে চারশত পদাতিক ও একশত অশ্বারোহী বার্বার সৈনিক সহ স্পেনে যাওয়ার নির্দেশ দেন। তারিক কার্য সমাধা করে প্রত্যাবর্তন করেন এবং অভিযান পরিচালনার অনুকূলে রিপোর্ট পেশ করেন।

তারেক বিন জিয়াদের নেতৃত্বে মুসমানদের বিজয় অভিযান
তারেক বিন জিয়াদের নেতৃত্বে মুসমানদের বিজয় অভিযান source: pinterest.com

দ্বিতীয় অভিযান হলো উত্তর আফ্রিকার শাসনকর্তা ও সামরিক অধিনায়ক মুসা ৭১১ খ্রিষ্টাব্দে তারিক বিন যিয়াদের নেতৃত্বে সাতহাজার বার্বার ও ৩০০ আরব সৈন্যের একটি বাহিনী দ্বিতীয় বারের মতো স্পেন বিজয়ের জন্য প্রেরণ করেন। পরবর্তীকালে সৈন্য সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে বারো হাজারে পৌঁছে। কাউন্ট জুলিয়ান কর্তৃক প্রেরিত চারটি জাহাজে তারিক জিব্রাল্টার প্রণালী অতিক্রম করে স্পেনের পার্বত্য অঞ্চলে অবতরণ করেন। তবে তারিক যে স্থানে ঘাটি স্থাপন করছিলেন তা আজও জাবালুত তারিক(তারিকের পর্বত)নামে পরিচিত। তিনি আন্দালুসিয়ার দক্ষিণাঞ্চল দখল করেন। অতঃপর ৭১১ সালের ১৯ জুলাই মূলবাহিনী রডারিকের একলাখ সৈন্যর মোকাবিলা করে ওয়াদী লাস্কের নিকটবর্তী সারিস বা জেরেখে মুসলিম ও গথিক বাহিনীর মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ হয়। এ যুদ্ধ ইতিহাসে ওয়াদী লাস্কের যুদ্ধ নামে পরিচিত। এ যুদ্ধ রাজা রডারিক শোচনীয়ভাবে পরাজিত ও নিহত হন। এ অভিযানে স্পেনের ভবিষ্যৎ রাজধানী কর্ডোভার এবং মূল রাজধানী টলেডোর পতন ঘটে।

সেনাধ্যক্ষ মূসা ও তারিকের যৌথ অভিযানঃ

মূসা ৭১২ সালে তারিকের অধিকৃত অঞ্চল ব্যতিরেকে উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের খ্রিষ্টান অধ্যুষিত শহরগুলোর দিকে অভিযান প্রেরণ করেন। তিনি তার আঠারশত সৈন্যসহ অতি সহজে মেদিনা, সেভিল, মেরিদা দখল করেন। এরপর তারিক ও মূসার সম্মিলিত বাহিনীর অভিযানে লিও, গ্যালিসিয়া ও ্যসরারগোসা মুসলিম অধিকারে আসে, তারপর তারা আরাগানে উপস্থিত হয়ে লিজিও আমিয়া অধিকার করেন। মাত্র দুই বছরে সমগ্র স্পেনে মুসলিম আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। রাজা রডারিকের পরাজয়ের মধ্যে দিয়ে স্পেনে মুসলমানদের আধিপত্য বিস্তারের পর অল্পদিনের মধ্যে স্পেন দামেস্কের উমাইয়া খেলাফতের অধীনে চলে আসে। অবশেষে এভাবে ধারাবহিক ভাবে স্পেনে খলিফাগণ খেলাফতের দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। এবং ৭৫০ সালে জাবের যুদ্ধের মাধ্যমে আব্বাসীয়দের হাতে উমাইয়াদের পতন হলে, আব্বাসীয় খেলাফতের প্রথম দিকে আব্দুর রহমান আদদাখিল নামক এক ব্যক্তি দামেস্ক থেকে জীবন নিয়ে পালিয়ে গিয়ে স্পেনে আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং সেখানে তিনি অবস্থান করার পর স্বাধীনভাবে আবার উমাইয়া খেলাফত প্রতিষ্ঠা করেন, অবশেষে ধারাবাহিকভাবে ১০৩১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তা চলতে থাকে। পরবর্তীতে বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজবংশ প্রতিষ্ঠিত হলে স্পেনে মুসলিম আধিপত্য চলতে থাকে।

সহজে স্পেন বিজয়ের কারণসমূহ:

