পুলিশি পাহারার মধ্যদিয়ে হাতে কোমরে দড়িবেঁধে চোর-ডাকাতের মতো আদালতে হাজির করা হচ্ছে একজনকে, রাষ্ট্রের চোখে তিনি আসামি। একটি কবিতায় অশ্লীলতার দায়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পুলিশের এই আয়োজন। আসামীর নাম কবি মলয় রায়চৌধুরী তার রচিত সে কবিতাটির নাম ‘প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’। সাহিত্যে অশ্লীলতার দায়ে মামলাটি ৩৫ মাস চলমান থাকে। নিম্ন আদালতের রায়ে এক মাসের সাঁজা হয় মলয় রায়চৌধুরীর, পরে উচ্চ আদালতে বেকুসর ছাড়া পান। প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার কোন স্বতন্ত্র কবিতা না হয়ে একটি সাহিত্য আন্দোলনের প্রতিনিধি হয়ে উঠল, কবি মলয় রায়চৌধুরীর এই আলোচিত কবিতা যে আন্দোলনের প্রতিনিধিত্ব করে তার নাম ‘হাংরি আন্দোলন’। হাংরি আন্দোলনের আন্দোলনকারীরা হাংরি জেনারেশনের কবি সাহিত্যিক হিসেবে পরিচিত। দেশভাগের পরবর্তী সময়ে বাংলা সাহিত্যে একধরনের প্রচলিত ধারায় পদচারণের দৃশ্যত অনুকরণ ইচ্ছা এবং তার প্রতিফলন বাংলা সাহিত্যে এক স্থবিরতার জন্ম দেয়। এক প্রকারের স্থবির অবস্থা চলতে থাকে, এই স্থবিরতা ভেঙে দিতে ক্ষুদার্ত তরুণ কয়েকজন কবি-সাহিত্যিক মিলে ইস্তেহার বের করেন, পত্রিকা-হেন্ডবিলে প্রকাশ করতে থাকেন তাদের রচনা। ক্ষুধার্ত কবিদের সে সমস্ত সাহিত্য সে সময়ে রাষ্ট্র ও তার অনুগামীদের ভাল্লাগ্লোনা! রাষ্ট্র সে সাহিত্য আন্দোলনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলো!
জার্মান সমাজতাত্ত্বিক অসওয়াল্ড স্পেংলারের ‘দি ডিক্লাইন অব দি ওয়েস্ট’ গ্রন্থটি ছিলো হাংরি আন্দোলনের তাত্ত্বিকভিত্তি। এই বইয়ের দর্শনগত দিকদিয়ে সে সময়ের বাংলা সাহিত্য ও সামাজিক অবস্থাকে ক্ষুৎপীড়িত অবক্ষয় হিসেবে দেখলেন হাংরি জেনারেশনের কবিরা। স্পেংলারের মতো তারাও ভাবলেন, সংস্কৃতি কখনই একটি সরলরেখা বরাবর চলতে পারে না, পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়াই সময়ে সময়ে তার পরিধি বিস্তার ঘটে। সংস্কৃতির গতিবিধি একটি জৈবিক প্রক্রিয়া। সংস্কৃতির সে গতিবিধি নিজস্ব সৃজনশীলতার দ্বারা বিকশিত ও সমৃদ্ধ করা সম্ভব। তবে সে সৃজনশীলতায় ঘটতি দেখা দিলে সংস্কৃতি অনান্য সমাজের দ্বারা প্রভাবিত হতে থাকবে, তৈরি হবে এক ক্ষুধার্ত পরিস্থিতির । হাংরি অন্দোলনের কবি সাহিত্যিকরা ৬০’র দশককে ক্ষুৎকাতর সময় হিসেবে চিহ্নিত করেন। দেশভাগে পর থেকে জন্ম নিয়েছে এই ক্ষুৎকাতরতার যা কাটিয়ে উঠতেই হাংরি আন্দোলনের সুত্রপাত। হাংরি আন্দোলনের সাহিত্যিকরা তাদের আন্দোলনকে কাউন্টার কালচারাল মুভমেন্ট এবং তাঁদের সাহিত্যকর্মকে কাউন্টার ডিসকোর্স হিসেবে প্রচার করেন।
১৯৬১ সালের নভেম্বর মাসে কলকাতার পাটনা থেকে ইস্তেহার প্রকাশের মধ্যদিয়ে হাংরি আন্দোলনের জন্ম। শুরুর দিকে সমীর রায়চৌধুরী, মলয় রায়চৌধুরী, শক্তি চট্টোপাধ্যায় এবং দেবী রায়ের মতো কবি সাহিত্যিকরা ছিলেন এই অন্দোলনের দিকনির্দেশক হিসেবে , ১৯৬২ -৬৩’তে যুক্ত হন বিনয় মজুমদার, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু, সুবিমল বসাক, ত্রিদিব মিত্র ও ফালগুনী রায়ের মতো বাঙালি কবি সাহিত্যিকরা।
