গ্রিক দর্শন – প্রকৃতির রহস্য উন্মোচনে দার্শনিকদের মতবাদ ও ভুমিকা – (প্রথম পর্ব)

0

দর্শন, দর্শন শাস্ত্র, দার্শনিক এই শব্দগুলোর সাথে আমরা সবাই কমবেশি পরিচিত। কিন্তু অনেকের মনেই এমন প্রশ্ন উঁকি দিতে পারে যে এই শব্দগুলোর ভাবার্থ আসলে কি? কিভাবে এই দর্শন বা দর্শন শাস্ত্রের আবির্ভাব হল, কারাই বা ছিল এর পেছনে? তাই চাইছিনা কোন পাঠক না বুঝেই লিখাটি পড়ুক। মূল বক্তব্যে যাওয়ার আগে তাই দর্শন বা দর্শন শাস্ত্র সম্পর্কে কিছু ধারণা পাঠকদের দেওয়া উচিৎ।

দর্শন শব্দের ইংরেজি অর্থ ‘philosophy’ অর্থাৎ জ্ঞানের প্রতি ভালবাসা বা জ্ঞান অর্জনের জন্য যে অনুসন্ধান। যখন কোন একটি বিষয়বস্তু সম্পর্কে চুল ছেড়া বিশ্লেষণ করা হয়, খুঁটিনাটি সব কিছু পর্যবেক্ষণ করা হয় তখন সেই শাস্ত্রকে বলা হয় দর্শন শাস্ত্র। প্রাচীন গ্রিকদের মতে দর্শন হচ্ছে নিজের জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করার জন্য অর্জিত জ্ঞান। যার মধ্যে শিল্পকলা, বিজ্ঞান, ধর্ম ও দূরকল্পনামূলক চিন্তাভাবনা এই সমস্ত ক্ষেত্র অন্তর্ভুক্ত। দর্শনে সুগভীর চিন্তা ও খুঁটিয়ে দেখা এই দুইটি বিষয়ের ব্যবহার বেশি লক্ষণীয় এবং প্রয়োগের ব্যবহার কম। অনেকের মতে সক্রেটিস, প্লেটো ও এরিস্টটল এরা হচ্ছেন দর্শনের আদি পুরুষ এবং এরা ছিলেন প্রাচীন গ্রিসের দার্শনিক। কিন্তু ভালভাবে বিশ্লেষণ করলে এই চিন্তাভাবনাটি ভুল।

প্রাচীন মিশরীয় চিন্তার প্রভাব পাওয়া গেছে প্লেটোর দর্শন চর্চার ফলে। অপরদিকে ‘এরিস্টটল’ নিজ বক্তব্যে স্বীকার করেছেন,
“মিশরের ধর্মগুরুদেরকে জগতের আদিম দার্শনিক-গোষ্ঠী বলে অভিহিত করা উচিৎ”।

তাই বলা যায় যে, মিশর থেকেই সর্ব প্রথম আবির্ভাব ঘটে এই দর্শন চিন্তার। আশাকরি কিছুটা হলেও পাঠকদের বুঝাতে পেরেছি। এবার আসা যাক মূল লিখনিতে।

দর্শন নিয়ে পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে যুগে যুগে দেশে দেশে অনেক ধরনের দর্শন শাস্ত্র পৃথিবীতে বিদ্যমান ছিল এবং আছে। যেমন গ্রিক দর্শন, মিশরীয় দর্শন, ভারতীয় দর্শন ইত্যাদি। সব দর্শন সম্পর্কেই আলোচনা করা হবে।

প্রথমে শুরু করা যাক গ্রিক দর্শন নিয়ে। বোঝানর সুবিধার জন্য গ্রিক দর্শন এর সময়কালকে তিনটি যুগে ভাগ করা যায় –

১.সক্রেটিস পূর্ব যুগ
২.সক্রেটিস যুগ
৩.সক্রেটিস পরবর্তী যুগ

সক্রেটিস পূর্ব যুগঃ

কিছু কিছু দার্শনিক সক্রেটিসের জন্মের পূর্ব থেকে তাঁর সময়কাল অবধি জীবিত ছিলেন। কিন্তু এদের চিন্তাধারা ছিল সক্রেটিসের চিন্তাধারা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। তাঁরা স্বাধীন চিন্তায় বিশ্বাসী ছিলেন। সে সময়কার বিভিন্ন দার্শনিক বিভিন্ন ভাবে পৃথিবীর আদি উপাদানগুলোকে বিভিন্ন আঙ্গিকে বর্ণনা করেছেন। সক্রেটিস পূর্ব যুগের কিছু দার্শনিকদের নাম ও তাদের বিভিন্ন চিন্তাধারা সম্পর্কে আলোকপাত করছি।

