“মনের কথা বলবো কারে,
কে আছে সংসারে।
আমি ভাবি তাই,
আর না দেখি উপায়
কার মায়ায়
বেড়াই ঘুরে।।”
জীবনের অধিকাংশ সময় গানে গানে মনের ভাব, কৌতুহল, দর্শন এভাবেই প্রকাশ করেছেন “লালন সাঁই”। জন্মটা হিন্দু ঘরে হলেও মুসলিম পরিবারের সেবা-শুশ্রূষায় তিনি আরোগ্য লাভ করেছিলেন। । মৃত্যুর আগে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন তাঁর নিজস্ব জীবন-দর্শন। তিনি তাঁর জীবদ্দশায় জাত-ধর্ম-বর্নের উর্ধ্বে গিয়ে মানুষের জয়গান গেয়েছেন। সেজন্যই হয়তো তিনি বলে গেছেন,
“আসবার কালে কি জাত ছিলে
এসে তুমি কি জাত নিলে।
কি জাত হবা যাবার কালে
সেই কথা ভেবে বলো না।।”
লালনের জন্মসাল নিয়ে অনেক তর্ক-বিতর্ক আছে। লালন কখনও তাঁর জন্মের কথা প্রকাশ করেন নি। তবে ধারনা করা হয় “১৭৭৪ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার (বর্তমান বাংলাদেশের) ঝিনাইদহ জেলার হরিণাকুণ্ড উপজেলার হারিশপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন”। কোন কোন লালন গবেষক মনে করেন, “লালন কুষ্টিয়ার কুমারখালী থানার চাপড়া ইউনিয়নের অন্তর্গত ভাড়ারা গ্রামে লালনের জন্ম”।
লালন যৌবনের প্রাক্কালে সংসারী ছিলেন। তাঁর স্ত্রীও ছিলো। একদিন পুণ্য লাভের আশায় লালন মুর্শিদাবাদ জেলার বহররমপুরে গঙ্গাস্নানে যান। ফেরার পথে হঠাৎ বসন্ত রোগে আক্রান্ত হন তিনি। সেখানকার রাস্তাঘাটা তেমন ভালো ছিলোনা। দুর্ঘটনা-বশত লালন হঠাৎ জ্ঞান হারিয়ে ফেললে তাঁর সঙ্গীরা তাঁকে মৃত ভেবে মুখাগ্নী করে নদীর জলে ভাসিয়ে দেয়। ভাসতে ভাসতে নদীর ধারে এক রমনীর চোখে পড়েন তিনি। পরবর্তিতে এক মুসলিম কারিগর পরিবারের সেবা-শশ্রুষায় তিনি আরোগ্য লাভ করেন। এরপর লালন তাঁর পরিবারের কাছে ফিরে আসলে তাঁকে গ্রহন করেনি তাঁর পরিবার, তাঁর সমাজ। মুসলিম ঘরে ভাত খাওয়ায় তাঁর জাত নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। মনের দু:খে লালন তাঁর সমাজ, ধর্ম ত্যাগ করে কাহার সম্প্রদায়ের সাধক পুরুষ ‘সিরাজ সাঁই’ এর দীক্ষা লাভ করেন।
লালনের জীবন দর্শন ছিলো মানুষকে ঘিরে, মানবতাকে ঘিরে। তাঁর গানে মানবতার কথা ফুটে উঠত। তাই ধারনা করা হয় লালনের ধর্ম একটাই। আর তা হলো ‘মানবধর্ম’। মানবধর্মে নির্দিষ্ট জাত, ধর্ম, সমাজের উর্ধ্বে গিয়ে মানুষের কথা বলা হয়, মানবতার কথা বলা হয়। লালনের গানগুলোতেই এ ধারনা পাওয়া যায়।
যেমন তিনি বলে গেছেন,
“জাত গেল জাত গেল বলে
একি আজব কারখানা।
সত্য কাজে কেউ নয় রাজি
সবই দেখি তা না না না।।
আসবার কালে কি জাত ছিলে
এসে তুমি কি জাত নিলে।
কি জাত হবা যাবার কালে
সেই কথা ভেবে বলো না।।”
আরেকটি গানেতো সরাসরিই বলেছেন,
‘‘এমন সমাজ কবে গো সৃজন হবে।
যেদিন হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান
জাতি গোত্র নাহি রবে।।
লালনকে ভুল করে অনেকেই অবিশ্বাসী বা নাস্তিক বললেও সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসী ছিলেন লালন। গানে গানে সৃষ্টিকর্তাকে ‘পড়শি, মনের মানুষ’ সহ বিভিন্ন নামে ডেকেছেন। “সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্য পাওয়া সাধনার ব্যপার।’’ গানে গানে একথাই কি বোঝাতে চেয়েছেন লালন?!