এই সাহিত্য আন্দোলনের প্রচারণা জন্য শুরু থেকেই প্রকাশ হতো একপৃষ্ঠার ব্যলেটিন। কলকাতার বিভিন্ন লাইব্রেরি, কফি হাউজে, কলেজগুলোতে এবং পত্রিকা দফতরে বিতরণের মধ্য দিয়েই চলতো প্রচার অভিযান। এই প্রচারনার ফলে চারদিকে আন্দোলনের কথা পৌঁছাতে থাকে, অন্যদিকে এই সফলতার পাশাপাশি ১৯৬৩-৬৫ তে বেশকিছু পত্রিকাও প্রকাশিত হয় সেগুলোর মধ্যে সুবিমল বসাক সম্পাদিত প্রতিদ্বন্দ্বী, ত্রিদিব মিত্র সম্পাদিত উন্মার্গ, মলয় রায়চৌধুরী সম্পাদিত জেব্রা, দেবী রায় সম্পাদিত চিহ্ণ, প্রদীপ চৌধুরী সম্পাদিত ফুঃ অন্যতম ।
এসব বুলেটিন ও পত্রিকায় প্রকাশিত হয় কবিতা , অনুগল্প, নাটক, চিত্রকর্ম যার মধ্যদিয়ে উঠে আসে ধর্ম, রাজনীতি, জীবনবোধ,দর্শন । শিল্প বা আর্ট বলতে যা বুঝি তা যে ইউরুপিয়দের দ্বারা সংজ্ঞায়িত তাও সামনে নিয়ে আসেন মলয় রায়চৌধুরীরা, বাংলার শিল্প বা আর্ট তৈরী যে অতিসাধারণদের হাত ধরেও হয়েছিলো তাও গুরুত্ব সহকারে জায়গা পায় ইস্তেহারে, কবিগান ও কবিগানের ভাষারীতি যে অনন্য বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন শিল্প তার প্রসঙ্গও জায়গা পায় আন্দোলনের ইস্তেহারে। শিল্প সৃষ্টিতেও শ্রোণীবৈষম্য যে একটি বিশেষ স্থান নিয়ে আছে, কাকে শিল্পী বলা হবে তাতে পুঁজিবাদের প্রভাব নিয়েও সচেতন অবস্থান হাংরি বুলেটনে উঠে আসে। প্রতিষ্ঠান বিরোধীরা ছিলো হাংরি জেনারেশন কবিদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য,তাঁরা প্রতিষ্ঠান বিরোধী প্রথম বাঙ্গালী সাহিত্যিক হিসেবে পরিচিত।
তাত্ত্বিক ও দর্শনগত বিষয়াদির কারণে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় সহ ইউরুপে হাংরি আন্দোলনের পক্ষে সমর্থন তৈরী হয়। বিখ্যাত ইংরেজ কবি কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ কলকাতায় থাকাকালীন ইংরেজি হাংরি বুলেটিনগুলো সংগ্রহ করে পরবর্তীতে স্ট্যনফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে দান করেন।
১৯৬৪ সালে মলয় রায়চৌধুরীর বিরুদ্ধে অশ্লীলতার দায়ে ‘প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ সংক্রান্ত মামলায় সুভাষ ঘোষ ও শৈলেশ্বর ঘোষের মুচলেকা দেওয়া এবং আন্দোলনরত শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় ও উৎপলকুমার বসুর পুলিশের পক্ষে সাক্ষ্য দেওয়া সহ অনেকের অংশগ্রহণের কথা অস্বীকৃতির ফলে হাংরি অন্দোলনের সমাপ্তি ঘটে। পরবর্তীতে সত্তর দশকের দিকে অরুণেষ ঘোষ প্রকাশ করেন জিরাফ, অলোক গোস্বামী প্রকাশ করেন কনসেনত্রশান ক্যাম্প, সুভাষ ঘোষ সম্পাদনা করেন আর্তনাদ ইত্যাদি পত্রিকাতে আবারো হাংরি আন্দোলনকে জিইয়ে রাখার চেষ্টা হয় তবে তাও অচিরেই ব্যর্থ হয়।
glucophage price – januvia 100 mg pills purchase acarbose generic
buy prandin online cheap – order generic prandin 2mg empagliflozin drug