মাস্টারদা সূর্যসেন – চট্টগ্রামের প্রথম স্বাধীনতার স্বাদ

1

শোষণ-বঞ্চনা, দারিদ্র্য-দুর্ভিক্ষ পীড়িত ভারতবর্ষের বুকে চেপে বসে অত্যাচারী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ। পরাধীনতার গ্লানি থেকে দেশ মাতৃকাকে মুক্ত করতে গড়ে উঠে আপোষহীন স্বদেশী বিপ্লব। ফাঁসির মঞ্চে বিপ্লবী ক্ষুদিরামের নির্ভীক আত্মদান জাগিয়ে তুলে সমগ্র ভারতবর্ষের তরুণ-যুব সমাজকে। সে মন্ত্রে উজ্জীবিত এক স্কুল ছাত্র ধীরে ধীরে নিজেই হয়ে উঠে এক মহান বিপ্লবী, স্বাধীনতা সংগ্রামের এক মহানায়ক – সকলের প্রিয় মাস্টারদা সূর্যসেন ।

সাদামাটা মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেয়া সূর্যসেন ছেলেবেলা থেকেই ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ।পশ্চিমবঙ্গের বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজে বি.এ পড়ার সময়ে কলেজের অধ্যাপক সতীশ চন্দ্র চক্রবর্তী’র সান্নিধ্যে বিপ্লবীদল “যুগান্তর” সাথে যুক্ত হন ও দিক্ষা লাভ করেন। তারপর শিক্ষকতার কাজে ফিরে আসেন চট্টগ্রামে।

১৯২০ সালের দিকে সূর্যসেনের নেতৃত্বে অম্বিকা চক্রবর্তী, চারুবিকাশ দত্ত, তারকেশ্বর দস্তিদার, নগেন্দ্র চন্দ্র সেন ও জুলু সেন সহ কয়েকজন বিপ্লবী নিয়ে গড়ে তুলেন “সাম্যাস্রম” নামের এক বিপ্লবী সংঘটন। পরবর্তীতে “আইরিশ রিপাবলিকান আর্মি” বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানে অনুপ্রাণিত “সাম্যাস্রম” সংঘটনের নাম পরিবর্তন করে রাখেন “ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি” বা আই.আর.এ

মাস্টারদা সূর্যসেনআই.আর.এ এর অন্যান্য বিপ্লবীদলগুলোর সাথে নীতিগত দিক থেকে পার্থক্য না থাকলেও, এর নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য ছিল। মাস্টারদা এই বিপ্লবী তরুণদের সামনে এমন কতগুলো নৈতিক আদর্শ তুলে ধরতেন যার ফলে দলে দলে অনেক তরুণ এই দলে যোগ দিতে থাকে। সে সময় বিপ্লবের অর্থসংগ্রহের জন্য ডাকাতি পথ বেছে নিত বিপ্লবীদল গুলো। ১৯২৩ সালে মাস্টারদার নির্দেশে এবি রেলে ডাকাতি করে তার দল প্রায় ১৭০০০ টাকা সংগ্রহ করে যা অস্ত্র কিনার জন্য ব্যয় করা হয় কিন্তু মাস্টার দা এভাবে অর্থ সংগ্রহের পথটাকে মেনে নিতে পারেননি তাই তিনি দ্বিতীয় বার একাজ করেননি বরং তিনি তার সদস্যদের কাছ থেকে চাঁদা গ্রহণ করে তার সংঘটনকে পরিচালনা করতেন। ফলে সাধারণ মানুষের কাছে তার জনপ্রিয়তা আর সম্মান বাড়তে থাকে আর তার সংঘটনের সকল সদস্য এই আদর্শিক শিক্ষায় বিপ্লবে আরো উদ্বুদ্ধ হয়ে পড়ে।

