যে যুদ্ধের ফলাফল এখনো প্রশ্নবিদ্ধ

0

সম্রাট শাহজাহানের ঘোরতর অসুস্থতার সময় একমাত্র দারাশিকোহই ছিলেন সম্রাটের পাশে। এ সময় আওরঙ্গজেব দাক্ষিনাত্যে, সুজা বাংলায় ও মুরাদ গুজরাটে অবস্থান করছিলেন। ফলে সম্রাট শাহজাহান দারাশিকোহকেই যোগ্য হিসেবে বিবেচনা করে উত্তরাধিকারী ঘোষণা করেন। এদিকে সম্রাটের অসুস্থতার সুযোগে গোটা সাম্রাজ্যে বিশৃঙ্খলতার সৃষ্টি হলো। প্রতিদ্বন্দ্বী সিংহাসনপ্রার্থী  অন্যান্য ভাইদের মনে স্বভাবতই সন্দেহের উদ্রেক হচ্ছিলো যে, তাঁদের পিতা সম্রাট শাহজাহানের মৃত্যু ইতঃপূর্বেই ঘটেছে এবং দারাশিকোহ সে খবর সিংহাসন হারানোর ভয়ে গোপন রেখেছেন। এর ফলে মুঘল সিংহাসন নিয়ে ভ্রাতৃযুদ্ধের অবতারণা হলো এবং সাম্রাজ্যের সর্বত্র সম্রাট শাহজাহানের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লো।

সর্বপ্রথম সুজা বাংলাদেশে ও মুরাদ গুজরাটে রাজকীয় উপাধি ধারণ করে দিল্লীর প্রভুত্ব অস্বীকার করলো। বাংলাদেশের রাজধানী রাজমহলে সুজা নিজেকে সম্রাট বলে ঘোষণা করে আগ্রা অভিমুখে অগ্রসর হয়ে ১৬৫৮ খ্রিস্টাব্দে বেনারসে পৌঁছালে দারাশিকোহর পুত্র সুলায়মান শিকোহ মীর্জা রাজা জয়সিংহের সাহায্যে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়ে তিনি বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করতে বাধ্য হন।

 

দুই ভাইয়ের ষড়যন্ত্র : আওরঙ্গজেব ও মুরাদের যুদ্ধজয়

এদিকে, মুরাদ আহমদাবাদে নিজেকে সম্রাট বলে ঘোষণা দিলেও আওরঙ্গজেব পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করলেন। যোগাযোগ রাখতে শুরু করলেন বোন জাহান-আরার সাথে। শাহান আরা আওরঙ্গজেবের পক্ষে এবং জাহান-আরা দারাশিকোহর পক্ষে ছিলেন এই যুদ্ধে। ধীর-স্থির ও কূটনৈতিকভাবে বিচক্ষণ আওরঙ্গজেব কৌশলে ছোটভাই মুরাদকেও নিজ দলে রাখলেন এবং মালব নামক একটি স্থানে একত্রিত হয়ে একটি শান্তিচুক্তি করলেন। এই চুক্তির শর্তগুলো ছিলো-

১. লুণ্ঠিত দ্রব্যের এক-তৃতীয়াংশ মুরাদ ও দুই-তৃতীয়াংশ আওরঙ্গজেব পাবেন

২. সাম্রাজ্য অধিকারের পর পাঞ্জাব, সিন্ধু, কাশ্মীর ও আফগানিস্তানে মুরাদের প্রাধান্য স্থাপিত হবে এবং ঐ স্থানে তিনি নিজেকে রাজা বলে ঘোষণা করতে পারবেন

বলপূর্বক সিংহাসন দখল করার কোনো ইচ্ছা আওরঙ্গজেবের ছিলো না। কিন্তু জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা দারাশিকোহর চক্রান্তের দরুণ তাঁকে আত্মরক্ষায় অস্ত্রধারণব্রতী হতে হয়েছিলো বলে কোনো কোনো ঐতিহাসিক মনে করেন। আওরঙ্গজেব ও মুরাদের যুগ্ম সেনাবাহিনী উজ্জয়িনীর নিকটবর্তী ধর্মাট নামক স্থানে উপস্থিত হলে সম্রাট শাহজাহানের আদেশে রাজা যশোবন্ত সিংহ এবং কাশিম খান তাঁদের বাধা দেন।