দার্শনিক থেলিস

দর্শনশাস্ত্রের আদি পিতা হিসেবে ধরা হয় ‘থেলিস’ কে। খ্রিষ্টপূর্ব ৬২৪ সালে তিনি ব্যবসা বাণিজ্যে সমৃদ্ধ নগরী ‘মাইলেটাস’ এ জন্মগ্রহণ করেন। থালিসের জন্মের আগে ধর্ম এবং দর্শন এই দুই এর মধ্যে কোন তফাৎ ছিল না। যে কোন বিষয়ে ধর্মীয় সিদ্ধান্তকেই চূড়ান্ত বলে মেনে নেয়া হতো।

তখনকার সময় গ্রিকরা ‘ওশেনিয়া’ নামের এক দেবতার পূজা করত। সেই সময় ওশান মানে নদীকে বুঝানো হতো।পরবর্তীতে এর নাম হয় মহা সমুদ্র।

দার্শনিক থেলিস
দার্শনিক থেলিস

যেহেতু গ্রিকদের জমি তখন এতটা উর্বর ছিল না। তাই ব্যবসা বাণিজ্যের দিকেই তাদের বেশি জোর দিতে হতো। আর ব্যবসা বাণিজ্যকে আরও উন্নতির শিখরে নিয়ে যাওয়ার জন্য এই মহাসমুদ্রের উপর তাদের ভরসা করা ছাড়া তাদের আর কোন উপায় ছিলনা।

তাই এই সমুদ্রের গুরুত্ব ছিল তাদের কাছে অসীম, আর পানি ছাড়া সমুদ্র অসম্ভব। তাই এই পানিই ছিল তাদের কাছে পূজনীয়।

থেলিস মনে করতেন যে এই পানি থেকেই জগতের সকল বস্তুর উৎপত্তি। তাই জনসম্মুখে একবার তিনি ঘোষণা দিলেন যে,
“এই পৃথিবী,মাটি, মানুষ, জীব,জানোয়ার,গাছপালা সবকিছুর আদি কারণ পানি।”

সেদিন থেকেই ‘দর্শন’ এর উৎপত্তি। থেলিস মিশর ও ব্যবিলন ভ্রমণ করেন। সে সময় তিনি লক্ষ্য করলেন যে মিশরীয়রাও পানির উপর নির্ভরশীল। তাদের সভ্যতা ছিল নীল নদ নির্ভর। তাই তিনি পানিকেই সবচেয়ে শক্তিশালী বলে আখ্যায়িত করেন। থেলিস অঙ্কশাস্ত্র ও জ্যোতির্বিদ্যাতেও প্রচুর জ্ঞান অর্জন করেন। পিরামিডের ছায়া দেখে তিনি পিরামিডের দৈর্ঘ্য নির্ণয় করে মিশর-বাসিদের স্তম্ভিত করে দেন। অঙ্কশাস্ত্র যে যুক্তির উপর নির্ভর করে তা থেলিস সর্বপ্রথম বর্ণনা করেন। থেলিসের সময় এক লোক বিভিন্ন ধরনের রটনা প্রচার করতে থাকে দর্শনশাস্ত্রের বিরুদ্ধে। তিনি জনে জনে বলে বেড়ান যে, দর্শনশাস্ত্রের কোন মূল্য নেই। দর্শন চর্চার মাধ্যমে সংসার চালানো অসম্ভব। তাই ঐ লোকের উপর প্রতিশোধ নিতে সেইবার মাইলেটাসের যত জলপাই উৎপন্ন হয়েছিল সব তিনি খরিদ করেন এবং যখন সেখানে জলপাই এর অভাব দেখা দেয় তখন সমগ্র জলপাই তিনি বিক্রি করে প্রচুর টাকা রোজগার করেন।

দার্শনিক অ্যানাক্সিমেন্ডার

এরিস্টটলের অনুমান অনুযায়ী তিনি খ্রিষ্টপূর্ব ৪৮৬ সালের দিকে জন্মগ্রহণ করেন। মাইলেসিয়ার অধিবাসী ছিলেন তিনি। অ্যানাক্সিমেন্ডারের মতে পৃথিবীর জন্মের কারণ ছিল অসীম কোন একটি বস্তু যার প্রচণ্ড গতির কারণে এবং তার সাথে শীতল ও উষ্ণর সংস্পর্শে জন্ম হয় আগুন, গাছপালা, মাটি ও পানির।

