সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য যে বিপ্লবটি পৃথীবিতে অগ্রগণ্য সেটিই অক্টোবর বিপ্লব। অক্টোবর মাসে বিপ্লবটি সংগঠিত হবার ফলে এটিকে অক্টোবর বিপ্লব নামে অভিহিত করা হয়। মূলত ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত চলে এই বিপ্লব। অক্টোবর বিপ্লবে নেতৃত্ব দান করে ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন। এই বিপ্লবের মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠা লাভ করে পৃথিবীর প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়ন। অক্টোবর বিপ্লবের নেতা ও প্রধান চালিকা শক্তি ছিলো শ্রমিক শ্রেণী এবং তারা গরিব কৃষকদের সাথে হাত মিলিয়েছিলো। এই বিপ্লবের বিজয় রাশিয়াকে রাজনৈতিক অর্থে অগ্রসর দেশে পরিণত করেছিল।
পটভূমি :
বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে রাশিয়া ছিল কৃষি নির্ভর একটি দেশ। কিন্তু রাশিয়ার তৎকালীন জার শাসিত সরকার কৃষকদের উপর উচ্চ হারে কর আরোপ করত। রাষ্ট্রের বড় যে পদ গুলো ছিল তা ধনীক শ্রেনী ও গির্জার চার্চ সম্প্রদায়ের দখলে ছিল। সাধারণ জনগণকে উচ্চ পদ গুলোতে বঞ্চিত করা হত। শিল্প কারখানার সংখ্যা খুবই অপ্রতুল ছিল। অধিকাংশ কারখানাগুলো ছিল সেন্ট পিটার্সবার্গে, কারখানা শ্রমিকদের জীবন যাত্রার মান ছিল খুবই নিম্ন মানের। পাশাপশি তাদের বেতন ভাতা ছিল প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্তই কম। ফরাসি বিপ্লবের পর থেকেই ইউরোপে গঠনতন্ত্রের চর্চা বেগবান হয়। রাশিয়াতেও গণতন্ত্রের ছোয়া লাগে। কিন্ত সতের শতাব্দী থেকেই রাশিয়ার শাসন ব্যবস্থায় অধিস্থিত হয় রোভানভ বংশের শাসক গণ। তাদেরকে জার বলে অভিহিত করা হয়। তারা সম্পূর্ন রাজকীয় নিয়মে শাসন ব্যবস্থা পরিচালনা করত। অর্থাৎ, সেখানে গণতন্ত্রের কোন প্রকার সুযোগ ছিল না।
![জার দ্বিতীয় নিকোলাস](https://itibritto.com/wp-content/uploads/2018/04/882fc25b-f61c-4c89-abc5-5456f336419b.jpg)
১৮৯৪ সালে ক্ষমতায় অধিস্থিত হয় জার দ্বিতীয় নিকোলাস। তার উপর রাজপুতিন নামে এক ব্যক্তির প্রভাব ছিল। রাজপুতিন পেশায় একজন চার্চের উচ্চ পদস্থ কর্মচারী ছিল। সে দাবি করত, সে যেকোন রোগ নিরাময় করতে পারত। এজন্য নিকোলাস তার উপর ভরসা করত। কিন্তু রাজপুতিনের সাথে রানীর গোপন সম্পর্ক লোক মুখে প্রচলিত ছিল। যার কারনে রাজা নিকোলাসকে জনগণ পছন্দ করত না।
RSDP গঠন :
রাশিয়ার এই দুরবস্থা দূর করার জন্য বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বিপ্লবী আলাদা হয়ে কাজ করা শুরু করে। কিন্তু তাদের মধ্যে যে নামটি সবার অগ্র গণ্য সেটি হল লেনিন। পারিবারিক ভাবেই লেনিন ছিল উচ্চ শিক্ষিত এবং বিপ্লবী মানসিকতার। তার দাদা এবং আপন ভাই জারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে মৃত্যুদন্ড গ্রহন করে। লেনিন ছিল কার্ল মার্ক্সের অনুসারী। ১৮৯৮ সালে লেনিন তার সমমনা বিপ্লবীদের নিয়ে গঠন করে রাশিয়ান সোশিয়াল ডেমোক্রেটিক পার্টি (RSDP)।
