মধ্যযুগের প্রতাপশালী সাম্রাজ্য অটোমান সালতানাতের শৌর্যবীর্যের অন্তরালে থাকা সামরিক শক্তির শক্তিশালী প্রভাব এ সাম্রাজ্যকে পুরো ইউরোপ দাপিয়ে বেড়াতে সাহায্য করেছিল। আর সেই সামরিক শক্তিকে দানবীয় কাতারে নিয়ে গিয়েছিল যে বিশেষ বাহিনী তার নাম জেনিসারি। তুর্কি শব্দ ইয়েনি চেরি থেকে বিকৃত হওয়া জেনিসারি ছিল অটোমান সালতানাতের গর্বিত সম্পদ। যুদ্ধক্ষেত্রে হিংস্র আর ক্ষ্যাপাটে চরিত্র ধারণ করা প্রত্যেক জেনিসারি সদস্য ছিল প্রতিপক্ষের সাক্ষাত যম, দুঃস্বপ্ন। প্রায় ৫০০ বছরের সামরিক ইতিহাসে জেনিসারি বাহিনী খুব কম যুদ্ধেই পরাজিত হয়েছিল। তাদের সম্পর্কে কথিত আছে, যুদ্ধক্ষেত্রে হাত কিংবা পা উড়ে গেলেও অবশিষ্ট অঙ্গ দিয়ে যুদ্ধ করেই তবে তারা ক্ষান্ত হত। কসোভো যুদ্ধ, নিউকোপলিসের যুদ্ধ, চালদিরানের যুদ্ধ, কনস্টান্টিনোপল দখল ইত্যাদি যুদ্ধে বীরবিক্রমে লড়াই চালিয়ে অটোমান সালতানাতের সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি দিনকে দিন বাড়িয়ে দিয়েছিল এ বিশেষ পদাতিক বাহিনী।

জেনিসারি বাহিনীর উত্থান
তৃতীয় অটোমান সুলতান মুরাদ (১৩৬২-১৩৮৯) সর্বপ্রথম ছোট পরিসরে ১৩৮০ সালের দিকে এ বাহিনীর গোড়াপত্তন করেন। মুরাদ বুঝতে পেরেছিলেন অটোমান সামরিক খাতকে ভয়ংকর পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য নিয়মিত সেনাদলের পাশাপাশি প্রয়োজন নতুন কোন বিশেষায়িত দলের। এজন্য দখলকৃত ইউরোপীয় অঞ্চল থেকে বিশেষ করে বলকান অঞ্চলের খ্রিষ্টান কিশোরদের ধরে এনে তুর্কি সংস্কৃতি, ভাষা শিক্ষা দিয়ে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করে কঠোর প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে এ বিশেষ বাহিনীর জন্য নিয়োগ দেয়া হত। প্রথম দিকে জেনিসারি সদস্যরা সুলতান এবং তার পরিবারের সদস্যদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত থাকত। সুলতানের প্রতি অনুগত থাকাই ছিল তাদের প্রধান কর্তব্য। ধীরে ধীরে তাদের বিচরণ পুরো সামরিক খাতে ছড়িয়ে পড়ে এবং অচিরেই রূপ নেয় এক অপ্রতিরোধ্য পদাতিক দল হিসেবে।
নিয়োগ এবং প্রশিক্ষণ পদ্ধতি
ইউরোপের নতুন অঞ্চল দখল করার পর বিশেষ করে বলকান অঞ্চল এবং পরবর্তীতে বুলগেরিয়ান, আর্মেনিয়ান, রুমানিয়ান এবং রাশিয়ানদের মধ্য থেকে বাছাই করে কিছু খ্রিস্টান কিশোরদের নিয়ে আসা হত৷ খ্রিস্টান পরিবার তাদের ছেলেদের জেনিসারী বাহিনীতে দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করত। উচ্চ বেতনের চাকরিতে প্রলুব্ধ হয়ে তুর্কি দখলকৃত খ্রিস্টান অঞ্চলের অনেক পরিবার নিজেদের পুত্রকে জেনিসারীতে দেয়ার জন্য ইচ্ছা পোষণ করত। সেই সময়ে কোন ইউরোপীয় পরিবারের ছেলের জেনিসারিতে যোগদান গর্বের বিষয় ছিল, সংশ্লিষ্ট ছেলের মা বাবা গর্ব করে বলত আমার ছেলে একজন জেনিসারি। প্রথম দিকে শুধু খ্রিস্টানদের নিয়োগ দেয়া হলেও পরবর্তীতে এ নিয়ম রহিত করে মুসলিমদেরও অবাধ প্রবেশ নিশ্চিত করা হয়৷ তুর্কি Devsrim প্রথার (রক্তের কর বা রক্তের সম্মানে কাজ করা) মাধ্যমে এসব কিশোরদের নিয়োগ দেয়া হত। বাছাইকৃত কিশোরদের রাজধানীতে নিয়ে এসে কঠোর নিয়মানুবর্তিতা শিক্ষা দেয়া হত। তাদের ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে হত।