মুসলিম সেনাবাহিনী শক্তি ও শান্তি উভয় নীতি অনুসরণ করে গথিক সাম্রাজ্য অধিকার করে। স্পেনের সামাজিক ও অর্থনৈতিক দুরবস্হা মুসলিম অভিযানকে সাফল্য মন্ডিত করতে সাহায্য করে। খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দীর প্রথম দিকে আগমনকারী ভিজিগথ শাসকশ্রেণী ও স্পেনীয় রোমানদের মধ্যে বিদ্বেষ ও বিভেদ তখনও বিদ্যমান। আত্মকলহে অতিষ্ঠ, যুদ্ধ ও বিবাদ-বিসম্বাদে জর্জরিত স্পেনের সাধারণ জনগণ মুসলমানদেরকে তাদের ত্রাণকর্তা ও হিতাকাঙ্ক্ষী হিসেবে বিবেচনা করে। এ জন্য তারা মুসলিম আক্রমণ ও অভিযানকে সর্বতোভাবে সাহায্য করে ও অভিনন্দন জানায়। ফলে মুসলিম সেনাবাহিনী স্বল্প সময়ের ব্যবধানে স্পেনকে সম্পূর্ণভাবে অধিকার করতে সক্ষম হয়। একদিকে ভিজিগথদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক দুর্বলতা এবং অন্যদিকে আরব ও বার্বারদের গোত্রীয় সংহতি(আসাবিয়াহ) ও ইসলামী আদর্শ তারিক মুসার স্পেন বিজয়ের পথ সুগম করে।

আল্পকাসার অফ সেভিল
আল্পকাসার অফ সেভিল Source: flyingrickshaw.com

স্পেন বিজয়ের ফলাফল:

স্পেনের জনগণের প্রতিটি ক্ষেত্রে স্পেন বিজয় প্রভাব বিস্তার করে। মুসলমানদের উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা, মসজিদ নির্মাণ ও প্রাসাদ স্থাপনকে ভিজিগথগণ তাদের জন্য স্থায়ীভাবে পতন হিসেবে বিশ্বাস করে। খ্রিষ্টান ও ইহুদীগন তাদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান শান্তিপূর্ণভাবে পালনের অনুমতি লাভ করে ।তিনশত খ্রীষ্টান ভূ-স্বামীকে তাদের জমিদারী ফিরিয়ে দেওয়া হয় এবং পূর্ব ক্ষমতা ও পদে পুনর্বহাল করা হয়। তাদেরকে রাজদরবারের আনুষ্ঠানিকতা থেকেও রেহাই দেওয়া হয়। ইসলামী জীবনব্যবস্থা চালু হওয়াতে জনগন দাসপ্রথা থেকে অব্যাহতি লাভ করে এবং সাথে সাথে সামন্ত প্রথার নাগপাশ থেকে মুক্তি পায়। কৃষকদের মালিকানা স্বত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় ও প্রাচ্যের শস্যাদি চাষাবাদ করায় এবং সেচ ব্যবস্থার প্রচলনের ফলে কৃষিক্ষেত্রে এক নব যুগের সূচনা হয়।প্রাচ্যের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন ও মুসলমানদের উন্নতমানের জীবনযাপনের দরুন এবং শাসকদের উদার নীতি গ্রহনের জন্য জনজীবনে,বাণিজ্যে ও শিল্পক্ষেত্রে প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়। সুয়েভী,গথ,ভ্যান্ডাল,রোমান এবং ইহুদী নির্বিশেষে সকলের জন্যই সামাজিক নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা হয়। কঠোর ও নির্যাতনমুলক ভিজিগথিক আইন-কানুন বাতিল হওয়ায় ইহুদীগন বিশেষভাবে উপকৃত হয় এবং মুসলমানদের মিত্র হিসেবে সরকারী চাকুরীর সুযোগ লাভ করে। কালক্রমে কর্ডোভা ইহুদীবাদের প্রাণকেন্দ্রে পরিনত হয়। স্পেনও ইউরোপের শিক্ষা সংস্কৃতির জ্যোতিকেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে।

 

রেফারেন্সঃ

১, স্পেনে মুসমানদের শাসন

২,  ব্রিটেনিকা

Source Featured Image
Leave A Reply
2 Comments
  1. Mnbozt says

    buy semaglutide 14 mg generic – purchase semaglutide generic desmopressin buy online

  2. Wtdfeh says

    buy repaglinide no prescription – empagliflozin uk jardiance medication

sativa was turned on.mrleaked.net www.omgbeeg.com

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More