তবে বাধা দেওয়া সত্ত্বেও আওরঙ্গজেবের সেনাবাহিনী পিছু না হটে যশোবন্ত সিংহের সেনাবাহিনীকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করলেন। মুঘল বাহিনী পরাজিত হলে যশোবন্ত সিংহ মারওয়ার অন্তর্গত যোধপুরে পলায়ন করেন। এই যুদ্ধে জয়লাভের ফলে আওরঙ্গজেবের ক্ষমতা, মর্যাদা ও প্রতিপত্তি আরও বৃদ্ধি পায় এবং ক্রমে তিনি শক্তিশালী হয়ে উঠলেন। দাক্ষিনাত্যের যুদ্ধের বীর ও ধর্মাট এর যুদ্ধের বিজয়ী আওরঙ্গজেবকে সাময়িকভাবে সুখ্যাতি এনে দেয় যেখান থেকে তিনি পরবর্তীতে ভারতের ইতিহাসে ‘অপ্রতিদ্বন্দ্বী শাসক’ হিসেবে মর্যাদা পান। এদিকে মুঘলদের এই পরাজয় মেনে না নিয়ে দারাশিকোহ পঞ্চাশ হাজার সেনাবাহিনী নিয়ে সামুগড়ের যুদ্ধে অগ্রসর হন। এই যুদ্ধে আওরঙ্গজেব ও মুরাদ গোয়ালিওরের দিকে অগ্রসর হয়ে ‘চাম্বল’ অতিক্রম করে সামুগড়ের যুদ্ধের ময়দানে সমবেত হন। এই যুদ্ধে রাজপুত নেতা রামসিংহ, মুঘল সেনাপতি খলিলউল্লাহ খান দারাশিকোহর পক্ষাবলম্বন করেন। দারাশিকোহর কনিষ্ঠ পুত্র সিপ্হির শিকোহও এই যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিলেন। আওরঙ্গজেব ও মুরাদ এই যুদ্ধে অত্যন্ত সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন। উভয় পক্ষে তুমুল যুদ্ধের এক পর্যাযে দুর্ভাগ্যজনকভাবে দারাশিকোহর হাতি তীরবিদ্ধ হলে হতাশ দারাশিকোহ হাতির পিঠ থেকে নেমে ঘোড়ার পিঠে যুদ্ধ করেন। ফলে মুঘল বাহিনী দারাশিকোহর মৃত্যু ঘটেছে অনুমান করে বিশৃঙ্খল হয়ে পড়লো। দারাশিকোহ হতাশ ও সন্ত্রস্ত অবস্থায় আগ্রায় পলায়ন করলেন।

 

দারাশিকোহ ও আওরঙ্গজেবের মধ্যে বিরোধের সূত্রপাত

সম্রাট শাহজাহান সবসময় দারাশিকোহকে অন্ধভাবে ভালোবেসেছেন এবং মনে মনে তাঁকেই উত্তরাধিকারী মনোনীত করেছিলেন। সেই কারণে আওরঙ্গজেবের প্রতি অবিচার করা হয়ে থাকতে পারে বলে তিনি বরাবরই দারাশিকোহর প্রতি ক্রোধান্বিত থাকতেন। এছাড়া দারাশিকোহ ইসলাম ধর্ম নিয়ে প্রায় কটাক্ষ করতেন আওরঙ্গজেবের সাথে। এমনকি আওরঙ্গজেব নামাযে দাঁড়ালে তিনি প্রায়ই ‘ফকির’ বলে খেপাতেন। এই কারণে আওরঙ্গজেবের মনে দারাশিকোহর প্রতি ঘৃণার উন্মেষ ঘটেছিলো। এছাড়াও দারাশিকোহর কুমন্ত্রণায় সম্রাট শাহজাহান তাঁকে তিক্ত ভাষায় চিঠি লিখলে এই চিঠির প্রভাব তাঁর মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে ছিলো। বিদ্যানুরাগী দারাশিকোহ বেদান্ত দর্শন, সূফি দর্শন, বাইবেল, ওল্ড টেস্টামেন্ট (ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থ) প্রভৃতি বিষয়ে জ্ঞানার্জন করলেও গোঁড়া ধর্মানুসারী সুন্নীদের বিরাগভাজন হয়েছিলেন। এদিক দিয়ে আওরঙ্গজেব গোঁড়া সুন্নী মুসলিম হওয়ায় গোঁড়া ধর্মানুসারীদের সমর্থন পেয়েছিলেন। তবে উদ্ধত ব্যবহার ও রুক্ষ মনোভাবের কারণে অভিজাতবর্গের কাছে তিনি ছিলেন বিরক্তির কারণ। দারাশিকোহর গোঁড়া সুন্নী মুসলিমদের বিরোধিতা ও অসন্তুষ্ট আমীর-ওমরাহদের মনঃক্ষুণ্নভাব উত্তরাধিকার যুদ্ধে দারাশিকোহর সিংহাসন লাভের সম্ভাবনা বহুলাংশে হ্রাস করে। এছাড়াও সবসময় পিতৃস্নেহে থাকার কারণে দারাশিকোহর মধ্যে যুদ্ধবিগ্রহের পারদর্শীতা, জীবনে দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষের অভিজ্ঞতা ও দৃঢ় ব্যক্তিত্বের অভাব ঘটেছিলো। তিন পুত্র তিন প্রদেশের শাসনকর্তা ছিলেন; শাহজাহান দারাশিকোহকে রাজদরবার থেকে দূরে রাখতে অনিচ্ছুক ছিলেন। এই অতিরিক্ত পিতৃবাৎসল্যের কারণে দারাশিকোহর মধ্যে যুদ্ধ ও শাসনকার্যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের সুযো্গ হয়ে উঠছিলো না। কোনো কোনো ঐতিহাসিক মনে করেন, সম্রাট শাহজাহান দারাশিকোহকে ‘আদুরে দুলালে’ পরিণত করেছিলেন।

