মস্কো অভিযান : শীতের কাছে নেপোলিয়নের হেরে যাবার গল্প

১৯৪১ সালে জার্মানির হিটলার রাশিয়া দখল করে যে মারাত্মক ভুল করেছিল ঠিক তার ১৩০ বছর এর কাছাকাছি সময় আগে আরেক বিশ্ব বিখ্যাত বরেণ্য যোদ্ধা নেপোলিয়ন বোনাপোর্ট রাশিয়া দখল করে আরেক চরম ভুলের সূচনা করেছিলেন। নেপোলিয়ন ও হিটলার দুইজনই অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে, রাশিয়া দখল করার চেষ্টা করার মূল্য কতটা ভয়াবহ হতে পারে। যে দেশের শীত হল যুদ্ধে ফার্স্ট জেনারেলের ভূমিকা পালন করে। আজকে আমরা নেপোলিয়নের রুশ বা মস্কো অভিযান সম্বন্ধে জানবো। এই অভিযানের ফলেই নেপলিয়নের প্রবল কর্তৃত্ব খর্ব হয়েছিল এবং যা আস্তে আস্তে নেপোলিয়নের ধ্বংস ডেকে এনেছিল।

রাশিয়া আক্রমণের উদ্দেশ্যে নেপোলিয়নের বাহিনীর যাত্রা
রাশিয়া আক্রমণের উদ্দেশ্যে নেপোলিয়নের বাহিনীর যাত্রা source: Wikipedia.com

যুদ্ধের পটভূমিঃ

অস্ট্রিয়া ও প্রাশিয়ার(বর্তমান জার্মানির অংশ) পর ইউরোপে স্থল শক্তির মধ্যে একমাত্র রাশিয়া সঙ্গে নেপলিয়নের শক্তি পরীক্ষা বাকী ছিল। ১৮০৭ সালে আইলাউ এবং ফ্রিডল্যান্ডের যুদ্ধে নেপোলিয়ন রাশিয়ার জার আলেকজান্ডারের সেনাববাহিনীকে পরাজিত করেন। এতে রাশিয়ার জার আলেকজান্ডার নেপলিয়নের সাথে চুক্তি করতে বাধ্য হন। এতে ইউরোপের রাজনীতিতে নাটকীয় পরিবর্তন আনে। ১৮০৭ সালে স্বাক্ষরিত টিলসিটের চুক্তির মাধ্যমে রাশিয়া ফ্রান্সের বন্ধুতে পরিণত হয়। কিন্তু এই চুক্তির ভিত্তি ছিল খুবই দুর্বল ফলে খুন অল্পতেই বিভিন্ন কারণে তাদের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়ন শুরু হয়। এই চুক্তিতে ফ্রান্স রাশিয়াকে তুরস্কের বিরুদ্ধে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিলেও পরে তা ভঙ্গ করে নেপোলিয়ন। ফলে রাশিয়ার জার আলেকজান্ডার খুবই ক্ষুদ্ধ হন।

১৮১০ সালে নেপোলিয়ন চুক্তি ভঙ্গ করে জার আলেকজান্ডার এর ভাগ্নিপতি ডিউক এর ওন্ডেনবার্গ দখল করেন। স্বাভাবিকভাবেই জার আলেকজান্ডার এতে খুশি হতে পারেননি। ইতিমধ্যেই নেপোলিয়ন আগ্রাসী হয়ে পোলান্ডের গ্যালিশিয়া দখল করে এই অঞ্চল নিয়ে “গ্রান্ড ডাচি অব ওয়ারস” নামক রাজ্য গঠন করেন। ফলে নেপোলিয়ন এই অঞ্চলে কয়েক লক্ষ সৈন্য মোতায়েন করে পোলান্ডকে ফরাসি উপনিবেশে পরিণত হয়। নেপোলিয়নের এই পদক্ষেপে জার আলেকজান্ডার ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন যে পোল্যান্ড ভাগ করে যে অংশ রাশিয়া পায় তা হারাবার অবস্থা তৈরি হতে পারে। ফলে জার আলেকজান্ডার নেপোলিয়নের কাছে এই দাবি করেন যে,তিনি ভবিষ্যতে স্বাধীন পোল্যান্ড এর দাবী করবেন না। কিন্তু নেপোলিয়ন তাতে রাজি হননি। ফলে দুই দেশের সম্পর্ক আরো খারাপ হতে থাকে।

