‘চারশো বছরে ঢাকা’ এরকম একটি চটকদার শিরোনামে ঢাকাকে গৌরবান্বিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে গতকয়েক বছর ধরে। অথচ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিচার বিশ্লেষণ করলে ঢাকার বয়স হাজার বছর ছাড়িয়ে যাওয়ার রোমাঞ্চকর তথ্যও সামনে আসবে। সে বিতর্কে আমরা যেতে চাইনা। ট্রাফিক সিগন্যালের অনন্ত অপেক্ষা, লোকাল বাসের নরকযন্ত্রণা, যানজট আর উন্নয়নের খোঁড়াখুঁড়ির যাদুর শহর, বংগজননীর জৈষ্ঠ্যপুত্র ঢাকার নামের নেপথ্যসূত্রের ব্যবচ্ছেদ করতেই আমাদের আজকের আয়োজন।
দিল্লীর মসনদে মুঘলরা যখন ভারতের অধিপতি স্বীকৃত ঠিক তখন বিশেষ করে সম্রাট হুমায়ূনের শাসনামলে মুঘল রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বাংলায় চলছিল হোসেন শাহী আমলের গর্বিত স্বাধীন সুলতানি যুগ। নিজেকে স্বাধীন সুলতান হিসেবে ঘোষণা করে ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ তখন সোনারগাঁ’য় রাজধানী স্থাপন করেন।
১৬১০ সালে সম্রাট জাহাঙ্গীরের সুবাদার ইসলাম খাঁ কর্তৃক ঢাকা মুঘল বাংলার রাজধানী হিসেবে মনোনয়নের আগ পর্যন্ত বিশেষ করে সুলতানি আমলে সোনারগাঁ’র পার্শ্ববর্তী নগরকেন্দ্রে হিসেবে ঢাকা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছিল। জলপথে সোনারগাঁ থেকে ঢাকা নৌযাত্রা সুখকর ছিল বলে দুটি অঞ্চলের মধ্যে এক ধরণের সখ্যতা সৃষ্টি হয়। মুঘলপূর্বযুগে ঢাকা শুধুমাত্র নগরকেন্দ্ররূপে দৃশ্যমান হলেও মুঘল আমলে এসে তার ঐশ্বর্য বৃদ্ধি পায়।
অনেকেই মনে করেন সুবাদার ইসলাম খাঁ’র আমলেই ঢাকার নামকরণ ‘ঢাকা’ করা হয়। তিনি যখন জিনজিয়া থেকে বুড়িগঙ্গা হয়ে এখানে আসেন তখন দেখতে পান, এখানের অধিবাসীরা ঢাকঢোল পিটিয়ে উৎসবে ব্যস্ত। পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ ইসলাম খাঁ ঢাকের শব্দে অভিভূত হোন যেহেতু এর আগে তিনি ঢাকের শব্দ শুনেননি। নতুন রাজধানীর সীমানা নির্ধারণ করার জন্য পূর্ব, পশ্চিম ও উত্তর দিকে তিনজন কর্মকর্তাকে প্রেরণ করেন এবং তাদের এই মর্মে আদেশ দেন যে যতক্ষণ না পর্যন্ত ঢাকের শব্দ শুনা না যাবে ততক্ষণ পর্যন্ত যেন তারা চলতে থাকেন। তিনি এও বলে দেন যেখানে গিয়ে ঢাকের শব্দ আর শুনা যাবেনা দক্ষিণে বুড়িগঙ্গা রেখে সেখানেই হবে নতুন রাজধানীর সীমানা। ইসলাম খাঁ’র পালিত আজ্ঞায় এলাকাটিকে রাজধানীর মর্যাদা দেয়া হয়। ঢাকের শব্দে ভিত্তিতে জায়গা নির্বাচন হয়েছে বলে নতুন রাজধানীর নাম হয়ে যায় ঢাকা। তবে ইতিহাসের বিভিন্ন উপাদান এ কিংবদন্তির পক্ষে সাফাই গায় না। ১৫৯৪ থেকে ১৬০৬ সালের মধ্যবর্তী সময়ে মুঘল সুবাদার শাহবাজ খাঁ এবং মানসিংহ মধ্যকার যুদ্ধে ঢাকা নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। আবার ইসলাম খাঁ’র সমসাময়িক সময়ে বুড়িগঙ্গার তীরে ঢাকা নামের একটি অঞ্চলের অস্তিত্ব স্বীকার করেন ঐতিহাসিকরা। তাছাড়া ঢাকার সুবাদার হয়ে ইসলাম খাঁ এ অঞ্চলের নাম রেখেছিলেন দিল্লীশ্বর জাহাঙ্গীরের নামের আদ্যক্ষরে জাহাঙ্গীরনগর। এ দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে একই সুবাদার কর্তৃক অভিন্ন একটি অঞ্চলের ভিন্ন নাম গ্রহণ যুক্তিযুক্ত না।
বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলির শহর ঢাকা শহরের নামকরণ এর ইতিহাস নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে আরো অনেক কিংবদন্তি। এরকম একটি দুর্বল কিংবদন্তির উল্লেখ করা যেতে পারে।
তৎকালীন হিন্দু ধর্মাবলম্বী একাংশদের মধ্যে বৃক্ষপূজার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। ঢাক-বৃক্ষ নামের এমন একটি বৃক্ষকে নাকি হিন্দুরা পূজা অর্চনা করত। আর এই বিশেষ বৃক্ষ থেকে ঢাকা নামের উৎপত্তি। তুলনামূলকভাবে এ কিংবদন্তি কিছুটা অবিশ্বাসযোগ্য। তবে অনেকের মতে, শুধু ঢাকবৃক্ষই নয় পুরো অঞ্চলটি ছিল বিভিন্ন ধরণের গাছ দিয়ে সবুজে ঢাকা। যার কারণে এ এলাকাটির নাম হয়ে যায় ঢাকা।
পুরান ঢাকায় অবস্থিত ঢাকেশ্বরী মন্দির থেকেও ঢাকা নামের উৎপত্তির আরো একটি চমৎকার কিংবদন্তির উল্লেখ পাওয়া যায়। রাজা বল্লাল সেনের মা যখন বিশ্বাসঘাতিনীর অপবাদ মাথায় নিয়ে নিজ স্বামী দ্বারা নির্বাসিত তখন হতোদ্যম মাতা আত্মহত্যার পথ বেছে না নিয়ে একটি জংগলে আশ্রয় নেন এবং সেখানেই জন্ম নেন বিক্রমপুরের শাসক বল্লাল সেন। বল্লাল সেন যখন বেড়ে উঠছিলেন জংগলের মধ্যে, এমন একদিন জংগলের আবৃত অবস্থায় একটি দেবমূর্তির দৃষ্টিগোচর হয় তার। তার নিপাট বিশ্বাস এই দেবমূর্তিই তাকে ও তার মা’কে রক্ষা করে আসছে। এ ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখতে তথা একে দৈব সংকেত গণ্য করে ঠিক যে জায়গায় দেবমূর্তিটি আবিষ্কার করেছিলেন তিনি, সেখানেই একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন এবং তার নাম দেন ঢাকেশ্বরী মন্দির। আর এ ঢাকেশ্বরী নাম থেকেই ঢাকা নামের উৎপত্তির আরো একটি চমৎকার বিশ্বাসযোগ্য কিংবদন্তি ইতিহাসে স্থান করে নেয়।
প্রাচীনকালে নাকি ঢাকা শহর তুলনামূলক উঁচু ছিল। তাই পার্শ্ববর্তী শহর সোনারগাঁ এবং বিক্রমপুরের সংযোগস্থল হিসেবে এখানে একটি পর্যবেক্ষণ ফাঁড়ি স্থাপন করা হয়। প্রাকৃত উপভাষায় ফাঁড়িকে বলা হত ঢাক্কা। ঢাক্কা থেকে কালক্রমে ঢাকা নামের উত্থান ।
কিংবদন্তির চরিত্রদোষ হচ্ছে এর আপেক্ষিকতা। স্থানভেদে, সময়ভেদে এর বহুরূপতা ছড়িয়ে পড়ে। আবার কখনো সংশ্লিষ্ট লোকজ বিশ্বাসের তারতম্যের কারণে এর হেরফের দেখা যায়। যার কারণে ঢাকার নামকরণ সংক্রান্ত কিংবদন্তি ঐতিহাসিকদের দোলাচলে ফেলে দিয়েছে আসলে কোন ঘটনার প্রেক্ষাপটে সৃষ্ট হয়েছে আজকের সব পেয়েছির শহর ঢাকা!
তথ্যসূত্র ঃ Banglapedia, Wikipedia
order lamisil 250mg generic – order generic diflucan purchase grifulvin v for sale