 

শাহজাহানের অন্যান্য পুত্র : সুজা ও মুরাদ

সম্রাট শাহজাহনের দ্বিতীয় পুত্র বাংলার শাসনকর্তা সুজা ছিলেন তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন সুদক্ষ, সাহসী যোদ্ধা। তবে তিনি ছিলেন আরামপ্রিয়। অতিরিক্ত বিলাসিতা ও অলসতা তাঁকে দূর্বল ও অকর্মণ্য করে তুলেছিলো।

তৃতীয় পুত্র আওরঙ্গজেব ছিলেন দাক্ষিণাত্যের শাসনকর্তা। দাক্ষিণাত্যের যুদ্ধে বীরত্বের পরিচয় দিলে তাঁকে দাক্ষিণাত্যের শাসনকর্তা হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। তিনি ছিলেন কূটনৈতিক ক্ষমতাসম্পন্ন ও ধর্মনুরাগী।

সর্বকনিষ্ঠ পুত্র মুরাদ গুজরাটের শাসনকর্তা ছিলেন। তিনি স্পষ্টবাদী, সরল, উদারমনা, সাহসী ও বীরযোদ্ধা হলেও মাদকাসক্তি তাঁকে অকর্মণ্য করে তুলেছিলো।

 

সামুগড়ের যুদ্ধের ফলাফল

কোনো ঐতিহাসিক মনে করেন, সেনাপতি খলিলউল্লাহ খানের ধূর্ত পরামর্শে দারা পরাজয় বরণ করেছিলেন। অবশ্য দারার পরাজয়ের এটাই একমাত্র কারণ ছিলো না। প্রকৃতপক্ষে তাঁর সেনাপতিদের সামরিক দক্ষতার অভাব পরাজয়ের দিকেই ঠেলে দিয়েছিলো দারাকে। এই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আওরঙ্গজেব ভারতের সিংহাসন হাসিল করতে সমর্থ হন। ফলে সম্রাট শাহজাহান ১৬৫৮ খ্রিস্টাব্দের ৮ জুন ক্ষমতাচ্যুত হন এবং কারাবরণ করেন। আওরঙ্গজেব এসময় আগ্রা দুর্গ অধিকার করেন। বৃদ্ধ পিতা শাহজাহান ও বোন জাহান-আরার অনুরোধ সত্ত্বেও আপোষ-মীমাংসার পথে এগোলেন না। তিনি বৃদ্ধ পিতাকে সাধারণ বন্দিদের ন্যায় কারারুদ্ধ করে সিংহাসন অধিকার করেন।

এদিকে, মুরাদ আওরঙ্গজেবের কার্যাবলীতে সন্দিগ্ধ হয়ে ঈর্ষান্বিত হয়ে ওঠেন। আগ্রা অধিকার করে আওরঙ্গজেব দিল্লীর দিকে অগ্রসর হন এবং পথিমধ্যে মুরাদের বিপক্ষতা দমন করার জন্য দৃঢ়সংকল্প করলেন এবং সাক্ষাৎ যুদ্ধে অগ্রসর হয়ে তাঁকে বন্দি করতে সমর্থ হন। হতভাগ্য মুরাদ প্রথমে সালিমগড় দুর্গে বন্দি হলেন এবং ১৬৫৯ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে গোয়ালিয়র দুর্গে স্থানান্তরিত করা হয়। দেওয়ান আলী নকিকে হত্যা করার অভিযোগে ১৬৬১ খ্রিস্টাব্দে আওরঙ্গজেবের আদেশে মুরাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।