ইংল্যান্ডকে ধ্বংস করতে নেপোলিয়ন যে বাণিজ্যিক অবরোধ আরোপ করে মহাদেশীয় ব্যবস্থা চালু করেন তাতে জার আলেকজান্ডারও সম্মতি দিয়েছিলেন কিন্তু যখন ইউরোপীয় অন্যান্য দেশের মতো রাশিয়ার অর্থনৈতিক অবস্থায় প্রায় ধ্বংসের পথে তখন জার আলেকজান্ডার মহাদেশীয় ব্যবস্থা মেনে চলতে অস্বীকৃতি জানান। ফলে  রাশিয়া নেপোলিয়নের বিরাগভাজনে পরিণত হন।

শীত উপেক্ষা করেও মস্কোর পথে নেপোলিয়ন
শীত উপেক্ষা করেও মস্কোর পথে নেপোলিয়ন source: history.com

মূল অভিযানঃ

১৮১২ সালে নেপোলিয়ন প্রায় ছয় লক্ষ সৈন্য নিয়ে মস্কো অভিযান শুরু করেন।নেপোলিয়নের পরিকল্পনা ছিল যে,তিনি সম্মুখ যুদ্ধে রুশ বাহিনীকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দিবেন। কিন্তু জারের চতুর সেনাপতি কুটুফজ সম্মুখ যুদ্ধ এড়িয়ে পশ্চাদপসরণ নীতি অনুসরণ করেন। ১৮১২ সালে নেপোলিয়ন প্রায় বিনা বাধায় রাশিয়ার ভূখণ্ডে ঢুকে পড়েন। স্মলেনস্কে ঢুকে অনেকটা জনমানবহীন রাশিয়াকে আবিষ্কার করে নেপোলিয়ন। ইতোমধ্যে খাদ্যাভাব ও প্রচণ্ড শীতে নেপোলিয়নের এক লক্ষ সৈন্য মারা যায়। নেপোলিয়নের উচিত ছিল স্মলেনস্কতে অবস্থান করে শীতকাল অতিবাহিত করে পরে রাশিয়ার মূল ভূখণ্ডের দিক অগ্রসর হওয়া। কিন্তু নেপোলিয়ন তা না করে বরং জার আলেকজান্ডারকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করার জন্য মস্কো অগ্রসর হন। কিন্তু রাশিয়ানগণ পোড়ামাটি নীতি অনুসরণ করে তাদের রাজধানী জনশূন্য ও বিধ্বস্ত অবস্থায় রেখে পশ্চাদপসরণ করেন।

মস্কো পুড়িয়ে ব্যর্থে বেসে বাড়ির পথে নেপোলিয়ন
মস্কো পুড়িয়ে ব্যর্থে বেসে বাড়ির পথে নেপোলিয়ন source: awesomestories.com

১৮১২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মস্কোর কাছাকাছি বোরডিনোর রণাঙ্গনে রাশিয়া ও ফ্রান্সের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হয়। যদিও যুদ্ধে নেপোলিয়ন জয়লাভ করেছিল কিন্তু তাতে তাঁর সৈন্য ও রসদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। ফরাসী বাহিনী মস্কো দখল করে আগুন লাগিয়ে দেয়। নেপোলিয়ন আশা করেছিলেন যে এতে হয়ত জার আলেকজান্ডার নরম হয়ে নেপোলিয়নের পায়ে লুটিয়ে পড়ে ক্ষমা চাইবেন ও শান্তিচুক্তির পথে ধাবিত হবেন। কিন্তু নেপোলিয়নের সেই আশা পূরণ হয়নি। এদিকে প্রচণ্ড খাদ্যাভাবে ও ভয়াবহ শীতে নেপোলিয়নের সেনাবাহিনী এক চরম অবস্থায় পতিত হয় এবং বহু সৈন্য মারা যায়। এদিকে রুশ সেনাদের গেরিলা কায়দায় পালটা হানায় বহু ক্ষুধার্ত ও রুগ্ন সেনা হতাহত হয়। শেষ পর্যন্ত নেপোলিয়ন ৬ লক্ষ সেনার মধ্যে মাত্র ৫০,০০০ হাজার সৈন্য নিয়ে দেশে ফিরতে সক্ষম হয়েছিলেন। এভাবেই নেপোলিয়নের মস্কো অভিযান ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।

শীতে বিপর্যস্ত নেপোলিয়নের সৈন্যরা
শীতে বিপর্যস্ত নেপোলিয়নের সৈন্যরা source: pinterest.com

