একাকীত্বে ভোগতে থাকা একজন চিত্রশিল্পীর জীবদ্দশায় শেষ দেড়-দুবছরের জীবন ও তার রহস্য ঘেরা মৃত্যু নিয়ে বায়োগ্রাফি চলচ্চিত্র লাভিং ভিনসেন্ট । এটি বিশ্বের সর্ব প্রথম চলচ্চিত্র যার প্রত্যেকটি ফ্রেম তৈরী হয়েছে রং তুলিতে আঁকার মধ্যদিয়ে। ১ ঘণ্টা ৩৪ মিনিট ব্যাপ্তির এ চলচ্চিত্রটিতে সর্বমোট ব্যবহৃত হয়েছে ৬৫ হাজার তৈল চিত্র। চলচ্চিত্রটিতে এইসমস্ত তৈলচিত্র অঙ্কনের পিছনে সাত বছর ধরে কাজ করেছেন ১২৫ জন প্রফেশনাল চিত্র শিল্পী।
পেইন্টড এনিমেশন চলচ্চিত্রটির একজন দর্শক হিসেবে আপনাকে ভ্যান গঘের অঙ্কন কৌশলে মগ্ন রাখতে পরিচালক ডোরোটা কোবিলা এবং হুগল ওয়েলচম্যানের এই প্রচেষ্টা। যারা ভিনসেন্ট ভ্যান গঘের আঁকা ৮৬০ টি বিশ্ববিখ্যাত তৈলচিত্র সম্পর্কে অল্প হলেও জানেন তারা গঘের চিত্রে উজ্জল রং ও প্রকৃতি কিভাবে জরুরী হয়ে উঠেছে তা সহজেই আঁচ করতে পারেন। এই চলচ্চিত্রটিতেও সেই অনন্য বৈশিষ্ট্যের দেখা মেলবে কেননা লাভিং ভিনসেন্ট তৈরীতে চিত্রকররা ভ্যান গঘের ঠিক সেই কৌশলকে অনুসরণ করে গেছেন ফ্রেম থেকে ফ্রেমে । লাভিং ভিনসেন্ট তৈরিতে সর্বমোট ৮৫৩ টি শটের ব্যবহার হয়েছে যার জন্য ক্যাম্পাসে রং-তুলিতে আঁকতে হয়েছে ঠিক ৮৫৩ টি আলাদা আলাদা তৈলচিত্র, পরবর্তীতে সময়, স্থান ও চরিত্র ধরে ফ্রেম হয়েছে পয়ষট্টি হাজার।

চলচ্চিত্রটির মধ্যদিয়ে পরিচালকরা দর্শকদের মুলত যে বিষয়বস্তুর কথা বলতে চেয়েছেন তা হল, ভ্যান গঘের শিল্পকর্মের সৌন্দর্যতা, যাকে সুক্ষহাতে চলমানতা দান করা হয়েছে আর অন্যদিকে সে সৌন্দর্যতায় মুগ্ধ রেখেই অনুসন্ধান করা হয়েছে ভ্যান গঘের মৃত্যু রহস্য এবং তার মৃত্যু পূর্ববর্তী ছয় সপ্তাহের জীবন। মানসিক হাসপাতাল ফিরত সুস্থ ভিনসেন্ট কিভাবে কি পরিস্থিতিতে আত্মাহতির দিকে এগিয়ে গেলেন এইটাই মুলত প্রধান জিজ্ঞাসা ছিলো লাভিং ভিনসেন্ট চলচ্চিত্রে। চরিত্র আরমান্ড রুলিন এর দ্বারা সে প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান করে গেছেন পরিচালক।
লাভিং ভিনসেন্ট সিনেমার গল্প এগিয়েছে, ভিনসেন্ট ভ্যান গঘের পোট্রেট সিরিজ পেইন্টিং ‘The Roulin Family’এর পোষ্টম্যান জোসেফ রুলিনের (ক্রিস ও’ডাউডি অভিনীত) পুত্র আরমান্ড রুলিনের (ডগলাস বুথ অভিনীত) মাধ্যমে। চলচ্চিত্রটিতে আরমান্ড রুলিনের দৃষ্টিকোণ থেকে গল্প এগিয়ে চলেছে । স্ক্রিপ্ট আনুযায়ী গল্পের শুরু ভ্যান গঘের মৃত্যুর একবছর পর থেকে । প্যারিসের বাইরে ফ্রেঞ্চ শহর অউভার্স-সুর-ওয়েসের পোষ্টম্যান ছিলেন জোসেফ তিনি গঘের বন্ধুও বটে। গঘ তার ভাই থিয়োকে একটি চিঠি লিখেন মৃত্যুর ছয় সপ্তাহ আগে যাতে ছিলো গঘ পূর্বের থেকে অনেক ভালো ও সুস্থ-স্বাভাবিক আছেন । গঘ সে চিঠিটি তার ভাইয়ের কাছে পৌঁছানোর জন্য জোসেফের হাতে দেন, চিঠি পৌঁছানোর দায়িত্বাভার আসে আরমান্ডের উপর।