সামুগড়ের যুদ্ধে পরাজিত হয়ে দারা আগ্রা থেকে দিল্লীতে পৌঁছেছিলেন। আওরঙ্গজেবের ক্ষমতা গ্রহণ ও বৃদ্ধ পিতা শাহজাহানের বন্দি অবস্থার সংবাদ পেয়ে তিনি লাহোরে যান। ধর্মাট ও সামুগড়ের যুদ্ধে দারার পরাজয়ে উৎসাহিত হয়ে সুজাও ক্ষমতা গ্রহণের জন্য সচেষ্ট হলেন। কিন্তু সুজাও আওরঙ্গজেবের হাত থেকে রক্ষা পেলেন না। ১৬৫৯ খ্রিস্টাব্দে এলাহাবাদের নিকট খাজওয়ার যুদ্ধে সুজা আওরঙ্গজেবের নিকট শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়ে বাংলার শাসনকর্তা মীর জুমলার দ্বারস্থ হলে মীর জুমলা তাঁকে আশ্রয় দেন এবং পরবর্তীতে তিনি আরাকান পার্বত্য অঞ্চলে সপরিবারে চলে যান। এরপর আর তাঁর সম্পর্কে কিছু জানা যায় না। খুব সম্ভবত তিনি আরাকানে সপরিবারে নিহত হয়েছিলেন। শোনা যায়, বাংলার শাসনকর্তা মীর জুমলার সাথে আওরঙ্গজেবের পুত্র মুহম্মদ কলহে লিপ্ত হলে তিনি সুজার পক্ষাবলম্বন  করেন। কিন্তু শাহজাদা মুহম্মদ আমৃত্যু কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন এবং ১৬৭৫ খ্রিস্টাব্দে মারা যান।

 

সুলায়মান শিকোহকে হত্যা

দারাশিকোহর ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলো না। এমতাবস্থায় দারার পুত্র সুলায়মান শিকোহকে কেউ সমর্থন করলো না। ফলে সুলায়মান স্থানান্তরে ঘুরে সপরিবারে গাড়োয়ালসহ পার্বত্য অঞ্চলে হিন্দু রাজার নিকট আশ্রয় গ্রহণ করেন। কিন্তু রাজা জয়সিংহের পুত্র রামসিংহ কতৃক তিনি ধৃত হয়ে ১৬৬১ খ্রিস্টাব্দে সলিমগড় দুর্গে প্রেরিত হলেন।

বন্দি শাহজাদাকে শৃঙ্খলিত অবস্থায় রাজদরবারে আওরঙ্গজেবের নিকট উপস্থিত করা হলে তিনি অবনত মস্তকে প্রার্থণা করেন যে, তিনি ‘পোস্ত’ দ্বারা ধীরে ধীরে বিষ প্রয়োগ অপেক্ষা অবিলম্বিত মৃত্যু শ্রেয় মনে করেন। আওরঙ্গজেব তাঁকে ‘পোস্ত’ দ্বারা বিষ প্রয়োগ করা হবে না বলে আশ্বস্ত করেন এবং পরের দিন গোয়ালিয়রে পাঠালেন। কিন্তু অবশেষে তাঁকে ‘পোস্ত’ (পানীয় বিষ) প্রয়োগ করে ১৬৬২ খ্রিস্টাব্দে হত্যা করা হলো। তবে দারার কনিষ্ঠ পুত্র সিপ্হির শিকোহ ও মুরাদের পুত্র ইজিদ কোনো শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী না হওয়ায় তাঁদের প্রাণরক্ষা পায়। আওরঙ্গজেবের কড়া নজরে তাঁরা লালিতপালিত হন এবং বয়ঃপ্রাপ্তির পর সিপ্হির শিকোহর সাথে তাঁর তৃতীয় কন্যা এবং ইজিদের সাথে তাঁর পঞ্চম কন্যার বিয়ে দেওয়া হয়।