মস্কো অভিযান ব্যর্থ হবার কারণঃ

নেপোলিয়ন একবার আক্ষেপ করে বলেছিলেন যে,”সম্ভবত মস্কো গমন করে আমি মারাত্মক ভুল করেছি। এখানে বেশিদিন থাকা উচিত হয়নি।” বিশ্ব বিখ্যাত সেনাবাহিনী নিয়ে মস্কো অভিযান ব্যর্থ হবার কয়েকটি কারণ তুলে ধরা হল:

প্রথমত, নেপোলিয়ন পরিকল্পনা করেছিলেন এক বছরের মধ্যেই তিনি রাশিয়া জয় করবেন। কিন্তু রাশিয়ার মতো একটা বিশাল দেশ জয় করার জন্য এটা অত্যন্ত উচ্চাভিলাষী ছিল। কম করে হলেও দুই বছরের একটা পরিকল্পনা নিয়ে নেপোলিয়নের মাঠে নামা উচিত ছিল।

দ্বিতীয়ত, প্রচণ্ড শীতের মধ্যে স্মলেনস্ক থেকে রাশিয়া গমন করা নেপোলিয়নের একটা মারাত্মক ভুল ছিল। তিনি একটু ভেবে চিন্তে কাজ করলে হয় যুদ্ধের ফলাফল ভিন্নও হতে পারতো। নেপোলিয়নের মাত্রাতিরিক্ত আগ্রাসী মনোভাবই তার ধ্বংস ডেকে এনেছিল।

রাশিয়ার প্রতিকূল পরিবেশে স্বয়ং নেপলিয়নেরই মন ভেঙ্গে যায়
রাশিয়ার প্রতিকূল পরিবেশে স্বয়ং নেপলিয়নেরই মন ভেঙ্গে যায় source: slate.com

তৃতীয়ত,রাশিয়ার প্রচণ্ড শীত ও রুশ জাতীয়তাবাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টাই ছিল নেপোলিয়নকে আটকানো। প্রকৃতপক্ষে এই যুদ্ধে শুধু রাশিয়ার সেনাবাহিনী নয়,সমগ্র জাতি নেপোলিয়নেরবিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। এই ধরণের গণজাগরণ নেপোলিয়ন ভুলেও আশা করেননি।

রাশিয়া থেকে খালি হাতেই ফিরতে হয় নেপলিয়নকে
রাশিয়া থেকে খালি হাতেই ফিরতে হয় নেপলিয়নকে source: the economist

যুদ্ধের ফলাফলঃ

পরবর্তী ইউরোপের ত্রাণকর্তা রূপে জার আলেকজান্ডার
পরবর্তী ইউরোপের ত্রাণকর্তা রূপে জার আলেকজান্ডার

মস্কো অভিযানের ব্যর্থতা সামরিক প্রতিভা ও ব্যক্তিগত মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করেছিল বহুলাংশে। পাশাপাশি এই অভিযান তাঁর পতনকে তরান্বিত করেছিল। নেপোলিয়নের এই ব্যর্থতা সমগ্র ইউরোপে আশা ও উৎসাহের সৃষ্টি করে। যে নেপোলিয়নকে কিছুদিন আগেও পরাজিত করা অসম্ভব মনে হত সেই বিশ্বাসে ফাটল ধরে। ওদিকে রাশিয়ার জার আলেকজান্ডার এর প্রভাব প্রতিপত্তি ইউরোপে উত্তর উত্তর বাড়তেই থাকে।যার নেতৃত্বেই পরবর্তীতে অস্ট্রিয়া, প্রুশিয়ার সমন্বয়ে নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে হলি এলায়েন্স গঠিত হয়। এছাড়াও এই যুদ্ধে নেপোলিয়নের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল যা পূরণ করে আবার সেই অপ্রতিরোধ্য নেপোলিয়ন হওয়াটা কিছুটা শঙ্কায় পরিণত হয়। তবে নেপোলিয়ন তার বিখ্যাত কৌশলী যোদ্ধাদের হারালেও একেবারে তার সেনাবাহিনী তখনো অচল হয়ে যায়নি। একেবারে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে গিয়েও নেপোলিয়ন আবার সামরিক প্রস্তুতি নিয়ে ইউরোপে ব্যাপক যুদ্ধের আঞ্জাম দিতে থাকেন।

Source Featured Image
Leave A Reply
sativa was turned on.mrleaked.net www.omgbeeg.com

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More