দার্শনিক অ্যানাক্সিমেন্ডার
দার্শনিক অ্যানাক্সিমেন্ডার

অ্যানাক্সিমেন্ডারের মতে মাছ ছিল পৃথিবীর প্রথম প্রাণী এবং তিনি বিশ্বাস করেন এই মাছ থেকেই মানুষের জন্ম। তিনি সর্বপ্রথম পৃথিবীর ম্যাপ অঙ্কন করেন। তার মতে পৃথিবী ছিল গোলকের মত এবং সূর্যের আয়তন ছিল পৃথিবী থেকে ২৯ গুন বড়। থালিসের মত তিনিও জ্যোতির্বিদ্যায় প্রচুর জ্ঞান অর্জন করেন।

দার্শনিক পিথাগোরাস

দর্শনে অঙ্কশাস্ত্রের যুক্তির আবির্ভাব করেন পিথাগোরাস। সামস দ্বীপের অধিবাসী ছিলেন তিনি। তার জন্ম খ্রিষ্টপূর্ব ৫৭০ সালে এবং মৃত্যু খ্রিষ্টপূর্ব ৪৯৫ সালে। পিথাগোরাসের মতে দর্শনের মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল সংখ্যা। তিনি বিশ্বাস করতেন এই সংখ্যার মধ্যে অলৌকিক কোন ক্ষমতা বিদ্যমান আছে, তাই এই সংখ্যাকেই তিনি পৃথিবীর আদি উপাদান হিসাবে আখ্যায়িত করেছিলেন। এছাড়া গ্রিক দার্শনিকদের মতে, তিনিই ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি অমরতা ও পুনর্জন্মে বিশ্বাসী ছিলেন। পিথাগোরাসের জন্মের আগে মানুষ জীবন যাপন করার জন্য ধর্মীয় নিয়ম কানুন কে প্রাধান্য দিত বেশি, এক কথায় ধর্মকেই জীবন যাপনের প্রধান পদ্ধতি মনে করা হতো।

দার্শনিক পিথাগোরাস
দার্শনিক পিথাগোরাস

পিথাগোরাস ধর্মীয় চিন্তাভাবনা কে অঙ্কশাস্ত্রের সাথে মেলানোর চিন্তা করেছিলেন। এর ফলে দর্শন শাস্ত্রের লাভ হলেও ক্ষতি সংঘটিত হয়েছিল বেশি। তবে পিথাগোরাস প্রকৃতির রহস্য উন্মোচনে অন্যান্য দার্শনিকদের থেকে ছিলেন অনেক এগিয়ে। তিনই প্রথম ব্যাক্তি যিনি বিশ্বাস করতেন যে চাঁদ একটি গ্রহ, যার নাম দিয়েছিলেন তিনি ‘কাউন্টার আর্থ’ (counter earth).

দার্শনিক হেরারিক্লিটাস

এই দার্শনিকের চিন্তাভাবনা ছিল একটু বিদঘুটে প্রকৃতির। অনুমান করা হয় যিশু খ্রিস্টের জন্মের ৫০০ বছর আগে তিনি জীবিত ছিলেন। যুদ্ধ, ঝগড়া-বিবাদ এইসব নিয়ে তাঁর আগ্রহ ছিল অত্যধিক। এই দার্শনিকের মতে পৃথিবীর আদি উপাদান ছিল আগুন। তিনি বিশ্বাস করতেন মানুষের আত্মা আগুন ও পানি থেকে তৈরি।

দার্শনিক হেরারিক্লিটাস
দার্শনিক হেরারিক্লিটাস

যার আত্মায় আগুনের পরিমাণ বেশি সে মানুষ হিসাবে উত্তম। আর যার আত্মায় পানির পরিমাণ বেশি সে মানুষ হিসাবে নিকৃষ্ট। কোন রকম দেব দেবিতে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন না। আগুণকেই তিনি দেবতার আসনে বসিয়েছিলেন। হেরারিক্লিটাস এর কাছে জগতের কোন বস্তুই স্থায়ী ছিলনা, সবই ছিল পরিবর্তনশীল। এই ছিল তাঁর মতবাদ।