১৮ এপ্রিল ১৯৩০ সাল, এদিনটি ছিল অন্য সব দিনের থেকে আলাদা। অনেক আগে থেকেই মাস্টারদার দিনটি নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। অনেক পরিকল্পনা আর প্রশিক্ষণের পর বিপ্লবীরা তৈরি আঘাত আনার জন্য। পরিকল্পনা অনুযায়ী আই.আর.এ এর সদস্যদেরকে চারটি দলে ভাগ করে দেয়া হলো একটি দলের দায়িত্ব ছিলো মাস্টার দা নিজে, অপর দলগুলোর দায়িত্ব ছিলো যথাক্রমে অম্বিকা চক্রবর্তী, অন্তত সিং ও গণেশ ঘোষ এবং নির্মল সেন। তাছাড়া দলগুলো বিভিন্ন উপদলেও বিভক্ত ছিল। চারটা বাড়ি হতে চারটা দল আক্রমণের জন্য বের হয়। সে রাতেই ধুম রেলস্টেশনে একটা মালবহনকারী ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে উল্টে যায়। একদল বিপ্লবী আগে থেকেই রেল লাইনের ফিসপ্লেট খুলে নেয়। এর ফলে চট্টগ্রাম সমগ্র ভারতবর্ষ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। অন্য একটি দল চট্টগ্রামের নন্দনকাননে টেলিফোন এবং টেলিগ্রাফ অফিস আক্রমণ করে। হাতুড়ি দিয়ে তারা সব যন্ত্রপাতি ভেঙ্গে দেয় এবং পেট্রোল ঢেলে সেখানে আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হয়। আরেকটি দল পাহাড়তলীতে অবস্থিত চট্টগ্রাম রেলওয়ে অস্ত্রাগার দখল করে নেয়। উন্নতমানের রিভলবার ও রাইফেল গাড়ীতে নিয়ে অস্ত্রাগারটি পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগানো হয়। তবে সেখানে কোনো গুলি পাওয়া যায়নি। সর্বশেষ পরিকল্পনা অনুযায়ী বিপ্লবীরা দামপাড়ায় পুলিশ রিজার্ভ ব্যারাক দখল করে নেয়। এই আক্রমণে অংশ নেয়া বিপ্লবীরা দামপাড়া পুলিশ লাইনে সমবেত হয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। সামরিক কায়দায় কুচকাওয়াজ করে সূর্য সেনকে সংবর্ধনা দেয়।

কয়েক দিন পরে, পুলিশ বিপ্লবীদের অবস্থান চিহ্নিত করে। ২২ এপ্রিল ১৯৩০ সালে চট্টগ্রাম  জালালাবাদ পাহাড়ে আশ্রয় নেয়া বিপ্লবীদের কয়েক হাজার সৈন্য ঘিরে ফেলে । দুই ঘন্টার প্রচন্ড যুদ্ধে ব্রিটিশ বাহিনীর ৭০ থেকে ১০০ জন এবং বিপ্লবী বাহিনীর নরেশ রায়ত্রিপুরা সেনগুপ্তবিধুভূষণ ভট্টাচার্যহরিগোপাল বলমতিলাল কানুনগোপ্রভাস চন্দ্র বলশশাঙ্কশেখর দত্তনির্মল লালা, জিতেন দাসগুপ্ত, মধুসূদন দত্তপুলিনচন্দ্র ঘোষ, এবং অর্ধেন্দু দস্তিদার শহীদ হন। জালালাবাদ পাহাড়ের যুদ্ধে অংশ নিয়েও মাস্টারদা সহ বাকি বিপ্লবীরা পালিয়ে যেত সক্ষম হন।

কার্যত, ১৮ এপ্রিল থেকে ২২ এপ্রিল পর্যন্ত চট্টগ্রাম বাকি সমগ্র ভারতবর্ষ থেকে বিছিন্ন থাকে, আর ভারতবর্ষে সর্বপ্রথম স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহণ করে যদিও এ স্বাধীনতা বেশি স্থায়ী হয়নি। চট্টগ্রাম আজও শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করে এযুদ্ধে সকল শহীদের।

 

Leave A Reply
1 Comment
  1. Vdneou says

    prandin for sale online – jardiance 10mg usa pill jardiance 10mg

sativa was turned on.mrleaked.net www.omgbeeg.com

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More