পার্টির মুল উদ্দেশ্য ছিল শ্রমিক শ্রেনীর অধিকার সংরক্ষন করা এবং তাদেরকে তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করা। সার্বিকভাবে জার সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগঠিত করা। আন্দোলন পরিচালনা করতে গিয়ে লেনিন সরকারের গ্রেপ্তারের হুমকির সম্মুখীন হয়ে দেশ ত্যাগ করে। দেশের বাইরে থেকেই লেনিন বিপ্লব সংগ্রাম চালু রাখে। ১৯০৩ সালে পার্টি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়, কারন ছিল আদর্শ গত মত পার্থক্য। বলশেভিক ও মেনশেভিক দুই গ্রুপে ভাল হয়ে যায় RSDP পার্টি। বলশেভিক পার্টির নেতৃত্ব ছিল লেনিন। তার দক্ষ নেতৃত্বের মাধ্যমে তিনি পার্টির উপর নিয়ন্ত্রন নিতে সম্মত হয়। এই কারনে এই বিপ্লবকে বলশেভিক বিপ্লব নামেও ডাকা হয়।
![অক্টোবর বিপ্লবের পর জনসম্মুখে লেনিন](https://itibritto.com/wp-content/uploads/2018/04/অক্টোবর-বিপ্লবের-পর-জনসম্মুখে-লেনিন.jpg)
রাশিয়া-জাপান যুদ্ধ :
১৯০৪ সালে রাশিয়া ও জাপানের মধ্যে মুনচুরিয়া ও কোরিয়াকে বিভক্ত করা নিয়ে দ্বন্ধ শুরু হয়। উক্ত সময়ে রাশিয়া এবং জাপান উভয়ই রাজ পরিবারের শাসনের অধীনে ছিল। পোর্ট আর্থারের নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া এই যুদ্ধে রাশিয়া খুব বাজে ভাবে পরাজিত হয়েছিল। এই পরাজয় রাশিয়ার জনগন মেনে নিতে পারে নি। যুদ্ধ পরাজয়কে রাশিয়ার শাসকদের দুর্বলতা হিসেবে বিবেচিত হয়। যা পরবর্তীতে ১৯০৫ সালে সংগঠিত বিপ্লবের অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। আমেরিকার তৎকালীন রাষ্ট্রপতি রুজভেল্ট দুই দেশের মধ্যে শান্তি চুক্তিতে ভূমিকা পালন করে। এজন্য তাকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়।
![রাশিয়ার কৃষকদের দুরবস্থার চিত্র](https://itibritto.com/wp-content/uploads/2018/04/রাশিয়ার-কৃষকদের-দুরবস্থার-চিত্র.jpg)
১৯০৫ সালের বিপ্লব :
সাল ১৯০৫, রাশিয়াতে একটি বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিলো। কিন্তু শাসকবর্গ শীঘ্রই তা দমন করে। বিদ্রোহের খবর পেয়ে লেনিন রাশিয়াতে ফিরে আসেন। এই বিদ্রোহের নেতৃত্বে ছিলেন ফাদার জর্জি গেপন। বিদ্রোহে প্রচুর লোক নির্যাতিত হয়েছিল শাসক বাহীনির দ্বারা। এই বিদ্রোহ ইতিহাসে ব্লাডি সানডে নামে পরিচিত। বিপ্লবের কারন ছিল শ্রমিক শ্রেনীর অধিকার আদায় ও তাদের জীবন যাত্রার মান বৃদ্ধির জন্য কতগুলো দাবি দাওয়া জারের নিকট পেশ। কিন্তু জার নির্মমভাবে তাদের প্রতিহত করে। কিন্তু এই আন্দোলনের কারনে জার অক্টোবর মেনিফেস্টো ঘোষনা করে এবং ডুমা গঠন করে। ডুমা ছিল পার্লামেন্টারি ব্যবস্থার একটি বিশেষ রূপ। কিন্তু এখানেও জনগণের ভোটাধিকারের কোন প্রকার সুযোগ ছিল না। ডুমার সৃষ্টির পর ১৯০৬ সালে প্রথম প্রধানমন্ত্রী হলেন পিটার স্টিলোপিন। তিনি শ্রমিকদের অবস্থা পরিবর্তনের জন্য কিছু পদক্ষেপ নিলেন। এ কারনে তার জনপ্রিয়তা খুবই বেড়ে গিয়েছিল। কিন্তু জার প্রতিহিংসার বশীভূত হয়ে তাকে ১৯১১ সালে হত্যা করে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ :
১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে রাশিয়া সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহন করে। কিন্তু রাশিয়ার জনগণ এই যুদ্ধের পক্ষে ছিল না। যুদ্ধে অংশ গ্রহনের ফলে রাশিয়ার প্রচুর অর্থনৈতিক ক্ষতি সাধিত হয়। যুদ্ধে রাশিয়ার প্রায় ২০ লক্ষ সৈনিক ও ৮০ লাখ নাগরিক নিহত হয়। ভয়াবহ এই পরিস্থিতি রাশিয়ার সর্ব সাধারণকে চরমভাবে ক্ষিপ্ত করে তোলে। অন্যদিকে লেনিন সহ অন্যান্য বিপ্লবীরা যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রচার চালাতে থাকে। জার্মানী সরকারের সহায়তা নিয়ে সে রাশিয়ায় প্রবেশ করে। ১৯১৪-১৭ পর্যন্ত এই যুদ্ধে রাশিয়ায় চরমভাবে খাদ্যের সংকট দেখা দেয়। কারন অটোমন সামাজ্যের (তুরস্কের) রাজা রাশিয়া মুখী সমস্ত জাহাজকে আটকে দিয়েছিল। ফলে জার সরকার চরম বিপদের সম্মুখীন হয়।