দার্শনিক পারমিনাইডস

খ্রিষ্টপূর্ব ৫১৫ সালে ইতালির ইলিয়া শহরে জন্মগ্রহন করেন এই দার্শনিক। ‘ইলিয়া স্কুল’ এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তিনি।পারমিনাইডাস এর মতবাদ ছিল হিলারিক্লিটাস থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। তার মতে বিশ্বে কোন কিছুই পরিবর্তনশীল নয়, সবই অক্ষত। তাঁর সুদীর্ঘ ‘প্রকৃতি’ কবিতার মাধ্যমে তিনি তার দার্শনিক চিন্তাভাবনার প্রকৃত রূপ প্রকাশ করেছিলেন। বলে রাখা ভালো সক্রেটিস ছিলেন পারমিনাইডাসের ছাত্র।

দার্শনিক ডেমোক্রিটাস

ডেমোক্রিটাসের জন্ম গ্রিসের ‘আবদেরা’ শহরে, খ্রিষ্টপূর্ব ৪৬০ সালে। অনেকের মতে ডেমোক্রিটাস অন্যান্য সকল দার্শনিকদের চেয়ে জ্ঞানার্জনের দিক থেকে অনেক এগিয়ে ছিলেন। দর্শন শাস্ত্রে অনুতত্ত্বের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ডেমোক্রিটাস। তার মতবাদ ছিল মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর আত্মা ও এই মহাবিশ্ব অসংখ্য অণুর সমষ্টিতে গঠিত। এক অণু থেকে অন্য অণুর পার্থক্য শুধু তাদের আকারে, এছাড়া তাদের মাঝে আর কোন পার্থক্য নেই। তিনি আরও বলেন যে বস্তুর নিজস্ব কোন গুনাগুণ নেই, মানুষের জিভ, নাক, চোখ বস্তুর ভেতরের বিভিন্ন গুনাগুণ কে প্রকাশ করে থাকে।

দার্শনিক ডেমোক্রিটাস
দার্শনিক ডেমোক্রিটাস

পরবর্তীতে বিজ্ঞানী ‘গ্যালিলিও’ ও দার্শনিক ‘লক’ ডেমোক্রিটাস এর এই মতবাদকে সমর্থন করেন। ডেমোক্রিটাস আত্মার অমরতাতে বিশ্বাসী ছিলেন না। তার নিজ শহর আবদেরা তে তিনি একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। দর্শন ছাড়াও অন্যান্য বিষয় যেমন মনোবিদ্যা, নীতিবিদ্যা প্রভৃতি বিষয়ে তিনি ২৯ টি বই রচনা করেছিলেন। ডেমোক্রিটাস বলতেন, “প্রত্যেক মানুষের উচিৎ সুখের সন্ধান করা”। তাঁর কাছে এই সুখের অর্থ ছিল মানসিক শান্তি।

অ্যানাক্সগোরাস
তৎকালীন পারস্য সাম্রাজ্যের আয়নিয়ান দ্বীপে খ্রিষ্টপূর্ব ৫১০ সালে তাঁর জন্ম। মৃত্যু খ্রিষ্টপূর্ব ৪২৮ সালে।
এই দার্শনিক জগতের সকল প্রাণীর মনকে বস্তু বলে বিবেচনা করতেন এবং তিনি এও মনে করতেন যে মানুষ তার দৈহিক কাঠামোর জন্য জগতের অন্যান্য প্রাণীর থেকে বেশি বুদ্ধিমান, মনের জন্য নয়। তাই এই দার্শনিক জগতের পরিবর্তনের জন্য মনকে দ্বায়ী করেন।

বিজ্ঞানী হিসাবেও অ্যানাক্সগোরাস খ্যাতিমান ছিলেন। চাঁদের নিজস্ব কোন আলো নেই সর্বপ্রথম তিনিই এটি পর্যবেক্ষণ করেন। চন্দ্রপৃষ্ঠে পাহাড় আছে ও মানুষ চাঁদে বসবাস করে এ সমস্ত উদ্ভট ধারনার জন্য তাকে পরবর্তীতে ‘ল্যাম্পসাকাস’ নামক কারাগারে বন্দি করা হয়।

কারাগার থেকে মুক্তির পর নিজ স্বদেশ-ভূমিতে ‘প্লুরাটিস স্কুল’ নামে একটি স্কুল স্থাপন করেন।

 

 

(চলবে)
তথ্যসূত্র –
*উইকিপিডিয়া
*বিভিন্ন ব্লগ
*দর্শনের গল্প (আরশাদ আজিজ)

Leave A Reply
sativa was turned on.mrleaked.net www.omgbeeg.com

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More