ঢাকা যখন বাংলার রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি পায় তার অব্যবহিত পরই এ অঞ্চলের দৃশ্যপট বদলাতে শুরু করে। রাজধানীর জৌলুসের সাথে পাল্লা দিয়ে নগরী সুশোভিত হয় নানান অবকাঠামোয়। শুরু হয় ইমারত নির্মাণের হিড়িক। মুঘল আমলের এসব ইমারতের ভিড়ে মুসলিম অধ্যুষিত ঢাকায় তাই নান্দনিক উপায়ে তৈরি হতে থাকে ছোটবড় সব মসজিদ। বলাই বাহুল্য যুগের চাহিদার সাথে নতুন রাজধানীর স্থাপত্যরীতিতে সিংহভাগই প্রতিফলন ঘটে মুঘল শিল্পকলার। পুরান ঢাকার ঐতিহাসিক লালবাগ কেল্লার ঠিক পাশেই এমনিভাবে মুঘল স্মৃতি বহন করে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে প্রায় সোয়া তিনশো বছরের পুরনো খান মোহাম্মদ মৃধা মসজিদ। স্থানীয় লোকেরা যার নাম দিয়েছে দোতলা মসজিদ। আজকের নিবেদন এই ঐতিহাসিক মসজিদ নিয়ে।

ইতিহাস
ঐতিহাসিক লালবাগ কেল্লার অদূরে পুরান ঢাকার আতশখানায় প্রায় সোয়া তিনশো বছর বয়সী খান মোহাম্মদ মৃধা মসজিদ ঢাকার অপরাপর মুঘল মসজিদের সমান্তরালে ১৭০৫ সালে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। ইতিহাসবিদ মুনতাসির মামুনের তথ্যমতে, নায়েবে নাজিম ফররুখ শিয়রের আমলে ঢাকার কাজী খান মোহাম্মদ এবাদউল্লাহর নির্দেশে খান মোহাম্মদ মৃধা এই মসজিদ নির্মাণ করেন। দোতলা এ মসজিদের সাথে ঢাকার অন্যসব মুঘল আমলের মসজিদের রয়েছে বেশ বৈসাদৃশ্য।প্রাচীরবেষ্টিত মসজিদ আঙিনার সাথে লালবাগ কেল্লার গাম্ভীর্যের স্বরূপ ফুটে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে।

Source: Tourist Places or Spot in Bangladesh
সরু প্রবেশপথ ডিঙিয়ে ডানপাশেই চোখে পড়বে দৃষ্টিনন্দন বাগান, বাম পাশে পোড়ামাটির আদলে দাঁড়িয়ে থাকা লাল বর্ণের স্থাপনাই খান মোহাম্মদ মৃধা মসজিদ। ১৭ ফুট প্ল্যাটফর্মের উপর প্রতিষ্ঠিত এ মসজিদের নিচের তলায় লালবাগ কেল্লার কর্মচারীদের থাকার স্থান করে দেয়া হয়েছে। ওপর তলায়ই নামাজ পড়া হয়। মসজিদটির উত্তর পূর্ব কোণে রয়েছে একটি ছোটখাটো মাদ্রাসা। ডানপাশের বাগানের পাশেই রয়েছে একটি পরিত্যক্ত কুয়া। আগে এই কুয়া থেকেই মসজিদের পানি সরবরাহ করা হত। পুরান ঢাকার এ প্রাচীন মসজিদকে ঘিরে সৃষ্টি হয়েছে রহস্য আর আধিভৌতিক অন্তর্জাল। লোকশ্রুতি বলছে, এ মসজিদের দক্ষিণ অংশে জ্বিনের আনাগোনা। প্রায়ই মুসুল্লিদের নামাজে বিঘ্ন ঘটায় তারা, এমনও হয়েছে মসজিদের দক্ষিণ অংশে নামাজ পড়া কাউকে ঠেলে উত্তর দিকেও নিয়ে গেছে কেউ!

Source: Picssr
গঠনশৈলী
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার মুসা খান মসজিদ, খাজা শাহবাজ মসজিদ, মোহাম্মদপুর এলাকার সাত গম্বুজ মসজিদ প্রায় সমসাময়িক সময়ে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার কারণে প্রায় অভিন্ন মুঘল স্থাপত্যরীতি অনুসরণ করা হয়েছিল। যদিও খান মোহাম্মদ মৃধা মসজিদ প্রায় একই সময়ে গড়ে উঠেছিল তাই স্বাভাবিকভাবে এ স্থাপত্যেও প্রায় অভিন্ন মুঘল শিল্পকলার সমাবেশ ঘটেছিল। তবুও গঠনশীলতার দিক দিয়ে অনন্য হয়ে আছে প্রাচীন এ মসজিদ। চারদিক প্রাচীরঘেরা এ মসজিদ একটি উঁচু প্ল্যাটফর্মের ওপর স্থাপিত। তিনটি বড় গম্বুজ ও অল্পকিছু লম্বা মিনার বিশিষ্ট এ মসজিদের উচ্চতা নিচ থেকে ৫.১৮ মিটার। উত্তর থেকে দক্ষিণে যার দৈর্ঘ্য ৩৮.১০ এবং পূর্ব থেকে পশ্চিমে যার দৈর্ঘ্য ২৮.১৬ মিটার। সপ্তদশ শতাব্দীতে সম্রাট শাহজাহান কর্তৃক নির্মিত দিল্লির লাল কেল্লার সাথে এ মসজিদের অল্পবিস্তর সাদৃশ্য পাওয়া যায়।

Source: Dhaka City
বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর একে সংরক্ষিত প্রত্নসম্পদ হিসেবে ঘোষণা দিয়ে তার প্রাঙ্গণে একটি সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দিয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর খান মোহাম্মদ মৃধা মসজিদকে সংরক্ষিত প্রত্নসম্পদ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। অধিদপ্তরের অনুমতি ব্যতিরেকে এর কোন অংশ ধ্বংস বা ক্ষতিসাধন করা যাবেনা। যদি কারো দ্বারা এমন হয় তবে এক বছরের সাজা ও অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। সংরক্ষণের দায়িত্ব প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর নিলেও মসজিদটি একটি কমিটির মাধ্যমে স্থানীয়রাই পরিচালনা করে। প্রতি শুক্রবার জুম্মার নামাজ থেকে প্রাপ্ত অর্থ দিয়েই চলে মসজিদের ইমাম খাদেমের বেতন নির্বাহ।
যেভাবে যাবেন
ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব প্রেমী যেকেউ চাইলেই ঘুরে আসতে পারেন প্রায় সোয়া তিনশো বছর বয়সী এ মসজিদ। এজন্য আপনাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রিকশাযোগে অথবা হেটে আসতে হবে লালবাগ কেল্লা। লালবাগ কেল্লার মূল ফটক থেকে রহমত উল্লাহ বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের অতিক্রম করেই দেখা মিলবে দোতলা মসজিদ তথা খান মোহাম্মদ মৃধা মসজিদ।