![বলশেভিক রেড গার্ড](https://itibritto.com/wp-content/uploads/2018/04/41390_large.jpg)
অক্টোবর বিপ্লব :
১৯১৭ সালের ফ্রেবুয়ারী মানে প্রায় ৫০,০০০ শ্রমিক সেন্ট পিটার্সবার্গে ধর্মঘট শুরু করে। ধর্ম ঘটের কারনে পুরো দেশ অচল হয়ে পড়ে। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে জার নিকোলাস তার দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করে এবং তার ভাই মাইকেলকে আমন্ত্রন করে জারের দায়িত্ব গ্রহন করার জন্য। কিন্তু মাইকেল তাকে মানা করে দেয়। ফলে ডুমা দায়িত্ব গ্রহন করে। পতন হয় তিনশ বছর বা তার বেশি সময় ধরে চলে আসা জার শাসনের। ডুমা কতৃর্ক গঠিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী হয় আলেকজান্ডার কেরেনস্কি। তিনি প্রভিশনাল সরকারের রূপ রেখা প্রণয়ন করেন। কিন্তু কেরেনস্কি রাশিয়াকে বিশ্বযুদ্ধ থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসে নি। যা জনসাধারনের প্রথম দাবি ছিল। অন্যদিকে তিনি নির্বাচন দিতে ইচ্ছুক ছিলেন না। তার বক্তব্য ছিল পরিস্থিতি স্থিতি লাভ না করা পর্যন্ত কোন নির্বাচন হবে না।
বলশেভিক নেতা লিয়ন টটোস্কি সরকারের কাছে দাবি করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে রাশিয়াকে প্রত্যাহার করতে। একই সাথে শ্রমিক শ্রেনীর অধিকার নিশ্চিত করতে। কিন্তু কেরেনস্কি সরকার তাদের নেতাদের গ্রেপ্তার করে জেলে বন্দি করে। আগস্ট মাসে রাশিয়ার সেনাবাহীনি সরকার পতনের উদ্যোগ নিলে কেরেনস্কি বলশেভিকদের সাহায্য প্রার্থনা করে। কারন বললেভিকদের সশস্ত্র বাহীনি রেড গার্ড খুব সংগঠিত ছিল। রেড গার্ড সরকারকে রক্ষা করে এবং সেন্ট পিটার্সবার্গে অবস্থান গ্রহন করে।
ফলে বলশেভিকদের প্রতি সরকার নমনীয় আচরণ করে। এই সুযোগে লেনিন রাশিয়ায় আগমন করে। লেনিন তার লেখা ও বক্তৃতার মাধ্যমে লোকদের অনুপ্রাণিত করতে লাগল।
অক্টোবরের ২৪ তারিখ লেনিন রেড গার্ডকে হুকুম দিলেন সেন্ট পিটার্সবার্গের সমস্ত সরকারী অফিস ভবন দখল করার জন্য। বলশেভিকরা মাত্র এক দিনের মধ্যেই সমস্ত সরকারী স্থাপনা নিজেদের দখলে নিয়ে যায়। শুধু সেন্ট পিটার্সবার্গ নয় রাশিয়ার গুরুত্বপূর্ন শহর গুলোই বলশেভিকদের নিয়ন্ত্রনে চলে যায়। ফলে বিনা রক্তপাতে অক্টোবরের ২৫ তারিখ বলশেভিকরা রাশিয়ার ক্ষমতা দখল করে। যা ইতিহাসের পাতায় অক্টোবর বিপ্লব নামে পরিচিতি লাভ করে।
অক্টোবর বিপ্লবের প্রভাব :
১.পৃথিবীর অন্যতম দীর্ঘ সময় ধরে চলে আসা রাজ শাসনের অবসান ঘটে।
২. সমাজতন্ত্রের বাস্তবিক প্রয়োগ ঘটে, কারন বিপ্লবের পূর্বে সমাজতন্ত্র কেবল বই পুস্তকে সীমাবদ্ধ ছিল।
৩. সর্বক্ষেত্রে জাতীয়করন এবং ব্যক্তিগত সম্পতির বিলোপ ঘটে।
৪. রাশিয়ায় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সূচনা ঘটে।
৫. পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম বিপ্লব যা প্রকৃত সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠা করেছিল।