তুর্কি ভাষা, সংস্কৃতি শিক্ষা ছিল অবশ্য কর্তব্য। কোরান হাদীসের পাঠ ছিল রুটিন কাজ। যুদ্ধবিদ্যা থেকে বিজ্ঞান এমনকি অর্থনীতির শিক্ষাও তাদের নিতে হত। সুলতানের প্রতি আনুগত্য পাঠের পাশাপাশি তাদের যেতে হত অমানুষিক প্রশিক্ষণের ভেতর। ভার উত্তোলন, রেসলিং, রোদে দাঁড়িয়ে থাকা, মল্লযুদ্ধ, ঘোড়দৌড়, তীর নিক্ষেপ ইত্যাদি ছিল তাদের নিত্যদিনের কাজ। ব্যারাক ছিল তাদের বাসস্থান। সবসময় যুদ্ধপ্রস্তুতি নিয়ে থাকতে হত তাদের। প্রায় ৬ বছরের প্রশিক্ষণে এসব কিশোরদের ভুলে থাকতে হত আনন্দ বিনোদন, ক্ষুধা, কষ্ট ও পরিবারের কথা৷ জেনিসারী বাহিনীর প্রথম দুইশো বছর কোন সদস্য বিয়ে করতে পারতো না। দাড়ি রাখা ছিল নিষিদ্ধ। যুদ্ধ প্রশিক্ষণ ছাড়াও তাদেরকে অন্যান্য কারিগরি প্রশিক্ষণও নিতে হত। প্রশিক্ষণ পর্ব শেষে চূড়ান্ত বাছাই শেষে জেনিসারী বাহিনীতে অন্তর্ভূক্ত করা হত। তার পর থেকেই এসব কিশোররা পূর্নাঙ্গ যুবক হয়ে বলতে পারত আমি একজন জেনিসারী।
জেনিসারীদের বর্ণাঢ্য জীবন
মধ্যযুগের সামরিক ইতিহাসে অটোমান সালতানাতের এ বিশেষ পদাতিক বাহিনী যুদ্ধক্ষেত্রে এমনি এমনিই অপরাজেয় হয়ে উঠেনি। প্রথমদিকে সুলতানের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা রক্ষী, প্রাসাদ প্রহরী থেকে পরাক্রমশালী সামরিক বাহিনী হয়ে উঠা এ দলের সদস্যরা যুদ্ধকালীন সময়ের বাইরে পৌরকেন্দ্রিক দায়িত্বও পালন করত। মাঝে মাঝে তাদের অগ্নি নির্বাপনের কাজেও প্রত্যক্ষ করা যেত৷ জেনিসারী কমান্ডারকে বলা হত Soup cook. তাঁকে এক বিশেষ আদলের সামরিক পোশাক পরতে হত যার হাতা ছিল তুলনামূলক লম্বা। জেনিসারি সদস্যরা সবসময় অস্ত্রসস্ত্র সজ্জিত হয়ে থাকত। দাড়ি ছাড়া গোঁফসমেত সদস্যদের দেখলেও অনেকে ভয় পেত। জেনিসারী বাহিনী পৃথিবীতে সর্বপ্রথম সামরিক মিউজিক্যাল ব্যান্ড প্রতিষ্ঠা করে। যুদ্ধে অংশ নেয়ার পূর্বমুহূর্তে বাদ্যসানাই বাজিয়ে এ ব্যান্ড যোদ্ধাদের অনুপ্রানিত করত। সবসময় যুদ্ধংদেহী মনোভাবে থাকা জেনিসারিগণ অটোমান সাম্রাজ্যে আলাদা সম্মান ভোগ করত। কোন কোন সময় সুলতান এবং তার পুত্রদের রাজনৈতিক উপদেষ্টা হিসেবে জেনিসারী কর্ণেলগণ দায়িত্ব পালন করতেন। সালতানাতের প্রতি নিরংকুশ আনুগত্য এ বাহিনীকে আরো জনপ্রিয় করে তুলেছিল।

যুদ্ধক্ষেত্রে জেনিসারি
যুদ্ধের ময়দানে জেনিসারিদের প্রধান দায়িত্ব ছিল সুলতানকে নিরাপত্তা দেয়া। তারা সাধারণত যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি বুঝে যুদ্ধে জড়াতো। নিয়মিত বাহিনী পরাস্ত হলেই তবে জেনিসারীগণ প্রতিপক্ষের
বিরুদ্ধে অস্ত্র তাঁক করত। যুদ্ধক্ষেত্রে কামান ব্যবহারের দায়িত্ব ছিল তাদের উপর। তিন ভাগে ভাগ হওয়া অটোমান বাহিনীর শেষ ভাগে থাকত জেনিসারীরা। কসোভোর যুদ্ধ, চালদিরানের যুদ্ধ, অস্ট্রিয়া ও হাঙ্গেরির বিরুদ্ধে যুদ্ধ, কনস্ট্যান্টিনোপল দখলে জেনিসারি বাহিনী অসামান্য রণনৈপুণ্য প্রদর্শন করেছিল। ক্রুসেডের এক যুদ্ধে ইউরোপীয় জোটের কাছে প্রায় হারতে বসেছিল তুর্কি বাহিনী৷ ইউরোপীয় জোটের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন হাঙ্গেরির রাজা৷ ইউরোপীয় সৈন্যরা যখন তুর্কি বাহিনীকে প্রায় বিপর্যস্ত করে দিয়েছিল ঠিক তখনই নজিরবিহীন যুদ্ধশৈলী প্রদর্শন করে জেনিসারি বাহিনী। যুদ্ধের মোড় পালটিয়ে নতুন পজিশন গ্রহণ করে অল্প সদস্যের এ পদাতিক দল বিশাল ইউরোপীয় বহরের একেক সৈন্যকে প্রবল হিংস্রতার সাথে হত্যা করে। জেনিসারীদের রুদ্রমূর্তি প্রত্যক্ষ করে সেদিন ইউরোপীয় জোট দিগ্বিদিক পালাতে থাকে। হাঙ্গেরির রাজার মাথা কেটে এনে সুলতানের সামনে রাখা হয়। সে দৃশ্য দেখে স্বয়ং সুলতান নিজেই বলেছিলেন “নিশ্চয়ই আল্লাহ এ দৃশ্যে সন্তুষ্ট হবেন না”