এদিকে দারা আশ্রয়ের জন্য লাহোর থেকে গুজরাটে চলে আসেন। গুজরাটের শাসনকর্তা শাহনেওয়াজ খান দারাকে অভ্যর্থনা দিয়ে প্রভূত অর্থ সাহায্য করেন। উৎসাহিত হয়ে দারা বিজাপুর ও গোলকুণ্ডার শিয়া মুসলমানদের সাথে যোগদান করে আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে মনস্থ হন। এই সময় আওরঙ্গজেবের সমর্থক রাজপুত নেতা যশোবন্ত সিংহ দারাকে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিলে দারা তাঁর দাক্ষিণাত্য যাওয়ার পরিকল্পনা বাতিল করে আজমীরের দিকে অগ্রসর হন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যশোবন্ত সিংহ দারার সাথে বিশ্বাসঘাততা করে কোনো সাহায্যই করলেন না। এদিকে আওরঙ্গজেব সসৈন্যে দ্রুত অগ্রসর হলেন। এমতাবস্থায় দারাকে কোনো ধরণের প্রন্তুতি ছাড়াই যুদ্ধে যেতে হলো। ১৬৫৯ খ্রিস্টাব্দে আজমীরের সন্নিকটে দেওয়ায় যুদ্ধে দারাশিকোহ শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়ে আত্মরক্ষার্থে শীঘ্র পলায়ন করলেন। স্থানে হতে স্থানান্তরে রাজপুতনা, সিন্ধু প্রদেশে জয়সিংহ ও বাহাদুর খানের নেতৃত্বে আওরঙ্গজেবের সেনাবাহিনী দ্বারা পশ্চাদ্ধাবিত হয়ে দারা কোথাও আশ্রয় পেলেন না। ফলে দারা সপরিবারে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ অতিক্রম করার পথে বোলন-গিরিপথের নয় মাইল পূর্বে দদর নামক স্থানে আফগান দলপতি জিওয়ান ভানের নিকট আশ্রয় প্রার্থণা করেন। এই জিওয়ান খানকে একবার দারা মৃত্যুদণ্ড থেকে রক্ষা করেছিলেন। দারার স্থান-স্থানান্তরে ঘুরে বেড়ানোর সময় তাঁর স্ত্রী নাদিরা বেগম তাঁর সাথে সবসময় ছিলেন। কিন্তু এখানে তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা ঘটলো। নাদিরা বেগম উদরাময় রোগে আক্রান্ত হয়ে বিশ্রামের অভাবে এখানে মারা যান। ফলে দারাশিকোহ গভীরভাবে আহত হন এবং মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। এই সময় জিউয়ান খান দারাকে পুত্র-কন্যসহ মুঘলদের হাতে সমর্পন করেন। বাহাদুর খান দারাকে বন্দি অবস্থায় দিল্লীতে নিয়ে আসেন এবং অবর্ণনীয়ভাবে অপমান করেন।

 

দারাশিকোহ ও শাহজাহানের মৃত্যু

দারাশিকোহকে অপমান করার ফলাফল হিসেবে দিল্লীতে দাঙ্গা-হাঙ্গামার সূত্রপাত হওয়ার আশংকায় আওরঙ্গজেব দারার বিলম্বিত মৃত্যুদণ্ড কার্যকর অনুচিত মনে করে এবং মালিক জিউয়ান খানের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে বিশৃঙ্খলার আশংকায় ১৬৫৯ খ্রিস্টাব্দের ৩০ আগস্ট ইসলাম ধর্মের বিরোধিতা ও স্বধর্ম ত্যাগের অপরাধে আওরঙ্গজেবের আদেশে কারারুদ্ধ দারার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।

এদিকে শাহজাহান আট বছর কারারুদ্ধ ছিলেন। সেসময় তাঁর সাথে ছিলেন তাঁর কন্যা জাহান-আরা বেগম। শাহজাহান কারারুদ্ধ অবস্থায়ও পুত্র আওরঙ্গজেবের দুর্ব্যবহার থেকে মুক্ত হতে পারেন নি। তিনি কারাগারে সাধারণ বন্দির সুযোগসুবিধা থেকেও বঞ্চিত ছিলেন। যমুনা নদী থেকে জল সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ার ফলে তাঁকে পাতকুয়া হতে নোনা জল দিয়ে তৃষ্ণা ‍নিবারণ করতে হয়েছিলো। দীর্ঘ আট বছরের কারাগারে পুত্র আওরঙ্গজেবের নিষ্ঠুর নির্যাতন সহ্য করার পর শাহজাহান ৭৪ বছর বয়সে ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দের ২২ জানুয়ারী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। পিতার মৃত্যুতে জাহান-আরা বেগম যেরূপ মর্মাহত হয়েছিলেন তা ছিলো কল্পনাতীত।

Leave A Reply
sativa was turned on.mrleaked.net www.omgbeeg.com

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More