স্নায়ুযুদ্ধের শুরুর দিকে ১৯৫০ সালের ১৫ জুন ছিল ইতিহাসের আরেকটি বিধ্বংসী যুদ্ধের সূচনা। উত্তর কোরিয়ান পিপলস আর্মির প্রায় ৭৫,০০০ হাজার সৈন্য ৩৮ ডিগ্রি অক্ষরেখা ভেদ করে দক্ষিণ কোরিয়ায় আচমকা আক্রমণ করে বসে। স্নায়ুযুদ্ধের সময় এটাই ছিল প্রথম কোন যুদ্ধ। উত্তর কোরিয়ার পক্ষে ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন আর অপরপক্ষে দক্ষিণ কোরিয়া সাপোর্টে ছিল ইউএস ঘেঁষা পশ্চিমামুখী। যুক্তরাষ্ট্র এটাকে সমাজতন্ত্রের আগ্রাসী পদক্ষেপ হিসেবে দেখে এবং দক্ষিণ কোরিয়ার সাহায্যে এগিয়ে আসে। তবে যুক্তরাষ্ট্র এটাও ভয় পাচ্ছিল যে, এই যুদ্ধ কিনা আবার রাশিয়া ও চায়না এবং অন্যান্য বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যে ছড়িয়ে যায়। অনেকে এটাকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হবার আশঙ্কা করেছিল। কিন্তু জতিসংঘের হস্তক্ষেপে ১৯৫৩ সালে আর্মেস্টিক চুক্তির মাধ্যমে এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। এই সংক্ষিপ্ত যুদ্ধে প্রায় ৫০ লক্ষ্য সৈন্য ও সাধারণ মানুষ মারা যায়।
বিভক্ত কোরিয়ার ইতিহাস:
বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকেই কোরিয়ান উপদ্বীপ জাপান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। কিন্তু সমস্যাটা বাঁধে তখন যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে কোরিয়াকে নিয়ে জাপানের দুই শত্রু দেশ যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত রাশিয়া এক দরকষাকষিতে অবতীর্ণ হয়। ১৯৪৫ সালের আগস্টে উভয় দেশের দুইজন তরুণ মিলিটারি অফিসার ৩৮ ডিগ্রি অক্ষরেখা বরাবর কোরিয়াকে ভাগ করে নেয়। দক্ষিণের অংশ দখল করে নেয় আমেরিকা আর উত্তরের অংশ সোভিয়েতের ভাগে। এরপরই উত্তরে গড়ে উঠে সোভিয়েত মদদপুষ্ট কমিউনিস্ট শাসন ব্যবস্থা। বর্তমানের উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম জং উনের বাবা কিম দ্বিতীয় সাং সোভিয়েত রাশিয়ার সাহায্য পেয়ে নিজের শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকে। যদিও দক্ষিণ কোরিয়া প্রথম দিকে যুক্তরাষ্ট্রের এতো সাহায্য পায়নি। তবে উত্তর কোরিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে দ্বন্দ্ব লেগেই ছিল। এমনকি যুদ্ধ শুরু হবার আগে বর্ডার কিলিংএ পাঁচ বছরে উত্তর-দক্ষিণের মিলিয়ে প্রায় দশ হাজার সৈন্য মারা যায়।
কোরিয়ান যুদ্ধ ও স্নায়ু যুদ্ধ:
এটা বলে রাখা ভালো যে স্নায়ুযুদ্ধের আমলের প্রথম অঘটন ছিল কোরিয়ান যুদ্ধ। উত্তর কোরিয়ার আচমকা আক্রমণ যুক্তরাষ্ট্রকে হতবাক করেছিল। যুক্তরাষ্ট্র এটাকে একটা মামুলি বিচ্ছিন্ন বর্ডার দ্বন্দ্ব হিসেবে না ভেবে এটাকে একটা বৈশ্বিক ঘটনা বলেই ধরে নেয়। আমেরিকানরা এটাকে প্রথমেই সোভিয়েত ইউনিয়নের আগ্রাসন হিসেবেই ধরে নেয়। ইতিমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র সিকিউরিটি কাউন্সিল পৃথিবীর যেখানেই সোভিয়েত আগ্রাসন চলবে সেখানেই “কন্টেইনমেন্ট” অর্থাৎ সোভিয়েতকে আটকানো বা প্রতিরোধের স্ট্রাটেজি হাতে নেয়। ট্রুম্যান এভাবেই বর্ণনা করেছিলেন যে, আমরা যদি তাদের (কমিউনিস্ট) বাড়তে দেই তাহলে তারা একের পর এক দেশ দখল করে নেবে। দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউল যখন আক্রান্ত হয় যুক্তরাষ্ট্র তখন কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে তার সৈন্য যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করেন।