সুলতান বায়েজিদ সার্বিয়ার রাজকন্যা অলিভেরাকে বিয়ে করলে ইউরোপের খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ দেখা দেয়। এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় পোপ মুসলমানদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক ক্রুসেড ঘোষণা করেন। ইতিহাসে ব্যাটল অফ নিউকোপোলিস নামে পরিচিত এ যুদ্ধে ২১,০০০ ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামে ১২,০০০ তুর্কি সেনা। যুদ্ধের শুরুতেই ক্রুসেডাররা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। তাদের ইচ্ছা ছিল অটোমানদের প্রথম দুই ভাগের সৈন্যদের পরাজিত করে জেনিসারীদের মোকাবেলা করা। কিন্তু ক্রুসেডারদের সে ইচ্ছা আগেই ভণ্ডুল করে দেয় চতুর জেনিসারী। প্রথম ধাপ শেষ করে যখন ইউরোপীয় বাহিনী দ্বিতীয় ধাপে এসে পৌছায় তখন কিছু বুঝে উঠার আগেই জেনিসারীদের উপর্যুপরি হামলার শিকার হয়। নিউকোপলিসের এ যুদ্ধেও জেনিসারীদের বিজয় সূচিত হয়। এছাড়া ১৪৫৩ সালে মুসলিমদের ঐতিহাসিক কনস্ট্যানটিনোপল বিজয়ে জেনিসারীদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে।

Source: Realm of History
জেনিসারিদের পতন
সামরিক ক্ষেত্রে প্রবল পরাক্রমশালী হওয়ার পর জেনিসারী নেতৃবৃন্দ রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও প্রভাব খাটাতে থাকেন। সৈন্যদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে থাকে। একসময় তারা সুলতান নির্বাচনেও হস্তক্ষেপ করা শুরু করে। সুলতান তৃতীয় সেলিম নিজাম-ই-জাদিদ নামের নতুন আরেকটি বিশেষায়িত সেনাদল গঠন করলে জেনিসারীরা শংকিত হয়ে পড়ে৷ তাদের নতুন প্রতিদ্বন্দ্বী দলের আবির্ভাবে জেনিসারীদের প্রভাব খর্ব হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। যার ফলে তারা এ বাহিনীর বিরোধিতা করে৷ তাদের প্রবল বিরোধিতার ফলে সুলতান বাধ্য হয়ে নতুন এ দল বিলুপ্ত করে দেন। দ্বিতীয় মাহমুদ সেনাবাহিনী সংস্কারের পদক্ষেপ গ্রহণ করলে আরেক দফা বিক্ষোভ করে বসে জেনিসারীরা। দ্বিতীয় মাহমুদ এবার কঠোর এক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তার গোলন্দাজ বাহিনীকে জেনিসারীদের ব্যারাক ধ্বংসের আদেশ দেন। ১৮২৬ সালে গোলন্দাজ বাহিনীর আঘাতে জেনিসারীদের ব্যারাক ভস্মীভূত হয়ে যায়। দূর্গে অবস্থান নেয়া জেনিসারী সৈন্যের সবাইকে দূর্গসহ ধ্বংস করে দেয়া হয়৷ অবশিষ্টদের বিচারের আওতায় এনে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়৷ আর এরই সাথে সমাপ্ত হয় অটোমান সালতানাতের গর্বের ধন জেনিসারী বাহিনীর গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়।
Nice blog! Is your theme custom made or did you download it from somewhere? A design like yours with a few simple tweeks would really make my blog jump out. Please let me know where you got your theme. Kudos