ব্রিটিশরা ভারতবর্ষ ত্যাগের আগে আগে এমন কিছু পরিকল্পিত হত্যাকান্ডের ছক নকশা করে রেখে গিয়েছিল যা গোটা ভারতবর্ষ ও বিশ্বমানবতাকে খুব কড়া এক ধাক্কা দিয়ে গিয়েছিল ।
বলা হয় যে, হিটলার যদি এমন নিখুঁত হত্যা-নকশার কথা জানতেন তবে তিনিও লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেলতেন । ১৭৭০ সালের ‘দ্য গ্রেট বেঙ্গল ফেমিন” বা বাংলার মহাদুর্ভিক্ষ এসব পরিকল্পিত হত্যাকান্ডের একটি । ভারতবর্ষে ব্রিটিশ রাজত্বের নির্দেশনায় প্রথম এই পরোক্ষ হত্যাকান্ডের বিভিন্ন তথ্য নিয়ে ইতিবৃত্তের এই আয়োজন ।
১. ভারতে ব্রিটিশ শাসনামলে উপমহাদেশ অগণিত দুর্ভিক্ষ দেখেছে। সবচেয়ে ভয়ংকর আঘাতটি আসে বাংলায়। ১৭৭০ সালে বাংলা (বর্তমান বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ) প্রথম দুর্ভিক্ষে আক্রান্ত হয়।
২. ১৭৭০ এর পর বাংলায় আবার দুর্ভিক্ষ হয় ১৭৮৩, ১৮৬৬, ১৮৭৩, ১৮৯২, ১৮৯৭ এবং সর্বশেষে ১৯৪৩ সালে। ১৭৭০ সালের পর স্মরণকালের ভয়ংকরতম দুর্ভিক্ষ হয় ১৯৪৩ সালে।
৩. ১৭৭০ এর দুর্ভিক্ষ শুরু হয় ১৭৬৯ এর শেষভাগে এবং এটি স্থায়ী হয় ১৭৭৩ সাল পর্যন্ত।
৪. বাংলা প্রদেশে প্রায় ১ কোটি মানুষ প্রাণ হারায় এই দুর্ভিক্ষে যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন ইহুদি হত্যাকান্ডের চেয়েও ভয়াবহ। ৬০ লক্ষ ইহুদী নিধন হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে।
৫. আমেরিকান ইতিহাসবিদ ও দার্শনিক জন ফিস্ক তার “The Unseen World” বইতে ১৭৭০ এর দুর্ভিক্ষকে ১৪ শতকের ইউরোপের ব্ল্যাক ডেথের চেয়েও বেশি নৃশংসতা বলে উল্লেখ করেন।
৬. ব্রিটিশ শাসন শুরুর আগে মুঘলামলে কৃষক প্রজারা তাদের শস্যের আয়ের ১০ থেকে ১৫ ভাগ দিত রাজরাজড়াকে। এই খাজনা দেয়ার পরেও কৃষকের হাতে থেকে যেত বেশ পরিমাণ শস্য। মুঘল রাজাদের এই খাজনানীতি ছিল খুবই সরল। কিন্তু তা পরিবর্তিত হয়ে যায় ভারতবর্ষে ব্রিটিশদের আগমনে।
৭. ১৭৬৫ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও মুঘল শাসক ২য় শাহ আলমের মাঝে এলাহাবাদ চুক্তি সাধিত হয়। এ চুক্তির ফলে ভারতের শুল্ক ও খাজনার দায়িত্বে নিয়োজিত হয় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যারা সাধারণ কৃষকপ্রজার খাজনার হার ১০-১৫% থেকে বাড়িয়ে ৫০% এ নিয়ে যায়। এই খাজনানীতিই জন্ম দেয় প্রলয়ঙ্করী দুর্ভিক্ষের।
৮. ১৭৬৮ সালে কৃষকের শস্য ক্ষতির মুখে পড়ে। তবে এটি চরম আকার নেয়নি। কিন্তু ১৭৬৯ এর বৃষ্টি ছিল ভয়াবহ। বাংলার গ্রামাঞ্চলসহ বহু নিম্নাঞ্চল ডুবে অগণিত কৃষক বাস্তুহারা হয়ে পড়েন। এ বন্যায় ভারতে সবচেয়ে ঝুঁকিতে পড়ে বর্তমান বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, আসাম, উড়িষ্যা ও ঝাড়খণ্ড।
৯. অতিরিক্ত খাজনা ও ভারি বন্যায় কৃষক শস্য শূন্য হয়ে পড়ে। ১৭৭০ এর শুরুতেই কৃষকের উপোষ শুরু হয়। বছরের মাঝামাঝি দুর্ভিক্ষ এমন রুপ নেয়, শোনা যায় মানুষ লাশের মাংস খাওয়া শুরু করে।
১০. বাংলার মুর্শিদাবাদ ও বীরভূমের অবস্থা বেগতিক হয়ে পড়ে ১৭৭০ সালের দুর্ভিক্ষে। লাখো কৃষক ও জনতা সুদিনের আশায় বিভিন্ন স্থানে চলে যাওয়া শুরু করে। কিন্তু কিছুতেই কিছু কাজ করা হয়ে ওঠেনি। যারা আগে চলে যায় তারা পথে লাশ হয়ে পড়ে থাকে, যারা পরে যায় তারাও মারা যায়।
১১. যে ভূমি ত্যাগ করে কৃষকেরা চলে যায় তা ক্রমে ঘন জংগলে রুপ নেয়। বৃটিশরা কোনো পদক্ষেপই গ্রহণ করেনি অবস্থার উন্নয়নে।
১২. ডানে বায়ে যখন মানুষ মরে পড়েছিল ১৭৭১ সালে তখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি খাজনার হার বাড়িয়ে ৬০% এ নিয়ে যায়। অল্প দিনেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কোষাগার পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে।
১৩. এ দুর্ভিক্ষের পর চাষাবাদের জন্য খুব অল্প সংখ্যক কৃষক জীবিত থাকে। পরবর্তীতে তারা যখন কৃষিকাজে ফেরত যায়, তারা আগের মত শস্য উৎপাদনে ব্যর্থ হয় এবং অতিরিক্ত খাজনা তাদের জীবিত থেকেও মৃত বানিয়ে ফেলে।
১৪. স্বাভাবিকভাবে কৃষকেরা খাদ্যশস্য ও শাকসবজি চাষাবাদ করত। কিন্তু বৃটিশ সরকার তাদের বাধ্য করে পপি, নীল এসবের চাষাবাদে। দুর্ভিক্ষ চলাকালীন এই সিদ্ধান্তে বাংলা সহ অন্যান্য অঞ্চলে মানুষ নিশ্চিহ্ন হয়ে পড়ে।
১৫. খাদ্যের অভাবে বিস্তৃত অঞ্চলে সৃষ্ট দুর্ভিক্ষ বয়ে নিয়ে আসে নানা জাতের মহামারি রোগ। দুর্ভিক্ষের সময় মহামারির প্রকোপ নিশ্চিত করে বাংলাসহ ভারতের দুর্ভিক্ষাক্রান্ত অঞ্চল বিরানভূমিতে পরিণত হয়েছে।