যুদ্ধের প্রথমদিকে দক্ষিণ কোরিয়ার স্ট্রাটেজি ছিল রক্ষণাত্মক যাতে করে উত্তর কোরিয়ার সৈন্যদের ঠেকিয়ে রাখা যায়। বস্তুত এই কৌশল আরো দক্ষিণ কোরিয়ার জন্য ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে এনেছিল। কেননা উত্তর কোরিয়ার সৈন্যরা ছিল বেশ শক্ত প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ও সোভিয়েত অস্ত্র সজ্জিত কিন্তু সে তুলনায় দক্ষিণ কোরিয়ার সৈন্যরা দুর্বল ও ভীতসন্ত্রস্ত। সবচেয়ে ভয়ানক ছিল আবহাওয়া। এ বছর এতই গরম পড়েছিল যে, যা আমেরিকান সৈন্যদের বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত করে দিয়েছিল। কিন্তু বছর শেষে ট্রুম্যান ও সামরিক কমান্ডার ম্যাকার্থি নতুন স্ট্রাটেজি হাতে নেন। এবার তারা আক্রমণাত্মক যুদ্ধ করার আদেশ দেন। আর এটি কাজেও লেগে যায়। খুব দ্রুত সিউল উদ্ধার করে উত্তর কোরিয়ার সৈন্যদের ৩৮” অক্ষরেখার ভিতর থেকে তাড়াতে সক্ষম হয়। এবার আমেরিকান ও দক্ষিণ কোরিয়ার সৈন্যরা ৩৮” অক্ষরেখা ভেদ করে উত্তর কোরিয়ায় ঢুকে পড়ে ও ইয়ালু নদীর দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এখানেই যুদ্ধে যুক্ত হয় আরেকটি মাত্রা। ইয়ালু নদী ছিল কমিউনিস্ট চায়না ও উত্তর কোরিয়ার মধ্যে বর্ডার। সুতরাং আমেরিকার শত্রু চায়না এতে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। মাও সেতুং তৎক্ষণাৎ সৈন্য সমাবেশ ঘটান এবং যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধ থেকে দূরে থাকার হুঁশিয়ার করে দেন। নয়ত চায়না বড় ধরণের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে।
ফলাফল ও শান্তিচুক্তি:
যুক্তরাষ্ট্র যে কোন মূল্যে এই যুদ্ধে জয় পেতে চাচ্ছিল আবার চায়নার সাথেও সংঘাত এড়াতে ছিল বদ্ধপরিকর। ১৯৫১ সালের জুলাই মাস থেকেই উত্তর-দক্ষিণ কোরিয়ার মাঝামাঝি পাঞ্জুমান গ্রামে শান্তি আলোচনা শুরু হয়। যদিও অন্যদিকে ঠিকই যুদ্ধ চলতে থাকে। তবে দুই পক্ষই অস্ত্র বিরতিতে সম্মত ছিল। কিন্তু যুদ্ধবন্দীদের কি করা হবে তা নিয়ে রয়ে যায় বিস্তর বিতর্ক। চায়না ও দক্ষিণ কোরিয়া বন্দি সৈন্যদের মুক্ত করে দিতে চাইলেও যুক্তরাষ্ট্র বেঁকে বসে। এরপর চলেছে এক দীর্ঘ দরকষাকষি। প্রায় দুই বছর কূটনৈতিক তৎপরতার ফলে ও জাতিসংঘের জোরালো হস্তক্ষেপে ১৯৫৩ সালের ২৭ জুলাই একটি শান্তিচুক্তিতে পৌঁছানো সম্ভব হয়। জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় আর্মেস্ট্রিচ চুক্তি বাস্তবায়িত হয়। সাধারণত কোরিয়ার জনগণ যে যেখানে অবস্থান করতে চায় সেখানে থাকতে দেয়ার অনুমিত দেয়া হয়। পুরাতন ৩৮” অক্ষরেখাকে একটু হেরফের করে সাজানো হয়। ফলে দক্ষিণ কোরিয়া এবার প্রায় ১,৫০০ স্কয়ার মাইল যায়গা বেশি পায়। কোরিয়ার এই অংশটি সম্পূর্ণ বেসামরিকীকরণ করা আছে।
কোরীয় যুদ্ধে হতাহত ও ব্যয়:
কোরিয়ান যুদ্ধটা যতটা না সংক্ষিপ্ত হয়েছিল ধ্বংসযজ্ঞ ও হতাহত ততটাই বেশি হয়েছিল। প্রায় উভয় কোরিয়া থেকেই তাদের জনসংখ্যার এক দশমাংশ নিহত হয়। সংখ্যার বিচারে উভয় কোরিয়ার মোটমাট প্রায় ৬ লক্ষ সৈন্য মারা যায়। এমনকি ১৬-১৭ লক্ষ সাধারণ মানুষ এই যুদ্ধে প্রাণ হারায় যা কিনা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও ভিয়েতনাম যুদ্ধেও সাধারণ মানুষ এই হারে মারা যায়নি। এছাড়াও অগণিত মানুষ এই যুদ্ধে নিখোঁজ হয়। দক্ষিণ কোরিয়ার সহযোগিতায় এগিয়ে আসা যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৪০,০০০ সৈন্য নিহত হয় ও লক্ষাধিক আহত হয়। টাকার অঙ্কেও যুক্তরাষ্ট্রের কম খরচ হয়নি।
তৎকালীন ৩০ মিলিয়ন ডলার যা আজকের ডলার মূল্যে প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ডলার তুল্য। সবমিলিয়ে এটা অন্যতম একটা ধ্বংসাত্মক যুদ্ধই ছিল যার ক্ষত এখনো দুই কোরিয়ার মানুষ বয়ে বেড়াচ্ছে।
তথ্যসূত্রঃ
১. http://www.history.com/topics/korean-war
২. https://www.britannica.com/event/Korean-War
৩. https://www.nytimes.com/2018/01/01/world/asia/korean-war-history.html
৪. http://www.bbc.co.uk/history/worldwars/coldwar/korea_hickey_01.shtml
prandin over the counter – prandin online buy generic empagliflozin for sale