তাঁর একটি গান হচ্ছে,
‘‘মিলন হবে কত দিনে,
আমার মনের মানুষেরও সনে।।”
মূলত লালনের গানের মূল সংগ্রাহক ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর কিছু গানে লালনের গানের প্রভাব সুস্পষ্ঠ। তেমনি কবি কাজী নজরুল ইসলামও লালনের দর্শনে প্রভাবিত ছিলেন। এছাড়াও আমেরিকান কবি এলেন গিন্সবার্গ লালনকে নিয়ে ‘After Lalon’ শিরোনামে একটি কবিতা রচনা করেন। কবিগুরুর ভ্রাতা “রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর” ১৮৮৯ সালের ৫ মে লালনের একটি পেন্সিল-স্কেচ আঁকেন। অনেকের ধারনা এই স্কেচে লালনের আসল চেহারা ফুটে ওঠেনি।
লালনকে নিয়ে ছোটগল্প, উপন্যাস, চলচ্চিত্র সৃষ্টি করা হয়েছে। পরিচালক গৌতম ঘোষ সুনীল গঙ্গোপধ্যায়ের রচিত উপন্যাস ‘মনের মানুষ’ এর আলোকে চলচ্চিত্র নির্মান করেছেন। এছাড়াও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত উপন্যাস “গোরা” শুরু হয় লালনের গান দিয়ে। সেখানে বলা হয়,
“খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়’’।
১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে সুনির্মল বসু “লালন ফকিরের ভিটে” নামে একটি ছোট গল্প রচনা করেন। শওকত ওসমান ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে রচনা করেন “দুই মুসাফির” নামের একটি ছোটগল্প।
১৮৯০ সালের ১৭ই অক্টোবর লালন ১১৬ বছর বয়সে কুষ্টিয়ার কুমারখালির ছেউড়িয়াতে নিজ আখড়ায় লালনের আত্না দেহ ত্যাগ করে। মৃত্যুর আগে তিনি তাঁর শিষ্যের উদ্দেশ্যে বলেন, “আমি চলিলাম”। এর কিছুক্ষন পরই তিনি পৃথিবী থেকে বিদায় নেন।
“আমি চলিলাম” বলে লালন তাঁর গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলেন ঠিকই, তবে রেখে গেছেন তাঁর সৃষ্টিগুলো। যেগুলো আপনাকে কখনো কখনো কাঁদিয়ে ছাড়বে। কখনো ভাবতে বাধ্য করবে আপনি কে, কোথা থেকে এসসছেন, আপনার গন্তব্যই বা কি!!! লালন সম্পর্কে জানতে হলে, তাঁকে বুঝতে হলে কোন “আর্টিকেল, গল্প, উপন্যাস কিংবা চলচ্চিত্র”- এসবের কিছুই আপনার জন্য যথেষ্ট নয়। আপনাকে তাঁর গানগুলো শুনতে হবে, গানের অর্থ বুঝতে হবে। তবে বাংলাদেশে যেহেতু জন্মেছেন, একদিন সময় করে ঘুরে আসুন কুষ্টিয়া থেকে। কুষ্টিয়ায় লালনের আখড়ায় বাউল সমাজের সাথে মিশে একই সাথে লালনের গান, মানবাত্না, লালন ও বাউল সমাজের ধর্ম ও দর্শন সম্পর্কে কিছুটা হলেও ধারনা পাবেন।
সাম্প্রদায়িকেরা যতই লালনের সমালোচনা করুকনা কেনো লালন ছিলেন একজন অসাম্প্রদায়িক দার্শনিক। অসাম্প্রদায়িকতাকে পুঁজি করে তিনি পরমাত্নাকে, স্রষ্টাকে খুঁজেছেন গানে গানে……..
“বাড়ীর কাছে আরশী নগর
সেথা এক পড়শী বসত করে
আমি এক দিনও না দেখিলাম তারে ।।
বিরাম বেড়ে অগাধ পানি
নাই কিনারা নাই তরণী পাঁড়ে,
বাঞ্ছা করে দেখবো তারি
কেমনে সেথায় যায়রে।।
কি বলবো পরশীর
হস্ত পদ স্কন্ধ মাথা নাইরে,
ক্ষনিক থাকে শূন্যের উপর ক্ষনিক ভাসে নীড়ে
আমি একদিন ও না দেখিলাম তারে ।।
পড়শী যদি আমায় ছুঁতো
যম যাতনা সকল যেত দূরে,
সে আর লালন এক খানে রয়
লক্ষ যোজন ফাঁক রে।।”
তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া, “Folklore II, 1961”, “Poet Saints of India – Sumita Roy – Google Books”, “Lalon Shah – the Mystical Poet”, “মনের মানুষ (চলচ্চিত্র)”, “Prothom Alo Blog”.
when does wellbutrin go generic
zyprexa sleep aid
zofran dystonic
buy glycomet without a prescription – order generic glucophage 1000mg precose for sale