Source: prod3.agileticketing.net
অন্যদিকে চিঠি লিখার ছয় সপ্তাহের মাথায় গঘের অপমৃত্যু ঘটে এবং তার ছয় মাসের মাথায় গঘের ভাই থিয়োরও মৃত্যু হয়। চিঠিটি আর পৌঁছানো হয় না । এপর্যায়ে আরমান্ড খুঁজতে থাকেন চিঠিটি ঠিক কার কাছে সরবরাহ করা উচিৎ! তাছাড়াও চিঠির লেখনি ও গঘের মৃত্যু জোসেফ ও আরমান্ডকে ভাবিয়ে তুলে। আরমান্ড চলে আসেন অউভার্স-সুর-ওয়েসেতে। অনুসন্ধানী আরমান্ড এই অপমৃত্যুর কারণ খুঁজতে থাকেন, দেখা হতে থাকে ভ্যান গঘের আশপাশের পরিচিত মানুষদের সাথে।দেখা হয় জুলিয়ান টাংগুয়ে সাথে (জন সিজন অভিনীত), যিনি ভিনসেন্টের পেইন্টিং বিক্রি করতেন, জানতে চান ভ্যান গঘের শেষ দিন গুলোর কথা । সেখানেই চিকিৎসক পল গ্যাচেটের (জেরোম ফ্লিন অভিনীত) সম্পর্কে জানতে পারে আরমান্ড তার সাথে সাক্ষাতের ইচ্ছাও প্রকাশ করেন।ডাক্তার গ্যাচেটের কন্যা, মার্গারিরেটের (সাওইরেস রোনামন অভিনীত) কাছ থেকে জানতে পারেন ডাঃ পল গ্যাচেট তার কাজের জন্য শহরের বাইরে আছেন। আরমান্ডকে সেজন্যই দেশকিছুদিন অপেক্ষা করতে হয়। অপেক্ষার দিনগুলোতে আলাপ হয় সেখানকার রেস্তরাঁ থেকে নৌকার মাঝির সাথে। স্থানীয় আরেক চিকিৎসক মাযেরি (বিল থমাস অভিনীত) মনেই করেন গঘ আত্মহত্যা করেন নি, তাকে হত্যা করা হয়েছিল। আরমন্ড আবিষ্কার করতে থাকে ভ্যান গঘকে। যেভাবে সহজতর ভাবে আত্মহত্যা বলা হচ্ছিল সেটা যে মুটেও হত্যা থেকে কিছুমাত্রায় কম নয় তাও আরমন্ডের কাছে স্পষ্ট হতে থাকবে। গঘের জন্য সে পরিবেশ যে বৈরী হয়ে উঠেছিল তার পাশের মানুষদের দ্বারা প্রতিনিয়ত নিগৃহীত হতে থাকার কারণে তা আরমান্ডের সাথে সাথে দর্শকের কাছেও পরিষ্কার হয়ে উঠবে। অন্যদিকে ফ্ল্যাশব্যাকের মাধ্যমে দেখানো দৃশ্য জানান দেবে গঘের স্বল্পভাষী, অন্তর্মূখী শিশুসুলভ স্বভাবের তথা শিল্পদর্শন ।
তাদের সাথে আলাপচারিতায় আরমান্ড আবিষ্কার করতে থাকেন একটি পরিস্থিতিকে যা গঘের অপমৃত্যুর জন্য দায়ী।

Source: Gazeta Online
লাভিং ভিনসেন্টের গল্প ভ্যান গঘের মৃত্যুর কারণ আত্মহত্যা না হত্যা তার অনুসন্ধানের মধ্যদিয়ে। অনুসন্ধানের জন্য আরমান্ড রুলিন গগের মৃত্যু স্থান প্যারিসের Auvers-sur-Oise গ্রামে যান। ঘটনা ক্রমে আরমান্ডের সাথে দেখা হয় গগের শেষ সময়ের চারপাশের মানুষদের ।ভালবাসার ভিনসেন্টকে নিয়ে আলাপ চারিতায় স্মৃতিচারণে উঠে আসে মৃত্যুর পেছনের নানা ঘটনা এবং ভিনসেন্টের আনকন্সাস মাইন্ড বা মানসিক অসঙ্গতি তীব্র হয়ে উঠার কারন।
বেঁচে থাকাকালীন সময়ে ভিনসেন্ট ভ্যান গগ তার চিত্রকর্মের একটি মাত্র বিক্রি করতে পেরেছিলেন। সেই আক্ষেপ,দারিদ্রতাই নাকি তার চারপাশের মানুষেই তার মৃত্যুর কারন ?
দর্শক মনে এই প্রশ্ন রেখেই পরিচালক লাভিং ভিনসেন্ট চলচ্চিত্রের ইতি টানেন।
সূত্র ও স্থিরচিত্র – bbc.com, lovingvincent.com, imdb, artnet